#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩৮)
নুসরাত জাহান লিজা
বহুদিন পর দীপ্ত অকাতরে ঘুমাচ্ছে। খুব ভোরে উঠা দীপ্ত আজ বেলা সাড়ে আটটা গড়িয়ে গেলেও ওঠেনি। শ্রেয়সী ওর পাশে এসে বসল। নির্নিমেষ চেয়ে রইল দীপ্তর ঘুমন্ত মুখের দিকে। হাজার বছর ধরে পথ চলে আজ যেন দু’দন্ড শান্তি এসে ভিড়েছে দীপ্তর চোখে, মুখে, মনে, মননে। হয়তো কোনো ভালো স্বপ্ন দেখছে ছেলেটা, একচিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে এসে ঝলমল করছে।
শ্রেয়সীর ভীষণ মায়া হলো, এই ঘুমটা ভাঙাতে ইচ্ছে করল না। এমনিতেই খুব কম ঘুমায় দীপ্ত। আজ বরং আরেকটু ঘুমিয়ে নিক। আনমনেই শ্রেয়সী হাত রাখল ওর চুলে। চুলগুলো রুক্ষ আর উসকোখুসকো হয়ে আছে৷ কয়দিন চুলে শ্যাম্পু করেনি কে জানে। গতকাল এসেছেও বিধ্বস্ত অবস্থায়। পারফেকশন মেইনটেইন করা ছেলের সমস্ত অবয়ব জুড়ে যে চাপা যন্ত্রণাটা এতকাল ছিল, তা অত্যন্ত জীর্ণ রূপে প্রকাশিত হয়েছে। তবুও অদ্ভুত এক টান, কী প্রবল উঠা পড়া হয় হৃদয়ে। সেই টান এতটাই পরাক্রমশীল যে এই মুখের দিকে এভাবেই তাকিয়ে যেন সহস্র বছর কাটিয়ে দেয়া যায়৷
শ্রেয়সী এই কয়েকদিন খুব ভেবেছে। ওদের পরিচয় থেকে পরপর ঘটে চলা সমস্ত ইনসিডেন্ট নিয়ে ভেবেছে। ভেবে একটা সিদ্ধান্তে সে আসতে পেরেছে। তা হলো, দীপ্ত ওকে ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা কবে থেকে হলো সেটা নিয়ে ভেবে এই প্রাবল্যটুকু অস্বীকার সে কখনো করবে না। তবে ওর এটুকু বিশ্বাস বিয়ের রাতে যখন প্রথমবার দীপ্তর কাছাকাছি এসেছিল, সেইদিন সেই চোখ জোড়ায় সে ভালোবাসাই দেখেছিল। এতে ওর ভুল নেই। অবচেতনে সুপ্ত থাকা ভয় হয়তো নিজেকেই ঠিকঠাক প্রকাশ করতে দেয়নি নিজের কাছে।
“গুড মর্নিং।”
শ্রেয়সী সম্বিৎ ফিরতে দেখল, চোখ মেলেছে দীপ্ত।
“এখন উঠবে নাকি আরও ঘুমোবে?”
“তুমি এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে আরও কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারি।”
দীপ্তর মুখে দুষ্টু হাসি, শ্রেয়সী কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “একদম না। মা খাবার আগলে বসে আছে।”
“মায়ের মেয়ে কী করছিল?”
“বর আগলে বসে ছিল। এখন ঢং না করে উঠো।”
দীপ্ত উঠে বসল, এরপর শ্রেয়সীর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল, “আজ অনেক দিন পরে সূর্য হাসছে। দেখতে পাচ্ছ শ্রেয়সী?”
