#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩২)
নুসরাত জাহান লিজা
দীপ্ত দুদিন ধরে বাসায় ফেরে রাতে করে। সেদিন শ্রেয়সী প্রশ্ন করেছিল, “আমাকে বলবে তোমার কী হয়েছে?”
দীপ্ত উত্তরে বলেছিল, “আমার আবার কী হবে! জ্বর হয়েছিল, এখন ঠিক নেই।”
“তাহলে এরকম অদ্ভুত আচরণ কেন করছ?”
“আমার কোন আচরণ তোমার কাছে অদ্ভুত লাগছে?”
“এই যে কথা বলছ না ঠিক করে, চুপচাপ হয়ে গেছ, মনে হয় কী যেন ভাব সবসময়। কী ভাব এত? আমাকে বলা যাবে?”
দীপ্ত শ্রেয়সীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে হঠাৎই যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এমনই।”
এরপর চার্জ থেকে মুঠোফোন খুলে নিয়ে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে সেদিকে মনোনিবেশ করল।
“দীপ্ত, মানুষ যখন হুট করে বদলে যাবার চেষ্টা করে, সেটা খুবই আরোপিত মনে হয়। আমার চিন্তা হচ্ছে তোমাকে নিয়ে।”
“আমাকে নিয়ে চিন্তার কী আছে? আমার সময়ের মধ্যে ‘মি টাইম’ বলে কিছু থাকতে পারে না? বাসায় থাকলে পুরো সময় তোমার সাথে থাকতে হবে? আমি নিজেকে কিছুটা সময় দিতে চাইছি।”
“আমি কি তোমাকে বিরক্ত করছি?”
দীপ্ত সাথে সাথে উত্তর দিল, “কিছুক্ষণ একা থাকি প্লিজ? এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
বলে আবারও বুঁদ হয়ে গেল মুঠোফোনে, যেন এখন আর অন্যকিছু দীপ্তর আশেপাশে নেই, কেউ নেই। শ্রেয়সীর নিজেকে বড্ড উপেক্ষিত মনে হলো।
সে বারান্দায় গিয়ে বসল, মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। দীপ্ত তার ‘মি টাইম’ কাটাক। সে কারো বিরক্তির কারণ হতে চায় না। সে ঠিক করল আর প্রশ্ন করবে না। ওর যখন সময় হবে নিজেই বলবে।
গত দু’দিন তাই আর ওই প্রসঙ্গ তোলেনি শ্রেয়সী। ওদের রুমে যখন দু’জন একসাথে থাকে, মনে হয় দুটো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ যেন সহসা মুখোমুখি হয়ে গেছে। এখন কী করা উচিত, চেনাশোনা কীভাবে হবে এর কিছুই তারা জানে না। গুমোট বাতাসে ভরে থাকে চার দেয়ালাবদ্ধ ওইটুকু কক্ষ। দম বন্ধ করা বাতাসে শ্বাসকষ্ট হয়।
একমাস থেকে ময়নার মা আসে সকালে। ঘর মোছা, রান্নার জোগাড় যন্ত্র, কাপড় ধোয়া এসব করে দেয়। সে শ্রেয়সীকে বলল,
“ভাবি, ময়নার বাফের চাকরি গেছে গা। একটা যদি ব্যবস্তা করন যায়!”
“ময়নার বাপ কী করত?”
