সে আমার অপরাজিতা পর্ব-০৫

0
146

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৫
#সারা মেহেক

বৃত্ত সাকিবের দেওয়া নাম্বারে কল দিলো। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো বিন্দু। মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
” আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

বিন্দুর কণ্ঠ শোনা মাত্রই বৃত্ত নিজের অজান্তেই কয়েকটা হৃৎস্পন্দন মিস করলো বোধহয়। মেয়েটার কণ্ঠ ভীষণ মিষ্টি। একবার শুনলে বারংবার শুনতে মন চায় এ কণ্ঠ। মনে হয় যেনো কোনো এক সুমধুর গান গাইছে সে। এটা যে কেউ মানতে বাধ্য হবে যে বিন্দুর চেহারা ও ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ার পূর্বেই তার কণ্ঠের প্রেমে পড়বে মানুষ।
বৃত্ত প্রারম্ভে কোনো কথা বললো না৷ দৃষ্টির সামনে মনের অজান্তেই কণ্ঠের অধিকারীনিকে কল্পনা করলো। ওদিকে বিন্দু সালামের অপেক্ষায় থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিলো। এমন রং নাম্বারের প্রতি ভীষণ বিরক্ত সে। এসব লোকজনের হাতে হয়তো অঢেল সময় থাকে। তাই তো অপরিচিত কারোর নাম্বারে কল দিয়ে তার সময় নষ্ট করে। কি আনন্দ পায় কে জানে!

বিন্দু কল কেটে দিয়েছে তা টের পেতেই সে ফের কল দিলো। বিন্দু এবার রিসিভ করলো না৷ মারিয়ার সাথে গল্পে মশগুল হলো। বৃত্ত ফের কল দিলো। এবার একদম শেষ রিং এ গিয়ে বিন্দু কল রিসিভ করলো। পূর্বের তুলনায় খানিকটা কড়া গলায় বললো,
” কে বলছেন? ”

বৃত্ত এবার তার বলিষ্ঠ কণ্ঠের সহিত জবাব দিলো,
” আমি।”

বিন্দু বিরক্তিমাখা গলায় বললো,
” এই আমি’টা কে? আমি কোনো ‘আমি’ নামের ব্যক্তিকে চিনি না।”

বৃত্ত হাসলো। মনে হলো বিন্দুকে আরো খানিকটা জ্বালানো যাক। সে বললো,
” আমার কণ্ঠ শুনেও চিনতে পারছো না?”

” জ্বি না। আপনি কোনো পাবলিক ফিগার বা সিঙ্গার না যে আপনার কণ্ঠ শুনেই চিনে ফেলবো।”

” কেনো চিনতে পারবে না? আমি তো তোমার কণ্ঠ শুনেই চিনতে পেরেছি।”

বিন্দু বিস্মিত হবার ভান করে বললো,
” ও তাই! বলুন তো আমি কে?”

” তুমি বিন্দু। আমার ভার্সিটির জুনিয়র। যার শাড়ির আঁচল আমার পায়ে লেগে ছিঁড়ে গিয়েছিলো। ”

বৃত্তের এহেন কথায় থতমত খেলো বিন্দু। অনেকটা আঁতকে উঠলো সে। দৃষ্টিজোড়ায় বিস্মিত ভাব স্পষ্ট হলো। তার এরূপ বিস্মিত ভাব দেখে মারিয়া জিজ্ঞেস ইশারা জিজ্ঞেস করলো, কে? বিন্দু ফিসফিস করে ইশারায় বললো,
” বৃত্ত ভাইয়া।”

বৃত্তের কথা শুনে বিন্দু যতোটা না বিস্মিত হলো, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিস্মিত হলো মারিয়া। সাতপাঁচ না ভেবে দ্রুত বিন্দুকে উঠিয়ে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো সে। কারোর কান অব্দি যদি বৃত্ত’র কল করার কথা পৌঁছায় তাহলে বিন্দুর উপর একদম শ কু নের মতো ঝাপিয়ে পড়বে সবাই। রুমের প্রতিটা মেয়ে যেনো মানুষ নয়,একেকটা শ কু ন!

