অবাধ্য পিছুটান পর্ব-১২+১৩

0
168

অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তুর্য কপাল টান করে তাকালো পৃথার পানে অতঃপর বলল,

-“কেন ওদের তোমার মানুষ মনে হয় না?”

পৃথা আহাম্মক বনে গেল। কি বলছে এই পুরুষ? মান ইজ্জত আবার মানুষ হলো কবে? মান ইজ্জত মানুষ তো দূরে থাক ধরা ছোঁয়ারও কোনো বস্তু নয়। ছোট বেলা থেকে সে মান ইজ্জত শুধুমাত্র এই মুখে মুখেই শুনে এসেছে কখনও এদের চোখে দেখার সৌভাগ্য পর্যন্ত হয়নি। আর এই পুরুষ কিনা বলছে মান ইজ্জত মানুষ! পৃথা বোকা বোকা কন্ঠে বলল,

-“মান ইজ্জত মানুষ হলো কবে থেকে?”

তুর্য নির্বিকার। ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

-“মানুষ এখনও হয়নি তো, হবে ভবিষ্যতে। ভাবছি বউয়ের সাথে পরিবার পরিকল্পনায় বসবো খুব শীঘ্রই। মুরগির বাচ্চা আর হাঁসের বাচ্চা মিলে গোটা পঁচিশে টিয়া পাখির বাচ্চার মতো ছাও পোনার জন্ম দেব। তারপর সেই ছাও পোনার মধ্যেই বেছে বেছে দুটোর নাম দেব মান এবং ইজ্জত।”

পৃথা ভরকে গেল। ভরকানো কন্ঠে বলল,

-“মুরগির বাচ্চা আর হাসের বাচ্চা মিলে টিয়া পাখির বাচ্চা কিভাবে হবে?”

তুর্য বিরক্ত হলো ভীষন। তার মতো এত বিচক্ষণ একজন মানুষের বউ কিনা এত বোকা। তার এই টুকু কথার মানে বুঝতে পারছে না? নিশ্চই ঐ রা’জা’কা’র শ্বশুর, আল’বদর, আল শাম’স শা’লা’দে’র মধ্যে থেকে বউটার মস্তিষ্ক এভাবে ফুলে উঠেছে। তুর্যের এখন ভীষন খারাপ লাগছে। কেন সেদিন বাচ্চা বউটাকে বিয়ের আসরে ফেলে ইংল্যান্ড পাড়ি জমিয়েছিল? সেদিন যদি সে বিদেশে না গিয়ে বউকে আপন করে নিত। বাচ্চা বউটাকে নিজের কাছে রেখে কোলে পিঠে করে মানুষ করতো তাহলে নিশ্চই বউটা এতটা মোটা মাথার অধিকারী হতো না। তুর্য বিরক্তিভরা কন্ঠেই বলল,

-“আমি বললেই কি ওরা হাঁস মুরগি আর টিয়া পাখির বাচ্চা হবে নাকি? ওগুলো তো আমি ওদের ভালোবেসে বলি। বাস্তবে তো এরা সবাই মানুষের বাচ্চা।”