“ডাইবার আছিল৷ সাহেব গাড়ি বেইচ্চা দিছে, ওর কাম নাই।”
সে মোহসীন সাহেবকে বলতেই তিনি বললেন, “আমাদেরও তো একজন ড্রাইভার প্রয়োজন। তাহলে সবারই সুবিধা হতো। ওর হাজব্যান্ডকে আসতে বলে দে মা। আমি কথা বলে দেখি।”
“ঠিক আছে বাবা। ভালোই হবে।”
শ্রেয়সী চলে যাচ্ছিল, তিনি ডেকে বললেন, “মা রে, দীপ্তর সাথে তোর কোনো ঝামেলা, মানে একটু…..” তিনি ইতস্তত করলেন, কথা পুরোটা শেষ করতে পারলেন না।
তার মনে হলো তিনি স্টেরিওটাইপ শ্বশুরের মতো আচরণ করছেন বোধহয়। তার তো দীপ্তকে প্রশ্ন করা উচিত। দীপ্তর যদি কোনো সমস্যা হয় তার জন্য মেয়েটাকে তিনি কিছু বলতে পারেন না বলে মনে হলো। আবার তাদের ভেতরের বিষয়েও এভাবে তার নাক গলানো উচিত নয়। চিন্তায় ঝোঁকের মাথায় প্রশ্ন করে আফসোস হচ্ছিল তার।
শ্রেয়সী হেসে এগিয়ে এসে তার পাশে বসে বলল, “বাবা, এত হ্যাজিটেড করার মতো কিছু বলোনি তুমি। আসলে অসুখের পর থেকে ও কেমন যেন গুটিয়ে আছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাচ্ছে, উত্তর দিচ্ছে না। আমি খুব টেনশনে আছি বিষয়টা নিয়ে। ওর প্রবলেমটা কী তুমি জানো?”
মোহসীন সাহেব দুইদিন থেকে বিষয়টা খেয়াল করেছেন। তিনিও টেনশনে আছেন বলেই আজ জিজ্ঞেস করে ফেললেন।
“আমিও জানি না। তবে ওর মা’কে নিয়ে ওর একটা ট্রমার মতো হয়েছিল ওইসময়। ওকে ওই ডিপ্রেশন থেকে বের করে আনতে আমার কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সেখান থেকে বিয়ে, সংসারের প্রতি বা ভালোবাসার প্রতি একটা প্রবল বিতৃষ্ণা ওর তৈরি হয়েছিল।”
“বিয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা?” এটা শ্রেয়সীর অজানা ছিল। ওর মনে হচ্ছিল যার এতটা বিতৃষ্ণা থাকবে সে ওকে বিয়ে করতে কেন রাজি হলো!
মোহসীন সাহেব যেন ওকে পড়তে পারলেন, “বিয়ের চেষ্টা করতাম, ও নিজেই দেখা করতে যেত, এরপর বিয়ে ভেঙে দিত। তোকে দেখতে গেলে তুই ওকে রিজেক্ট করলি। এরপর আবার তোদের দেখা হলো। ওর তোকে পছন্দ হলো বুঝতে পারি। এরপর বিয়েটা হলো।”
দীপ্তকে শ্রেয়সীর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, “আমাকে কেন তোমার পছন্দ হয়েছিল?”
কিন্তু সে এখনো বাসায় আসেনি। সে রিজেক্ট করেছিল বলেই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল দীপ্ত! কী জানি! শোভার কথা মনে পড়ল ওর। সেদিন কেমন আচরণ করেছে ছেলেটা সেটা মনে পড়ল, এখনকার ঘটনার সাথেও সেটার যোগসূত্র আছে বলেই মনে হলো। কিন্তু শ্রেয়সীর এখানে ভুলটা কোথায়! ওর সাথে এই আচরণের মানে কী!
রুমে আসতে দেখল শান্তা কল করেছিল অনেকবার। সে কল ব্যাক করল।
“কেমন আছো আপু?”
“ভালো। তুই?”
“ভালো। তোমরা বাসায় আসো না কেন এখন?”
“আরে আসব। শিমুল হুট করে ব্যস্ত হয়ে গেছে। তাই। শোন না, পরশু অবশ্যই তুই আর দীপ্ত আমার বাসায় আসবি।”
“কোনো উপলক্ষ?”