বিন্দু খানিকটা সময় নিয়ে গলা পরিষ্কার করে নরম সুরে কিঞ্চিত অপরাধবোধ নিয়ে বললো,
” সরি ভাইয়া, আমি চিনতে পারিনি আপনাকে। তাই ওমন ব্যবহার করে ফেলেছি। ”

বৃত্ত মুচকি হাসলো। রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে আরাম করে রকিং চেয়ারে বসলো। মাথার পিছনে এক হাত দিয়ে হেলান দিলো। বললো,
” ইটস ওকে সমস্যা নেই। নাম্বার সেভ নেই তাই চিনতে পারোনি। বুঝেছি।”

” জি ভাইয়া। ”

” আমি আসলে ফোন করেছিলাম কিছু কথা জানতে।”

” কি কথা?”

” এই যে, তুমি হোস্টেলে থাকো নাকি বাসায়?”

” জি, হোস্টেলে থাকি ভাইয়া। এখানে থেকেই পড়াশোনা করি। ”

” ওহ। তুমি কি স্থানীয় এখানকার?”

” না ভাইয়া। আমার বাসা অন্য শহরে। ”

” ওহ। আসলে আমি মেইনলি কল করেছিলাম ক্ষতিপূরনের ব্যাপারে। ”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিন্দু ভুলে বসলো যে বৃত্ত কিসের ক্ষতিপূরনের কথা বলছে। তাই তো সে চট করে জিজ্ঞেস করলো,
” কিসের ক্ষতিপূরণের কথা বলছেন?”

বৃত্ত কিঞ্চিত অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে হাসলো,
” এত দ্রুত ভুলে গিয়েছো শাড়ির কথা!”

বিন্দুর এবার খেয়াল হলো যে বৃত্ত সেদিনের ঘটনার কথা বলছে। সে বললো,
” না না ভুলিনি। আসলে একটু বুঝতে সময় লেগেছে আরকি।”

” তাহলে শাড়ি কবে পাঠাবো?”

বৃত্ত’র এহেন প্রশ্নে বিন্দু তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
” আরে কি বলছেন ভাইয়া! শাড়ি পাঠাতে হবে না। ওটা তো আর আপনি ইচ্ছে করে ছিঁড়েননি।”

মারিয়া পিছে দাঁড়িয়ে বিন্দুর ফোনের সাথে কান লাগিয়ে দুজনের সম্পূর্ণ কথোপকথন শুনছিলো। হঠাৎ বিন্দুর এহেন কথায় সে পিছন থেকে গুঁতো দিয়ে সামনে চলে এলো। বিন্দুর দিকে চেয়ে গরম চোখে ফিসফিস করে বললো,
” তুই কি গাধা! এত ভালো অফার পেয়ে আবার বলছিস লাগবে না! হ্যাঁ বল জলদি।”

বিন্দু চোখের ইশারার ক্রোধ দেখিয়ে মারিয়াকে ‘না’ বললো। ওদিকে ওপাশ থেকে বৃত্ত বললো,
” ইচ্ছেয় ছিঁড়ি আর অনিচ্ছায় ছিঁড়ি, কোনো এক ভাবে ছিঁড়েছি তো। তাই ক্ষতিপূরণটাও আমি দিবো। তোমার ঐ শাড়িটা ভীষণ সুন্দর ছিলো। তুমি বললে হুবহু ঐ শাড়িটাই পাঠিয়ে দিবো। ”

” না না। আমার শাড়ি লাগবে না ভাইয়া। আপনার কাছ থেকে ছিঁড়ার আগেই আমার রিকশায় লেগে ছিঁড়ে গিয়েছিলো শাড়িটা। সেক্ষেত্রে দোষটা আমারই।”

” আহহা, বড্ড জেদি মেয়ে তো তুমি! একজন সিনিয়র এত করে সাধছে আর তুমি বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো! জানো না, সিনিয়রদের রাগাতে নেই।”

বিন্দু বৃত্ত’র কথা শুনে ভীত চাহনিতে মারিয়ার দিকে তাকালো। মারিয়া তখন চিবিয়ে চিবিয়ে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললো,
” বলেছিলাম রাজি হয়ে যা। এখন কোনো ঝামেলা বাঁধলে সামলাস একা। আসছে মাদার তেরেসা সাজতে।”

বিন্দু শুকনো একটা ঢোক গিললো। আমতাআমতা করে বললো,
” সরি ভাইয়া। আসলে এভাবে শাড়ি নেওয়াটা কেমন যেনো লাগছিলো তাই আরকি……”

” কেমন লাগার কি আছে? এটা তো আমি গিফট দিচ্ছি না। ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি।
আচ্ছা এবার বলো, শাড়িটা কোথা থেকে কিনেছো?”

