অবাধ্য পিছুটান পর্ব-১৬+১৭

0
467

অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১৬

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

পৃথা কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি প্রশ্ন করলো,

-“তুর্য চৌধুরী কে বাবা?”

খাবারেই হাত থেমে গেল পলাশ শিকদার, পিয়াস এবং পিয়ালের। সুফিয়া বেগম সবাইকে এতক্ষন খাবার পরিবেশন করে নিজেও কেবল বসেছিল খেতে এর মধ্যে হঠাৎ মেয়ের এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে তিনিও থমকে গেছেন। হৃদয়ে ভয়ের জন্ম নিল সুফিয়া বেগমের। তবে কি নিজের বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে মেয়ের অপরিণত বয়সে যে ভুল তারা করেছিল তা সামনে আসতে শুরু করেছে? তুর্য কি বলে দিয়েছে পৃথাকে সব? এখন মেয়েটার কি হবে? মেয়েটা কিভাবে নিবে সব কিছু? সুফিয়া বেগমের ভাবনার মধ্যেই মুখ খুললো পিয়াল। বড় ভাই আর বাবা এখনও অব্দি পৃথার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো উত্তর না দিলেও সে চুপ রইতে পারলো না। অধৈর্য্য হয়ে বোনকে প্রশ্ন করলো,

-“কেন তুর্য চৌধুরীকে দিয়ে তোর কাজ কি? সে কিছু বলেছে তোকে?”

পিয়ালের প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই পিয়াস মুখ খুললো। গম্ভীর কন্ঠে শুধালো,

-“তুর্য চৌধুরীর সাথে তোর কোথায় দেখা হয়েছে?”

অপ্রস্তুত হলো কিছুটা। তুর্যের সাথে দেখা, ঝগড়া, রাতে ফোনকলে কথা বলা এসব যদি বলতে যায় তবে তাকেই বিপদে পড়তে হবে। তার ভাই আর বাপ মিলে পুতে দিবে এখানেই। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো পৃথা। আমতা আমতা করে বলল,

-“কলেজের সম্মুখে এক লোকের সাথে দেখা হয়েছিল। তিনি তার নাম বললেন তুর্য চৌধুরী।‌ আমি চিনি না বলে জানাতেই সে বলল তোমার বাবা চিনে, তার কাছ থেকে আমার পরিচয় জেনে নিও।”

পলাশ শিকদার তাকালেন মেয়ের পানে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললেন,

-“আমি জানি না তুর্য চৌধুরী কে, এই নামে আমি কাউকে চিনি না।”

কথাটা শেষ করেই আবার ওয়া শুরু করলেন বয়স্ক লোকটা। এমন ভাব যে সত্যিই সে চিনে না তুর্য চৌধুরী নামের কাউকে। পৃথা অবাক হলো কিছুটা। কেন যেন পিয়াস আর পিয়ালের তুর্যকে নিয়ে আগ্রহ দেখে তার মনে হয়েছিল ছেলেটাকে তার পরিবার চিনে। অথচ পলাশ শিকদার বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে দিল চিনে না। মনের কোনে প্রশ্ন জাগলেও তা প্রকাশ করলো না পৃথা। হতে পারে তার পরিবার সত্যিই চিনে না তুর্যকে। ঐ লোকটাই মিথ্যা বলেছে। এমনি আধপাগল ব্রিটিশ লোক তুর্য চৌধুরী।

পৃথা দ্রুত তার খাবার শেষ করে উঠে চলে গেল। এমনিও আজ সারাদিনের ঘটনায় তার খাওয়া দাওয়ায় মনোযোগ ছিল না কোনো। তাই একটু আগে ভাগেই শেষ হয়েছে খাওয়া। অন্য সময় হলে হয়তো বাবা ভাইয়া কম খাচ্ছে কেন? খাবার নিচ্ছে না কেন? এত তাড়াতাড়ি উঠে যাচ্ছে কেন? এ নিয়ে হাজার খানেক প্রশ্ন তুলতো। শেষে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে গান্ডে পিন্ডে গেলাতো। আজ অবশ্য তেমন কেউ কিছু না করায় বেশ চমকেছে পৃথা তবে চুপচাপ সটকে পড়েছে। এখানে এ নিয়ে প্রশ্ন করা মানেই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা’রা। পরে দেখা যাবে তার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ধরে বেঁধে খাওয়ানো শুরু করেছে। পৃথা যেতেই পিয়াস এবং পিয়াল যেন হা’ম’লে পড়লো বাবার উপরে। এতক্ষন তারা এখান থেকে পৃথার সরার অপেক্ষাতেই ছিল। পিয়াস বেশ চিন্তিত সুরে বলল,

