অবাধ্য পিছুটান পর্ব-৪৪+৪৫

0
469

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৪৪

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

[ প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

৪৭.
রাত বেড়েছে। চারিদিকটা আঁধারের চাদরে মুড়ে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। হয়তো ইতমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। তবে আজ রাতটাতেও ঘুম নেই তুর্য এবং পৃথা নামক দুই নর নারীর আঁখিদ্বয়ে। পৃথা আজ শাড়ি পড়েছে। নিজেকে খুব সুন্দরভাবে পরিপাটি করে সাজিয়েছে। যদিও আজকের রাতটা নিয়ে পরিকল্পনা ছিল অনেক তবে তার কিছুই তুর্যের জন্য পূর্ণতা দিতে পারেনি। পৃথা খুব করে ভেবে রেখেছিল। ঐ নাটক, সিনেমা কিংবা গল্পের ন্যায় আজ পুরো কক্ষটা সে মোমের আলোয় সাজাবে। সাথে নিজেও শাড়ি পড়ে সুন্দরভাবে সেজেগুজে তুর্যের নিকট ধরা দিবে। তুর্যকে চমকে দিয়ে সে লাজুক ভঙ্গিতে বলবে,

-“ভালোবাসি প্রিয়।”

কিন্তু তার কিছুই হলো না আজ। কি হতো গতকালকের মাত্র একটা রজনী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলে! কত রজনীই তো নিয়ন্ত্রণে কাটালো। তা না, নিজেও নিয়ন্ত্রণ হারালো আর তাকেও উস্কে দিল। সকাল সকাল উঠে আবার পরিবারে লাগিয়ে দিল আরুশ আর ইরার বিয়ের কথাটা। সব মিলিয়ে একটা হযবরল অবস্থা। এর
মধ্যে আবার নিজ কক্ষে বিবাহ বার্ষিকীর আয়োজন করবে কখন? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল পৃথা। তার সকল পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেওয়ার জন্য যদিও লোকটার উপরে রাগ লাগছে ভীষন তবুও আজ নিশ্চুপ রয়েছে। আজ এমন একটা দিনে আর কোনো রাগ, অভিমান, খারাপ লাগা নিয়ে থাকতে চায় না পৃথা। পিছনের সকল খারাপকে ভুলে সে নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে চায় তুর্যের সাথে।

পৃথা নিজেকে পরিপাটিভাবে সাজিয়ে আয়নায় দেখে নিল আরেকটি বার। অতঃপর দরজার নিকটে গিয়ে খুলে দিল দরজাটা। মৃদু কন্ঠে বলল,

-“ভিতরে আসুন।”

তুর্য কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাটছিলো। মূলত পৃথাই তাকে বের করে দিয়েছিল। শক্ত কন্ঠে বলে দিয়েছিল,

-“আমার সব প্ল্যানিং এ তো জল ঢেলেছেন এখন অন্তত কিছুটা সময় বাইরে থেকে আমাকে উদ্ধার করুন।”

তুর্যও আর কথা বাড়ায়নি। এমনিই কম অন্যায় সে করেনি। সবচেয়ে বড় অন্যায় বিবাহ বার্ষিকীর তারিখ ভুলে যাওয়া। এটা নিয়ে যে পৃথা এখনও কোনো ঝামেলা করেনি এই তো অনেক। তারপর যদি আবার বউয়ের কথাও না শোনে তবে আজ আর রক্ষা থাকবে না। পৃথার কন্ঠস্বর কর্ণে পৌঁছাতেই চোখ তুলে তাকালো তুর্য। অমনি থমকে গেল বেচারা। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বেড়ে গেল আগের থেকে দ্বিগুণ হারে। সম্মুখে দাঁড়ানো এ কাকে দেখছে তুর্য? এই মুহূর্তে পৃথাকে তার নিকট কোনো পরীর তুলনায় কম লাগছে না। তুর্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা শরীরে মেয়েটা এক খানা লাল রঙের শাড়ি জড়িয়েছে আজ। এই শাড়িটা তারই কেনা। প্রথমদিন মেয়েটা এ বাড়িতে আসার পর যে জামা কাপড় পরিপূর্ণ লাগেজটা পৃথাকে সে দিয়েছিল এটা তার মধ্যেই ছিল। আঁখিদ্বয়ে মোটা করে কাজল লেপেছে পৃথা, ওষ্ঠদ্বয়ে আবার হালকা গোলাপি লিপস্টিক লাগিয়েছে। মেয়েটার ঐ উষ্ণ ওষ্ঠজোড়া তুর্যের নিকট যেন আরও উষ্ণ হয়ে উঠেছে এই সময়ে। ইচ্ছে করছে এখনই ঐ ওষ্ঠের উপরে হামলে পড়ে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিতে। তুর্য মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে গেল কক্ষে ভিতরে পৃথার পানে। দরজাটা লাগিয়েই দুই হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটাকে একটু জড়িয়ে ধরতে। পৃথা সরে গেল সাথে সাথে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-“এখন না।”

