অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২০
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
অসহায় কন্ঠে বলল,
-“আমার কাছে আপাতত কিছুই নেই স্যার।”
তুর্যের মেজাজ বিগড়ালো আরও। দাঁতে দাঁত চেপে সে আরুশকে বলল,
-“তুই আছিস কেন? তুইও নাই হয়ে যা।”
আরুশ ঠোঁট উল্টালো। একটু সময় নিয়ে বলল,
–“আমি নাই হয়ে গেলে কিভাবে হবে স্যার? আমি নাই হলে আপনি কার মাথায় নুন রেখে বড়ই খাবেন? রোজ রোজ মা’রা’মা’রি করে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবেন?”
তুর্য ফুঁসে উঠলো। তেড়ে গেল আরুশের পানে। ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
-“আমি তোর মাথায় নুন রেখে বড়ই খাই? নিজের দোষ তোর ঘাড়ে চাপাই? দাঁড়া তুই আজ তোর ঘাড়সহ মাথাটাই রাখবো না বেয়াদব।”
আরুশ আঁতকে উঠলো। ভয়ে সিটিয়ে গেল মুহুর্তেই। তুর্যের ক্রোধ সম্পর্কে সে জানে বেশ ভালোভাবেই। এবার যদি ছেলেটা সত্যি সত্যি ক্রোধে ভুতের ন্যায় তার ঘাড় মটকে দেয় তখন কি হবে? এই অল্প বয়সে বিয়ের আগেই অক্কা পেতে হবে। আরুশের নিজের উপর নিজের রাগ লাগলো। কে বলেছিল তাকে এমন বেঁফাস মন্তব্য করতে? অবশ্য দোষটা তার নয়। তার চরিত্রে কোনো কালেই এই বেফাঁস মন্তব্য করার গুনটি ছিল না। এটা এসেছে তুর্যের সহচার্যে থাকতে থাকতে। তুর্যের বাতাস লেগেছে তার শরীরে। আরুশের ভাবনার মধ্যেই সে খেয়াল করলো তুর্য চোখ লাল করে তার নিকটে চলে এসেছে। আর একটু হলেই গলাটা টি’পে দিবে। আরুশ ভয়ে দৌড় দিল তুর্যের সম্মুখ থেকে। এক দৌড়ে গিয়ে থামলো ফ্ল্যাটের বাহিরে। তুর্য চেঁচিয়ে উঠলো। গলা বাড়িয়ে বলল,
-“এখন কোথায় পালাচ্ছিস মীর জাফরের বংশধর। দাঁড়া বেয়াদব।”
আরুশকে আর পায় কে? সে নিজের জান বাঁচাতে পালিয়েছে। তুর্য ছেলেটার পিছু পিছু দৌড় দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাথায় আবার চড়াও হলো পৃথার বিয়ের ব্যাপারটা। তার রা’জা’কা’র শ্বশুর যে এত বড় রা’জা’কা’রী’টা করবে বুঝতে পারলে এতটা সময় সে কখনওই নিতো না। তুর্য ভেবেছিল আগে পৃথার কাছাকাছি যাবে, একটু একটু করে মেয়েটার মনে তার জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি করবে তারপর না হয় সবকিছু খুলে বলবে। একবার পৃথার মনে নিজের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারলে নিশ্চই মেয়েটা নিজে থেকেই তার কাছে চলে আসতো। তখন কারো সাথে আর যুদ্ধ বিগ্রহে জড়াতে হতো না তুর্যকে। শ্বশুরের সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়ে তার চোখে অন্তত খারাপ হতে হতো না। সম্পর্কও ভালো থাকতো বউও পেয়ে যেতো। কিন্তু তার শ্বশুরটা সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল দারুনভাবে। এখন আর উপায় নেই যেভাবে হোক বউকে অতিদ্রুত নিজের কাছে নিয়ে আসতে হবে। যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে হলেও বউকে নিজের করে নিতে হবে। তুর্যের ভাবনার মধ্যেই ফ্ল্যাটের দরজা গলিয়ে শুধুমাত্র মাথাটা ঢুকিয়ে দিল আরুশ। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
-“স্যার আপনি কি আবার আমাকে তাড়া করবেন নাকি আমি ভিতরে আসবো?”
