সে আমার অপরাজিতা পর্ব-১২

0
144

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১২
#সারা মেহেক

বৃত্তের এহেন কথায় মারিয়া ও সজিব মুখ টিপে হেসে নিলো। কিন্তু বিন্দুর প্রতিক্রিয়া সামান্যতমও পরিবর্তন হলো না। সে বৃত্ত’র দিকে বেশ বিরক্তি নিয়ে চোখমুখ কুঁচকে চেয়ে রইলো। বিন্দুর এমন চাহনিতে বৃত্ত থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” সকাল সকাল কি করলা খেয়ে এসেছো?”

বিন্দু জবাব দিলো না। তবে পূর্বের চেয়েও বেশ বিরক্তিপূর্ণ চাহনি নিয়ে অন্যদিকে চাইলো। সে মুহূর্তে তার নজর ঠেকলো ক্যান্টিনের অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের প্রতি। ক্যান্টিনে উপস্থিত প্রায় প্রতিটি ছেলেমেয়ে তাদের টেবিলের দিকে চেয়ে আছে। তাদের এ জিজ্ঞাসাপূর্ণ চাহনি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, প্রত্যেকের আগ্রহ বৃত্তকে ঘিরে। বিন্দুদের টেবিলে বৃত্ত’র এমন উপস্থিতি সকলের মনে সন্দেহের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে।
বিন্দু বেশ অস্বস্তি বোধ করলো। কোনো সন্দেহ নেই, আজকের পর থেকে তাকে নিয়ে ভার্সিটিতে বেশ আলোচনা হবে। এসব তার মোটেও পছন্দ নয়। সবসময় সে সকলের আড়ালে থাকতে পছন্দ করেছে। অথচ নবীনবরনের পর হতে কোনো না কোনোভাবে কারো না কারোর নজর কাড়তে সক্ষম হচ্ছে সে। ব্যাপারটা বড্ড দৃষ্টিকটু।

বৃত্ত’র প্রশ্নের জবাব বিন্দু দিলো না। তবে মারিয়া পাশ হতে ঠিকই টিপ্পনী কেটে বললো,
” অনেকদিন বাদে আপনাকে দেখেছে তো। তাই একটু অভিমান দেখাচ্ছে আরকি।”

বৃত্ত মারিয়ার এহেন কথায় ঠোঁট উল্টে কৌতুকের সুরে বললো,
” আরে বাহ! বিন্দু অভিমানও করতে পারে! অবশ্য মেয়েদের অভিমানীনি চাহনিটা একদম অন্যরকম হয়। একটু চালাক না হলে তাদের অভিমানী রূপখানা ধরতে পারা বড্ড কষ্ট হয়ে যায়। ”

সজিব এবার সাহস করে মুখ খুললো। খানিকটা আমতাআমতা করে বললো,
” ঠিক বলেছেন বৃত্ত ভাই। মেয়েদের মনের অবস্থা বুঝা অনেক কষ্টের। তারা কখন রাগ করে আর কখন অভিমান করে তা টের পাওয়া কঠিন।”
বলেই সে খানিকটা ভয় ও ইতস্ততবোধ নিয়ে বললো,
” বাই দা ওয়ে, আপনার আর বিন্দুর মধ্যে যে কিছু চলছে তা আমি জানতাম না। ইয়ে মানে কবে থেকে এসব চলছে? ”
বলে সে বিন্দুর পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” দোস্ত? আমাকে তো একবারও জানালি না যে তোর আর বৃত্ত ভাইয়ের……”

বিন্দুর মেজাজ এবার চটে গেলো। সজিবের কথা সম্পূর্ণ শেষ করতে না দিয়েই টেবিলের নিচে পা দিয়ে সজিবের পায়ে গুঁতো দিলো। অকপট ক্রোধ নিয়ে বললো,
” সজিবের বাচ্চা, আজ ক্লাস শেষ দেখা কর। দেখ তোর কি অবস্থা করি আমি। আর তোর গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ করানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার।”

সজিব বুঝলো, সে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। তাই তো সে দাঁত বের করে বোকা বোকা হেসে বললো,
” দোস্ত, আমার এখনও বাচ্চা হয়নি। আর আমাদের ব্রেকআপ করিয়ে দিলে বাচ্চাই বা হবে কি করে!”

বিন্দু বিরক্ত হলো। ভীষণ বিরক্ত হলো। তার মন চাইছে এ মুহূর্তে সজিবের মাথাটা নিয়ে টেবিলের উপর ইচ্ছামতো বাড়ি দিতে। কিন্তু সে হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করলো। বৃত্তর পানে চাইলো সে। বৃত্ত তখন বিন্দুর এমন চটে যাওয়া মেজাজ দেখে হাসি থামাতে ব্যস্ত। বিন্দুর এরূপ লুচির মতো ফুলে যাওয়া রূপ ভীষণ উপভোগ করছে সে।