তুর্য আশাহত হলো। অসহায় কন্ঠে বলল,

-“তাহলে কখন?”

পৃথা উত্তর দিল না কোনো। তুর্যের পানে এক পলক তাকিয়ে এগিয়ে গেলো কক্ষে স্থান পাওয়া টেবিলের পানে। একটা বাক্স থেকে ছোট একটা কেক বের করে রাখলো টেবিলে। অতঃপর একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকালো আবার তুর্যের পানে। মৃদু হেসে বলল,

-“শুভ বিবাহ বার্ষিকী প্রিয় স্বামী। আমরা একে অপরের না হয়েই আটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি।”

পৃথার কথা শেষ হতে না হতেই তুর্য ফট করে বলল,

-“আট বছরের থেকে একটা রাত কম হবে। কারন আমরা গত রাতে এক হয়ে গেছি।”

পৃথার মেজাজ বিগড়ালো। কথাটা বলার সময়ে কি সুন্দর একটা অনুভূতি ছিল পৃথার ভিতরে অথচ এই পুরুষ মাত্র একটা বাক্যবান দিয়েই সে অনুভূতি ধূলিসাৎ করে ছাড়লো। এর কি সর্বদা মুখটা চালাতেই হবে? পাঁচটা মিনিটের জন্যও এর মুখ বন্ধ রাখা যায় না? পৃথা দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল,

-“ওটা আট বছরই হবে। কাল রাত ১২ টার পরে আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন।”

তুর্য ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো। দুষ্টুমির স্বরে বলল,

-“বাহ ভালোই হিসেব রেখেছো দেখছি। তা আর কি কি হিসেবে রেখেছো?”

পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“অনেক কিছুরই হিসেব রেখেছি। আগে কেকটা কাটি তারপর বলছি। এদিকে আসুন।”

তুর্য এগিয়ে গেল টেবিলের নিকট। তবে সে পৃথার পাশে না দাঁড়িয়ে দাঁড়ালো পিছনে। আলতোভাবে মেয়েটার পিছন থেকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। পৃথার এক হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে টেবিলের উপরে রাখা প্লাস্টিকের ছুড়িটা তুলে নিয়ে নিল হাতে। কেকের উপরে আস্তে ধীরে সে ছুড়িটা চালাতে চালাতে মেয়েটার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

-“ভালোবাসি বউ।”

পৃথার ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। কেক কাটার ছুড়িটা ছেড়ে দিয়ে এক টুকরো কেক হাত তুলে নিল সে। তুর্যের মুখের সম্মুখে ধরে বলল,

-“ভালোবাসি প্রিয়।”

তুর্য পরম তৃপ্তি নিয়ে কেকের টুকরোটা মুখে পুরে নিল। নিজেও এক টুকরো কেক তুলে ধরলো পৃথার মুখের সম্মুখে। পৃথা হা করলো কেক খাওয়ার জন্য। কিন্তু তুর্য কেকের টুকরোটা পৃথার মুখে না দিয়ে লাগিয়ে দিল গালে। হকচকিয়ে উঠলো পৃথা। ফুঁসে উঠে তাকালো তুর্যের পানে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-“এটা কি করলেন আপনি?”