তুর্য তাকালো আরুশের পানে। আপাতত এই ছেলেটার উপরে যতটুকু ক্রোধ ছিল গিলে নিল। একে তো সে পরে দেখে নিবে। আগে বউয়ের বিয়ে আটকে নিক। তুর্য চড়া গলায় বলল,
-“ভিতরে আসতে হবে না তোকে। গার্ডসদের তৈরি থাকতে বল। আমি বেরুবো।”
আরুশ আর কথা বাড়ালো না। মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে চলে গেল সে।
২৪.
মাগরিবের আজান পড়েছে বেশ অনেক্ষণ। নামাজের পর পরই পৃথাদের ঘরে বেশ কিছু জনমানবের আগমন ঘটেছে। যদিও পৃথা এখনও এই জনমানবের কাউকেই চিনে না বা কেন এসেছে জানে না। তাকেও এ বিষয়ে বলেনি কেউ, সেও জিজ্ঞেস করেনি। যদিও ভিতরে ভিতরে মেয়েটা একটু কৌতুহল অনুভব করেছিল যে এ সময় কারা এসেছে, কেন এসেছে তা ভেবে কিন্তু জিজ্ঞেস করেনি কাউকে। পরে এরা গেলে না হয় জানা যাবে এদের পরিচয়।
ঘরে একটু বেশি মানুষের প্রাদুর্ভাব উপলব্ধি করে নিজ কক্ষেই বসে ছিল পৃথা। এর মধ্যেই সুফিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন সে কক্ষে। পৃথাকে তাড়া দিয়ে বললেন,
-“সেদিন শপিং এ গিয়ে একটা কালো শাড়ি এনেছিলি না। শাড়িটা সুন্দর ভীষণ, ঐ কালো শাড়িটা পড়ে নে আর সাথে একটু হালকা পাতলা সেজে নে তো তাড়াতাড়ি।”
পৃথা আকস্মিক মায়ের এমন তোড়জোড়ে অবাক হলো। কোথা থেকে এসে হুট করে বলছে শাড়ি পড়তে। মেয়েটা কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
-“এই রাত বিরতে আমি আবার শাড়ি পড়ে কি করবো মা? আর হুট করে তুমি আমাকে শাড়িই বা পড়তে বলছো কেন?”
সুফিয়া বেগম আমতা আমতা শুরু করলেন। মেয়েকে সে কিভাবে বলবেন যে তার বাবা হুট করেই তার বিয়ের তোরজোর চালাচ্ছেন। মেয়েকে না বলে কয়ে তালাক হীনা মেয়ে দেখানোর জন্য পাত্রপক্ষ বাড়িতে এনে তুলেছেন ইতমধ্যে। সুফিয়া বেগম চুপ রইলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
-“তোর বাবা তোর বিয়ে দিতে চাইছেন। বাইরে পাত্রপক্ষ এসেছে তোকে দেখতে। তাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।”
পৃথা এতক্ষনে বুঝলো হঠাৎ ঘরে অপরিচিত জনমানবের আগমনের কারন। সবটা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো মেয়েটার। তার বিয়ে! পাত্রপক্ষ বাড়িতে পর্যন্ত চলে এসেছে অথচ সে কিছুই জানলো না? জীবন তার, বিয়ে তার অথচ তারই মতামত নেওয়া হলো না। একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করা হলো না “তুই কি চাস? কেমন ছেলে পছন্দ তোর?” পৃথার পরিবার তার সাথে এত বড় বেইমানিটা করতে পারলো? তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি বিয়ে কিসের? এখন পর্যন্ত বিয়ের বয়স হয়েছে পৃথার? মাত্র তো সতেরো বছর হলো মেয়েটার। বান্ধবীদেরও বিয়ে হয়নি। পৃথা সমর্থন করতে পারলো না বাবা মায়ের এ সিদ্ধান্তকে। প্রতিবাদী কন্ঠে বলল,
-“কিসের পাত্রপক্ষ আর কিসের বিয়ে? আমি এখন কোনো বিয়ে টিয়ে করবো না।”
সুফিয়া বেগম ব্যস্ত হলেন। মেয়ের নিকটে গিয়ে বললেন,
-“এমন করে না মা। তোর বাবা তোর ভালোর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
পৃথা গলা বাড়ালো। স্থান কাল পাত্র ভুলে বলল,
-“ভালো কিসের ভালো? একটা মেয়েকে না জানিয়ে হুট করে পাত্রপক্ষকে বাড়িতে এনে বলছো শাড়ি পড়ে নে, এটা কোনো ভালো কার্য?”
