সে আমার অপরাজিতা পর্ব-০৩

0
150

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৩
#সারা মেহেক

অনুষ্টান শেষে হোস্টেলে ফিরে এলো বিন্দু ও মারিয়া। খালাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ বাসায় যাবে না সে। পরের সপ্তাহের শুক্রবারে যাবে।
বিন্দু রুমে এসেই শাড়ি চেঞ্জ করে নিলো। শাড়ির আঁচলটা হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল চাহনিতে বিছানায় বসে রইলো কিছুক্ষণ। এত সুন্দর শাড়িটার এমন অবস্থা দেখে সত্যিই তার করুণা পাচ্ছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি বরং নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কেনো যে খালার শাড়িটা পরতে গেলো সে! এ ঘটনার মাধ্যমে বেশ শিক্ষা হয়েছে তার। আর কোনোদিনও অন্যের কোনো কিছু পরবে না সে।

মারিয়া এসে বিন্দুর সামনে বসলো। তার পিছু পিছু এলো তাদেরই রুমের একটা মেয়ে। নাম মুন। সে এসেই বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
” শাড়িটা একেবারে ছিঁড়ে গিয়েছে তাই না?”

বিন্দু জবাব দিলো,
” হুম।”

” ইশ, খুব খারাপ লাগছে। আসলে ওখানে না বসলেই পারতে বিন্দু। ”

মুনের কথা শুনে চট করে তাকালো মারিয়া। মুন সেদিকে খেয়াল করলো না৷ টিটকারি মেরে বললো,
” আসলে শাড়ি না সামলাতে পারলে পরা উচিত না। শুধু শুধু তোমার জন্য বৃত্ত ভাইয়া সবার সামনে এভাবে ‘সরি’ বলে বলে মুখে ফেনা তুললো। সিনিয়রদের কাছ থেকে যত পারো দূরে থেকো। বিশেষ করে বৃত্ত ভাইয়ার কাছ থেকে। শুনেছি উনি ভার্সিটির সকল রাজনৈতিক বিষয়ের সাথে জড়িত। উনাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও পুরো রাজনৈতিক। এজন্য বলছি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখো উনার কাছ থেকে।”

মুনের এহেন কথায় মাথা গরম হয়ে এলো বিন্দু ও মারিয়ার। মারিয়া কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই বিন্দু মেকি হাসি হেসে ভীষণ নমনীয় গলায় বললো,
” থ্যাংকস মুন। আমার এত ভালো চিন্তা করার জন্য। তুমি না থাকলে আমি জানতেই পারতাম না বৃত্ত ভাইয়ার ব্যাপারে। ”

বিন্দুর এহেন কথায় গর্বের সহিত হাসলো মুন। কিন্তু মারিয়া ভীষণ অবাক হলো। কেননা সে ভেবেছিলো বিন্দু বোধহয় দু চারটা কড়া কথা শুনিয়ে দিবে। অবশ্য তার এ ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করতেই যেনো বিন্দু পরক্ষণেই কড়া চাহনিতে চেয়ে বিদ্রুপের সুরে বললো,
” তুমি না বললে জানতেই পারতাম না যে বৃত্ত ভাইয়ার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তুমি এটা না জানালে তো আমি উনার কোলে গিয়ে বসে থাকতাম। বড় বাঁচা বাঁচালে মুন। থ্যাংকস। ”

হাসি মুখে বিন্দুর নিকট হতে এরূপ অপমানিত হবে তা কল্পনাও করেনি মুন। সে ভেবেছিলো বিন্দু বোধহয় বেশ চুপচাপ নরম-সরম গোছের মেয়ে। কিন্তু এই মেয়ে এভাবে অপমান করতে পারে তা ভেবে উঠতে পারেনি সে। ফলস্বরূপ অপমানে মুখখানা থমথমে হয়ে এলো তার। অপরদিকে মারিয়া বিন্দুর এরূপ জবাবে ভীষণ খুশি হলো। সে-ও মুনকে ক্ষিপ্র গলায় বললো,
” তুই যে বৃত্ত ভাইয়াকে পছন্দ করিস, এটা আমার অজানা নয়। কাকে কার থেকে দূরে থাকতে হবে এটা তোর না জানালেও চলবে। নিজের চরকায় তেল দে মুন। ফার্দার এমন টাইপের কথাবার্তা শুনলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। এখনও তো আমাকে চিনিসনি। কিন্তু যেদিন চিনবি,একদম সারাজীবনের জন্য চিনে রাখবি। ”

মারিয়ার হু’ ম’ কিপূর্ণ কথায় ভীতসন্ত্রস্ত দেখালো মুনের মুখখানা। সে আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলো না। নীরবে স্থান ত্যাগ করল। মুন চলে যেতেই মারিয়া বিন্দুর উদ্দেশ্য বললো,
” দ্যাটস মাই গার্ল বিন্দু! এসব পাবলিকদের এমন করেই ধুয়ে দেওয়া উচিত। মিষ্টি মুখের অপমান গায়ে লাগে বেশি। ”