“অবশ্যই। আমাদের ম্যারেজ এনিভার্সারি। মিস করিস না কিন্তু। আঙ্কেলকেও বলেছিলাম, কিন্তু উনি আসবেন না।”
“ঠিক আছে শান্তা আপু। অবশ্যই যাব।”
***
অফিস থেকে ফেরার সময় আলাউদ্দিন এলো গাড়ি নিয়ে। সে ময়নার বাবা৷ দীপ্ত আসেনি।
শ্রেয়সী কল দিতে দিতে গাড়িতে উঠে বসল। দীপ্ত ধরল না৷
বাসায় এসে শ্রেয়সী একটা শাড়ি বের করল, জলপাই রঙের জামদানী শাড়ি। এটা ওদের বিয়ের সময় দিয়েছিল এখান থেকে। আগে পরা হয়নি। শিমুল আর শান্তা দীপ্তর জন্য ভীষণ স্পেশাল মানুষ। তাদের বিবাহবার্ষিকী। ওর সাথেও খুব ভালো সখ্যতা তাদের।
দীপ্ত বাসায় কখন আসবে, ফোনও ধরছে না। থাক, ও রেডি হয়ে থাকুক। গতকাল রাতেও শান্তা আরেকবার কল দিয়েছিল।
সে গোসল করে সময় নিয়ে শাড়িটা পরল। জামদানি একা একা পরাটা বেশ ঝক্কির। শাড়ি পরতেই অনেকটা সময় লেগে গেল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসল। এরপর এই শাড়ির সাথে মাননসই সাজগোজ করল।
কী মনে করে দীপ্তর গাছ থেকে দুটো গোলাপ ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজল। এবার মনে হলো সাজ পরিপূর্ণ হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, প্রায় সাতটা বেজে গেছে।
ও বেরিয়ে এলো ড্রইংরুমে। ওকে দেখে মোহসীন সাহেব বললেন, “বেরুবি এখন?”
“ও তো এলো না। কল রিসিভ করছে না।”
“বস তাহলে, ওর টাইম সেন্সের এই অবস্থা তো ছিল না।”
সাড়ে সাতটার দিকে শান্তার কল এলো, “তুই এলি না কেন দীপ্তর সাথে? দেরি করিস না, চলে আয়।”
“দীপ্তের সাথে? ও গেছে আপু?”
“হ্যাঁ, সেই ছয়টা সময়। আমি তো রান্না ঘরে ছিলাম। এখন ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে দেখি তুই আসিসনি।”
“আপু, স্যরি, দেখো, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। প্রেসার লো হয়ে গেছে ভীষণ। তোমাদের জন্য অনেক শুভকামনা থাকল।”
“তুই তাহলে আসবি না?”
“ভীষণ ইচ্ছে ছিল আপু। কিন্তু শরীর…”
“দীপ্তর সাথে তোর… আচ্ছা, থাক। পরে কথা বলি এটা নিয়ে। তুই যত্ন নিস নিজের।”
শান্তা আপু বুঝতে পারলেন, দীপ্তর এভাবে ওকে না বলে চলে যাওয়াতে সে এটা করল।
শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে মোহসীন সাহেব কী বুঝলেন সে জানে না, ও তাকিয়ে বলল, “আমি একটু রুমে যাই বাবা। তুমি খেয়ে নিও। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
তার চোখে সহানুভূতি ছিল, সেটা আরও পোড়াচ্ছিল ওকে। ভীষণ অপাংক্তেয় বলে মনে হলো নিজেকে। শান্তা, শিমুলের কাছে ওকে এভাবে অপমানিত করার সাহস দীপ্তকে কে দিয়েছে!
ঘরে এসে কোনোরকমে শাড়ি বদলে শুয়ে পড়ল সে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, কষ্টে, অপমানে। এমন উপেক্ষা আর অসম্মান ওকে আজ অব্দি কেউ কোনোদিন করেনি।
……..
ক্রমশ
#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩৩)
নুসরাত জাহান লিজা
দীপ্ত যে বদলে যাচ্ছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে। যেখানে কোথাও যাবার থাকলে সে একেবারে শতভাগ পারফেকশন আনার চেষ্টা করে নিজের এ্যাটায়ারে, এপিয়ারেন্সে, সেখানে এখন সে প্রিয় বন্ধুর এত বড় এনিভার্সারি পার্টিতে সে অফিসের গেট আপেই চলে এসেছে।
খাবারের পরে শিমুলের বাসায় আড্ডার আসর জমল। সেখানেও দীপ্ত গুম হয়েই রইল প্রায়। একসময় উঠে বিদায় নিতে গেলে শান্তা বলল,
“তুমি কিছুক্ষণ পরে যাও, কথা আছে।”
আগত্যা বসে রইল সবাই চলে যাবার জন্য। কী কথা হতে পারে সে বুঝতে পেরেছে। চলে যেতে ইচ্ছে করছিল, তবুও বসে রইল। বাসায় গিয়ে শ্রেয়সীর মুখোমুখি হতে হবে বলে। আজ সে যা করেছে, তারপর আর ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো মুখ ওর নেই বলেই মনে হচ্ছে। সে তুলনায় এখানে নির্জীব হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকাও ভালো।
সবাই চলে যাবার পরে শিমুল ওর পাশে এসে বসল। শান্তা এসে বলল,
“আজ যা করলে এটা কি ঠিক করেছ?”