থামলো পৃথা। ধরা গলায় বলল,
-“আমার মতামতের কি কোনো দাম নেই মা? তোমরা আমাকে একটা বার জিজ্ঞেস না করে কিভাবে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলে? আমার বিয়ে অথচ আমিই জানি না!”
পৃথার চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যেই কক্ষে এলেন পলাশ শিকদার। মা মেয়ের পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
-“চিৎকার চেঁচামেচি জুড়েছো কেন? বসার কক্ষে মানুষ রয়েছেন। তাদের সম্মুখে আমার মান সম্মান নষ্ট না করলে হচ্ছে না তোমাদের?”
বাবাকে দেখে গলার আওয়াজ একটু নিভে এলো পৃথার। বাবাকে সে ভয় পায় ভীষন। কিন্তু তাই বলে আজ ভয় পেয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। তার বাবা তো এমন ছিলেন না। কখনও তার উপরে জোর জবরদস্তি করে কোনো সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেয়নি। হ্যা শাসন করেছে কিন্তু তাই বলে তার মতামতকে অবহেলা করেনি। তাহলে আজ কেন এমন করছে? পৃথা কিছুটা নরম কন্ঠেই বাবাকে বলল,
-“আমার তো এখনও পড়াশোনা শেষ হয়নি বাবা, বিয়ের বয়সটাও হয়নি। এর মধ্যে বিয়ে কিসের? আমি কোনো বিয়ে করবো না বাবা।”
পলাশ শিকদার শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের পানে। থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“ভরসা রাখো আমার উপর। তোমার খারাপ হবে তেমন কোনো সিদ্ধান্ত আমি কখনওই নেব না। আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি।”
থামলেন পলাশ শিকদার আবার বললেন,
-“ধরে নাও বহুদিন আগে তোমার বাবা বড় কোনো ভুল করেছিলেন সেই ভুল সংশোধনেই আজ নেমেছেন তিনি। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো। বসার কক্ষে ওরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
কথাগুলো কোনো মতে শেষ করে ব্যস্ত পায়ে মেয়ের কক্ষ ত্যাগ করলেন পলাশ শিকদার। ডুকরে কেঁদে উঠলো পৃথা। কান্না বিজড়িত কন্ঠে মাকে বলল,
-“আমি কোনো বিয়ে করবো না মা। তুমি বাবাকে বুঝাও একটু। তুমি বুঝালে বাবা নিশ্চই বুঝবেন।”
সুফিয়া বেগম মেয়েকে আগলে নিলেন নিজের সাথে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“কাঁদছিস কেন পাগলি মেয়ে? দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায় নাকি? আগে পাত্রপক্ষ তোকে দেখবে পছন্দ হবে তারপর তো বিয়ে।”
পৃথার কান্না তবুও থামালো না। সুফিয়া বেগম নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন মেয়েকে। খুঁজে খুঁজে কালো শাড়িটা বের করে দাঁড়ালেন পৃথার সম্মুখে। তাড়া দিয়ে বললেন,
-“এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে তো। উনারা যেহেতু বাড়ি পর্যন্ত এসেছেন মেয়েকে তো দেখাতেই হবে। আমাদের মান সম্মানটা অন্তত রাখ মা। তারপর না হয় আমি তোর বাবাকে বুঝাবো।”
পৃথা কান্না থামালো একটু। মায়ের পানে তাকিয়ে শুধালো,
-“তুমি সত্যিই বাবাকে বুঝাবে তো?”