শ্রেয়সী ঠিক একইভাবে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মেঘের ছায়া কেটে স্নিগ্ধ ভোর নামছে আমাদের পৃথিবী জুড়ে।”
উষ্ণ আলিঙ্গনে সুন্দর রৌদ্রজ্বল দিনের সমস্ত রোদ হৃদয়ে ধারণ করে একটা সুন্দর সকাল শুরু হলো আজ।
***
আজ দীপ্ত আর শ্রেয়সী যাচ্ছে নিলুফার রায়হানের চেম্বারে। মোহসীন সাহেবও সাথে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দীপ্ত নিষেধ করে দিয়েছে।
শ্রেয়সী গাড়িতে বসে বলল, “তুমি বাবাকে ওভাবে বললে কেন? কষ্ট পেয়েছেন।”
“এলে আরও কষ্ট পেত শ্রেয়সী। ওখানে আমাকে এমনকিছু বলতে হবে যা বাবার জন্য এই বয়সে এসে শোনাটা ঠিক হবে না। আবার একই কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে আমি যেতে দেব না। আমি ছোট ছিলাম, আমার কষ্টগুলো বাবা সামলে নিয়েছে। কিন্তু বাবাকেও তো ভয়ংকর মানসিক চাপের মাঝখান দিয়ে যেতে হয়েছে। লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে। পুরনো ক্ষত নতুন করে তাজা না হোক।”
শ্রেয়সী দীপ্তর দিকে আরেকবার তাকাল ভালো করে। ওর ভেতরের সংবেদনশীল মনের সন্ধান সে আগেই পেয়েছিল, আজ আরেকবার পেল। গত কিছুদিন সেই সংবেদনশীলতাটুকুই ঢাকা পড়েছিল ভয় নামক এক কালো ছায়ার আড়ালে।
শ্রেয়সী চায় সেই কালো ছায়াটুকু সে বাক্সবন্দী করে ফেলে আসবে সহস্র আলোকবর্ষ দূরের কোনো এক কাল কুঠুরিতে, যেখান থেকে তা আর দীপ্তর জীবনে ফিরে আসার পথ খুঁজে পাবে না।
চেম্বারে ঢোকার আগে যখন ওদের ডাক পড়ল, দীপ্ত শক্ত করে শ্রেয়সীর হাতটা ধরল, যেন নির্ভরতা খুঁজতে চাইল। শ্রেয়সী আলতো করে ভরসার স্পর্শ দিয়ে আগলে ভেতরে গেল।
নিলুফার রায়হান হেসে ওদের অভিবাদন জানালেন। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে ব্যাক্তিত্বের ছাপ। স্পষ্ট স্বরে হেসে বললেন, “কেমন আছো শ্রেয়সী?”
শ্রেয়সীর মামার বন্ধুর বোন হচ্ছেন নিলুফার রায়হান। তার মাধ্যমেই উনাকে পাওয়া। বাড়িতে যাবার আগে শ্রেয়সী উনার সাথে দেখা করে গেছে। তখনই প্রথম সামনা-সামনি কথা৷ তবে তার আন্তরিকতা দেখলে মনে হয় বহুদিনের চেনা মানুষ।
“ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো। দীপ্ত, তোমাকে তুমি না বললে মাইন্ড করবে?”
মাথা নেড়ে না বোঝাল দীপ্ত। শ্রেয়সী ভেতরে ঢোকার আগে পরিচয়ের সূত্র ওকে দিয়েছিল।
“আগে চা নাও। আমরা চা খেতে গল্প করি।”
নিজেই ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে ওদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। নিজেও নিলেন এক কাপ।
“তুমি কেমন আছ দীপ্ত?”
দীপ্ত কিছুটা নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, “ভালো আছি।”
নিলুফার রায়হান মৃদু হাসলেন, তার হাসি প্রতিষেধকের মতো কাজ করল খানিকটা, “আমরা খুব স্বাভাবিক আলাপ পরিচয় করব দীপ্ত। নাথিং আনইউজুয়াল৷ তোমার দুটো কথা শুনব। এই যা। বি নর্মাল, ওকে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি দিল দীপ্ত। ওর হাতদুটো শ্রেয়সীর ডান হাত আবারও চেপে ধরল।
“শুনেছি তুমি খুব মুভি সিরিজ দেখো। তোমার কয়েকটা প্রিয় মুভির নাম বলো তো।”
দীপ্ত খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, সব মুভির নাম যেন ভুলে গেছে। তবুও যে কয়টা ইনস্ট্যান্ট মনে পড়ল, তাই বলার চেষ্টা করল, “ফরেস্ট গাম্প, টুয়েলভ এংরিম্যান, লাইফ ইজ বিউটিফুল…..”
এরকম কিছু প্রশ্ন করে দীপ্তকে সহজ করে নিলেন। এরপর বললেন, “তোমার ছেলেবেলার গল্পটা আমাকে বলবে?”