বিন্দু হাসলো। বললো,
” মুন মনে হয় ভেবেছিলো আমি একদম চুপচাপ, কিছু বলবো না। কিন্তু আসলে ও এটা জানেনি যে জায়গামতো ভদ্র ভাষায় কথা শুনিয়ে দিতে আমি কখনও পিছপা হই না।
ওর কথাগুলো শুনে আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। এমনভাবে বৃত্ত ভাইয়ার নামে বললো, মনে হলো যে উনি মুনের ফিউচার হাজবেন্ড। পৃথিবীতে যে এমন কত পাবলিক আছে আল্লাহ জানে।”

মারিয়াও সায় দিলো বিন্দুর সাথে।

————

শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত আলিশান বাংলোর অধিকারী মেয়র আফতাব হোসাইন। বিগত প্রায় আট বছর ধরে দু’বার নিয়োগের মাধ্যমে মেয়র পদে বহাল আছেন তিনি। এলাকার প্রতিটি মানুষের কাছে তিনি সুপরিচিত। আর এ সুপরিচিত লাভ করেছেন জনউন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে। দু ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী ও মা নিয়ে আফতাব হোসাইনের পরিবার। এদের নিয়েই সুখে শান্তিতে বসবাস করেন তিনি। বড় ছেলে বৃত্ত আর তিন মাস বাদে মাস্টার্স শেষ করার মাধ্যমে পড়াশোনার ইতি ঘটাবে। সামলাবে বাবার অফিস। ছোট ছেলে বাদল অনার্স শেষ বর্ষে পড়ালেখা করছে। আর মেয়ে বর্ষা এবারই অনার্সে ভর্তি হয়েছে।

আফতাব হোসাইন রাতের খাবার খেয়ে রিডিং রুমে বসে বই পড়ছিলেন। হঠাৎ দরজার ওপাশ হতে বৃত্ত ও বাদলের কণ্ঠস্বর শুনলেন তিনি। বৃত্ত ও বাদল অফিসের কাজ শেষ আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরলো মাত্র। আফতাব হোসাইন ঘড়িতে সময় দেখলেন। রাত প্রায় বারোটা বাজে। অকারণে ছেলেদের এতো দেরিতে বাসায় আসা যাওয়া ভীষণ অপছন্দ করেন তিনি। তাই তো বন্ধ দরজার এপাশ থেকে গলার স্বর উঁচু করে বৃত্ত ও বাদলকে ডাকলেন তিনি। দুজনেই চুপিচুপি নিজেদের রুমে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু বাবার ডাকে থমকে দাঁড়ালো দুজনে। একে অপরের দিকে সতর্ক চাহনিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আফতাব হোসাইন পুনরায় ডাকতেই দুজনে নিশ্চিত হলো যে এ তাদের ভ্রম নয়, বাবা সত্যিই ডাকছেন।

বৃত্ত ও বাদল রিডিং রুমের দরজায় নক করলো। আফতাব হোসাইন ভিতর থেকে অনুমতি দেওয়ার পর তারা রুমে প্রবেশ করলো। দুজনে গিয়ে দাঁড়ালো আফতাব হোসাইনের সম্মুখে। আফতাব হোসাইন ছেলেদের দেখে অতি সন্তর্পণে বইটা রাখলেন। চোখের চশমাটা খুলে সোজা হয়ে বসলেন৷ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কয়টা বাজে এখন?”

বৃত্ত নিজের হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো,
” বারোটা পাঁচ।”

” আজ অফিসে অতিরিক্ত কোনো কাজ ছিলো?”

” না। ”

” তাহলে এতো দেরিতে বাড়ি ফেরার কারণ কি?”

বৃত্ত নীরব রইলো। আফতাব হোসাইন বাদলকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি বলো, বাড়িতে এতো দেরিতে আসার কারণ কি?”

বাদল একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। আফতাব হোসাইন তা লক্ষ্য করতেই বললেন,
” ওর দিকে তাকাচ্ছো কেনো? তোমার জবান নেই? ”
বলেই তিনি বৃত্তের দিকে চাইলেন। পুনরায় দুজনের উদ্দেশ্যে বললেন,
” সত্য কথা বলবে দুজনে।”

বৃত্ত খানিকটা সময় নিয়ে নিচু কণ্ঠে বললো,
” আড্ডা দিচ্ছিলাম দুজনে।”