সুলতানা বেগম অভয় দিয়ে বললেন,
-“হ্যা বুঝাবো।”
মায়ের কথায় একটু ভরসা পেল পৃথা। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কালো শাড়িটা পড়ে তৈরি হয়ে নিল সে। তবে সাজলো না একটুও। সুফিয়া বেগমও আর মেয়েকে জোর করেননি। শাড়িটা পড়াতে পেরেছেন এই তো অনেক।
ক্ষানিক সময় নিয়ে সুফিয়া বেগম পৃথাকে নিয়ে ঢুকলেন বসার কক্ষে। মায়ের শিখানো বুলি আওড়িয়ে পৃথা নত মস্তকে সকলকে সালাম জানালো। অস্বস্তি নিয়ে মায়ের কথায় বসলো সোফায়। তবে হৃদয়টা যে বড্ড উতলা হয়ে উঠেছে। বারবার তুর্যের কথা মনে পড়ছে। বিয়ের কথাটা জানার পর থেকেই মস্তিষ্কে একটু পর পর তুর্য নামক ব্যক্তিটি হানা দিচ্ছে। তার তো তুর্যের কথা মনে আসার কথা নয়। এই তো কয়টা দিন আগে তাদের দেখা হলো। তারপর শত্রুতা। হ্যা এখন ছেলেটা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাই বলে তার প্রতি তো পৃথার কোনো অনুভূতি নেই তাহলে তাকে কেন মনে পড়বে? পৃথা উসখুস করে আড় চোখে তাকালো সম্মুখে বসা অপরিচত মানুষগুলোর পানে।আশ্চর্য হলো বেশ। এখানে তিনজন পৌঢ় নারী এবং দুজন প্রবীন পুরুষ ব্যতীত আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তাহলে পাত্র কোথায়? তার বাবা আবার কোনো বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করেনি তো? করতেও পারে। যারা এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে তার কথা না ভেবে বিয়ে ঠিক করতে পারে তারা সব পারে।
সময় অতিবাহিত হলো আরও একটু। সম্মুখে উপস্থিত পৌঢ় নারীদের মধ্যে একজন এক গাল হেসে পৃথাকে শুধালো,
-“তোমার নাম কি মা?”
পৃথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না। এখানে বসে থাকতেই তো তার মেজাজ গরম হচ্ছে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে মেয়েটা উত্তর দিল,
-“পৃথা ইসলাম।”
পাশের আরেক মহিলা হাসলেন। বললেন,
-“বাহ ভারী মিষ্টি নাম তো একদম তোমার মতোই মিষ্টি।”
মহিলা কথা শেষ করতে না করতেই দরজার দিক থেকে এক গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো। গমগমে কন্ঠে সে বলল,
-“তুর্য চৌধুরীর বউ বলে কথা। মিষ্টি তো ওকে হতেই হতো।”
পরপর একই কন্ঠ শোনা গেল আবারও। বেশ গম্ভীর কন্ঠে এবার পুরুষটি আওড়ালো,
-“শুনলাম আমার বউকে নাকি কারা বিয়ে দিচ্ছে। তাই আমিও চলে এলাম। দেখি কার বুকে কত বড় পাটা আমার বউয়ের বিয়ে দিবে।”
চলবে…..