-“বাবা তুর্য পৃথুর সামনে চলে এসেছে। এখন কি করবো আমরা?”

পিয়াল অধৈর্য্য হয়ে উঠলো। অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,

-“ও যদি একবার ওদের বিয়ের কথাটা বলে দেয় পৃথুকে তখন কি হবে?”

সুফিয়া বেগম অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন আরও। ভয়ার্ত কন্ঠে শুধালেন,

-“ছেলেটা যদি কোনো ক্ষতি করে দেয় আমার মেয়ের।”

পলাশ শিকদার বুঝলেন নিজের স্ত্রী এবং ছেলেদের ব্যাকুলতা। তবে তার মধ্যে তেমন একটা বিচলিত ভাব দেখা গেল না। বরং বেশ থমথমে কন্ঠৈ তিনি বললেন,

-“বিষয়টা নিয়ে ভাবতে দাও আমাকে।”

২২.
বেলা গড়িয়েছে কিছুটা। চারদিকটা সূর্যের ফুটফুটে উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠেছে। ঘড়ির কাঁটায় টিক টিক করে জানান দিচ্ছে সকাল নয়টা। পৃথার কলেজের সময় হয়ে এসেছে। মেয়েটা খেয়ে দেয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে তৈরী হয়ে বেরিয়ে এলো নিজের কক্ষ থেকে। কিন্তু কক্ষে আসতেই মুখোমুখি হলো পলাশ শিকদারের। ঐ অবশ্য নতুন কিছু নয়। পৃথার কলেজে যাওয়ার সময়ে প্রায়ই পলাশ শিকদার বসে থাকেন বসার কক্ষে। মাঝে মাঝে পত্রিকা পড়ে আবার মাঝে মাঝে টিভিতে খেলা বা নিউজ দেখে। তার ব্যবসার কাজ এখন বেশিরভাগই দুই ছেলে সামলয়। মাঝে মাঝে শুধুমাত্র ব্যবসায় একটু উকি দিতে যান তিনি। ঐ প্রায় দিনের মতোই আজও বসার কক্ষের সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। তবে মেয়েকে আসতে দেখে তিনি পত্রিকা থেকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন মেয়ের পানে। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

-“কোথায় যাচ্ছো?”

পৃথা ভরকে গেল ক্ষানিকটা। সে যে প্রতিদিন এই সময়ে কলেজে যায় তা তো জানে তার বাবা। তাছাড়া এই মুহূর্তেও তার শরীরে কলেজের পোশাক আবার পিঠে ব্যাগ তারপরও জিজ্ঞেস করছে কেন? পৃথা নিজের ভরকানো ভাব প্রকাশ করলো না বাবার সম্মুখে। নমনীয় কন্ঠে বলল,

-“কলেজে বাবা।”

পলাশ শিকদার মেয়ের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে আবার তাকালো পত্রিকার পানে। আদেশের সুরে বললেন,

-“আজ কলেজে যেতে হবে না তোমাকে।”

পৃথা আশ্চর্য হলো। বাবা তাকে কলেজে যেতে বারন করছে? অবিশ্বাস্য! সে মাঝে মাঝে কলেজে না যেতে চাইলেও বাবার ধমকের জোরে উড়ে চলে যেতে হয় কলেজে অথচ আজ কিনা সে নিজে বলছে কলেজে যেতে হবে না! পৃথা অবাক কন্ঠেই প্রশ্ন করলো,

-“কেন?”