দীপ্ত উত্তর দিল না, শিমুল কথা বলল এবার, “উত্তর দে।”
দু’দিকে মাথা নাড়ল দীপ্ত।
“তাহলে কেন করলি?”
“আমি ভয় পাই। কীসের জন্য তুই জানিস।”
“আবার সেই একই গান। সব ঠিকঠাক ছিল৷ তোরাও একটা সুন্দর দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছিলি। তাহলে হঠাৎ এতদিনে এসে এসব যুক্তিহীন কার্যকলাপ করে তুই কী প্রমাণ করতে চাইছিস?”
“তূর্যর ডিভোর্সটা হয়েই গেল। বাবার বিষয়টা, আর সেদিন উনি আমার অফিসে এসেছিল।”
“কে?”
দীপ্তর মুখের অভিব্যক্তি দেখে শিমুল বলল, “তোর মা?”
“হুম।”
“এসবের সাথে শ্রেয়সীর সম্পর্কটা কী?” শান্তা একরাশ বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলল।
“ওর কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আমার সাথে। আমি ভয় পাই। আমি ইদানিং শ্রেয়সীর সান্নিধ্যে অনেক বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম। ও পাশে থাকলে সব ভালো লাগত। আমার ভয় হয়, ও যদি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়, আমার পৃথিবী থমকে যাবে একটা জায়গায়। তাই দূরে থাকছি।” দীপ্তর গলা মৃদু কেঁপে গেল কথাগুলো বলতে।
“ওর কোনো আচরণে তোর মনে হয়েছে যে ও চলে যাবে তোকে ছেড়ে?”
“না। কিন্তু বাস্তবতা তো এটাই, তাই না?”
“টোটালি বুলশিট। দীপ্ত, আল্লাহর ওয়াস্তে এসব ফালতু ভাবনা বাদ দে। ওভারথিঙ্কিং ইজ ভেরি হার্মফুল ফর এনি রিলেশনশিপ। ওয়েক আপ ম্যান।”
দীপ্ত জানে সেটা, কিন্তু বেরুতে পারছে কই।
শান্তা উত্তেজিত গলায় বলল, “তোমার মা যা করেছে সেই ভাবনা থেকে সব মেয়েদের জাজ করবে তুমি? এত চাইল্ডিশ তোমাকে আমার কখনো মনে হয়নি। স্যরি টু সে, এরকম আচরণ করতে থাকলে শ্রেয়সী তোমার সাথে থাকবে না। সেজন্য ওকে দোষ দিতে পারবে না। একমাত্র তুমি দায়ী থাকবে তার জন্য। তোমার মাকে তুমি দায়ী করো, অথচ তুমিও কি একই পথে হাঁটছ না? যাকে সবচাইতে ঘৃণা করো তার ফুটস্টেপ কী সুন্দর করে ফলো করছ। বাহ্! মায়ের যোগ্য ছেলে তুমি!”
দীপ্ত হাঁটুর উপরে দুটো কনুই রেখে হাতের তালুতে মুখ গুঁজে দিল। এই কথাগুলো ওর ভেতরে সুনামি তুলেছে৷ কথাগুলো ওর হৃদয়ের মর্মমূলে এমন আঘাত হেনেছে যে ভেতরটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে।
“শান্তা, একটু শান্ত হও প্লিজ। আমি বুঝিয়ে বলছি ওকে।”
“আমি শান্ত হতে পারছি না শিমুল। শ্রেয়সী আমাকে বড় বোনের মতো ভালোবাসে। ওর সাথে আমি লজ্জায় কথা বলতে পারছিলাম না। আমি পালিয়ে বাঁচার জন্য ফোন কেটে দিয়েছি। আজ এটা করেছে, কাল আরও বড় কিছু করবে। ও কেন অযথা কোনো কারণ ছাড়াই ভুক্তভোগী হবে? নাকি মেয়ে বলে যেমন খুশি তার সাথে তেমন করা যায়?”