গল্প:অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পরপর একই কন্ঠ শোনা গেল আবারও। বেশ গম্ভীর কন্ঠে এবার পুরুষটি আওড়ালো,
-“শুনলাম আমার বউকে নাকি কারা বিয়ে দিচ্ছে। তাই আমিও চলে এলাম। দেখি কার বুকে কত বড় পাটা আমার বউয়ের বিয়ে দিবে।”
উপস্থিত সবাই চমকালো। বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে এক যোগে তাকালো সদর দরাজার পানে, দেখা মিললো তুর্যের। শরীরে জড়ানো কালো শার্টের হাতাটা গোটাতে গোটাতে এলো ভিতরে। ছেলেটা আশেপাশে একবার তাকিয়ে তাকালো পৃথার পানে সাথে সাথেই থমকে গেল। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো মুহুর্তেই। কালো শাড়িতে কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। মুখে কোনো সাজ নেই, গায়ের রংটা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা অর্থাৎ তুর্যের গায়ের রঙের তুলনায় বেশ চাপা তবুও মেয়েটাকে যেন পরীর ন্যায় মনে হচ্ছে তুর্যের নিকট। ছেলেটার দৃষ্টি মুগ্ধ হলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে বউকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। অমনি একটু আগে ঠান্ডা হওয়া মেজাজটা চটে গেল আবারও। এদের কি সাহস তার দেওয়া শাড়ি পড়িয়ে তার বউকেই অন্য পাত্রপক্ষের সম্মুখে বসিয়েছে। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে একটু তুর্য একটু শান্ত করলো নিজেকে। অতঃপর গিয়ে দাঁড়ালো সোফায় বসা পাত্রপক্ষের পাশে। একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সকলের পানে তাকিয়ে পাত্রপক্ষের সাথে আসা দুই প্রবীন পুরুষকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
-“আঙ্কেল একটু চেপে বসুন। আমার ছোট খাটো দেহটা নিয়ে আপনাদের মধ্যে একটু বসার স্থান দিন।”
প্রবীন পুরুষ দুইজন ভরকে গেলেন তুর্যের কথায়। এ ছেলে আবার কে? আর হঠাৎ এসেই কেন এমন সব কথায় নেমে পড়েছে? জোর পূর্বক হাসলেন একজন প্রবীন। একটু সরে বসে বললেন,
-“বসো বাবা।”
এ পর্যায়ে আর চুপ থাকতে পারলেন না পলাশ শিকদার। কন্ঠে ক্রোধ এটে বললেন,
-“এসব কেমন ধরনের অসভ্যতামো? আর তুমিই বা এখানে কেন এসেছো?”
তুর্য পাত্তা দিল না পলাশ শিকদারের কথায়। সে বসে পড়লো সোফার ফাঁকা স্থানে। শার্টের গলার কাছের দুটো বাটোন খুলে গা এলিয়ে দিল সোফার সাথে। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“কি গরম? মনে হচ্ছে এখনই ডিমের মতো সিদ্ধ হয়ে যাব।”
থামলো তুর্য। পলাশ শিকদারের পানে তাকিয়ে বলল,
-“এত বছর রা’জা’কা’রী করে জীবনে কি করেছেন শ্বশুর মশাই? পথে ঘাটে দুই চারটা এসি লাগিয়ে রাখতে পারলেন না? আপনি জানতেন না এই পথে আপনার মেয়ের জামাই আসবে, তার গরম লাগতে পারে?”
পলাশ শিকদার দাঁতে দাঁত চাপলেন। কটমট করে বললেন,
-“চুপ থাকো বেয়াদব ছেলে। আর তুমি এখানে কেন এসেছো? আমার বাড়িতে পা রাখার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে?”
তুর্য অবাক হওয়ার ভান ধরলো। বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
-“সে কি শ্বশুর মশাই এসব কি ধরনের কথাবার্তা বলছেন? আমার বউয়ের বিয়ে আর আমি আসবো না সে কখনও হয় নাকি?”