-“আমি বলেছি তাই।”

পৃথাও আর কথা বাড়ালো না। বাবা যখন একবার কলেজে যেতে বারন করেছে সে যাবে না। এমনিতেও কলেজে যেতে হবে না শুনে বেশ খুশিই হয়েছে মেয়েটা। রোজ রোজ কলেজে যেতে হবে না তার। শুধুমাত্র বাপ ভাইদের ভয়ে যেতে হয়। আজ যাক তাও বাবা বারন করেছে। পৃথা বাবার সম্মুখ থেকে কেটে পড়লো দ্রুত। বাবার যদি আবার মত বদলে যায়! না না, বাবার মত বদলানোর আগেই ঘরে গিয়ে কলেজের পোশাক পাল্টে ফেলতে হবে।

***

প্রায় ঘন্টাখানেক পৃথার কলেজের সম্মুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো তুর্য। কত মেয়ে এলো গেল অথচ তার বউয়ের দেখা নেই। বাড়ির সম্মুখে আরুশকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল যে যখনই পৃথা এখান থেকে যাবে তাকে খবর দিতে। আরুশ রাস্তায় দেখা পায়নি মেয়েটার। তারা ভেবেছিল আজ হয়তো আরুশ রাস্তার পাশে দাঁড়ানোর আগেই পৃথা কলেজে চলে গেছে তাই দুজন মিলে চলে এলো সোজা কলেজে অথচ এখানেও মেয়েটার খোঁজ নেই কোনো। পৃথাদের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তবে কি ফাঁকিবাজ মেয়েটা কলেজে আসেনি? হয়তো আসেনি। তুর্যের মেজাজ গরম হলো। সে সেই সকাল থেকে একটা বার বউয়ের মুখটা দর্শনের জন্য হাঁফ হিস্তেস করে ম’র’ছে আর মেয়েটা কলেজেই এলো না। তুর্যের রাগ লাগলো। ইচ্ছে হলো বউকে যদি ঠাঁটিয়ে একটা থাপ্পর মে’রে গাল লাল করে দিত। তবে পরক্ষনেই নিজের চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো তুর্যের। ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে সে তাকালো নিজের হাতের পানে। ঠাটিয়ে চড় সে কাকে মা’র’বে? তার বউকে! একবার না জেনে থাপ্পর মে’রে দিয়েছিল বলে কি সে আবার মা’র’বে? এই পৃথিবীতে তুর্যের বাচ্চা বউকে মা’রা’র অধিকার সে কাউকে দেয়নি এমনকি নিজের হাতকেও না।

তুর্য ব্যস্ত হাতে নিজের পকেট ঘেটে মোবাইলটা বের করলো। দ্রুত কল লিস্ট কল করলো পৃথাকে। একটু সম। অতিবাহিত হতেই ওপাশ থেকে এক সুমিষ্ট নারী কন্ঠ তাকে জানান দিশ,”নাম্বারটি ব্যস্ত আছে।”

তুর্যর কপালে ভাঁজ পড়লো। তার মুরগির বাচ্চার মতো বউটা আবার কার সাথে কথা বলছে? তাছাড়া কারো সাথে কথা বললে তো ওয়েটিং বলবে, ব্যস্ত আছে তো বলবে কেটে দিলে বা ব্ল্যাক লিস্টে ফেললে। পৃথা তার কল কেটে দিয়েছে বলেও তো মনে হলো না, তবে কি মেয়েটা তার নাম্বার ব্ল্যাক লিস্টে ফেলেছে? তুর্যের সন্দেহ হলো। ছেলেটা তড়িঘড়ি করে আবার কল লাগালো পৃথার নাম্বারে। নাহ এবারও একই কথা বলছে। তুর্যের সন্দেহ গাঢ় হলো। সে নিজের মোবাইলে থাকা অন্য সিম দ্বারা কল করলো পৃথাকে। এ বার কল ঢুকলো কোনো বাঁধা ছাড়াই। এর মানে পৃথা তার ঐ নাম্বারটা ব্ল্যাক লিস্টেই ফেলেছে। ক্রোধ জাগলো তুর্যের, মস্তিষ্কটা ফুটে উঠলো টগবগিয়ে। কত বড় সাহস এই নারীর তার নাম্বার ব্ল্যাক লিস্টে ফেলে। তুর্যের ক্রোধের মধ্যেই কলটা ধরলো পৃথা। সাথে সাথেই বাজখাঁই কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো তুর্য। হুংকার দিয়ে বলল,

-“এই বেয়াদব মেয়ে আমার নাম্বার ব্ল্যাক লিস্টে ফেলার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে?”