দীপ্ত একবার শ্রেয়সীর দিকে তাকাল, সোজা চোখের দিকে। সেই চোখে নতুন করে অনেক আশা বসতি গেড়েছে। মনে মনে যাই থাকুক, সে ওই চোখে তাকিয়ে এরপর নিলুফার রায়হানের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানাল।
বলতে শুরু করল, যতটা ওর মনে আছে। শ্রেয়সী চেয়ে রইল দীপ্তর মুখের দিকে। সেখানে ক্ষণে ক্ষণে অভিব্যাক্তি বদল হচ্ছে। কখনো সেখানে প্রগাঢ় বিষাদের ছাপ, কখনো নিদারুণ যন্ত্রণা, কখনো ভয়, কখনো স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যথা, মা থেকেও হারিয়ে যাওয়া সমস্ত কষ্টগুলো যেন ওর চোখেমুখে লেখা আছে।
অনেক কথা শ্রেয়সীও আজই প্রথম শুনল। শুনে শিউরে উঠল কখনো কখনো। ফুটফুটে এক শিশুকে কী নিদারুণ কঠোরতা সহ্য করতে হয়েছিল, সমাজের কাছ থেকে, বন্ধুবেসী লোকের কাছে থেকে এমনকি জন্মদাত্রীর কাছ থেকে! এমন পরিস্থিতি যেন কারো শত্রুরও না হয়। মনে মনে বলল শ্রেয়সী। সমস্ত সময় সে দীপ্তকে ভরসা দিয়ে গেল বিশ্বস্ত সহধর্মিণী হয়ে।
………..
ক্রমশ
#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩৯)
নুসরাত জাহান লিজা
নিলুফার রায়হান দীপ্তের কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনে, ওর আগের মেডিকেল রিপোর্টগুলো রেখে এক সপ্তাহ পরে আবার আসতে বলেছিলেন। আজ অর্থাৎ একদিন আগেই শ্রেয়সী একাই এসেছে তার বাসায়। মামার কাছ থেকে একটা সুবিধা সে নিয়েছে। তাছাড়া তিনিও রাজি হয়ে গেছেন। চেম্বারের উপর তলাতেই তিনি থাকেন। শ্রেয়সীর মনে হয়েছে পরিস্থিতি কতটা কেমন তা সে নিজে আগে শুনবে। তাহলে আগামীকাল যখন দীপ্তর সাথে আসবে তখন নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারবে।
তিনি আজও আন্তরিক ভঙ্গিতে হেসে স্বাভাবিক কুশল বিনিময় শেষ করে দীপ্তর ফাইল বের করে বললেন, “আমরা শারীরিক সুস্থতা বা অসুস্থতা নিয়ে যতটা ভাবি, মানসিক অবসাদ, বা মানসিক অসুস্থতা নিয়ে ততটা ভাবি না। তবে এটাও কিন্তু একইরকম গুরুত্বপূর্ণ।”
শ্রেয়সী প্রশ্ন করল, “আন্টি, ওর সমস্যাটা…”
শ্রেয়সীকে থামিয়ে দিয়ে নিলুফার রায়হান বললেন, “আমি একটু ব্যাখ্যা করে বলছি দীপ্তর বিষয়টা। একজন শিশুর মানসিক বিকাশ কিন্তু শুরু হয় আরলি চাইল্ডহুড থেকেই। শিশুদের ক্ষেত্রে সবসময়ই একটা সুন্দর ফ্যামিলি এনভায়রনমেন্ট কিন্তু মেজর প্রায়োরিটি। তাদের শৈশব যত সুন্দর এবং আনন্দময় করা যায়, তার মানসিক গঠন তত ভালো মতো তৈরি হয়। আবার একটা অসুস্থ পরিবেশ শিশুর জন্য ততটাই হার্মফুল হয়। আমি তোমাদেরকে খুব সহজ করে বলি বরং বিষয়টা তোমার বোঝার সুবিধার্থে। মেডিকেল টার্মগুলো কম ব্যবহার করে বলার চেষ্টা করছি। মা-বাবা ও পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের মধ্যে সহিংসতা, ঝগড়া-মারামারি, মাদকাসক্তি শিশুর মনে প্রভাব ফেলে। প্রিয়জনের মৃত্যু, বাবা-মার মধ্যে বিচ্ছেদ অথবা অন্য কোনো কারণে শৈশবে তাদের সঙ্গ বঞ্চিত হওয়া শিশুর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।”