পৃথার মাথা ঘুরে উঠলো। মনে হচ্ছে এখনই জ্ঞান হারাবে এই ভদ্রলোকের যুক্তি তর্ক শুনে। এই পুরুষ এইসব কি উদ্ভট কথা বলছে? প্রথমে বলল “মান ইজ্জত মানুষ” তারপরে কি সব মুরগির বাচ্চা হাসের বাচ্চা তাদের আবার টিয়ার বাচ্চা সবটাই মাথার উপর দিয়ে গেল মেয়েটার। এই মুহূর্তে পৃথার নিজেকে কেমন মানসিক রোগী মানসিক রোগী মনে হচ্ছে। আচ্ছা সে নিজে মানসিক রোগী নাকি এই পুরুষ মানসিক রোগী কোনটা? পাবনা থেকে পালিয়ে আবার রাজশাহীতে এসে উঠেনি তো আবার! আরুশ তুর্যের এই অসুস্থতার কথাই বলেছিল হয়তো? পৃথা চোখ বড় বড় করে তাকালো আরুশের পানে, চোখে পড়লো ছেলেটা কেমন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথার ভয় হলো। এ কোন পাগল ছাগলের কাছে এসে পড়লো সে? ছোট বেলা থেকে এমনিই এই পাগলে ভয় পায় পৃথা। ছোট বেলায় একবার রাস্তায় তাকে একা পেয়ে এক পাগল ধাওয়া করেছিল সেই থেকে পাগলে ভয়। এখানেও তো পৃথা একাই। আর আরুশ তো এই পাগলের লোক। যদি কোনোভাবে তাকে ধরে মারে। সেদিনই তো সকলের সম্মুখে থাপ্পর মারলো। কি জোরে থাপ্পরটা ছিল। ব্যথায় তাৎক্ষণিক পৃথার মনে হয়েছিল তার দাঁত নড়ে গেছে। মেয়েটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো। অতঃপর হুট করেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। পৃথাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে হকচকালো তুর্য। সেও ছুটলো মেয়েটার পিছু পিছু। কিন্তু দরজার নিকট আসতেই খেয়ালে এলো সে অর্ধ নগ্ন। দেহের উর্ধ্বভাগে নেই কিছুই নিচে শুধুমাত্র একটা শুভ্র রঙা তোয়ালে জড়ানো। তুর্য নির্লজ্জ ঠিক আছে তাই বলে এতটাও নির্লজ্জ নয় যে অর্ধ উ’ল’ঙ্গ হয়ে শুধুমাত্র একটা তোয়ালে জড়িয়ে রাস্তায় রাস্তায় দৌড়াবে। তুর্য নিজ কক্ষের দরজার সম্মুখে গিয়েই থেমে গেল। আরুশকে তাড়া দিয়ে বলল,

-“আমার বউকে তাড়াতাড়ি ধর আরুশ।”

১৬.
পৃথা দৌড়ে বেরিয়ে এলো তুর্যদের বিল্ডিং থেকে। তবে সে এসেই থামলো না বিল্ডিং সম্মুখে। দৌড়ে আরও কিছু দূরে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। হাঁটুতে ভর দিয়ে জোড়ে জোড়ে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। অতঃপর আবার স্বাভাবিক গতিতে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু কিছুটা দূরে যেতেই পৃথা অনুভব করলো তার নাম ধরে ডাকছে কেউ একজন, পুরুষালী সে কন্ঠস্বর। আবার ঐ ব্রিটিশ পাগল আর তার চ্যালাটা না তো? মেয়েটা দাঁড়ালো না। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। তবে তাই বলে পিছন থেকে তার নাম ধরে ডাকাটা থামেনি বরং আরও বেশি করে শোনা যাচ্ছে ডাকটা। পৃথা আবারও দৌড়াতে গিয়েও থেমে গেল। কন্ঠস্বরটা কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আরুশ কিংবা তুর্যের কন্ঠের ন্যায় মনে হচ্ছে না। পৃথা থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়লো অতি পরিচিত একটি মুখশ্রী। একি এ তো পৃথার কলেজের একজন সম্মানীয় অধ্যাপক নাহিদ স্যার। যদিও বয়সে নিতান্তই অল্প বয়স্ক পুরুষ সে তবুও স্যার তো, তাদের পড়ায়। অথচ তার এত ডাকাডাকি সত্ত্বেও পৃথা চলে যাচ্ছিলো বেয়াদবের মতো। মনে মনে অনুতপ্ত হলো মেয়েটা ততক্ষণে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো নাহিদ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

-“কতক্ষন ধরে ডাকছি আপনাকে শুনছেন না?”

পৃথা জ্বীহ্বা নাড়িয়ে ওষ্ঠ ভেজালো। আমতা আমতা করে বলল,

-“দুঃখিত স্যার, আমি শুনিনি।”

নাহিদ আর এই বিষয়ে তেমন কথা বাড়ালো না। স্বভাবসুলভ ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,

-“আপনি এখানে?”

-“জ্বী আমার বাসাই এখানে স্যার।”

-“ওহ, আমি একটা কাজে এসেছিলাম এখানে। তা কলেজে যাচ্ছেন নাকি?”