তুর্যের বাজখাঁই কন্ঠে কেঁপে উঠলো পৃথা। তবুও দমে গেল না মেয়েটা। ঢোক গিলে বলল,

-“এতে আবার সাহসের কি আছে? আমার মোবাইল, আমার হাত আমার ইচ্ছে। যাকে খুশি ব্ল্যাক লিস্টে ফেলবো আপনার কি?”

তুর্য আরও তেতে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“আমাকে ব্ল্যাক লিস্টে ফেলে তুমি আবার কথা বলছো? তোমার জ্বীহ্ব টেনে ছিঁড়ে নেব বেয়াদব মেয়ে।”

ব্যস সাথে সাথেই তুর্যের ভিতর থেকে তার আরেকটা সত্ত্বা যেন তার থেকেও দ্বিগুণ ক্ষেপে গেল। তাকে শাসিয়ে বলল,

-“তোকে কে সাহস দিয়েছে আমার বউয়ের জ্বীহ্ব‌ টেনে ছিঁড়ে নেওয়ার। আয় তোরটা ছিঁড়ি আগে।”

নিজের সাথে নিজের যুদ্ধেই চুপসে গেল তুর্য। এই মেয়েটার নিকট আসলেই তার কেমন সব গুলিয়ে যায়। একটু শান্তিমতো রাগও দেখাতে পারে না। মস্তিষ্ক পৃথার উপর ক্রোধিত হলেও হৃদয় তাকে শান্তনা দিয়ে বলে,

-“আহহ শান্তি শান্তি। মুরগির বাচ্চার মতো বউ তোর। তার উপর এতটা রাগ দেখানো তোর প্রাকৃতি বিরুদ্ধ।”

হৃদয়টা সর্বদা বেইমানি করে তুর্যের সাথে। অবস্থান তার বুকের মধ্যে অথচ সমর্থন বউয়ের প্রতি। এই জীবনে তুর্যের ক্রোধের স্বীকার কত লোকই তো হলো এবং তার আশেপাশের পরিবেশে রাগচটা বদমেজাজি হিসেবেই পরিচিত ছিল ছেলেটা কিন্তু আজ! আজ মাত্র একটা মেয়ের সম্মুখে সে অসহায়। এও কি বিশ্বাসযোগ্য? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। ক্রোধ কমিয়ে শুধালো,

-“কলেজে আসোনি কেন?”

হঠাৎ তুর্যের কন্ঠ নরম হতে দেখে অবাক হলো পৃথা। এই মাত্র না লোকটা হুংকার ছাড়লো, এর মধ্যেই আবার ভেজা বিড়াল সেজে গেল? পৃথা অবাক কন্ঠেই প্রশ্ন করলো,

-“আপনি না এই মাত্র বাঘের মতো গর্জন ছাড়লেন হঠাৎ বিড়ালের মতো মিও মিও কেন করছেন?”

তুর্য অপ্রস্তুত হলো। আমতা আমতা করে বলল,

-“পুরুষ মানুষ বাহিরে যতই বাঘ থাকুক বউয়ের সম্মুখে আসলে সে বিড়ালই হয়ে যায়।”

পৃথা বিভ্রান্ত হলো। কি বলছে এই পুরুষ? কে বাঘ? আর কেই বা বউ? পৃথা ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

-“মানে?”

তুর্য এড়িয়ে যেতে চাইলো পৃথার প্রশ্ন। কন্ঠ কিছুটা স্বাভাবিক করে সে বলল,

-“ওসব বাদ দাও। এখন বলো আজ কলেজে কেন আসোনি?”