আফতাব হোসাইন এবার তাঁর গলার স্বর পূর্বের তুলনায় গম্ভীর ও কঠোর করলেন। বললেন,
” কোনো কারণ ছাড়াই রাত বারোটা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকা কি ভদ্র ঘরের ছেলেদের লক্ষণ? আমি তোমাদের নিশ্চয়ই এ শিক্ষাটা দেইনি।
তোমাদের হয়তো মনে হতে পারে, এ বয়সে এসেও বাবা এতো কঠোরতা কেনো করে তোমাদের উপর। এজন্য তোমাদের জ্ঞাতার্থে আবারও বলে দিচ্ছি, আমার কাছে মূল্যবোধ, ভদ্রতাই আগে। এতো রাত পর্যন্ত সম্মানীয় ঘরের ছেলেরা আড্ডা দেয় না৷ যারা আড্ডা দেয় তাদের লোকে ব’ খা’ টে বলে। নিশ্চয়ই একজন মেয়রের ছেলেদের কেউ ব’ খা’ টে’ বলবে এটা আমার সহ্য হবে না। অফিসের কাজ থাকলে এতো রাত অব্দি বাইরে থাকাকে মেনে নিতাম। কিন্তু অকারণে এসব আমার পছন্দ নয়। এখন যে যার রুমে চলে যাও। ভবিষ্যতে যেনো এ কাজের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।”

বৃত্ত ও বাদল বাধ্য ছেলেদের ন্যায় মাথা দোলালো। অতঃপর রিডিং রুম থেকে বেরিয়ে যে যার রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
বাদল ফ্রেশ হয়ে সোজা চলে এলো বৃত্ত’র রুমে। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। বৃত্ত ল্যাপটপে কাজ করছিলো। পিছে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বাদল রুমে এসেছে। বাদলকে জিজ্ঞেস করলো,
” এখনও ঘুমাসনি যে?”

” ঘুম আসছে না।”
বলেই সে তড়াক করে উঠে বসলো। বৃত্ত’র উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
” আচ্ছা ভাই, বলো তো, বাবা এমন কেনো? এত শাসন করে কেনো? বিরক্ত হয়ে যাই মাঝে মাঝে।তুমিই বলো, এ বয়সে এসে যদি টিনএজারদের মতো বাবার শাসনে থাকতে হয় তাহলে কেমন লাগে!”

বৃত্ত মৃদু হাসলো। বললো,
” এতো বছরেও কি বাবাকে চিনতে পারলি না? বাবা সবসময় নিজের আদর্শ মেনে চলে। উনি চায় আমরাও যেনো তার আদর্শে চলি। উনার কথাগুলো কিন্তু ঠিক। এত রাত পর্যন্ত অকারণে বাইরে থাকার কোনো মানেই হয় না। ”

” কিন্তু তাই বলে এভাবে রুমে ডেকে কথা শোনাবে?”

” কিছু করার নেই। ছোট থেকেই দেখে আসছি এমন। সত্যি বলতে মাঝেমধ্যে আমারও একটু রাগ হয়। কিন্তু বাবাকে কিছু বলতে পারি না। কারণ আমি চাই না আমাদের উপর থেকে উনার বিশ্বাস উঠে যাক। বাবা কিন্তু সবসময় বলে আমরা তার গর্ব। আর নিশ্চয়ই কেউ চাইবে না নিজের গর্ব খোয়াতে?”

বাদল আর প্রত্যুত্তর করলো না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিরবির করে বললো,
” বাড়িতে দ্বিতীয় আফতাব হোসাইন তৈরী হচ্ছে বোধহয়।”

বাদলের এ ফিসফিস কথা বৃত্ত ঠিকই শুনে ফেললো। সে সহাস্যে বললো,
” আই হ্যাভ নো প্রবলেম। বাবার মতো হতে পারলে আমার জীবনটা আসলে সার্থক হয়। তুইও চেষ্টা কর।”

বাদল বললো,
” নো ওয়ে। এতোটা সন্ন্যাসী লেভেলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। তুমি কাজ করো। আমি ঘুমাতে গেলাম। ”
বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বৃত্ত পুনরায় কাজে মনোযোগ দিলো।

————-

অফ পিরিয়ডে ক্যান্টিনে বসে নাস্তা করছিলো বিন্দু ও মারিয়া। তাদের খাওয়াদাওয়ার মাঝেই তড়িঘড়ি করে ক্যান্টিনে প্রবেশ করলো সজীব। হাঁপাতে হাঁপাতে বিন্দুকে বললো,
” দোস্ত, তোকে ফিফথ সেমিস্টারের বড় ভাই আর আপুরা ডেকে পাঠিয়েছি। ইমেডিয়েটলি। ”

সজীবের এহেন কথায় বিন্দু ও মারিয়া একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। মারিয়া দেখলো বিন্দুর মুখখানায় কিঞ্চিৎ আতঙ্কের ছাপ।
পরবর্তী পর্ব পেতে পেইজ ফলো দিয়ে রাখুন: সারা মেহেক । Sara Jahan Mehek
®সারা মেহেক

#চলবে