পৃথা মাথা নাড়ালো। মুখে জবাব দিল,

-“হ্যা।”

নাহিদ আবারও হাসলো। অতঃপর বলল,

-“আমিও যাচ্ছি। চলুন একসাথে যাই আমরা।”

পৃথা বারন করতে চেয়েও পারলো না। হাজার হলেও শিক্ষক মানুষ। তার মুখের উপর না কিভাবে বলবে? পৃথা সায় জানালো নাহিদের কথায়। পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো দুজন। ততক্ষণে তুর্যও নিচে চলে এসেছে আরুশকে নিয়ে। বিল্ডিং এর সম্মুখে দাঁড়াতেই তার চোখে পড়লো অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটি। তার বউয়ের পাশে কিনা অন্য একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে। আর তার বউও কি সুন্দর অবলীলায় হেটে যাচ্ছে ঐ অল্প বয়সী ছোকরার পাশে। তুর্যের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহুর্তেই। বক্ষপিঞ্জরে জ্বলে উঠলো হিংসা’ত্মক মনোভাব। তুর্য অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। ভারী কন্ঠে বলল,

-“এই শিয়ালের বাচ্চাটা আবার কে খোঁজ নে আরুশ।”

আরুশ তুর্যের আসার কিছুটা আগেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাই পৃথার সাথে থাকা ছেলেটাকে বেশ ভালোভাবেই দেখে নিয়েছিল। আরুশ পৃথা এবং নাহিদের হাঁটার পানে দৃষ্টি রেখেই বলল,

-“খোঁজ নিতে হবে না স্যার। ছেলেটা ম্যামের কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ নাহিদ ভুঁইয়া। প্রথম যেদিন ম্যামকে খুঁজতে তার কলেজে গিয়েছিলাম সেদিন দেখেছিলাম।”

আরুশের কথায় তুর্যের ক্রোধ যেন বাড়লো আরও। কপালের রগগুলো ফুলেফেঁপে নীলচে হয়ে ধরা দিল সাথে সাথে। থমথমে কন্ঠে সে বলল,

-“মহিলা কলেজে কেন অল্প বয়সী শিক্ষক থাকবে? দেশে কি মহিলা শিক্ষক কিংবা বয়স্ক শিক্ষকের অভাব পড়েছিল?”

আরুশ তাকালো তুর্যের ক্রোধিত মুখ পানে। আমতা আমতা করে বলল,

-“আমি আগেই বলেছি স্যার শিক্ষক পিতার সমতুল্য।”

তুর্য কটমট করে তাকালো আরুশের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“চুপ থাক আহাম্মক। তোর এই ব্যাটাকে কোন দিক থেকে আমার বউয়ের বাপ মনে হচ্ছে? এই ব্যাটার সাথে কি এখন আমার শ্বাশুড়িকে বিয়ে দেওয়া যাবে? এ ব্যাটা কি আমার শ্বাশুড়ির মতো অর্ধ বুড়ির পানে দুষ্টু দৃষ্টি দিবে? উল্টো এর হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে এটা আমার শ্বাশুড়ির মেয়ের দিকে দুষ্টু দৃষ্টি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।”

আরুশ আর কিছু বলার অবকাশ পেল না। তুর্য তো ভুল কিছু বলেনি। আর তাছাড়া এই নাহিদ ব্যাটার হাব ভাবও খুব একটা ভালো ঠেকেনি তার নিকট। কলেজের স্যাররা থাকবে ভাব নিয়ে। তাদের আচরণ হবে অন্যরকম। তা নয় এ তো ছাত্রীর পিছনে পিছনে দৌড়ে ছাত্রীর সাথে ভাব বিনিময় করে। কোন কলেজের শিক্ষক ছাত্রী তার ডাকে না সাড়া দিলে পিছনে পিছনে দৌড় শুরু করে? নিশ্চই এই নাহিদ শিয়ালের মনে অন্য কিছু চলছে।

১৭.
সময় গড়ালো। পৃথার কলেজ ছুটি হয়েছে মাত্রই। কলেজের সম্মুখে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য এবং আরুশ, অপেক্ষা করছে পৃথার জন্য। মেয়েটাকে গেট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেই গাড়িতে উঠে বসলো তুর্য। পৃথা তাদের গাড়ির কাছাকাছি আসতেই একটু গলা বাড়িয়ে ছেলেটা বলল,

-“গাড়িতে উঠে এসো পৃথা।”

