সে আমার অপরাজিতা পর্ব-১৮

0
133

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১৮
#সারা মেহেক

ঘনঘোর বর্ষণে ছেয়ে আছে প্রকৃতি। আকাশের রঙ ক্রমান্বয়ে গাঢ় হচ্ছে। সে জানান দিচ্ছে, প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নামতে চলেছে। আশেপাশে থেমে থেমে মৃদু হতে ভারী বজ্রপাত হচ্ছে। প্রকৃতির এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির কবলে পরেছে বৃত্ত ও বিন্দু। বৃত্ত খানিকটা ভয় হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিন্দুকে কিভাবে বাড়ি অব্দি নিয়ে যাবে তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সে। বিন্দুকে বেশ ক’বার বলার পর শেষমেশ নির্বাক্যে শান্ত হয়ে গাড়িতে উঠে বসে সে। বিন্দু বসার পরপরই বৃত্ত গাড়িতে স্টার্ট দেয়। এখন আর দেরি করা যাবে না। মারিয়ার বলে দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী ম্যাপ দেখে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করলো বৃত্ত৷ ভারী বর্ষণ ও পিচ্ছিল রাস্তার কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে সে।

বিন্দু নীরবে সিটে বসে আছে। তার জবান হতে টু শব্দটুকু পর্যন্ত বের হচ্ছে না। দু নয়নজোড়া অশ্রুর নোনাজলের ফলে শুষ্ক হয়ে আছে। ভেজা সালোয়ার কামিজ হিজাব শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। বৃত্ত যে বিন্দুর শরীরের উপর কোনো কাপড় দিবে সেটাও আজ কাছে নেই। আফসোস হচ্ছে ভীষণ।

বাড়িতে মুরুব্বিরা জড়ো হয়েছেন। তারা প্রায় সকলে আহসান সাহেব বা বিন্দুর বাবার পরিচিত। সকলে দোয়া মাহফিলের জন্য সুফিয়া বেগমের অনুরোধে এই সন্ধ্যেবেলা জড়ো হয়েছে। নতুন দালানঘরের ড্রইংরুমে সকলে গোল হয়ে বসে আছেন। তারা জুবায়ের ও তামিমের অপেক্ষায় আছেন। দুজনে বাজারে গিয়েছে জিলাপি ও মিষ্টি আনতে। আহসান সাহেবকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। স্ট্রোকের ফলে যে বাম পাশ প্যারালাইস হয়ে গিয়েছিলো, সে পাশেই কাত হয়ে বসে আছেন তিনি।
এমতাবস্থায় বাড়ির প্রধান দরজা দিয়ে বিন্দুকে নিয়ে প্রবেশ করলো বৃত্ত। কিন্তু ড্রইংরুম দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করার পূর্বেই তাদের দুজনকে দ্রুত মুরুব্বিদের চোখের আড়াল করলো জুবায়ের। ভীত ও সতর্ক কণ্ঠে বৃত্তকে বললো,
” এ কি বিপদ ঘটাতে যাচ্ছিলে বৃত্ত! এভাবে বিন্দুকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে এলাকার মানুষজন ভালো ভাববে না। বাড়িতে প্রবেশের আরেকটা গেট আছে। ওদিক দিয়ে চলো।”
বলেই সে বিন্দুর হাত ধরে এগিয়ে গেলো। পিছে পিছে এলো বৃত্ত।
জুবায়ের বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে উচ্চস্বরে সুফিয়া বেগমকে ডাকলো,
” আম্মা! কোথায় তুমি? জলদি একটা টাওয়াল নিয়ে আসো।”

সুফিয়া বেগম ঘরের জানালা দিয়ে জুবায়ের,বিন্দু ও বৃত্তকে দেখলেন। বিন্দুকে এহেন অবস্থায় দেখে সুফিয়া বেগম দ্রুত তোয়ালে নিয়ে বাইরে এলেন। কোনোরূপ জিজ্ঞাসা ব্যতিত বিন্দুকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। ঘরে প্রবেশ মাত্রই ক্রন্দনরত উদ্বিগ্ন স্বরে বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এ কি অবস্থা তোর বিন্দু? এভাবে ভিজে এসেছিস কেনো? আর তোর ফোন বন্ধ কেনো? কখন থেকে ফোন করছি! চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। ”

সুফিয়া বেগমের প্রশ্নের জবাব দিলো না বিন্দু। নিষ্প্রাণ নিষ্প্রভ মুখাবয়ব নিয়ে রইলো সে। তার দৃষ্টিতে শুষ্কতা, তার জবানে শুষ্কতা ঠাঁই পেয়েছে। মেয়ের এ অবস্থা দেখে নীরবে অশ্রু নিপাত করতে লাগলেন সুফিয়া বেগম।