এক জোড়া দৃষ্টি তার দিকে নিবন্ধ, তিনি ব্যাখা করতে শুরু করলেন, “দীপ্তর তখন যে বয়স, সে স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা দু’জনর উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল। তাদেরকে সে ভালোবাসত, ভরসা করত। কিন্তু চোখের সামনে তার বাবা-মায়ের অসুস্থ দাম্পত্য সম্পর্ক, ওকে প্রথমবার একটা ধাক্কা দিল। এরপর যখন দেখল যাকে সে পরম নির্ভরতায় আগলে ধরতে চায় সেই মা ওর গায়ে হাত তুলছে, কোনো অপরাধ না করা সত্ত্বেও, তখন ওর ভেতরের সংবেদনশীল স্নেহার্দ্র মনে ওর অবচেতনেই এক ধরনের হতাশা বাসা বাঁধে। ক্ষুধায় কাতর দীপ্ত যখন কেঁদেও খাবার পায় না মায়ের কাছ থেকে, বরং নির্লিপ্ত আচরণ বা ওর প্রতি বিরক্তি দেখে, ওর গঠিত হতে থাকা মেন্টাল স্টেট কলাপ্স করতে থাকে। তবুও যখন রাতে ঘুমের সময় মায়ের স্নেহ মাথায় কখনো পেত, ওটাকেই ওর সাব-কনশাস মাইন্ড সর্বস্ব দিয়ে পেতে চাইত। কিন্তু যখন দেখল ওর মা আর আসছে না, তখন এই অবহেলা বা উপেক্ষা থেকে ওর ভেতরে একটা অপরাধবোধ তৈরি হয়। ওর মনে হতে থাকে ও নিশ্চয়ই কোনো ভুল করেছে, তাই তার প্রিয় মানুষ ওকে ছেড়ে চলে গেছে। একটা দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে, চাইল্ডহুড ট্রমা বা যেকোনো বয়সের ক্ষেত্রেও হতে পারে, কখনো কখনো পেশেন্ট নিজেকে অপরাধী ভাবে। তবে পরিবারের সাপোর্টে তা কাটিয়েও ওঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। দীপ্তও ওর বাবার সাপোর্টে সে কাটিয়ে উঠতেও হয়তো পারত।
কিন্তু ওর ক্ষেত্রে সেটা হয়নি, কারণ সে সোস্যাল বুলিংয়ের শিকার হয়েছিল চরমভাবে।”
বলার সময়টায় তিনি শ্রেয়সীর অভিব্যক্তি খেয়াল করছিলেন, “যাদের সে বন্ধু ভাবত তাদের কাছ থেকে তিরস্কার পেয়ে, আত্মীয় এবং ক্লাসমেটদের অভিভাবকদের কাছ থেকে যে আচরণ সে পেয়েছে, সেটা ওর মেন্টাল স্ট্যাবিলিটিকে রিকাভার করতে দেয়নি। ওর ভেতরে যে সমস্ত গিল্টি ফিলিংস ছিল, সেগুলো ওর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। নিজেকে মনে হয়েছে অবাঞ্চিত একজন। প্রচণ্ড হীনমন্যতায় সে ভুগতে শুরু করে। নিজেকে লুকিয়ে ফেলার প্রবল ইচ্ছে থেকে স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী হয়ে যায়। দীপ্তর বাবাকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয় যে তিনি ছেলের এই মানসিক সমস্যা নিয়ে তখন কনসার্ন হয়েছেন। অনেক অভিভাবক এসব মুহূর্তে লুকিয়ে রাখতে চান সমস্যা। অনেকক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি তৈরি হয়। ওর ক্ষেত্রেও সেদিকেই যাচ্ছিল, তবে তখন তিনি স্পেশালিষ্ট ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন বলে দীপ্ত আপাতভাবে সমস্যাটা কাটিয়ে উঠেছিল। কিন্তু ওর অবচেতন মন সেটাকে ধারণ করে রেখে দিয়েছিল।”
এবার শ্রেয়সী কথা বলল, “সেই সময় তো ওর কাউন্সেলিং হয়েছিল। ও ঠিকও হয়ে গিয়েছিল। তবে এখন আবার ওই বিষয়টা…”
নিলুফার রায়হানের মুখে এবার একটা বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল। তিনি একটা জার্নালে চোখ রেখে বললেন, “বিষয়টা অত্যন্ত সেনসিটিভ আর কমপ্লেক্স। শৈশবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া শিশুরা ভবিষ্যতে নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। বড় কোনো দুর্যোগ, বিপর্যয় বা আঘাতের শিকার শিশু পরবর্তী সময়ে ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডারে’ আক্রান্ত হতে পারে। যেটাকে আমরা সংক্ষেপে পিটিএসডি বলে থাকি। এই রোগে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার দুঃসহ স্মৃতি বারবার ফিরে ফিরে আসে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি প্রতিবার একই রকম ভয়, আতঙ্ক, বেদনা অনুভব করে। শৈশবের ক্ষত ভবিষ্যতে সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমস্যা তৈরি করে। আমি বরং ওর আচরণ নিয়ে পর্যায়ক্রমে বলি।”