আচমকা কারো এমন কথায় হকচকালো মেয়েটা। তবে পরক্ষনেই পাশ ফিরে তুর্যকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। সাথে কিছুটা ভয়ও লাগলো। এই পাগলটা আবার এখানে কেন চলে এসেছে? আগে তো তাকে একদম দেখতেই পারতো না আর এখন পিছন ছাড়ছে না। এদের উদ্দেশ্য কি? তারপর আবার গাড়িতে উঠতে বলছে। কোথায় না কোথায় নিয়ে গুম করে দিবে বা তার সাথে কোনো খারাপ কাজও করতে পারে। কথাগুলো ভাবতেই আঁতকে উঠলো পৃথার নাজুক কিশোরী হৃদয়। আজকাল কোনো মেয়েই তো নিরাপদ নয়। রোজই পত্রিকা খুললে অসংখ্য মেয়েদের সম্ভ্রাম হারানোর হাহাকার চোখে পড়ে। সেখানে এই লোক তো পৃথার অপরিচিত। পৃথার হৃদয়ে ভয় ডানা মেললো। দুই হাতে সে খামচে ধরলো নিজের কলেজ ড্রেসের দুই পাশ। তখনই আবার ভেসে এলো তুর্যের ভারী কন্ঠস্বর। থমথমে কন্ঠে সে বলল,

-“গাড়িতে উঠে এসো।”

পৃথা আর দেরী করলো না একটুও। তুর্যের পানে একবার তাকিয়ে আবারও দৌড় শুরু সম্মুখের দিকে। তুর্যের কপালে ভাঁজ পড়লো। এমনিই সকালে অন্য পুরুষের সাথে দেখে মেজাজটা চটে ছিল এখন আবার এই মেয়ে তাকে উপেক্ষা করলো। সকালেও তাকে উপেক্ষা করে দৌড়ে চলে গেল, আবার এখনও। অথচ সকালে পরপুরুষের সাথে কি সুন্দর হেসে খেলে হেঁটে গেল। শরীরের রক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটে উঠেলো ছেলেটার। লম্বা লম্বা পা ফেলে সে এগিয়ে গেল পৃথার পানে। দুপুরের দিকে রাস্তা ফাঁকা থাকায় অল্পতেই মেয়েটাকে ধরে ফেললো তুর্য। পৃথা তবুও তুর্যের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা চালালো। কিন্তু ছেলেটা ছাড়লো না তাকে। বরং এক প্রকার টেনে হিচড়ে ছুঁড়ে ফেললো গাড়ির ভিতরের দিকে অতঃপর নিজেও গাড়ির ভিতরে ঢুকে বসলো। পৃথার এক হাত শক্ত করে ধরে আরুশকে আদেশের সুরে বলল,

-“বাইরে যা তুই।”

চলবে…..

অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১৩

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

পৃথার এক হাত শক্ত করে ধরে আরুশকে আদেশের সুরে বলল,

-“বাইরে যা তুই।”

তুর্যের আদেশ আসতে দেরী কিন্তু আরুশের বেরিয়ে যেতে দেরী হলো না। আরুশ যেন টুপ করে লাফিয়ে গাড়ির বাইরে পড়লো। সাথে সাথে গাড়ির দরজা লক করে দিল তুর্য। পৃথার হাত ছেড়ে দিয়ে গা এলিয়ে দিল সিটের সাথে। পৃথার ভয় আরও বাড়লো। আগে তো তাও একজন সুস্থ মানুষ আরুশ তাদের সাথে ছিল আর এখন সে একা একটা অর্ধ পাগল, ব্রিটিশ পুরুষের সাথে গাড়ির ভিতরে। এ লোক যদি তাকে কিছু করেও ফেলে সে অবলা একজন মেয়ে মানুষ হয়ে কিছুই করতে পারবে না। যদি মে’রে টে’রে ফেলে দেয়? ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো পৃথার। না না এই পরিস্থিতিতে কোনো ভাবেই তাকে দমে গেলে চলবে না। যে করেই হোক নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে। এখান থেকে বেরুতে হবে অতি দ্রুত। পৃথা দুই হাত উঁচিয়ে গাড়ির জানালায় আঘাত করতে শুরু করলো। চেঁচিয়ে বলল,

-“কেউ আছেন? দয়া করে সাহায্য করুন আমাকে। এই খারাপ লোকটা আমাকে তুলে নিয়েছে।”

তুর্য নিজে চোখ বন্ধ করে নিল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

-“তুমি ভয় পেলে চিৎকার করলে অথচ তুমি জানলেই না পৃথিবীতে এই মুহূর্তে সবথেকে আমার নিকটই নিরাপদ বেশি। স্বামী আমি তোমার।”