শিমুল দীপ্তর পিঠে হাত রেখে বলল, “আজ খোলাখুলি কথা বল আমাদের সাথে দীপ্ত। তোর ভয়টা কীসের?”
“আমি ওকে ভালোবাসি তুই বিশ্বাস কর। কিন্তু যখন বিয়েটা হয়, তুই জানিস আমি তখন…”
ওকে থামিয়ে দিয়ে শান্তা প্রশ্ন করল, “কী হয়েছিল?”
শিমুল ইশারায় বোঝালো যে পরে খুলে বলবে। এই বিষয়টা সে স্ত্রীর সাথে শেয়ার করেনি।
“দীপ্ত, তুই তো ওকে ভালোবাসিস। শ্রেয়সীও তাই৷ অল্প সময়ের তোরা মনের কাছাকাছি চলে এসেছিস। নিজের বোকামোর জন্য এত চমৎকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং নষ্ট করে ফেলিস না। তোদের মধ্যে খুবই ন্যাচারাল প্রসেসে একটা দারুণ বন্ডিং ক্রিয়েট হয়ে গেছে। তোদের এক্সট্রা এফোর্ট দিতে হয়নি। অনেকে কাঠখড় পুড়িয়েও এটা পায় না কিন্তু। যা গেছে তা গেছে, চাইলেও সেই সময়ে গিয়ে সেটা তুই মুছে ফেলতে পারবি না। ভবিষ্যতও আমাদের হাতে নেই৷ তাই বর্তমানে ফোকাস কর। বর্তমান সুন্দর হলে সামনের জীবন আপনাআপনি স্মুথ হয়ে যাবে।”
“তোমার ফ্রেন্ড সহজে পেয়ে গেছে বলে মর্ম বুঝতে পারছে না সম্পর্কের।” মাঝখান থেকে শান্তা ফোঁড়ন কাটল।
“শান্তা, আমি নিজে মানুষটা ভীষণ ভাঙাচোরা। ভেতর থেকে গুছিয়ে উঠতে সময় প্রয়োজন। তুমি এভাবে বলো না প্লিজ। আমি রিকুয়েষ্ট করছি।”
“ওকে, আমি আর কিছু বলছি না, তবে এটুকু বলছি, সম্পর্কের পরিচর্যা করতে হয়। চারাগাছকে যেমন খুব যত্ন নিলে একদিন মহীরুহ হয়ে উঠে সম্পর্কও তেমনি শেকড় গজায়। মায়ার শেকড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে বেঁধে ফেলে যে নড়াচড়া করার সাধ্য থাকে না। আর বিনা পরিচর্যায় বীজ অঙ্কুরিতই হয় না। তুমি কোন প্রসেসে এগুবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার উপর। তোমাদের দুজনের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কথাগুলো বললাম। ভেবে দেখো।”
উঠে দাঁড়াতে দীপ্তর মনে হচ্ছিল মাথাটা প্রচণ্ড ঘোরাচ্ছে, স্বাভাবিক স্থিতিতে নেই আর। চারপাশের পৃথিবীটা অন্ধকার মনে হচ্ছিল। শিমুল ওকে ধরে বলল, “শরীর খারাপ লাগছে?”
“হুম।”
“আমি দিয়ে আসব?”