কথাটা বলেই চোখ মুখে বিষন্ন ভাব ফুটিয়ে তুললো তুর্য। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“তবে আমার বউয়ের বিয়েতে আমাকে দাওয়াত না করায় আমি কিন্তু ভীষন কষ্ট পেয়েছি শ্বশুর মশাই। এই কাজটা কিন্তু আপনি একদম ঠিক করেননি।”
পিয়াস এবং পিয়াল উপস্থিত ছিল ঐ স্থানেই। তুর্যের হঠাৎ আগমন এবং এমন অদ্ভুত বাক্যে ক্ষেপে গেল দুই ভাই ই। পিয়াস শক্ত কন্ঠে বলল,
-“এসব কেমন ধরনের বেয়াদবি। এটা ভদ্র বাড়ি, ভদ্রভাবে কথা বল।”
তুর্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পিয়াসের পানে। হেঁয়ালিপূর্ণ কন্ঠে বলল,
-“এটা ভদ্র বাড়ি? ওহ আমার জানা ছিল না।”
থামলো ছেলেটা। চোখ মুখ শক্ত করে আবার বলল,
-“তা ভদ্র বাড়ির মেয়েদের বুঝি তালাক হীনা অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়? স্বামী জীবিত থাকতেও অন্য পাত্রপক্ষের সম্মুখে বসানো হয় রূপ দেখানোর জন্য?”
তুর্যের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই তার কথার উত্তর দিলেন পলাশ শিকদার। তাচ্ছিল্য করে বললেন,
-“স্বামী জীবিত অথচ স্ত্রীর কোনো খোঁজ খবর রাখেনি টানা সাত বছর। স্ত্রী বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে একটাবার জানার প্রয়োজনবোধ করেনি। তাকে কি আদৌ স্বামীর কাতারে ফেলা যায়?”
তুর্যের কন্ঠ নরম হয়ে এলো। অপরাধীর কন্ঠে বলল,
-“আমি জানি আমি ভুল করেছি তার জন্য আমি আপনাদের এবং পৃথার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। তবে এখন সেই ভুলটা শুধরে নিতে চাইছি, স্ত্রীকে আপন করে নিতে চাইছি। দয়া করে আপনারা আমার ভুল শুধরানোর জন্য একটা সুযোগ অন্তত দিন।”
পৃথা এতক্ষন চুপচাপ শুনছিলো সবটা। বোঝার চেষ্টা করছিলো কিন্তু এদের একেক জনের এক এক স্থান থেকে এক এক ধরনের কথায় বোধগম্য হচ্ছিলো না কিছুই। তার মধ্যে আবার তুর্য কি বলল, সে পৃথার নিকট ক্ষমা প্রার্থী আবার স্ত্রীকে আপন করে নিতে চাইছে। এ পর্যায়ে মেয়েটা আর নিজের ধৈর্য্য রাখতে পারলো না। উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,
-“এখানে কি হচ্ছে কেউ একটু বলবে আমাকে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
পৃথার কথা শুনে তার পানে তাকালো সবাই। হঠাৎ তুর্যের আগমনে তো তারা সবাই পৃথার কথা ভুলেই বসেছিল। মেয়েটা নিশ্চই সবটা শুনে নিয়েছে। আর লুকানো গেল না কিছু, হয়তো লুকানো টাও ঠিক হবে না। পলাশ শিকদার হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়। শান্ত কন্ঠে বললেন,
-“তোর জীবনের অনেক কথাই এখনও তোর অজানা। আমরা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম জানতে দেইনি তোকে। ভেবেছিলাম সবটা জানলে তুই হয়তো ভেঙে পড়বি, মেনে নিতে পারবি না। আর তাছাড়া তখন তুর্যের ফিরে আসারও সম্ভাবনা ছিল না তাই জানাইনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তোকে সবটা জানানো উচিৎ। তোর জীবন সুতরাং তোর জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছু জানার অধিকার তোর আছে।”