পৃথার নিজের চিৎকার চেঁচামেচিতে তুর্যের বলা নিচু কন্ঠের একটা শব্দও তাদের কর্ণে পৌঁছালো না। ছেলেটা শেষ এক পলক তাকালো ব্যস্ত পৃথার পানে অতঃপর চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো আগের মতোই। পৃথা কতক্ষন চিৎকার চেঁচামেচি করলো। অতঃপর ক্লান্ত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। তুর্য চোখ মেলে তাকালো পৃথার পানে। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,

-“দম শেষ।”

পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

-“আপনি অমাকে এখানে তুলে কেন এনেছেন? বদ লোক একটা।”

তুর্য নড়েচড়ে উঠলো। সোজা হয়ে বসে গাড়ির পিছনের দিক থেকে এক বোতল পানি বের করে আনলো। পৃথার পানে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-“পানিটা খেয়ে নাও। ইসসস হাঁপিয়ে গেছো একদম।”

পৃথা পানিটা হাতে নিল না। বরং তেতে ওঠা কন্ঠে বলল,

-“খাব আমি আমি আপনার পানি। নামিয়ে দিন আপনি আমাকে।”

তুর্যের মেজাজটা সেই সকাল থেকেই চটে আছে। বউ তার যার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে। খুঁজতে খুঁজতে ছুটে এসেছে সেই সূদূর ঢাকা থেকে রাজশাহীতে। তবুও বউকে নিজের করে পয়নি। সেই বউ কিনা তার চোখের সম্মুখে তাকেই উপেক্ষা করে অন্য পুরুষের পাশ ঘেঁষে রাস্তায় হাঁটে। আর যত অভিনয় তার সম্মুখে। তুর্য তবুও নিজেকে যথা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সে কখনওই চায় না এই বাচ্চা বউটার উপরে তার ক্রোধের কোনো লেশমাত্র পড়ুক। তুর্য জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,

-“মুরগির বাচ্চা মুরগির বাচ্চার মতো থাকো। এভাবে বাচ্চাওয়ালা মুরগির মতো ফোঁস ফোঁস না করে পানিটা গলায় ঢলো। চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে ঘেমে গেছো।”

-“আমাকে নিয়ে আপনাকে এত ভাবতে হবে না। আমাকে নামিয়ে দিল এক্ষুনি।”

পৃথার কাঠ কাঠ কন্ঠস্বর। দাঁতে দাঁত চাপলো তুর্য। নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে বলল,

-“নামিয়ে দেব অবশ্যই তবে তোমার বাসা পর্যন্ত গিয়ে।”

-“আমি আপনার সাথে যাব না ব্রিটিশ,বদ লোক।”

তুর্য এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ভিতর থেকে ক্রোধ যেন উপচে বেরিয়ে আসতে চাইছে ছেলেটার। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তুর্যের। তার লম্বাটে পরিপুষ্ট হাতটা বাড়িয়ে হুট করে সে চেপে ধরলো পৃথার সুডৌল নরম কোমড় খানা। সেখানে বেশ শক্তপোক্তভাবে চেপে ধরে মেয়েটাকে নিয়ে এলো নিজের নিকট। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“তা আমার সাথে যাবে কেন? যাবে তো ঐ কলেজের অল্প বয়স্ক কচি কোনো স্যারের সাথে।”

তুর্যের কন্ঠ নিঃসৃত কোনো কথা তেমনভাবে পৌঁছালো না পৃথার কর্ণে। মেয়েটা বরং নাজেহাল হয়ে উঠেছে তুর্যের অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে। এই প্রথম পৃথার অঙ্গে কোনো পুরুষের ছোঁয়া তাও এতটা গভীরভাবে, শরীরের গভীরতম এক স্থানে। মেয়েটা ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে কেমন। তীব্র অস্বস্তিবোধে নাজুক হয়ে পড়েছে ছোট মেয়েটার কিশোরী হৃদয়। ভিতরে ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো পৃথা। কম্পিত কন্ঠে বলল,

-“আমাকে ছেড়ে কথা বলুন।”

তুর্য ছাড়লো না। বরং টেনে মেয়েটাকে আরও নিকটে নিল। পৃথার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

-“ছাড়বো না। কি করবে তুমি?”