” আসলে শাড়িটা আমার না। আমার খালামনির। খালু কিনে দিয়েছিলো। কিন্তু কোথা থেকে কিনেছিলো সেটা জানি না। আর সেইম টু সেইম শাড়ি এখন না-ও পেতে পারেন। কেননা শাড়িটা আরো প্রায় দশ বছর আগের কেনা। ”

বৃত্ত’র কণ্ঠে এবার উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেলো। বললো,
” এই যা, কি এক বিপদে পড়লাম! খালামনির শাড়ি ওটা! সেটাও আমার দশ বছর আগের কেনা! এখন কিভাবে এরেঞ্জ করবো!”

” জি ভাইয়া, আমিও সেটাই বলছিলাম। তাই আরকি বলছিলাম যে শাড়ি না দিলেও চলবে। আমি খালামনিকে ম্যানেজ করে নিবো। ”

বৃত্ত কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর বললো,
” উঁহু, এখনই তোমার খালামনিকে জানিও না। আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।
আচ্ছা, তুমি তাহলে পড়াশোনা করো। আমি রাখছি। সময় দেওয়ার জন্য থ্যাংকস।”

বিন্দু এর প্রত্যুত্তরে কি বলবে ঠিক খুঁজে পেলো না। তাই ছোট্ট করে জবাব দিলো,
” আচ্ছা ভাইয়া। ”

বৃত্ত কল কেটে দিলো। সে কল কাটতেই বিন্দু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতক্ষণ বেশ কষ্টেসৃষ্টে কথা বলছিলো সে। হাত পা বুঝি ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। গলাটাও বেশ শুকিয়ে এসেছে। ইশ, এসব সিনিয়রের কি এক ঝামেলা!

বৃত্ত ফোন রাখতেই মারিয়া সকল ক্রোধ পাশে রেখে বিন্দুকে টিপ্পনী কাটতে লাগলো। বললো,
” তোর নাম্বার জোগাড়ও শেষ! কি ফাস্ট ভাবা যায়! এবার আমি ১০০% শিওর বৃত্ত ভাইয়া তোর উপর ক্রাশ খেয়েছে। লিখে নে খাতায়।”

বিন্দু চোখ ছোট ছোট করে বললো,
” তোর শিওরিটির মাথায় বাড়ি।”

” শোনো জান, বাড়ি দাও আর যাই দাও না কেনো। আমার কথা যে সত্য হবে, অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নিস৷ পছন্দ না করলে এভাবে ফোন দিয়ে কথা বলা, শাড়ির ক্ষতিপূরণ দেওয়া, কখনোই এসব করতো না। দেখিস, আজ একদিন তো কথা হলো। পরে আরো কথা হবে। মিলিয়ে নিস।”

বিন্দু বিরক্তিমাখা চাহনিতে বললো,
” ফোন করলে আর ক্ষতিপূরণ দিলে কেউ কাউকে পছন্দ করে এমন লজিক কোথায় পাস তুই?”

” শুধু আমি কেনো, সবাই এমন লজিক দিবে। আর এ লজিক হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার মতো লজিক না। একদম ইট পাথরের খোদাই করা লজিক।
আহ, তোদের ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি আমি৷ বিন্দু -বৃত্ত’র ভবিষ্যৎ।”
বলেই সে এমন ভাব করলো যেনো লজ্জায় বিন্দু নয় সে-ই লাল হয়ে যাচ্ছে।
বিন্দু মারিয়ার কথার তোয়াক্কা করলো না। বিরক্তিতে ওর হাতে আলতো করে এক চাপড় মেরে রুমে চলে এলো।