তুর্য ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। একটু ঝুঁকে পৃথার গালের সাথে নিজের গাল লাগিয়ে দিল। কেকের তৈলাক্ত ক্রীমের অবস্থান নিজের গালে নিয়ে নে’শা’লো কন্ঠে বলল,

-“ভালোবেসেছি।”

পৃথা শিউরে উঠলো। কেঁপে উঠলো তার বক্ষস্থল। হাত বাড়িয়ে মেয়েটা খামচে ধরলো ধরলো স্বামীর বাহু। তুর্য টুপ করে এক খানা চু’মু খেল পৃথার গালে। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

-“তোমার জন্য একটা জিনিস আছে।”

পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

-“কি?”

তুর্য উত্তর দিল না পৃথার কথার। পা বাড়িয়ে সে এগিয়ে গেল আলমারির নিকট। আলমারির উপর থেকে একটা গোলাপী রঙা লাগেজ নামিয়ে রাখলো পৃথার সম্মুখে। শান্ত কন্ঠে বলল,

-“এটা তোমার। আমি যখন দেশে ফিরেছিলাম তখন এনেছিলাম।”

পৃথা কৌতুহল অনুভব করলো। উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“কি আছে এতে?”

-“তুমি খুলে দেখো।”

পৃথা দেরী করলো না, বেশ উৎসুক হয়ে খুললো লাগেজটা। সাথে সাথেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো অসংখ্য চকলেট, ছোট ছোট পুতুল, চুলের ব্যান্ড, হাতের ব্রেসলেট, কানের দুলসহ আরও অসংখ্য মেয়েলী সামগ্রী। পৃথার চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

-“এসব আমার?”

তুর্য মুখ বাঁকালো। ঠোঁট কামড়ে বলল,

-“নাহ, আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউয়ের।”

পৃথা ভেংচি কাটলো। চটপট করে চকলেট গুলো খুলে খেতেও শুরু করে দিল। অনেক দিন আগে চকলেটগুলো আনলেও যেহেতু খোলা হয়নি তাই ভালোই ছিল সেগুলো। স্ত্রীর বাচ্চাদের ন্যায় এমন কর্মকাণ্ড দেখে হাসলো তুর্য। একটু এগিয়ে গিয়ে বসলো পৃথার পাশে। ওষ্ঠে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল,

-“একা একাই খাবে? আমাকে একটু দিবে না?”

পৃথা চট করে একটা চকলেট এগিয়ে দিল তুর্যের পানে। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,

-“নিন।”

-“আমার এই চকলেটে হবে না। অন্য চকলেট লাগবে।”

তুর্যের ঘোর লাগা কন্ঠস্বর। পৃথা থমকালো, দুই সেকেন্ড লাগলো তার কথাটা মস্তিষ্কে ধারন করতে। তুর্যের কথার মানে বুঝতে পেরেই লাজে রাঙা হলো মেয়েটা। সরে যেতে চাইলো তুর্যের পাশ থেকে। কিন্তু তুর্য তাকে যেতে দিল না। কোমড় চেপে মিশিয়ে নিল নিজের সাথে। হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে ধরলো স্ত্রীর থুতনি। বল প্রয়োগে মুখটা একটু তুলে বলল,

-“তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে বউ।”

পৃথা লজ্জা পেল আরও, নিজের চোখ জোড়া নামিয়ে নিল সাথে সাথে। তুর্য একটু একটু করে এগিয়ে গেল মেয়েটার ওষ্ঠের পানে। খুব যতণে ওষ্ঠজোড়া আঁকড়ে নিল নিজ ওষ্ঠের ভাঁজে। পৃথা নিজের আঁখিদ্বয় বন্ধ করে নিল পরম আবেশে। আগে পিছে আর না ভেবে মত্ত হলো স্বামীর ভালোবাসায়।