তুর্যের প্রতিটি নিঃশ্বাসের বায়ু আছড়ে পড়ছে পৃথার চোখ মুখে। পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে নিল মেয়েটা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো তুর্যের এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পৃথার কেমন খারাপ লাগছে না। পৃথা শুনেছে পুরুষ মানুষের অযাচিত স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ বা কু নজর নাকি নারীরা বুঝতে পারে। পৃথাও হয়তো এর আগে এমন স্পর্শের কখনও সম্মুখীন হয়নি তবে কোনো পুরুষের নজর দেখেই বুঝে নিতে পারতো কোনটা ভালো নজর এবং কোনটা খারাপ নজর। তবে আজ কেন এ স্পর্শের মানে সে বুঝতে পারছে না? এই অপরিচিত স্পর্শ খারাপ লাগছে না পৃথার নিকট আবার ভালোও লাগছে না। কেমন দোটানার মন মজেছে। লজ্জা, ভয়, সংকোচ, সংশয়ে হৃদয় অবদ্ধ হয়েছে। তবুও কেন যেন পৃথা জোর গলায় কিছু বলতে পারছে না। এটাই বোধহয় পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন। লোকমুখে শোনা যায়,” বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলে দুই নর নারীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা এক অদৃশ্য বন্ধনের সৃষ্টি করে সাথে সাথেই।” কথাটা বোধহয় বহুলাংশে সত্যি। তাই না জেনে, না বুঝেও তুর্যের স্পর্শেকে খারাপের খাতায় ফেলতে পারছে না মেয়েটা। পৃথা চোখ বন্ধ রেখেই শীতল কন্ঠে বলল,

-“চিৎকার করবো আমি।”

তুর্য বাঁকা হাসলো। পৃথার মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝলো সে। ক্ষীন কন্ঠে ছেলেটা বলল,

-“প্রথমত তুমি হাজার চিৎকার করলেও তোমার কন্ঠে উচ্চারিত একটা শব্দও গাড়ির বাইরে যাবে না। দ্বিতীয়ত তুর্য চৌধুরীর হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর সাধ্য কারো এই মুহূর্তে কারো নেই মুরগির বাচ্চা।”

“তুর্য চৌধুরী” নামটাই কম্পন ধরালো পৃথার কায়া জুড়ে। এর আগে বহুবার এই লোকের সাথে পৃথার দেখা হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে তবে নামটা জানা হয়নি। বারবার ব্রিটিশ লোক বলেই সম্বোধন করেছে তাকে। কিন্তু এই নামটা কেমন পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথাও শুনেছে হয়তো। কিন্তু কোথায় শুনেছে পৃথা মনে করতে ব্যর্থ হলো। যেথায় শুনেছে শুনুক তো। এখন এই লোকটার থেকে নিজেকে মুক্ত করাই মেয়েটার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কিন্তু সে লেগেছে এর নামের রহস্য খুঁজতে। তুর্য চৌধুরী নামটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল পৃথা। মুহুর্তেই আবার আগের রূপে ফিরে গেল সে। কটমট করে বলল,

-“ছাড়ুন আমাকে অ’স’ভ্য পুরুষ মানুষ।”

তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,

-“ছাড়লেই ঐ চ্যাংড়া স্যারের কাছে যাবে নাকি? সেই পাঁয়তারা করছো?”

পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। তখন থেকেই
নাহিদ স্যারকে নিয়ে এই লোক অপমানের পর অপমান করে যাচ্ছে। কেন? নাহিদ স্যারের সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? নেই তো। শুধুমাত্র আজ সকালে একসাথে একটু কলেজে এসেছে তাই এই লোক এত কথা বানিয়ে ফেললো? পৃথা ফুঁসে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

-“আমি যার কাছে খুশি যাব আপনার কি? আপনি কোন অধিকারে আমাকে এসব কথা বলছেন?”

তুর্য রেগে গেল। খাবলে ধরলো মেয়েটার নরম কোমড়ের ভাঁজ। ক্রোধে হিসহিসিয়ে বলল,

-“কোন অধিকারে বলেছি তা তোমার রা’জা’কা’র বাপকে জিজ্ঞেস করো। সে খুব ভালোভাবে চিনে আমাকে। আর আমার অধিকারটাও তার জানা সম্পূর্ন ভাবে।”

পৃথা তেতে গেল। উঁচু কন্ঠে বলল,

-“একদম আমার বাবাকে উল্টা পাল্টা কথা বলবেন না। আমার বাবা মোটেই রা’জা’কা’র না বরং আপনি ব্রিটিশ।”

তুর্য মুখ বাঁকালো। নির্লিপ্ত হয়ে বলল,

-“তোমার বাপটা রা’জা’কা’র। ভাই দুটো আ’লব’দর আল শা’মস। তোমার গুষ্টি শুদ্ধো সব বেই’মানে’র দল শুধুমাত্র তুমি ছাড়া।”

-“মুখ সামলে কথা বলুন।”

তুর্য আলতো হাসলো। পৃথার পানে আরেকটু ঝুঁকে বলল,

-“মুখ সামালাবো না আমি। কি করবে? মুখে চু’মু খাবে! তেমন ইচ্ছে থাকলে দ্রুত কাজটা সেড়ে ফেল। শুভ কাজে দেরী করতে নেই জানো না তুমি?”