অনেকক্ষণ যাবত ধৈর্য্য ধরে বসে ছিলো বিন্দু। কিন্তু এবার আর পারলো না। টেবিলের উপর এক হাত মুঠো করে রাখলো। বৃত্ত’র দৃষ্টি বরাবর চেয়ে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” দেখুন, একটা কথা ক্লিয়ার করে দেই। আপনি সিনিয়র বলে এই ভাববেন না যে আপনার সব কথা আমাকে শুনতে হবে। বলতে খারাপ শোনালেও বলছি, এসব ছ্যাচড়ামি আমার পছন্দ না। আর আজ আপনার কারণে ক্যান্টিনের প্রায় অনেকেই গুনগুন করছে আমাদের নিয়ে। আপনার কারণে যদি আমার চরিত্র নিয়ে কোনো কথা উঠে আমি তা সহ্য করবো না৷ এতদিন আপনি ছিলেন না, আমার লাইফ অনেক স্মুথলি কেটেছে। আমি চাই না আমার লাইফে আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি হোক। কোনো খারাপ কথা বলে থাকলে এখনই সরি বলছি। কিন্তু প্লিজ, আমার সাথে আর কথা বলতে আসবেন না। লোকে আমাকে নিয়ে আলোচনা করুক এটা আমি চাই না।”
বলেই সে উঠে চলে গেলো। তার এসব কথা যে বৃত্তর উপর কোনো প্রভাব ফেললো তা নয়। বরং বৃত্ত নিজের সিদ্ধান্তকে আরোও অটল করলো। সে অস্বীকার করবে না, বিন্দুর প্রতি তার আগ্রহ দিনকে দিন বাড়ছে বৈ কমছে না৷ কিন্তু বিন্দুর প্রতিক্রিয়া যে বদলাচ্ছে না!

———-

দুদিন পরীক্ষার নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলো বিন্দু। ফলে বাড়িতে যোগাযোগ করা হয়ে উঠেনি। ভেবেছিলো আজ রাতে খাবার পর খালাকে ফোন দিবে। কিন্তু রাত দশটার পর বাসা থেকে ফোন এলো বিন্দুর ফোনে। সে হাসিখুশি মেজাজ নিয়ে ফোন রিসিভ করলে ওপাশ থেকে তামিম ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো,
” আপু, আব্বু স্ট্রোক করেছে। তুমি দ্রুত সদর হাসপাতালে চলে আসো। আমি আর আম্মু আব্বুকে নিয়ে যাচ্ছি। ”

অকস্মাৎ এমন সংবাদ শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না বিন্দু। কিছুক্ষণের জন্য বোধ হলো তার কান দুটো ঝিম ধরে আছে। শরীরটা একদম স্থির হয়ে আছে। সংবাদটা মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াকরণ হতে সময় নিলো কিছুটা। তার গলাটা শুকিয়ে আসতে লাগলো। সেই সাথে বোধ হলো গলায় শক্ত দলার ন্যায় কিছু আটকে আসছে।
বিন্দু নিজেকে সচল করলো। হালকা কেশে তামিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” ভাই কোথায়? তুই আর খালা একা নিয়ে যাচ্ছিস? ”

তামিম বললো,
” ভাইয়া গতকাল রাতে মিটিং এর জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছে। ”

” জানিয়েছিস ভাইকে?”

” এখনও জানাইনি। হসপিটালে গিয়ে আব্বুকে ভর্তি করিয়ে জানাবো। এখন ভাইয়াকে জানিয়েও লাভ নেই। তুমি দ্রুত আসো আপু। ”
বলেই তামিম কল কেটে দিলো। সে কল কেটে দিতেই বিন্দু ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। অকস্মাৎ কান্না আরম্ভ করলো। বাবাতূল্য খালুর এহেন অবস্থা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। খালার পর খালুকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে,সম্মান করে। ছোট বেলায় খালা যখন তাকে বকতো তখন খালু এসে তাকে আদর করতো। কোলে নিয়ে মুদি দোকানে গিয়ে যা মন চায় কিনে দিতো। ভীষণ স্নেহ করতো তাকে। আর আজ সেই প্রিয় মানুষটা এহেন অবস্থা মেনে নিতে পারছে না বিন্দু।

বিন্দুর কান্না দেখে রুমে অবস্থিত কয়েকটি মেয়ে এগিয়ে এলো তার দিকে। একজন জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। বিন্দু কান্না করতে করতে জবাব দিলো, তার খালু স্ট্রোক করেছে। সদর হাসপাতালে যাচ্ছে। এ সংবাদ শুনে মেয়েগুলো স্বান্তনা দিলো বিন্দুকে। বিন্দু মিনিট পাঁচেকের মতো ওভাবে বসেই কান্না করলো। অতঃপর উঠে চোখের জল মুছে দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। একাই হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো সে। মারিয়া হোস্টেলে নেই আজ। তার পাশের বাড়ির এক চাচার কুলখানি বলে পরীক্ষা শেষ করেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ফলস্বরূপ বিন্দুকে এই রাত দশটার সময়েও একা বের হতে হলো।