৪৮.
সময় প্রবাহমান। এরই মধ্যে কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। আজ আরুশ এবং ইরার আকদের তারিখ। সেদিন পরিবারে আরুশ এবং ইরার বিয়ের কথাটা তুলে দেওয়ার পরে পরিবারের সকলে বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে বেশ। আরুশ ছেলে ভালো। এমন ছেলেকে মেয়ে দিবে না খুব কম লোকই আছে। ইরার কাছেও বিয়ের ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে সে হ্যা বলে দিয়েছে এক বাক্যে। যেখানে মেয়ে নিজেই রাজী সেখানে আর ঝামেলা করে লাভ কি? তবুও বাড়ির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখন বিয়ের কথা পাকাপাকি করে রাখবে পরে ইরার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে বিয়ে দিবে কিন্তু বাঁধ সাধলো তুর্য। সে বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে আরুশ আর ইরার বিয়ের জন্য। তার মাতামাতি দেখে মনে হয় এ যেন আরুশের বিয়ে নয় তার নিজেরই বিয়ে। তুর্যের এক কথা তুলে নেওয়া পরে হোক কিন্তু আকদটা এখনই হয়ে যাক। বাড়ির লোকও শেষ পর্যন্ত তার জোরাজুরিতে মেনে নিয়েছে বিষয়টা। সেই অনুপাতেই আজ আরুশ এবং ইরার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে।

****

সন্ধ্যার সময়টা অতিবাহিত হয়ে কেবলই রাতের পানে পা বাড়িয়েছে। আরুশ বেশ পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে নিজের বাড়ির লোকদের নিয়ে চলে এসেছে তুর্যদের বাড়িতে। আজ তার বিয়ে তাও প্রিয় নারীর সাথে। তাদের প্রেম হলো না, পাশাপাশি বসে দুই চারটা কথা হলো না অথচ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের করে নিতে পারছে প্রেয়সিকে। ভাবতেই প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে আরুশের হৃদয়। এই প্রথম ছেলেটার মনে হচ্ছে তুর্য ভীষণ ভালো, তার থেকে উত্তম পুরুষ আর এই পৃথিবীতে নেই। আরুশদের আসার পর পরই তাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বসার কক্ষে। কাজী সাহেবও চলে এসেছে ইতমধ্যে। এখন শুধু আসার বাকি ইরার। তাও পৃথা নিয়ে আসছে।

ক্ষানিক বাদেই ইরাকে নিয়ে পৃথা প্রবেশ করলো বসার কক্ষে। ইরার ফর্সা শরীরে আজ গোলাপী রঙা শাড়ি রঙের এক খানা শাড়ি জড়ানো হয়েছে, মাথায় ঘোমটা। মুখে সাজগোজের প্রলেপ নেই মোটেই। আরুশ যেন থমকে গেল ওখানেই। হৃদ স্পন্দনের গতি বেড়ে গেল তার। আজ এ কোন ইরাকে সে দেখছে! শাড়িতে কোনো নারীকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে জানা ছিল বেচারার। আরুশের চিন্তা ভাবনার মধ্যেই পৃথা ইরাকে বসালো আরুশের পাশে। অতঃপর নিজেও ইরার পাশে বসবে ঠিক তখনই চোখ গেল তার অপরপাশে তুর্যের পানে। আর ঠিক এই সুযোগটাই নিল তুর্য। সে যেন এতক্ষন অপেক্ষায় বসে ছিল একটাবার পৃথার তাকানোর জন্য। বেচারী তাকানোর সাথে সাথেই সকলের অগোচরে তুর্য এক খানা উড়ন্ত চু’মু ছুঁড়ে মা’র’লো বউয়ের পানে। বুকে হাত দিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বুঝালো,

-“চলো আর একবার বিয়ে করে করে ফেলি, আর তারপর আরেকবার বাসর।”

চলবে…..