পৃথা হতবম্ব হয়ে গেল। সবকিছু যেন মাথার উপর থেকে চলে গেল। এতক্ষন না হয় চেপে ধরেছে ক্রোধের বশে আর এখন চু’মু খাওয়ার কথাও বলছে? আগে তো ভেবেছিল এ লোক শুধুমাত্র ব্রিটিশ, তারপরে আবিষ্কার করলো এ ব্রিটিশের পাশাপাশি আধপাগল এখন অ’স’ভ্য”ও বটে। ছিঃ ছিঃ চরিত্রের কি শ্রী। পৃথার হতবাকতার মাঝেই তাকে ছেড়ে দিল তুর্য। ঠিকঠাক হয়ে বসে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আরুশকে মেসেজ করলো,

-“গাড়িতে আয়।”

আরুশ প্রায় সাথে সাথেই গাড়িতে এলো। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করলো দ্রুততার সাথে। এরপরে সময় কেটে গেল খুব দ্রুত। এমনিও কলেজ থেকে পৃথার বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। তার উপর মেয়েটা চুপচাপ বসে রয়েছে গাড়ির সিটে। আরুশ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের বিল্ডিং এর সম্মুখে এসে থামালো গাড়িটা। পৃথাদের বাসার সম্মুখে আর নিল না। পরে দেখা যাবে ঐ রাজাকারের দল তাদের একসাথে দেখে কোনো গন্ডগোল লাগিয়ে দিবে।

গাড়ি থামার বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও পৃথাকে গাড়ি থেকে নামতে না দেখে ভ্রু কুঁচকালো তুর্য। কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালো,

-“নামবে নাকি তোমার বাসা পর্যন্ত যাব? পরে তোমার রাজা’কার বাপ, আল’বদর আর আল শা’মস ভাই দেখে ফেললে কিন্তু আমার কোনো দোষ নেই।”

পৃথা ফুঁসে উঠে তাকালো তুর্যের পানে। তবে বলল না কিছুই। এখন এই লোকের সাথে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে দেরী করার ইচ্ছা নেই কোনো। এমনিই এই আধপাগলের পাল্লায় পড়ে অনেকটা সময় দেরী হয়েছে মেয়েটার। পৃথা ফোঁস ফোঁস করতে করতে গাড়ি ছেড়ে বাইরে নেমে দাঁড়ালো। তীব্র ক্রোধ নিয়ে ঠাস করে লাগালো দরজাটা অতঃপর হনহন করে হাঁটা দিল সম্মুখ পানে। তুর্য হেসে ফেললো বউয়ের রাগ দেখে। বিরবিরিয়ে বলল,

-“মুরগির বাচ্চার মতো বউটা আমার।”

আরুশ সম্মুখে বসে লুকিং গ্লাসে দেখলো তুর্যের হাসি মুখটা। কেমন যেন তুর্যের কার্যকলাপে সায় দিতে পারছে না সে। বউকে যেহেতু হাতে পেয়েছে তাদের বিয়ের কথা বলে দিলেই তো পারে। এত অভিনয় করে সময় নষ্ট করার কি দরকার? তবে এই কথাগুলো তুর্যের সম্মুখে বলার সাহস পায় না ছেলেটা। আবার না বলেও থাকতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজের ভিতরে সাহস সঞ্চয় করলো আরুশ। অতঃপর তুর্যকে শুধালো,

-“স্যার আপনি ম্যামকে এখনও বলে দিচ্ছেন না কেন সে আপনার বউ। আপনাদের বিয়ে হয়েছিল।”

থামলো আরুশ। আমতা আমতা করে বলল,

-“একবার সত্যিটা বলে দিলেই তো হয়। সব ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। এসব লুকোচুরি খেলার মানে কি স্যার?”

চলবে…..