তুর্যের নরম কন্ঠের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথাও আর ক্রোধ দেখালো না। নরম কন্ঠেই বলল,

-“বাবা যেতে দেয়নি।”

তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,

-“তা দিবে কেন? তোমার রা’জা’কা’র বাপের আবার আমার সুখ সহ্য হয় না।”

কথাটা শেষ করেই বুকে হাত দিল তুর্য। আহহ এখন শান্তি লাগছে। বউকে কিছু বলতে পারবে না তাতে কি হয়েছে? বউয়ের বাপ ভাইদের তো বলতে পারবে। পৃথা কিছু বলার আগেই তুর্য আবার বুকে হাত দিয়ে বলল,

-“তার সাথে আবার জুটেছে তোমার আল’বদ’র এবং আল শাম’স ভাই দুইটা।”

চলবে…..

অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_১৭

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

পৃথা কিছু বলার আগেই তুর্য আবার বুকে হাত দিয়ে বলল,

-“তার সাথে আবার জুটেছে তোমার আল’বদ’র এবং আল শাম’স ভাই দুইটা।”

পৃথা ফুঁসে উঠলো। এই লোক যখন তখন তার বাবা ভাইদের অপমান করা শুরু করে দেয়।‌ ব্রিটিশ লোক একটা। পৃথা কিছুটা ঝাঁঝালো কন্ঠেই বলল,

-“একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। আমার বাপ ভাইরা রাজা’কার, আল ব’দর, আল শা’মস কোনোটাই নয় বরং আপনি ব্রিটিশ। ১৯৪৭ সালে আমদের দেশ থেকে পালানো ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া বাচ্চা আপনি।”

তুর্য যেন আকাশ থেকে মাত্রই টুপ করে পড়লো। অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,

-“ছিঃ ছিঃ মুরগির বাচ্চা। আমার মতো একটা নীরিহ হাসের বাচ্চাকে তুমি এভাবে বলতে পারলে? এসব কথা বলার আগে তোমার বুকটা একটুও কাঁপলো না।”

পৃথা এই লোকের অভিনয় দেখে আর আশ্চর্য না হয়ে পারলো না। মিনিটে মিনিটে ভোল বদলায় এই আধপাগল লোক। পৃথা কপাল টান টান করলো। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,

-“না কাঁপেনি। আমার বাপ ভাইকে রা’জা’কা’র, আলব’দর, আল শা’মস বলতে আপনার যেমন বুক কাঁপেনি তেমনি আমারও আপনাকে ব্রিটিশ বলতে একটুও বুক কাঁপেনি।”

তুর্যের চোখদ্বয় ছোট ছোট হলো। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“বাপ ভাই মিলে ভালোই তো আমার বিরোধীতা করতে শিখিয়েছে। যাক ব্যাপার না আমিও দেখি এরা আর কি কি করতে পারে। দিন শেষে ঐ রাজা’কার’দের আমার মতো মুক্তি সেনাদের হাতেই পরাস্ত হতে হবে দেখে নিও।”

পৃথা অবাক হলো। অবাক কন্ঠেই বলল,

-“আপনি মুক্তি সেনা? আপনি তো ঘসেটি বেগমের বংশধর যাকে সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। নিজের স্বাধীন দেশকে পরাধীন করতে উঠে পড়ে লাগেন আপনারা।”

তুর্য চিন্তায় পড়লো। খুব একটা ভুল পৃথা বলেনি। সেদিন বিয়ের আসরে বউ তার ছিল এবং স্বাধীনও ছিল। কিন্তু সে কি করেলো সেদিন বিয়ের আসরে বউকে ত্যাগ করে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করে চলে গেল দূর দেশে। আর এখন সেই শিকল কেটে আবার বউকে স্বাধীন করার কত প্রচেষ্টাই না চালাচ্ছে। তুর্য ভাবুক ভঙ্গিতেই বলল,

-“এই প্রথম তুমি একটা সত্যি কথা বললে।”

পৃথা মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,

-“আমি সব সময়ই সত্যি বলি।”

-“তা না হয় বুঝলাম। এখন একটা কাজ করো তো। তাড়াতাড়ি আমার বাসায় চলে এসো।”

তুর্যের কথায় ভাঁজ পড়লো পৃথার কপালে। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

-“আপনার বাসায় আমি কেন যাব?”

