#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৪১)
নুসরাত জাহান লিজা
দীপ্তের ঘুমের মধ্যে এখন দুঃস্বপ্ন এসে সহসা হানা দেয় না। বরং জেগে জেগে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা ছাড়াই সুখস্বপ্নে বিভোর হতে পারে। গত সপ্তাহে ওরা কক্সবাজার থেকে ঘুরে এসেছে। আগেও বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে, কিন্তু এবার যেন অন্যরকম হয়ে ধরা দিয়েছিল সুবিশাল সমুদ্র। মোহসীন সাহেব ওদের এক প্রকার জোর করে পাঠিয়েছিলেন। ভীষণ মিষ্টি কিছু স্মৃতি তৈরি হয়েছে এক সপ্তাহে।
হানিমুনে তোলা ছবিগুলো দেখছিল শ্রেয়সী। আজ সে অফিসে যায়নি। দীপ্ত বেরিয়ে গেছে একটু আগে। ছবি দেখতে দেখতে আবারও মনে হলো দীপ্তর হাসিটা ভীষণ সুন্দর। এই হাসিতে সে বারবার ডুবে যায়, ভালোবাসায়, প্রেমে।
দীপ্ত গাড়ি থেকে নামতেই দেখল সৌম্য এগিয়ে আসছে। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল,
“দীপ্ত, দাঁড়া, কথা আছে।”
“আমার তোর সাথে কোনো কথা নেই।”
“দীপ্ত, আমি সেদিন তোকে আমার রাগ মেটানোর জন্য কথাগুলো বলেছিলাম। আমি কিন্তু শ্রেয়সীকে কখনো কল দিইনি। সেরকম ইনটেনশনও ছিল না। তুই আমাকে তাচ্ছিল্য করতি বলে তোর উপরে খুব রেগে ছিলাম। তাই শোধ তুলতে চেয়েছিলাম, তোকে স্যরি বলতে বাধ্য করার জন্য। এছাড়া অন্যকিছু ছিল না। সেটাও উচিত হয়নি৷ আমি আজ তোকে স্যরি বলতে এসেছি। তুই আমার বিয়েতেও এলি না। ভাবলাম এসব জিইয়ে রেখে লাভ কী। স্যরি রে।”
ছয় মাস আগে হলে দীপ্তর প্রতিক্রিয়া কেমন হতো সেটা সে জানে না, তবে এখনকার দীপ্ত হুট করে রেগে যায় না। নিজের স্নায়ুর উপরে সে নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখেছে। তাছাড়া ছয় মাস আগে রেস্টুরেন্টে সৌম্য সেদিন ওর সাথে ঝামেলা না করলে সে হয়তো এখনো শ্রেয়সীকে বলতেই পারত না কিছু, সেভাবেই গুমরে মরতে হতো হয়তো। তাই আজ আর রাগ ধরে রাখল না।
“ইটস ওকে। তোর নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা।”
“আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ ছিল। সেই তাড়না থেকে এসেছিলাম।”
“ভেতরে আয়। চা খেয়ে যা।”
“আজ না রে। অফিসে যাব। একসময় আড্ডা মারা যাবে।”
সৌম্যর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল দীপ্ত। সৌম্য ওর জীবনের সাথে শ্রেয়সী আসার এক ধরনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এটা দীপ্ত কখনোই অস্বীকার করে না। তাছাড়া ছেলেটা মাসখানেক হয় বিয়ে করেছে। আসলেও তো সে সৌম্যকে তাচ্ছিল্যই করেছে অনেক সময়। একবার স্যরি কি ওরও বলা উচিত!
***
মোহসীন সাহেব তসবিহ হাতে বসে ছিলেন। শ্রেয়সী ধোঁয়া উঠা চা হাতে তার ঘরে এলো।
“বাবা, তোমার চা।”
“দীপ্ত ঘুমাচ্ছে?”