সুফিয়া বেগম বিন্দুকে ঘরে নেওয়া মাত্রই জুবায়ের বৃত্তকে নিজের রুমে নিয়ে তার জন্য একটা তোয়ালে আর শুকনো পাঞ্জাবি পায়জামা আনলো। বৃত্ত’র দিকে এগুলো এগিয়ে বললো,
” বৃত্ত,দ্রুত ভেজা কাপড় বদলে নাও। জ্বর আসতে পারে। আর কাপড় বদলে এ দিক দিয়েই ড্রইংরুমে চলে এসো। খালুর, মানে বিন্দুর বাবার প্রথম মৃ’ ত্যু’ বার্ষিকী আজ। এজন্য সামান্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। রেডি হয়ে চলে এসো। ”
বলেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো জুবায়ের। সে চলে যেতেই বৃত্ত ওয়াশরুমে গিয়ে ভেজা পাঞ্জাবি পায়জামা বদলে একটা সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে নিলো। জুবায়েরের রুমের আয়নায় ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে অগোছালো করে কপালের এপাশ ওপাশে মেলে রাখলো। এভাবে রুম থেকে বের হওয়া মাত্র সুফিয়া বেগমের সহিত সাক্ষাৎ হলো তার। তাঁকে দেখেই বৃত্ত নিজের উদ্বিগ্নতা লুকিয়ে শুধালো,
” বিন্দুর কি অবস্থা আন্টি? ”

সুফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বললেন,
” মেয়েটা কথা বলছে না। একদম চুপচাপ আছে। তাই ওকে শুইয়ে দিয়ে এসেছি। এখন একটু ঘুমিয়ে পড়লে ভালো। তাহলে হয়তো একটু সুস্থ হতে পারে। ”

বৃত্ত’র অবাধ্য মন চাইলো, একবার সরাসরি গিয়ে বিন্দুকে দেখে আসতে। কিন্তু এ বাড়িতে যে এভাবে বিন্দুকে দেখা নিষিদ্ধ এক কার্য তার নিকট! তাই সে বললো,
” আচ্ছা আন্টি। ও ঘুমাক। আমি গিয়ে ড্রইংরুমে বসি। ”

” আচ্ছা বাবা। তোমার আংকেলের আশেপাশে বসো। যদিও জুবায়ের বা তামিম হয়তো বসে থাকতে পারে। তারপরও তুমি আশেপাশে থেকো।”

বৃত্ত সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
” আচ্ছা আন্টি।”

দোয়া মিলাদের কার্যক্রম শেষে সুফিয়া বেগম ও জুবায়েরের জোরাজোরিতে রাতের খাবারের অব্দি বাড়িতে থেকে গেলো বৃত্ত। তার সাথে পরিচিত কয়েকজন মুরুব্বিও রয়ে গেলো রাতের খাবারের জন্য। এ মুরুব্বিদের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়লো জুবায়ের ও তামিমের উপর। ফলস্বরূপ টুকটাক কথা বলার জন্য কাউকে না পেয়ে সুফিয়া বেগমের শরণাপন্ন হলো বৃত্ত। সুফিয়া বেগম রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। অকস্মাৎ বৃত্তকে সেখানে দেখে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিছু লাগবে বাবা? আমি দিয়ে আসছি। তুমি ভিতরে গিয়ে বসো।”

বৃত্ত মৃদু হাসি সহিত বললো,
” না আন্টি, কিছুই লাগবে না। আপনার সাথে গল্প করার জন্য এলাম। ”

সুফিয়া বেগম হাসলেন। বললেন,
” এই বুড়ো মানুষের সাথে গল্প করবে!”

” কে বলেছে আপনি বুড়ো! এখনও যথেষ্ট সুন্দরী আপনি।”

” হাসালে আমাকে।”

এভাবে দুজনের টুকটাক কথা এগুচ্ছিলে। কথার মাঝে বৃত্ত’র কৌতূহলী মন বিন্দুর বাবার সম্পর্কে সকল জিজ্ঞাসার জন্য তৎপর হলো। সে কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করে বসলো,
” আন্টি, বিন্দুর বাবার মা’ র্ডা’ র হয়েছে তাই না?”

চমকে উঠলেন সুফিয়া বেগম। প্রায় আতঙ্কিত চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” এ কথা তোমাকে কে বলেছে বাবা?”

” বিন্দুর মুখেই শুনেছি। ”

এবার খানিকটা আতঙ্ক কমলো সুফিয়া বেগমের। ঈষৎ স্বাভাবিক হয়ে তরকারিতে জ্বাল দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি বলেছে ও তোমাকে?”

” বেশি কিছু না। বলেছিলো, ওর বাবাকে কেউ মে’ রে ফেলেছে। খুব খারাপভাবে মে’ রে’ ছে শুনলাম। কিন্তু কারা মেরেছে ওর বাবাকে?”

সুফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে আরম্ভ করলেন,
” বিন্দুদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ির মধ্যে বেশি দুরত্ব নেই। এখান থেকে ভ্যানে চড়ে যেতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগবে। কাছাকাছিই থাকতাম আমরা। মেয়েটা ছোট থেকেই এ বাড়ি থেকে ঐ বাড়িতে ছোটাছুটি করতো। ভীষণ চঞ্চল ছিলো। বিন্দুর বাবা এখানকার প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলো। ভীষণ নরম ও শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলো ওর বাবা। বিন্দুর বাবা ওকে চোখে হারাতো। আর বাবার প্রতিও বিন্দুর ভালোবাসা ছিলো দেখার মতো। কিন্তু দুজনের এ ভালোবাসায় বোধহয় কারোর নজর লেগেছিলো। এক বছর আগে বিন্দুর বাবা স্কুলের কাজ শেষে ফেরার পথে স’ ন্ত্রা’ সী’ রা এতোটা খারাপভাবে ছু’ রি দিয়ে আ’ ঘা’ ত করে যে হাসপাতালে নিতে নিতেই ওর বাবা মা’ রা যায়। পরে এটা পুলিশি কেস হয়। হাসপাতাল থেকে ওর বাবার লা’ শ সরাসরি ম’ র্গে চলে যায়। বিন্দু কাঁদতে কাঁদতে পুলিশকে অনেকবার বলেছিলো যেনো এসব কাঁ’ টা’ ছে’ ড়া তার বাবার উপর করা না হয়। কিন্তু পুলিশরা আইনি অযুহাত দেখিয়ে ঠিকই তাদের কাজ করলো। অথচ আজ পর্যন্ত আমরা কোনো ন্যায়বিচার পেলাম না৷ আজও জানলাম না বিন্দুর বাবার আসল খুনি কে।”

” পুলিশরা কি কেসটা নিয়ে আর ইনভেস্টিগেশন করেনি? ”

” না বাবা। হঠাৎ তারা কেসটা থামিয়ে দেয় মাঝপথে। আমরা এক দুবার বলেছিলাম কেসটা আবারো চালু করতে। কিন্তু পুলিশ সে কথা আমলে নেয়নি। আর বিন্দুও চায়নি এতোটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে। ”

” তাহলে বিন্দুর বাবার মৃ’ ত্যুর আসল কারণটা কি? এভাবে দিনে দুপুরে অজ্ঞাত মানুষের উপর নিশ্চয়ই স’ ন্ত্রা’ সী হা’ ম’ লা হয় না!”

” ওদের এলাকার লোকজনরা সন্দেহ করেছিলো এটা সাধারণ কোনো স’ ন্ত্রা’ সী হা’ ম’ লা না। ওর বাবাকে অন্য কেউ খু’ ন করেছে। এটাও শুনেছি জমিজমা নিয়ে বোধহয় কোনো ঝামেলা চলছিলো বিন্দুর বাবার। কিন্তু এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।”

বৃত্ত’র কণ্ঠে এবার অনুসন্ধিৎসার আভাস পাওয়া গেলো,
” এর মানে এই দাঁড়ালো যে, বিন্দুর বাবার খু’ নে’ র আসল কারণ আর আসল খু’ নি কে তা এখনও জানা যায়নি।”

” হ্যাঁ।”

বৃত্ত এর প্রত্যুত্তর করলো না। তবে খানিক সময় বাদে হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা আন্টি, বিন্দুর মা কোথায়? মানে ওর মা কি আদৌ বেঁচে আছে বা অন্যকিছু? আসলে ওর মা সম্পর্কে এ পর্যন্ত কিছুই শুনিনি আমি।”

বিন্দুর মায়ের কথা শুনে সুফিয়া বেগমের চাহনি পরিবর্তিত হলো। তিনি বৃত্ত’র নিকট হতে দৃষ্টি লুকিয়ে বেশ কৌশলে কথা ঘুরিয়ে বললেন,
” আরে, দেখেছো তো, রান্নাটা আমরা পুড়ে যাচ্ছে। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে খেয়ালই করিনি আমি। শোনো বাবা, একটা কাজ দিবো। করতে পারবে। কিছু মনে করো না।”

বৃত্ত সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রতাসূচক মিষ্টভাষী হয়ে বললো,
” আরে না আন্টি। কোনো সমস্যা নেই। কি করতে হবে বলুন।”

” একটু কষ্ট করে টিউবওয়েল থেকে এক কলস পানি এনে দিবে? এখানে পানি শেষ হয়ে গিয়েছে।”

” আচ্ছা আন্টি এনে দিচ্ছি। ”
বলেই বৃত্ত কলস নিয়ে টিউবওয়েলে চলে গেলো। তার এ প্রস্থান মাত্রই সুফিয়া বেগম হাফ ছেড়ে বাঁচলেন যেনো।