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৪৫

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

বুকে হাত দিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বুঝালো,

-“চলো আর একবার বিয়ে করে করে ফেলি, আর তারপর আরেকবার বাসর।”

পৃথা চোখ গরম করে তাকালো তুর্যের পানে। লোকটা ইদানীং নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে ভীষণ। স্থান, কাল, পাত্র সব বিবেচনা হারিয়েছে। পৃথাকে চোখ গরম করে তাকতে দেখেও থামলো না তুর্য। একের পর এক নির্লজ্জ ধাঁচের ইশারা করেই যাচ্ছে। পৃথা তর্যের পানে খেয়াল করতে করতেই হঠাৎ ভেসে এলো কাজী সাহেবের কন্ঠস্বর। কাজী সাহেব বেশ নম্র কন্ঠে ইরাকে বললেন,

-“বলুন মা কবুল।”

ইরা হাঁসফাঁস করে উঠলো। খামচে ধরলো পৃথার এক হাত। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে মেয়েটার মন প্রাণ। আরুশকে যেদিন এ বাড়িতে প্রথম দেখেছিল ইরা সেদিনই ছেলেটার প্রতি একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করেছিল তার হৃদয়ে। তারপর আস্তে আস্তে সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হলো। অনেকবার আরুশকে নিজের মনের কথা জানাতে গিয়েও ভয়ে পিছিয়ে এসেছে মেয়েটা। লোকটা নিতান্তই ভদ্র এবং সভ্য ধাঁচের সে যদি না মেনে নেয় ওকে, ভালো না বাসে তখন কি হবে? প্রিয় মানুষটার কন্ঠে “ভালোবাসি না” এই বাক্যটা শোনার মতো শক্তি ছিল না ইরার। তাই সে আরুশকে ভালোবাসলেও তা প্রকাশে ছিল ভীত। অথচ আজ দেখো সুন্দর এক ভাগ্যের চাওয়ায় নিজ প্রিয় পুরুষটার পাশেই বসে রয়েছে বউয়ের সাজে। আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো সে হয়েও যাবে আরুশের, শুধুমাত্র আরুশের। ইরার আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনার মধ্যেই আবারও ভেসে এলো কাজী সাহেবের কন্ঠস্বর। কাজী সাহেব নম্র কন্ঠে আবার বললেন,

-“বলুন মা কবুল।”

ইরা এবার আর নিজের ভাবনা চিন্তায় সময় ব্যয় করলো না। থেমে থেমে উচ্চারণ করলো,

-“কবুল, কবুল, কবুল।”

সাথে সাথেই চারদিকে সমস্বরে প্রতিধ্বনিত হলো,

-“আলহামদুলিল্লাহ।”

এরপর কাজী সাহেব আরুশকে কবুল বলতে বললে সে সময় নিল একটু। সে তো আর তুর্যের ন্যায় নির্লজ্জ নয়। তাই চারদিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে থেমে থেমে বলল,

-“কবুল, কবুল, কবুল।”

ঝামেলাবিহীন সুন্দর সুষ্ঠভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো আরুশ এবং ইরার। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরে তুর্যদের বাড়িতে ছোট খাটো একটা খাবার আয়োজনও করা হয়েছিল সকলের জন্য। আরুশদের বাড়ির সকলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে এসে বসলো বসার কক্ষের সোফায়। এবার তাদের যাওয়ার পালা। একেক করে সোফা থেকে সকলে উঠে চলে গেলেও আরুশ উঠছে না, ঠাঁয় বসে রয়েছে ছেলেটা। তুর্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরুশের পানে। চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো,

-“তুই উঠছিস না কেন? এখনও এখানে বসে আছিস কোন দুঃখে?”