নিলুফার রায়হান একটু থেমে আবারও বলতে লাগলেন, “দীপ্তর মধ্যে নিজেকে নিয়ে একধরনের কমপ্লেক্সিসিটি তৈরি হয়েছিল। যা ওর সাব-কনশাস মাইন্ডে ছিল। ওই যে একটা গিল্টি ফিলিং, ওর মনে হতো ওর জন্যই ওর মা হয়তো চলে গেছে অনেক দূরে। তাই দীপ্ত নিজের চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য পাঁচিল তৈরি করল। ওর মনে হতো ওর নিশ্চয়ই কোনো দোষ আছে। সেই দোষ সে অন্য কাউকে দেখতে দেবে না। ওর মনে হতো যদি ওর ভেতরের গভীর দুর্বলতার আঁচ অন্য কেউ পায়, তবে তারা আবার ওকে উপহাস করবে, বিদ্রুপ করবে। যা পেয়েছিল তখন মানুষের কাছ থেকে। সেই সুযোগ সে কাউকে দেবে না। তাই অত্যন্ত সাবধানী আর সতর্ক হয়ে গেল আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে। নিজেকে গড়ে তুলতে চাইল অত্যন্ত দৃঢ়চেতা একজন মানুষ হিসেবে। ওই যে একটা ট্যাবু আমরা সেট করে দেই, পুরুষ মানুষ আবেগী কেন হবে? কেন কাঁদবে? তাহলে তার পৌরুষ কোথায়! এই অযৌক্তিক আর বিদঘুটে লজিক আদতে মানুষের সর্বনাশ করে। তারা মরে গেলেও ভাবে কেন দুর্বল হবো। কিন্তু কাঁদলে বা বিশ্বস্ত কারোর সামনে নিজেকে মেলে দিলে অনেককিছুই খুব সহজ হয়ে যেত। আবেগের প্রকাশ না ঘটালে ভেতরে ভেতরে ডিপ্রেশন গাঢ় হয়। ট্রমাটাইজড করে ফেলে আরও। আমাকে বলো তো, আবেগের কী লিঙ্গভেদ আছে? মানুষ যেহেতু সবার মধ্যেই আবেগ অনুভূতি আছে, কেউ তো রোবট নয়। তাই না?”
শেষের দিকে নিলুফার রায়হান কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন, মুহূর্তেই সামলে নিলেন।
শ্রেয়সীর মনে হলো সত্যিই তো, কেন মানুষ এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বাঁচবে!
গলা খাঁকারি দিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন নিলুফার রায়হান, “স্যরি, তত্ত্ব কথা বলে ফেললাম। যা বলছিলাম, দীপ্তর মধ্যে যে হীনমন্যতা গেড়ে বসেছিল তা ঢাকতে সে বদলে যেতে লাগল। একসময় সেই বদলটাকেই সে বিশ্বাস করে ফেলল। সবকিছুতেই ওকে পারফেক্ট হতে হবে এমন ভাবনা ওর মধ্যে তৈরি হলো। হার না মানা মানসিকতা তৈরি হলো। সেলফ অবসেশন তৈরি হলো। তবে এই পরিবর্তনগুলো কিন্তু কেবল কনশাস মাইন্ডের ক্ষেত্রেই হলো। অবচেতনে কিন্তু সেই দুঃসহ কৈশোর রয়ে গেল। ওর ঘুম হয় না, সেটাকে কাটানোর জন্য নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল রাতের বেলা। মুভি দেখা, খেলা দেখা, এমনকি পড়াশোনা সমস্তকিছু। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবে এরকম যারা রাত জাগে তারা ঘুম থেকে কিন্তু দেরিতে উঠে৷ কারণ সবার ঘুমের জন্য একটা মিনিমাম সময় নির্ধারণ করা আছে। ওর ঘুম খুবই কম। এমনকি সে ঘুমাতে ভয়ও পায়। নাইটমেয়ারের ভয়। যা দীপ্ত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তা প্রকাশও করেনি কারোর কাছে, বরং এসব অজুহাতে তা ঢেকে রেখেছে। নিজেকে পারফেক্ট দেখাবার চেষ্টা। তবে সে শিমুলের মতো খুব ভালো বন্ধু পাওয়ায় ওকে সে অত্যন্ত ভরসার একটা জায়গা দিয়েছে। সেটাও কিন্তু খুব সহজে হয়নি। একবার বেড়াতে গিয়ে সাঁতার না জানা দীপ্ত পানিতে ডুবে যাচ্ছিল, তখন শিমুল ওকে পানি থেকে উদ্ধার করেছিল। তখন থেকে এই ভরসার জায়গাটা তৈরি হয়েছিল। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকে। ভাগ্যক্রমে একইসাথে ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গিয়েছিল। তাই এই বন্ধুত্বটা ও রক্ষা করেছে। বাবার পরে এই শিমুলকেই দীপ্ত সর্বোচ্চ ভরসা করে এসেছে। এক্ষেত্রে দীপ্তর একান্ত ভেতরের কথা না বলতে পারলেও কোনো বিষয়ে মনে দ্বিধার সৃষ্টি হলে ওর কাছেই ছুটে যায়।”
“এই ধরনের কমপ্লেক্সিসিটিতে ভোগা মানুষরা সম্পর্কের প্রতি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে থাকে। নির্দিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ওর বাবার কষ্টটা সে নিজের চোখে দেখেছে। তাই দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতি দীপ্তর প্রবল ভয় আছে ভেতরে ভেতরে। সহজে কাউকে বিশ্বাস করে ফেলার ভয় আছে বলে কখনো রিলেশনশিপে যায়নি। বিয়েও করতে চায়নি। এরপর তোমার সাথে পরিচয় হয়, তুমি ওকে প্রত্যাখ্যান করেছিল বিয়ের জন্য। এখানে এসে ওর কনশাস আর সাব-কনশাস মাইন্ডের একটা দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ভেতরে ভয়, অথচ বাইরের হার না মানা মানসিকতা, দুইয়ে মিলে সে স্বাভাবিক বোধ গুলিয়ে ফেলে। দুই মনের টালমাটাল অবস্থায় সে প্রলুব্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, তোমাকে সে পরাজিত করেই ছাড়বে। এবার সেটা কীভাবে? একমাত্র উপায় তোমাকেও সেই একই প্রত্যাখ্যান ফেরত দেয়া। কিন্তু তুমি তো শুধু শুধু ওকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে না, তাই প্রয়োজন হয় ছলের।”
এই পর্যায়ে শ্রেয়সীর মুখে ম্লান একটা ছায়া পড়ল যেন, সে মেনে নিয়েছে সবটা। তবুও কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম কষ্ট হলো।
“কিন্তু দীপ্ত আর যাই হোক ধূর্ত নয়। ওর ভেতরে একটা ভীষণ সংবেদনশীল হৃদয় আছে। তাই মাঠে নেমে পড়ার পরে পুরোনো অপরাধবোধ ফিরে আসে। আগেরবারের অপরাধ ভুল হলেও এবারেরটা তো সত্যি। আগেই বলেছি, এই ক্রনিক ট্রমায় যারা ভোগে, তাদের একটা কমন সিম্পটম হলো তীব্র অপরাধবোধ। এটা ওকে কষ্ট দিচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিল তোমাকে খুলে বলে সে অপরাধবোধ থেকে পরিত্রাণ নেবে। কিন্তু সেই সুযোগ ওর হলো না। বিয়ে হয়ে গেল তোমাদের। ভয় থাকলেও তোমাকে সে কষ্ট দিতে পারবে না। কারণ সে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তাই সম্পর্কটাকে সুযোগ দিতে চাইল দীপ্ত। তোমার প্রতি করা কৃতকর্ম লুকিয়ে রেখে। লুকিয়ে রাখার সবচাইতে বড় কারণ কিন্তু ছিলে তুমি। প্রথম কারণ এই কথাটা জানতে পারলে তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে। দ্বিতীয়ত, ওর ভয় হতো এটা জানলেই তুমি ওর কাছ থেকে চলে যাবে, ওকে ঘৃণা করবে। মায়ের কাছ থেকে একবার যা পেয়েছিল, তা সে কোনোভাবেই তোমার কাছ থেকে পেতে চায়নি।”