হোস্টেলের নিচে এসে মূল দরজা দিয়ে বের হতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। এত রাতে গার্ড কিছুতেই একা বের হতে দিবে না বিন্দুকে। এদিকে বিন্দুও তার কথার দ্বারা রাজি করাতে পারছে না গার্ডকে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে সে গার্ডের সাথে তামিমকে কথা বলালো। অতঃপর গার্ড তাকে বের হতে দিলো। কিন্তু পাছে বলে রাখলো, কোনো বিপদে পড়লে গার্ড বা ভার্সিটির কেউ দায়ী থাকবে না। বিন্দু সেসবের তোয়াক্কা করলো না৷ খানিকটা ভয়, খানিকটা দুশ্চিন্তা ও বুকে সাহস নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ক্যাম্পাস থেকে।

ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়া মাত্রই কোনো প্রকার আমন্ত্রণপত্র ব্যতিত অকস্মাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। একে তো বিপদ, তার উপর প্রকৃতির এ অকস্মাৎ রূপ বদলে দিশেহারা হয়ে পড়লো বিন্দু। উপরন্তু একটা রিকশা বা অটোও পাওয়া যাচ্ছে না এ রাস্তায়। ফলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই রাস্তা ধরে সোজা পথে এগুলো বিন্দু। এই আশায় যে হয়তো সামনে কোনো যানবাহন পাওয়া যাবে। কিন্তু তার এ আশাকে ধূলিসাৎ করে পূর্বের চেয়েও বেশি গতিতে বৃষ্টি নামতে লাগলো।
বিন্দু বারবার দোয়া ইউনুস পড়ছে। আশেপাশে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। এত রাতে এই বৃষ্টির মাঝে মাঝ রাস্তায় হাঁটতে ভীষণ ভয় করছে তার। ওদিকে খালুর অবস্থা জানার জন্য যে ব্যাগ থেকে ফোন বের করবে তারও উপায় নেই।

হাঁটতে হাঁটতে একটা বন্ধ টং দোকানের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো বিন্দু। সেখানে আশ্রয় নিলো সে। এতক্ষণে বৃষ্টির তীব্র ছটা হতে খানিকটা রেহায় পেলো সে। এই ঝমঝম বৃষ্টি ভীষণ পছন্দের তার। কিন্তু পরিস্থিতির কবলে পড়ে ভীষণ পছন্দের এই বৃষ্টিকেও আজ অভিশাপের ন্যায় লাগছে।

বৃষ্টিতে ভেজার ফলে শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে বিন্দু। কিন্তু সে কাঁপুনিকে তোয়াক্কা না করে তার অসহায় দৃষ্টিজোড়া যানবাহন খুঁজতে ব্যস্ত হলো। কিন্তু হায় আফসোস একটা খালি রিকশা বা অটোর ব্যবস্থা হলো না। তীব্র অসহায়ত্বের মুখে পড়ে বিন্দু মনে মনে বললো,
” আল্লাহ! আমাকে এতোটা অসহায় কেনো বানালে আজ? সব বিপদ কি একসাথে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো? কি কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছো আমার! একটু সাহায্য করো আল্লাহ তায়ালা।”

বিন্দু কাঁদছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। এরই মাঝে আবছা দৃষ্টিতে সে দেখলো টং দোকানের সম্মুখে একটি সাদা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে কেউ বের হলো না ঠিক। তবে ড্রাইভিং সিটের জানালা খুলে নিজের মুখখানা বের করলো গাড়ির মালিক নিজে। আর এ গাড়ির মালিক আর কেউ নয় বরং আশরাফ। আশরাফ বিন্দুকে চিনলেও, বিন্দু আশরাফকে চিনতে পারলো না। তবে নিজের ভেজা শরীরের উপর ক্ষণিকের মধ্যে আশরাফের স্থাপন করা লোলুপ দৃষ্টিজোড়া ঠিকই চিনতে পেলো বিন্দু।

আশরাফ বিন্দুর শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” লিফট লাগবে বিন্দু? তুমি চাইলে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি আমি। ”

আশরাফের দৃষ্টিজোড়ায় ভীষণ অস্বস্তি বোধ করলো বিন্দু। হাত দিয়ে শরীর হতে ভেজা জামা ঢিল করার বৃথা চেষ্টা করলো সে। আশরাফের উদ্দেশ্যে বললো,
” কোনো প্রয়োজন নেই এসবের। আপনি নিজের কাজে যেতে পারেন। ”

আশরাফ বাঁকা হাসলো। বললো,
” টেনশন করো না। তুমি আমার জুনিয়র। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি বোধহয়। কিন্তু আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।
এত বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি পাওয়া বেশ কষ্টকর। তুমি আমার গাড়িতে উঠে বসো। আমি পৌঁছে দিয়ে আসি তোমাকে। ”

আশরাফের কথায় চমকে উঠলো বিন্দু। কেননা আশরাফ যে তারই ক্যাম্পাসের সিনিয়র এ বিষয়টি হতে অনবগত ছিলো সে। ক্ষণিকের জন্য তার মস্তিষ্কে একটি প্রশ্ন ঘুরলো,
” এই বিপদের সময় কি উনার কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া উচিত হবে?”

#চলবে