থামলেন পলাশ শিকদার। মেয়ের মাথায় হাত রেখেই বলতে শুরু করলেন,
-“ছোট বেলা থেকেই তুর্যের মা এবং তোর মা ভীষন ভালো বান্ধবী ছিলেন। আবার আবার তাদের বিয়েও হয়েছিল প্রায় পাশাপাশি স্থানে। তুর্যদের বাড়ি এবং আমাদের বাড়ি কাছাকাছিই ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষদের ভীটে রাজশাহীতে হলেও আমরা বাসিন্দা ছিলাম রাজধানী ঢাকার। তুর্যের বাবা মায়ের বিয়েতেই তোর মাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। তারপরে তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই আর তারপরে বিয়ে।
এইটুকু বলে আবার থামলেন পলাশ শিকদার। একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করলেন,
-“পাশাপাশি বিয়ে হওয়ার দরুন তোর মা এবং তুর্যের মায়ের বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। তারা দু’জনই চেয়েছিল তাদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে এই সম্পর্কটা আরও মজবুত করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তুর্যের মা তাহমিনা এবং তোর মা দুজনেরই প্রথম সন্তান ছেলে হয়। এরপরে আবারও তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে শুরু করেন দ্বিতীয় সন্তানের। কিন্তু এবারও দু’জনেই পুত্র সন্তানের জননী হন। তৃতীয় বারের বেলায় তাহমিনা আবারও পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেও আমাদের কোল আলো করে তুই এসেছিলি। তাহমিনা তখনই বলে রেখেছিলেন তোকে তার বড় ছেলে তুর্যের বউ করে নিবে। আমি তখন তোর আর তুর্যের বয়সের পার্থক্যের কথা ভেবে বিষয়টা মানিনি। তারপর আর এ নিয়ে কথাও ওঠেনি। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো যখন তোর বয়স ১০ হলে। তখন তুর্য ২০ বছরের এক তরতাজা, খামখেয়ালি যুবক। তার ঠিক যা ইচ্ছে হয় সে তাই করে বেড়ায়। এখানে সেখানে মা’রা’মা’রি, নেতাগীরি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সভা সমাবেশ সব স্থানে তুর্যের নাম। অল্প বয়সে এলাকার ছোট খাটো এক নেতাও হয়ে উঠেছিল সে। তাহমিনার ভয় বাড়ে, ছেলের এমন বখে যাওয়াকে মেনে নিতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে দিবেন ছেলের। ছেলেকে ঘরমুখো করতে এ ছাড়া নাকি আর উপায় নেই। আমার কাছে তোর হাত চেয়ে বসে তখন। আমিও তুর্যে বখে যাওয়া স্বভাব এবং তোদের বয়সের পার্থক্য ভেবে তার প্রস্তাবে সরাসরি না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহমিনার অনুরোধ এবং তোর মায়ের কান্নাকাটিতে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারিনি। তোর মাত্র ১০ বছর বয়সে এক প্রকার গোপনেই তোর বিয়ে দিয়েছিলাম তুর্যের সাথে। কিন্তু সেই কর্মটাই ছিল আমার জীবনের চড়ম ভুল। তুর্য তোকে মেনে নেয়নি। বিয়ের আসরেই তোর মুখ না দেখেই তোকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। তারপর আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম তুর্যের সাথে যোগাযোগ করার, সবটা ঠিক করার কিন্তু সে করেনি। ধীরে ধীরে বিষয়টা লোক জানাজানি হতে শুরু করলো। ফলস্বরূপ সমাজে তোর গায়েও একটু একটু করে কলঙ্ক লাগতে শুরু করেছিল। ছোট বলে তারা তোকে ছাড়া দেয়নি মা। অনেকেই কথা তুলছিলো টাকার লোভে তুর্যের সাথে তোর বিয়ে দিয়েছি অথচ তুর্যদের থেকে অর্থবিত্তে কোনো অংশেই কম ছিলাম না আমরা। শুরু হলো সমাজে তোকে হেয় প্রতিপন্ন করা। যে অল্প সংখ্যক আশেপাশের মানুষ তুর্য আর তোর বিয়েটা সম্পর্কে জানলো তারা দিন দিন হেয় করতে শুরু করলো তোকে যা বাবা হিসেবে আমি মানতে পারছিলাম না। আর আমি এও চাইনি আমার ভুলের কারনে তোর শৈশব নষ্ট হোক, তুই সবটা জেনে ভেঙে পড়িস। তাই পুরোপুরিভাবে লোক জানাজানি হওয়ার আগেই তোদের নিয়ে এলাকা ছেড়েছি আমি। ঘাঁটি গেড়েছি রাজশাহীতে।”
পৃথা সবটা শুনলো মনোযোগ দিয়ে, আঁখিদ্বয় ভরে উঠলো মেয়েটার। এখন তার কাছে সবটা পরিষ্কার। তুর্য কেন তার ঠিকানা খুঁজেছিল, কেন এতদিন তার সম্মুখে প্রেমময় বাক্য আওড়াতো সবটা পরিষ্কার। কিন্তু এই পুরুষ তো তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো, ত্যাগ করেছিল। পৃথার যে নিজের ১০ বছর বয়সে বিয়ের কথা মনে ছিল না তা নয়, ঠিক মনে ছিল। কিন্তু যখনই বাবা মায়ের কাছে এ বিষয় কিছু জিজ্ঞেস করেছে তারা বলেছে ওটা পুতুল বিয়ে ছিল, পুতুল তো কথা বলতে পারে না তাই পুতুলের হয়ে তাকে কবুল বলানো হয়েছিলো। পৃথাও আর সে বিষয়ে ততটা মাথা ঘামায়নি। তার মাথাতে একবারের জন্যও এ চিন্তা আসেনি তার মা বাবা তাকে মাত্র ১০ বছর বয়সেই বিয়ের পীড়িতে তুলে দিয়েছে। পৃথার অজান্তেই তার জীবনে এত কিছু ঘটে গেল। বিয়ে হলো, স্বামী ত্যাগী হলো অথচ সে জানতেই পারলো না। সবাই এরা সবাই মিলে তাকে ঠকিয়েছে। বাবা মা নিজেদের সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য ১০ বছরের এক মেয়েকে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর যার সাথে বিয়ে দিয়েছিল সেই পুরষটাও শুধুমাত্র নিজের কথা ভেবে তাকে ত্যাগ করে ঠেলে দিয়েছিল অন্ধকারে। কেউ তার কথা ভাবেনি একটা বারের জন্যও। যে যার নিজের স্বার্থে শুধুমাত্র ব্যবহার করেছে পৃথাকে। মেয়েটার ভাবনার মধ্যেই শোনা গেল তুর্যের কন্ঠস্বর। অপরাধীর কন্ঠে সে বলল,
-“আমি আমার কর্মের জন্য অনুতপ্ত। আমি পৃথাকে ছেড়ে গিয়ে বুঝেছি আমি কতটা ভুল করেছি। ধীরে ধীরে ভীষন বাজেভাবে আটকে গেছি ওর মায়ায়। আমি ভালোবেসে ফেলেছি পৃথাকে। তাই তো আবারও ছুটে এসেছি ওকে ফিরিয়ে নিতে।”
পৃথা পিছন ঘুরে তাকালো তুর্যের পানে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-“আপনি আমাকে ছেড়ে গিয়ে বুঝলেন আমাকে ভালোবাসে ফেলেছেন। আমার বাবা মা বুঝলো তারা ভুল করেছেন। আফসোস শুধুমাত্র আমিই বুঝলাম না আমার অগোচরে আমার কাছের মানুষগুলোর নিকট তাদের সম্পর্ক রক্ষায়, স্বার্থ রক্ষায় আমি ভীষন বাজেভাবে ঠকে গেছি।”
চলবে…..