শ্রেয়সীর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু জমছে, কিন্তু সে ভেঙে পড়তে চায় না। পুরো কথা শুনতে চায়। তাই আবারও কথায় মনোযোগ দিল।
“তোমার উপরে ধীরে ধীরে সে ভরসা করতে শুরু করল। অল্পতে রেগে উঠা দীপ্ত ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। ভেতরের ভয়টাও কেটেই যাচ্ছিল। কিন্তু এখানে এসে আবারও সমস্যা হয়ে গেল। ওর মা আবারও দৃশ্যপটে ফিরে এলেন, তূর্য এলো। ওর সদ্য প্রলেপ লাগা ক্ষততে আবার নতুন করে ঘা জমল। সম্পর্কের প্রতি যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা, বিশ্বাসহীনতা তা আবারও ফিরে আসতে লাগল। আগেই বলেছি চাইল্ডহুড ট্রমা অনেকসময় ঘটনার পুনরাবৃত্তির আভাস পেলে নতুন করে ট্রিগার করে। ওর ক্ষেত্রেও তাই হলো। তীব্র ভয়, সাথে ওর তোমার সাথে শুরুর দিকের ইনসিডেন্টের অপরাধবোধ তো আছেই। দুটো মিলিয়ে ও আবারও কলাপ্স করল।”
শ্রেয়সীর মুখে উদ্বেগের ছাপ পড়ল, তিনি বললেন, “পিটিএসডি’তে আক্রান্ত অনেকে সামাজিক সম্পর্ক এড়িয়ে একাকী হয়ে পড়ে, আবার অনেকে নির্দিষ্ট কারো প্রতি অস্বাভাবিক ও মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়। নিজের আবেগ-অনুভূতি যথাযথ প্রকাশ করতে পারে না অথবা অতি আবেগী আচরণ ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক চাপে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। দীপ্তর ক্ষেত্রে কিন্তু এসব সিম্পটম পুরোমাত্রায় আছে।”
“কিন্তু আন্টি, আসেপাশে তো কত সুস্থ দাম্পত্য সম্পর্ক, এসব থেকে ও কেন প্রভাবিত হয় না? শুধু ভাঙনটুকু নিয়েই কেন এত অস্থিরতা?”
শ্রেয়সীর প্রশ্নে তিনি মৃদু হাসলেন, “যখন কারো মনে নেতিবাচক কোনো ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় তখন আর বিচার বুদ্ধি কাজ করে না, বিশেষ করে এমন কমপ্লেক্স মানসিকতায়৷ সে যা দেখতে চায় তাই তার চোখে পড়ে৷ অন্যকিছু তার চোখ এড়িয়ে যায়। বা ভাবে ভালো জিনিসগুলো আসলে বাইরে থেকে ভালো। কিন্তু ভেতরে অন্তঃসারশূন্য। তুমি স্বাভাবিক আচরণের সাথে ওসব মেলাতে পারবে না।”
“এর সমাধান?”
“তুমি কাল দীপ্তকে নিয়ে এসো। আমি ওর সাথে আরেকবার কথা বলি।”
শ্রেয়সী বেরিয়ে গেল। নিলুফার রায়হান তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার যাওয়ার দিকে। তার ফোনটা বাজছে। নায়লা কল করেছে। এই মেয়েটার একসময় চিকিৎসা করেছিলেন তিনি। বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছিল তার।
“কেমন আছো নায়লা?”
“ভালো আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো। রিশাদের কী খবর? আজকাল পত্রিকায় প্রায়ই ওর ইন্টারভিউ বেরোয়।”
“ওর ব্যস্ততার শেষ আছে নাকি। এই তো সেদিন আউটডোর শ্যুটিং থেকে ফিরল। এবার গো ধরেছে আমাদের নিয়ে একটা ফ্যামিলি ট্যুরে যাবে।”
“তোমার পুঁচকেটা কেমন আছে?”
“হাঁটার চেষ্টা করে এখন। বড্ড দুরন্ত হবে, তেমনই লক্ষন। ওর বাবার মতো বাউন্ডুলে না হলেই হয়।”
“বাবার মতো বাউন্ডুলে হলে বুঝি তোমার আপত্তি আছে নায়লা?”
নায়লার গলায় রিনরিনে হাসি। তাতে অত্যন্ত সুখী সুখী আবেশ মিশে আছে। নিলুফার রায়হানের ভীষণ ভালো লাগে।
………
(ক্রমশ)