আরুশ ঠিক কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। আজ তার আকদ হয়েছে। অন্তত একটু সময়ের জন্য হলেও তো ইরার সাথে দেখা করতে দিবে তাকে। বিয়ের আগে মেয়েটার সাথে তেমন কথা হয়নি আরুশের। এখন বিয়ে হয়েছে তাই এই টুকু সুযোগ তো অন্তত তাকে দেওয়া উচিৎ। তাছাড়া তাহমিনা বেগমও বলেছেন আরুশকে আজ থেকে যেতে। হয়তো একটু সময় নয় আজ পুরো রাতটাই ইরাকে কাছে পাবে সে। সেই আশাতেই সোফায় বসে ছিল বেচারা। কিন্তু এই তুর্য নামক প্রাণীর সম্মুখে নিজের মনের আশার কথা সে বলবে কি করে? আরুশ আমতা আমতা শুরু করলো। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খোলার আগেই তাহমিনা বেগম এসে উপস্থিত হলেন ঐ স্থানে। তুর্যের মুখ পানে তাকিয়ে বললেন,

-“ও আজ থাকবে আমাদের বাড়িতে। বিয়ে যেহেতু হয়েছে দুজন দুজনের সাথে একটু কথা বলার জন্য হলেও ওদের সময় দেওয়া প্রয়োজন।”

আরুশ খুশিতে গদগদ হলো। যাক এবার অন্তত নিজের প্রেয়সির নিকটে যাওয়ার সুযোগ পাবে সে। তবে আরুশের এই খুশি বোধহয় সহ্য হলো না একজনের। কপাল কুঁচকে তুর্য বলল,

-“এসব কি ধরনের কথা মা। আকদের তারিখ আমি ঠিক করেছি তাহলে তোমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত আমাকে জানিয়ে নেওয়া উচিৎ ছিল না?”

-“মানে?”

তাহমিনা বেগমের প্রশ্নে কুটিল হাসলো তুর্য। মাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,

-“ইরার সামনে পরীক্ষা মা। বিয়েটা হয়েছে বলেই যদি ওদের এক সাথে থাকতে দাও, এক সাথে সময় কাটাতে দাও তাহলে এর প্রভাব ইরার মনে পড়বে। মেয়েটার বয়স কম স্বামীর সান্নিধ্যে গেলে ওর মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে স্বামী সংসারের দিকে যাবে। পড়াশোনায় কিন্তু আর মন বসবে না ওর।”

থামলো তুর্য। আবার বলল,

-“বিয়ে যখন হয়ে গেছে সারাজীবন পড়ে আছে ওদের একসাথে থাকার জন্য। অথচ পরীক্ষায় যদি একবার ফেল করে তাহলে আমাদের যে সম্মানটা হারাবে তা কিন্তু আর ফিরে আসবে না মা।”

তাহমিনা বেগম মনোযোগ দিয়ে শুনলেন ছেলের কথা। ছেলে তার ভুল বলেনি একটা কথাও। ইরার কিশোরী হৃদয়। এই বয়সটা তারাও অতিবাহিত করে এসেছে। এই বয়সে মেয়েদের বিবেকের তুলনায় আবেগ কাজ করে বেশি। প্রিয় পুরুষ, স্বামী, সংসার এসব সম্পর্কে নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম দেয় হৃদয়ে। সে হিসেবে এখন আরুশ আর ইরাকে একসাথে থাকতে না দেওয়াই শ্রেয়। তাহলে এর প্রভাব ইরার পড়াশোনার উপরে পড়বে। কিন্তু আরুশকে বা সে কিভাবে বাড়িতে যেতে বলবে। নতুন জামাই তাকে একবার থাকতে বলে পর মুহুর্তে বাড়িতে যেতে বলতে পারে নাকি। বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাহমিনা বেগম আমতা আমতা করলেন। ইতস্তত করে বললেন,

-“কিন্তু….”