“না, আলাউদ্দিন এসেছে গাড়ি নিয়ে।”
শিমুল ওকে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে গেল। যাবার আগে বলল,
“সাবধানে যা। আর এবার ঠান্ডা মাথায় ভাবিস আমাদের কথাগুলো। অনেক বেশি যেহেতু ভালোবেসে ফেলেছিস, ওকে ধরে রাখ শক্ত করে তোর কাছে। যেতে দিস না।”
দীপ্ত শিমুলকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
***
বাসায় ফিরতে রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। বাবা ঘুমের ওষুধ খান বলে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। একবার রুমে ঢুকে বাবাকে ফিরছিল, দেখল বাবার চশমার নিচে একটা সাদা কাগজ। বাবা আগে ওকে এভাবে চিরকুট লিখে ঘুমাতেন। তাই সে চিরকুটটা তুলে নিল,
“তোর সাথে সকালে কথা আছে। শুক্রবার, তোর অফিস নেই। তবুও বলে রাখলাম যাতে পালিয়ে না যাস সকাল সকাল। ইদানিং তোর পালানোর স্বভাব হয়েছে।”
দীপ্ত এই পরিস্থিতেও খানিকটা হাসল। এরপর নিজের ঘরে এলো। শ্রেয়সী ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর গালে জল শুকিয়ে গেছে কিন্তু চিহ্ন রেখে গেছে। সেজেছিল মেয়েটা। ফ্রেস হতে বাথরুমে ঢুকে দেখল শ্রেয়সীর শাড়ি ভিজে পড়ে আছে নিচে। দীপ্ত ভেতরে ভেতরে যেন মরে গেল অপরাধবোধের তীব্র দহনে। শাড়িটা ভালো করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে পানি ঝরাতে দিল।
একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ধরাল না। ভেতরে এসে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। হোয়াটসঅ্যাপে শ্রেয়সীর মেসেজের নোটিফিকেশন দেখে ক্লিক করল তাড়াহুড়ো করে। দেখল একটা সেলফি আর দুটো মেসেজ।
শাড়ি পরা ভীষণ মিষ্টি একটা ছবি, ছবির দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর নিচের লেখা পড়ল।
“আমাকে কেমন লাগছে? ঠিকঠাক তো?”
দীপ্ত স্বগতোক্তি করল অস্ফুটস্বরে, “তোমার পাশে আমিই বড্ড বেমানান শ্রেয়সী।”
এরপর লেখা, “আমি রেডি হয়ে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।”
দীপ্ত প্রায় ছুটে রুমে এলো। এরপর শ্রেয়সীর পাশে শুয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ঘুমের মধ্যে আচমকা এমন হওয়ায় শ্রেয়সীর ঘুম ভেঙে গেল। প্রায় আর্তচিৎকার বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সামলে নিল দ্রুত। এভাবে ঘুমের মধ্যে কেউ এমন করে! ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে, ফোঁপানের ক্ষীণ শব্দের সাথে দীপ্তর বুক-পিঠ উঠানামা করছে।
শ্রেয়সী হতভম্ব গলায় বলল, “দীপ্ত, কখন এলে? কী হয়েছে? এমন করছ কেন?”
“প্লিজ আজ কোনো প্রশ্ন করো না। গত কিছুদিন একফোঁটা ঘুম হয়নি, শ্রেয়সী। আজ একটু ঘুমায়ে চাই। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে প্লিজ? আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই, কিন্তু পারছি না।”
শ্রেয়সী আজকের ঘটনা কখনো ভুলতে পারবে না। তবে এটা নিয়ে কথা বলার সময় এখন নয় তা বেশ বুঝতে পারছে। রাগ, জেদ, ক্ষোভ প্রকাশের যথোপযুক্ত সময় আর ঠান্ডা এবং সুস্থ মস্তিষ্কের প্রয়োজন। দুজনের একজনও এখন সেই অবস্থায় নেই।
সকালে ধীরেসুস্থে কথা বলা যাবে। তবে এখন ওকে পীড়া দিচ্ছে দীপ্তর এভাবে ভেঙে পড়াটা। শ্রেয়সী ভেবেছিল ওকে বুঝতে পারছে, কিন্তু নাহ্! ভুল ধারণা। মানুষের মন হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে জটিল গোলকধাঁধা, তাকে কি এত সহজে ধরে ফেলা যায়! একে বুঝতে আরও খানিকটা সময় লাগবে। তার জন্য ওকে দীপ্তর সমস্তটা জানতে হবে।
………..
ক্রমশ