তুর্য ভাবলেশহী, নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল,

-“দেখবো তোমায়, দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষন। চলে এসো তাড়াতাড়ি।”

পৃথা ভরকালো কিছুটা। কেমনভাবে তাকে অধিকার নিয়ে বাসায় যাওয়ার কথা বলছে পুরুষটা। সে কি তুর্যের বিয়ে করা বউ নাকি যে বললেই যেতে হবে? তাছাড়া পুরুষ মানুষকে লাই দিলেই লাই পেয়ে যায়। মথায় উঠে নাচতে শুরু করে। যেমন এই পুরুষ শুরু করেছে। দুই দিন একটু কথা বলেছে তাও ভলোভাবে না। তাতেই এখন অধিকারবোধ নিয়ে বাসায় যেতে বলছে। পৃথা কপালে ভাঁজ ফেললো। তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল,

-“আপনি বললেই যেতে হবে আমাকে? যাব না আমি আপনার বাসায়।”

তুর্য চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। সে ঠিক জানতো এই নারী তার আদেশকে সরাসরি না দ্বারা প্রতিহত করবে। এর এ ছাড়া তো আর কাজ নেই কোনো। তাই তো মনের ভিতরে আগে থেকেই সকল হুমকি ধামকি সাজিয়ে রেখেছে তুর্য। ছেলেটা হুমকির স্বরে পৃথাকে বলল,

-“তুমি আমার বাসায় আসবে নাকি আমি তোমার বাসায় চলে আসবো? কোনটা?”

থামলো তুর্য আবার বলল,

-“আমি তোমার বাসায় আসলে কিন্তু তোমার বাপ ভাইকে ধরে ধরে বলবো তুমি এখানে আমাকে আসতে বলেছো। আমি কিছুতেই আসতে চাইছিলাম না কিন্তু তোমার নাকি আমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে তাই জোর করে এনেছো।”

পৃথা বোকা বনে গেল। এসব কথা সে কখন বলল? ছেলেটা বানিয়ে বানিয়ে কেমন মিথ্যা বলছে। পৃথা চোখ বড় বড় করে বলল,

-“আমি এসব কথা কখন বললাম? মিথ্যাবাদী লোক একটা।”

-“সে তুমি জানো আর আমি জানি আর কেউ তো আর জানে না।”

পৃথা তেতে গেল। কটমট করে বলল,

-“বাবা তাহলে ঠিকই বলছে কিন্তু আপনি আমাকে মিথ্যা বলে ঘুরিয়েছেন।”

তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

-“তোমার বাবা আমাকে নিয়ে আবার কি বলেছে?”

পৃথা অতটা ভাবলো না। সরল মনে জবাব দিল,

-“বাবা বলেছেন তিনি আপনাকে চিনেন না অথচ আপনি সেদিন গাড়িতে বলেছিলেন আমার বাবা আপনাকে ভালোভাবে চিনে।”

তুর্যের কপালের ভাঁজ হালকা হলো। সে তো আগে থেকেই জানতো এ কথা। ঐ প্রথম যেদিন শ্বশুরের সাথে তার সাক্ষাৎ হলো সেদিনই তো সে বলেছিল,

-“রা’জা’কা’র’রা ভালো মানুষ চিনে না।”

এ আর নতুন কি? তুর্য পৃথার কথায় ততটা পাত্তা দিল না। মেয়েটাকে আবার হুমকি দিয়ে বলল,

-“আমার বাসায় আসবে নাকি আমি তোমার বাসায় আসবো? গাড়িতেই আছি আমি। গাড়িটা আমার বাসার সম্মুখে না থামিয়ে সোজা তোমার বাসার সম্মুখে থামাবো বলে দিলাম।”

পৃথা ভয় পেয়ে গেল। এই আধপাগল লোক যদি একবার তার বাড়িতে চলে আসে তাহলেই তো বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে। তারপর যদি আবার ঐসব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে তবে তো আজ ম’র’তে হবে নির্ঘাত। পৃথা তাড়াহুড়ো করলো। ব্যস্ত হয়ে বলল,