মায়ের এইটুকু কথাতেই বাকিটা বুঝে নিল তুর্য। আরুশকে টেনেটুনে সোফা থেকে তুলে দাঁড় করালো। কাঁধে হাত রাখলো বেচারার। মায়ের পানে তাকিয়ে বলল,

-“তুমি একদম চিন্তা করো না মা। ও আমার সহকারী কম বন্ধু বেশি। ওকে আমি একটা কথা বললে ও জীবন দিয়ে হলেও তা রাখবে।”

কন্ঠে তোলা কথার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েই আরুশকে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো তুর্য। আর আরুশ! বেচারার মাথা বোধহয় ঘুরছে এই মুহূর্তে। এ কোন তুর্যকে দেখছে সে? একটু আগে যে লোক আরুশের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ধরা দিল এখন সে সবচেয়ে বড় শত্রুর ভূমিকা পালন করছে। এই ছিল এই লোকের পেটে পেটে? এর জন্যই বোধহয় এত তাড়াহুড়া করে তুর্য তাদের বিয়েটা দিয়েছিল। অথচ আরুশ ভেবেছিল তুর্য ভালো হয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে তুর্য ব্যতীত উত্তম পুরুষ আর নেই কেউ। আরুশের হৃদয় কেঁদে উঠলো। তীব্র ব্যথা নিয়ে গেয়ে উঠলো,

-“সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে।
কে আপন কে যে পর হলো রে।”

আরুশের উথাল পাতাল চিন্তা ভাবনার মধ্যেই বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে এলো তারা। তুর্য আরুশের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ভদ্র বাচ্চাদের ন্যায় বলল,

-“রাত অনেক হয়েছে। এখন বাড়ি চলে যা, নিজের একলা বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে জব্বর একটা ঘুম দে।”

আরুশের বুক ফেটে চৌচির অবস্থা। বিয়ের পরও একলা বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানোর উপদেশ দিল এই পুরুষ! এর হৃদয়ে কি একটু দয়া মায়া বলতে কিছু নেই? কেন করলো এই লোক এমন? আরুশের হৃদয়ে ভয়ের তুলনায় বউ হীনা হাহাকারের পরিমাণ বাড়লো। কন্ঠে সাহস এটে সে বলল,

-“আমার সাথে এটা কেন করলেন স্যার।”

তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালো,

-“কি করেছি আমি?”

-“এই যে আমাকে বিয়ে করতে না করতেই বউ ছাড়া করলেন।”

আরুশের অসহায় কন্ঠস্বর। তুর্যের চোখে মুখে গম্ভীর ভাব ফুটে উঠলো সাথে সাথে। থমথমে কন্ঠে সে বলল,

-“ছিঃ ছিঃ আরুশ! তোকে দেখে আমার লজ্জা হচ্ছে। আমার মতো একজন নম্র ভদ্র লাজুক পুরুষের সাথে থেকে তুই এতটা নির্লজ্জ কবে থেকে হলি? বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের কাছে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিস।”

হতবম্ব হলো আরুশ। সে নির্লজ্জ আর তুর্য লাজুক! এ কেমন ভ’য়ং’ক’র কথা। এই কথা শোনার আগে তার কান বন্ধ হয়ে গেল না কেন? আরুশ হতবাক কন্ঠেই বলল,

-“আমি নির্লজ্জ?”

তুর্য কপাল টানটান করে তাকালো। বেশ গৌরবের সাথে বলল,

-“তা নয়তো কি? আমাকে দেখে, আমাকে দেখে কিছু শেখ। বিয়ে করেও টানা আট বছর ব্যাচেলর জীবন কাটিয়েছি। আমার মতো ধৈর্য্যশীল, সুশীল, ভদ্র, লাজুক পুরুষ তুই এই দেশে কেন এই পৃথিবীতেও পাবি না। আমাকে তো নোবেল দেওয়া উচিৎ। শুধুমাত্র সিক্রেট মিশনে থেকে নিজের সবকিছু লুকিয়ে রেখেছি বলে এখন নোবেলটা পাচ্ছি না।”

কথাটা বলেই থামলো তুর্য। বিরবিরিয়ে বলল,

-“ভাগ্যিস রাত ১২ টার পর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলাম। নয়তো মাত্র অল্প সময়ের জন্য এই ৮ বছরের রেকর্ডটা মিস হয়ে যেতো।”