“না, রুটি বেলছে।”
মোহসীন সাহেব হেসে বললেন, “তোরা দুজনেই কী চমৎকার সংসারী হয়ে উঠেছিস। দেখতে ভালো লাগে।”
“তোমার দোয়া আমাদের সাথে আছে বাবা।”
“সে তো সবসময় আছে। আমি ভাবতাম দীপ্ত বোধহয় ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে৷ সেখান থেকে সে ঘুরে দাঁড়াল। তুই ওকে আগলে রাখছিস, ও তোকে সাপোর্ট করছে৷ একসময় আমার মনে হতো নিশ্চয়ই কোনো পাপ হয়তো করেছিলাম, যার শাস্তি আল্লাহ আমার সন্তানকে দিচ্ছে। এখন এমন আলো ভরা ঘর দেখার সৌভাগ্য আল্লাহ আমাকে দিলেন। এখন আর কোনো কুণ্ঠাবোধ নেই।”
শ্রেয়সী বুঝতে পারে, তিনি তার নিজের সাংসারিক জীবনের অপূর্ণতা থেকেই এসব ভাবতেন। যা নিয়ে তার ভেতরে চাপা এক কষ্টবোধ আছে এবং তা তিনি কখনো কারোর সামনে প্রকাশ করেন না৷
মোহসীন সাহেব বললেন, “একটা ভুল মানুষ জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে, আবার সঠিক একটা মানুষ জীবনকে ধ্বংসস্তূপ থেকেও গড়ে নিতে পারে।”
নিজের আর দীপ্তর জীবন থেকে এই উপলব্ধি মোহসীন সাহেবের হয়েছে।
শ্রেয়সী বুঝতে পারে, মোহসীন সাহেব বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকেন, তেমন কোনো আত্মীয় পরিজনের সাথে যোগাযোগ নেই বলেই চিন্তা করার অফুরন্ত সময় পান। ওদেরও পুরো সময়টা বাসায় থাকা হয় না কাজের জন্য। মানুষটাকে কিছুটা হলেও একাকীত্ব স্পর্শ করেছে।
শ্রেয়সী বেরিয়ে এসে দেখল দীপ্ত’র রুটি বানানো প্রায় শেষ। ওকে দেখে বলল,
“কী এত ভাবছ বলো তো?”
“ভাবছি বাবা সারাদিন বাসায় একা থাকেন। আমরা তো থাকতে পারি না। উনার মধ্যে একাকীত্ব ভর করছে।”
দীপ্তও খানিকটা গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, এরপর হঠাৎ মুখে উদ্ভাসিত হাসি ফুটল। হাসিতে খানিকটা দুষ্টুমি এসে ভিড়ল, বলল,
“বাবার একাকীত্ব আমরা কিন্তু চাইলেই দূর করতে পারি।”
শ্রেয়সী প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কীভাবে, কিন্তু তার আগেই ইঙ্গিতটা ধরতে পারল। কিঞ্চিৎ যেন রাঙা আভা ফুটল গালে।
শ্রেয়সীও তো চায় একটা ছোট্ট হাত পা, যে এই ঘরজুড়ে বিচরণ করবে! কথা বলার চেষ্টা করবে অবোধ্য বুলিতে। কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে, আবার চাঁদ নেমে আসবে তার হাসি জুড়ে।
“আমি খুব ভালো একজন বাবা হতে পারব শ্রেয়সী? আমার বাবার মতো?”
কত যে আকুতি মিশে আছে প্রশ্নে, শ্রেয়সী এগিয়ে এসে চুলা জেলে রুটি সেঁকে দিয়ে দীপ্তর একটা হাত ধরে বলল, “অবশ্যই পারবে দীপ্ত। তুমি তো তারই সন্তান। আমিও আছি তোমার সাথে।”
সাত সকালে রান্নাঘরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচিত হলো দু’জনের মনে।
***
আজ অফিসের পরে দুজন এসেছে কিছু কেনাকাটা করতে।
হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ডাক ভেসে এলো৷ শ্রেয়সী পেছনে তাকিয়ে আঁতকে উঠল ভেতরে ভেতরে, শোভা দাঁড়িয়ে আছে।
দীপ্তও ডাক অনুসরণ করে ঘুরে তাকালো পেছনে।
………..
(ক্রমশ)