————

খালেদ মোল্লার নিজস্ব কারখানার সামনে একে একে তিনটা গাড়ি থামলো। প্রথম তৃতীয় গাড়ি থেকে তিনজন করে মোট ছয়জন বডিগার্ড আর দ্বিতীয় গাড়ি থেকে বৃত্ত ও বাদলসহ একজন বডিগার্ড নামলো। কুচকুচে কালো রঙের পাঞ্জাবি ও কালো সানগ্লাস পরিহিত বৃত্ত ও বাদলকে দূর থেকেই চিনে ফেললেন খালেদ মোল্লা। অতিথিদের দেখে ধীরেসুস্থে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন তিনি। পান চিবানো লালচে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এগুলেন তিনি। গলার স্বর উঁচু করে কণ্ঠে উৎফুল্লতা প্রকাশ করে বললেন,
” আরে কে কোথায় আছিস, আমাদের দুজন মেহমান এসেছে। কেউ চেয়ার নিয়ে আয়। নাস্তা পানির আয়োজন কর কেউ।”
বলতে বলতে তিনি বৃত্ত ও বাদলের সম্মুখে দাঁড়ালেন। বিস্তৃত এক মেকি হাসি এঁটে বললেন,
” স্বাগতম আমার এ ছোট্ট এলাকায়। বসুন আপনারা। আপনাদের খাতিরদারি করতে আমরা সবসময় প্রস্তুত। ”
বলেই একটা ক্রুর হাসি দিলেন তিনি। তার এ হাসিতে বৃত্ত ও বাদলের যেনো শরীরে৷ জ্বলন ধরলো। বাদলের মন চাইলো এক্ষুণি এক ঘুষিতে এই বুড়োর চেহারার মানচিত্র বদলিয়ে দিতে।

বৃত্ত খালেদ মোল্লার কথায় প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চোখ থেকে কালো সানগ্লাস খুলে পাঞ্জাবির গলার কাছে ঝুলালো। গাম্ভীর্যপূর্ণ গমগমে কণ্ঠে বললো,
” আমরা এখানে চা নাশতা খেতে আসিনি। জরুরি আলোচনা করতে এসেছি।”

” আরে আলোচনা হবে। সব আলোচনা হবে। তবে আগে একটু চা পানি খেয়ে নিন আপনারা। ”

” আপনার, আমার, দু’জনেরই সময়ের মূল্য আছে। আমি কোনো সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। ব্রিজ…..”

বৃত্ত’র কথা সম্পূর্ণরূপে শেষ হতে দিলেন না খালেদ মোল্লা। পিছে ফিরে শরীরের আড়মোড়া ভেঙে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
” সিরিয়াস কথাবার্তা পরে হবে। আগে বসুন আপনারা।
এই, দুটো চেয়ার এগিয়ে দে।”

খালেদ মোল্লার এহেন খামখেয়ালিপনায় মেজাজ বিগড়ে যেতে লাগলো দুজনের। তবুও ধৈর্য্য ধরে চেয়ারে বসলো তারা। এবার বাদল সরাসরি মোদ্দা কথা তুললো। বললো,
” দেখুন, শুধু নিজের সময় নষ্ট করছেন আপনি। আমরা ব্রিজ নির্মাণের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। ”

খালেদ মোল্লার চেহারা হতে এবার মেকি হাসিও মুছে গেলো। চেহারায় একটা কাঠখোট্টা ভাব এনে বললেন,
” শোনো ছেলেরা, জায়গাটা আমার। সুতরাং আমি ওখানে কি করবো সেটা আমার সিদ্ধান্ত হবে। তোমাদের এখানে নাক গলানোর প্রয়োজন দেখছি না আমি।”

বৃত্ত খালেদ মোল্লার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমন অনেক ময়লা আবর্জনার সহিত সে লেনদেন করেছে। খালেদ মোল্লা তার নিকট নতুন কোনো আবর্জনা নয়। বরং পুরোনো এক আবর্জনা যে বিগত কয়েকটা বছর ধরে শহরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। বৃত্ত ধৈর্য্য ধরলো। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বললো,
” শুনুন তবে, মেয়র হওয়ার জন্য যে এখন থেকেই খুঁটি গেড়ে বসে আছেন, এটা তো একটু খেয়াল রাখবেন যে জনগণের ভালো কোথায় আর খারাপ কোথায়। লোক দেখানো জনসেবা করলে সব জায়গায় করবেন। একদিন খাবার বিলিয়ে দিয়ে পরেরদিন খাবার ছিনিয়ে নিলে তো জনগণ ভোট দিবে না। বরং ঝাঁটা পেটা করে শহর ছাড়া করবে। আপনি নিশ্চয়ই জনগণের ঝাঁটার বাড়ি খেতে চান না? নাকি খেতে চান?”

বৃত্ত’র কথায় খালেদ মোল্লার চেহারায় অপমানের ছিঁটেফোঁটারও দেখা মিললো না। বরং হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি।

চলবে।