-“আমি আসছি, এক্ষুনি আসছি।”

তুর্য বাঁকা হাসলো। হাত ঘড়ির পানে একবার তাকিয়ে বলল,

-“তাড়াতাড়ি এসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার।”

কথাটা বলেই কল কাটলো তুর্য। পৃথা পড়লো মহা চিন্তায়। ভয়ে তো বলে দিল সে যাবে কিন্তু তুর্যের বাসায় যেতেও কেমন ভয় ভয় লাগছে। অত বড় ফ্ল্যাটে মাত্র দুইজন পুরুষের বসবাস সেখানে একা একটা মেয়ে যাবে যদি ওরা খারাপ কিছু করার চেষ্টা করে পৃথার সাথে? যদিও মেয়েটার মনে হচ্ছে না তুর্য এমন কিছু করতে পারে তবুও এই অতি আধুনিক সভ্যতায় বিশ্বাস করতে কে আছে? দীর্ঘদিনের অতি পরিচিত মানুষগুলোও হুট করে নিজের রূপ বদলে নিতে দুইবার ভাবে না সেখানে তুর্য তো অপরিচিত এক পুরুষ। আবার না গিয়েও উপায় নেই কোনো। ছেলেটা একবার এ বাড়িতে চলে আসলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। মনের মধ্যে একরাশ চিন্তা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো পৃথা। কলেজ ব্যাগের মধ্য থেকে মরিচ গুলিয়ে রাখা একটা স্প্রের বোতল রাখলো তার কাঁধ ব্যাগে। নিজের নিরাপত্তার জন্য ব্যাগে সর্বদা এ মরিচ গোলানো স্প্রে রাখে পৃথা। আজও সে বোতল নিয়ে নিল নিজের নিরাপত্তার জন্যই। যদি তুর্য বা আরুশ তার সাথে অপ্রত্যাশিত কিছু করার চেষ্টা করে তবে সেও এর প্রয়োগ করবে। মনের মধ্যে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। বসার কক্ষে এসে সে আবারও মুখোমুখি হলো বাবার। সেই যে লোকটা এখানে বসেছে আর ওঠেনি। পৃথাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকালেন পলাশ শিকদার। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

-“আবার কোথায় যাচ্ছো?”

পৃথা অপ্রস্তুত হলো। আমতা আমতা করে বলল,

-“এই তো সামনের বিল্ডিং এ। আমার নতুন এক বান্ধবী ঐ বিল্ডিং এ বাসা ভাড়া নিয়েছে। কলেজে গেলাম না ঘরে একা একা বসে ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম ওর বাসা থেকে ঘুরে আসি একটু।”

পলাশ শিকদার মেয়েকে সন্দেহ করলেন না। উল্টো তিনি চাইছিলেন মেয়ে এই মুহূর্তে ঘরের বাইরে যাক। আবার বাইরে গেলে যদি তুর্যের সাথে দেখা হয়ে যায় সেই ভয়ে কলেজে যেতে দেয়নি। তবে সামনের বিল্ডিং যেতে তো বাঁধা নেই। সেখানে তুর্য আসবে কোথা থেকে। প্রথমে একবার ভাবলেন মেয়েকে এমনিই যেতে দিভে কিন্তু পরক্ষনেই কি ভেবে আবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন লোকটা। পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-“চলো আমি দিয়ে আসছি তোমাকে।”

পৃথা চমকালো। ভয় ডানা বাঁধলো তার হৃদয়ে। বাবা তাকে দিয়ে আসতে যাবে? কোনোভাবে যদি পলাশ শিকদার একবার টের পেয়ে যায় পৃথা মিথ্যা বলেছে, সে কোনো বান্ধবীর বাড়িতে নয় বরং এক অপরিচিত পুরুষের ফ্ল্যাটে যাচ্ছে তখন কি হবে? পৃথার গলা শুকিয়ে এলো। মেয়েটা আটকাতে চাইলো নিজের বাবাকে। জোরপূর্বক হেসে বলল,

-“তোমার যেতে হবে না বাবা। এই তো সামনের বিল্ডিং এ যাব আমি। তুমি আবার শুধু শুধু কষ্ট করতে যাবে কেন?”