আরুশ তুর্যের বিরবিরিয়ে বলা কথাগুলো শুনলো না। তবে আগের বলা কথা ঠিক শুনেছে। আরুশ জানে ঐ আট বছরের কথা মিথ্যা নয়। তাই আর সে কথা বাড়ালো না। কিন্তু একটা খটকা থেকেই যায়। তুর্য এমনি যেমনই হোক কারন ছাড়া কিছু করে না। আরুশকে যে তুর্য ইরার কাছ থেকে নিজের পূর্বপরিকল্পনা মাফিক সরিয়েছে তা সে ঠিক বুঝতে পেরেছে। এত বড় অফিসার হয়েও এই টুকু যদি সে বুঝতে ন পারে তবে সে কেমন অফিসার? আরুশ সুরু দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। সন্দিহান কন্ঠে শুধালো,

-“সত্যি করে বলুন তো স্যার আমার বাসর ঘরে আপনি আঘাতটা কেন হানলেন?”

তুর্য হাসলো। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,

-“কি ভেবেছিস আমি সব ভুলে গেছি? রাজশাহীতে বউয়ের হাত কেঁটে যাওয়ায় তার সেবা যত্ম করে একটু কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু তুই এসে ব্যাগরা দিয়েছিলি। আর তারপর আমার মাথায় বারি। একটা কথাও ভুলিনি আমি। প্রতিটির কথা মনে রেখেছি, এখন নিজের বোনের সাথে বিয়ে দিয়ে পাই টু পাই হিসাব নেব সবকিছুর। প্রস্তুত থাক।”

কথাটা বলেই তুর্য চলে গেল ঘরের ভিতরে। হতবম্ব হয়ে ঐ স্থানেই দাঁড়িয়ে রইলো আরুশ। তুর্যের বউয়ের সাথে কাটানো মুহূর্তে একটু ব্যাগরা দেওয়া আর ভুলবশত মাথায় একটা আঘাতের জন্য এত বড় একটা শাস্তি দিয়ে দিল আরুশকে? সোজা একদম তার বাসর ঘরে আঘাত করে দিল? এই তুর্যের বোনকে বিয়ে করে আর কি কি তার কপালে আছে সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আরুশের বুক ভারী হলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

-“একটা ভুল সারা জীবনের কান্না।”

৪৯.
পুরো বাড়িতে উৎসব লেগেছে। চারদিকে হইহই রইরই অবস্থা। ইরার আর আরুশের বিয়ের দিনক্ষণ এগিয়ে এসেছে যে। সময়ের প্রবাহমান গতিতে এর মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি মাস। পৃথা এবং ইরার এইচএসসি শেষ হয়েছে, রেজাল্টও চলে এসেছে ইতমধ্যে। মোটামোটি ভালো রেজাল্ট করেছে দুজনই। আর এদিকে আরুশও তার পরিবারকে দিয়ে ইরাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চাপ দিচ্ছে। তাই আর দেরী করতে চাইলো না কেউ। এমনিই এই পরীক্ষা পরীক্ষা করে বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। সামনের সপ্তাহে আরুশ এবং ইরার আনুষ্ঠানিক দিন ধার্য করা হয়েছে। আর তার আগের দিন গায়ে হলুদ। সেই অনুপাতে ইতমধ্যে বাড়িতে অতিথিদের আগমনও শুরু হয়ে গেছে। তুর্যও ছিল আজ বাড়িতেই। বসার কক্ষে বসেছিল সবার সাথে। যদিও তার নজর রান্নাঘরে। কারন সেখানে যে বেচারার এক এবং একমাত্র বউ কোমড়ে ওড়না বেঁধে রান্নার কাজ সামলাচ্ছে। তুর্যের পৃথার পানে উঁকি ঝুঁকির মধ্যেই তার পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। তুর্য রান্নাঘরের পানে দৃষ্টি রেখেই কল ধরে মোবাইলটা কানের ধরলো। মুহুর্তেই চোখ মুখের রং পাল্টে গেল ছেলেটার। শক্ত কন্ঠে বলল,

-“আসছি আমি। ”

চলবে…..