পলাশ শিকদার তাকালেন মেয়ের পানে। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

-“আমার সাথে এসো নয়তো যেতে হবে না তোমাকে।”

পৃথা পড়লো মহা বিপাকে। না গিয়েও তো উপায় নেই তাহলে তুর্য এখানে চলে আসবে। আর বাবাকেও যদি এখন বলে সে যাবে না তবে নিশ্চই তার বাবা সন্দেহ করবে। বান্ধবীর বাড়িতে বাবার দিয়ে আসা নিয়ে আসা তো আর অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেখানে বাবা যাবে শুনেই যাব না বলাটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। অগত্যা পৃথাকে তার বাবার প্রস্তাবে রাজী হতে হলো। মনের মধ্যে একরাশ ভয় নিয়ে চললো সে বাবার সাথে। নিজেদের বাসার পরে তিনটা বিল্ডিং রেখে চতুর্থ বিল্ডিং এর সম্মুখে এসে থামলো পৃথা। ঢোক গিলে পলাশ শিকদারকে বলল,

-“চলে এসেছি বাবা। এই বিল্ডিং এই আমার বান্ধবীদের বাসা।”

পলাশ শিকদার মেয়ের কথার সত্যতা পেলেন। এ বিল্ডিংটা তো তাদের বাসায় কাছেই, ধরতে গেলে সামনেই। তিনি আর ঘাটলেন না বিষয়টা নিয়ে। বিল্ডিং এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে মেয়েকে বললেন,

-“তুমি ভিতরে যাও তাহলে। আমি আসছি এখন।”

পৃথা এক প্রকার নিঃশ্বাস আটকে বাবাকে প্রশ্ন করলো,

-“তুমি ভিতরে যাবে না বাবা?”

-“না।”

পলাশ শিকদারের এক অক্ষরে উত্তর। পৃথা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক তার বাবা অনন্ত এখানে এসে একটা কাজের কাজ করলো। পলাশ শিকদার একবার বিল্ডিং এর ভিতরে গেলেই তো পৃথা ধরা পরে যেত বাজেভাবে। আর তারপর সোজা উপরে। পৃথা ঠোঁট টেনে একটু হাসলো। নম্রভাবে বলল,

-“আচ্ছা আমি ভিতরে যাচ্ছি।”

পৃথা বাক্যের সমাপ্তি ঘটিয়েই দ্রুত ঢুকে গেল বিল্ডিং এর ভিতরে। পলাশ শিকদারও আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে চলে এলেন নিজ বাড়িতে। বসার ক্ষে ঢুকতেই দেখা পেলেন পিয়াস এবং পিয়াল বসে রয়েছে সোফার উপরে। তাদের সাথে সুফিয়া বেগমও রয়েছেন। সকলের চোখ মুখে চিন্তার ছাপ। বাবাকে আসতে দেখেই পিয়াস উঠে দাঁড়ালো। চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,

-“হুট করে কল করে আসতে বললে কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”

পিয়াসের কথা শেষ হতে না হতেই পিয়াল বলল,

-“ঐ তুর্য চৌধুরী আবার কোনো সমস্যা করেছে নাকি বাবা?”

পলাশ শিকদার একবার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন স্ত্রী সন্তানদের পানে। অতঃপর থমথমে কন্ঠে বললেন,

-“আমি পৃথার আবার বিয়ে দেব।”

পলাশ শিকদারের কন্ঠে তোলা প্রতিটি ধ্বনি যেন বিস্ফোরণ ঘটালো উপস্থিত সকলের মধ্যে। পিয়াস গোল গোল চোখ তাকালো বাবার পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

-“কি?”

পলাশ শিকদার পরপর আবার একটা বিস্ফোরণ ঘটালেন বসার কক্ষে। সোফার উপরে বসতে বসতে বললেন,

-“আজ সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে পৃথাকে। সব ঠিকঠাক থাকলে কাল আকদ।”

চলবে…..