———–

রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো বিন্দুর। সুফিয়া বেগম মাঝরাতে বিন্দুকে দেখতে এসে দেখলেন জ্বরে তার সমস্ত শরীর পুড়ে যাচ্ছে যেনো। জ্বর দেখে পরে বিন্দুকে উঠিয়ে জোর করে ওষুধ খাওয়ালেন তিনি। সারা রাত বিন্দুকে দেখার জন্য পরে বিন্দুর পাশেই শুয়ে পড়লেন তিনি। আর আহসান সাহেবের পাশে রেখে এলেন জুবায়েরকে।

মাঝ রাত,
বিন্দু তার বাবাকে দেখছে। একদম সুস্থ সবল তার বাবা। হাস্যজ্জ্বল মুখাবয়ব। হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে। বিন্দু তার বাবার হাত ধরার জন্য ছুটছে। কিন্তু ধরতে পারছে। যতই ধরার চেষ্টা করছে ততোটাই দূরে চলে যাচ্ছে তার বাবা। এক পর্যায়ে ভয়ে সে ‘বাবা’ বলে চিৎকার দিলো। অমনিই কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই একটা ট্রাক এসে তার বাবাকে উড়িয়ে দিয়ে গেলো। সাথে সাথে পিছন থেকে তাকে আঁকড়ে ধরলো কেউ। ফিরে দেখলো বৃত্ত দাঁড়িয়ে আছে। বৃত্তকে দেখে বিন্দু কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
” বাবা! বাবাকে কেউ মে’ রে ফেলেছে।”

বৃত্ত বিন্দুর মাথা নিজের বুকে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
” ওদিকে তাকিয়ো না। ওদিকে তাকাতে হবে না।”

কিন্তু বিন্দু শুনতে পেলো তার বাবা চিৎকার করে তাকে ডাকছে। বলছে ‘বাঁচা, বাঁচা আমাকে, বিন্দু!”

বাবা বলে ডাকতে ডাকতে তীব্র আতঙ্কে ঘুম থেকে জেগে উঠলো বিন্দু। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে সে। গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। তার এ আতঙ্কিত স্বরে জেগে উঠলেন খোদ সুফিয়া বেগমও। বিন্দুকে এহেন অবস্থায় দেখে তিনি বুঝলেন, বিন্দু খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। তাই দ্রুত বিন্দুকে ধাতস্থ করতে জড়িয়ে ধরলেন বিন্দুকে।
বিন্দু এখনও হাঁপাচ্ছে। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। চোখের সম্মুখে ভাসছে কিছুক্ষণ পূর্বে দেখা স্বপ্নটা। সে স্বপ্নে তার বাবাকে দেখে যতোটা না অবাক হয়েছে এর চেয়ে দ্বিগুণ অবাক হয়েছে স্বপ্নে বৃত্তকে দেখে। সে ভেবে পেলো না, স্বপ্নে বৃত্ত এলো কি করে!
.
প্রায় তিনদিন খালার বাড়িতেই থাকলো বিন্দু। জ্বর পুরোপুরি সেরে যাওয়ার পর হোস্টেলে এলো সে। যে ক’দিন তার জ্বর ছিলো, প্রতিদিন বৃত্ত হয় নিজে বিন্দুকে ফোন দিয়ে তার শারীরিক অবস্থা জেনেছে। নাহয় মারিয়ার মাধ্যমে বিন্দুর খোঁজ নিয়েছে। প্রত্যহ দুবেলা করে বিন্দুর খোঁজ নেওয়া যেনো বিন্দুর জন্য এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছিলো।

—————–

তিনদিন পর খালার বাসা হতে ফেরার চতুর্থ দিনে বিন্দু পুনরায় ক্লাসে যাওয়া আরম্ভ করলো। পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে শুরু করলো সে। এ সময়ে মারিয়া তার পাশে থেকে সবসময় তাকে সাহস জুগিয়েছে। বৃত্ত সরাসরি দেখা না করেও দূর থেকে বিন্দুকে মানসিক ভাবে সামলিয়েছে। বিন্দুর মন অন্যদিকে ভুলানোর চেষ্টা করেছে। শেষ অব্দি বৃত্ত ও মারিয়ার সম্মিলিত চেষ্টায় বিন্দু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এ ক’দিনে বৃত্ত’র ব্যবহারে তার অবদান মানতে বাধ্য হয়েছে বিন্দু। তার মনের অজান্তেই বৃত্ত নিজের জন্য একটুখানি জায়গাও দখল করে নিয়েছে বোধহয়!

আজ ক্যাম্পাসে বৃত্তদের দলের পক্ষ হতে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। আজকের সমাবেশ ও আলোচনা সভার বিষয়বস্তু ‘ক্যাম্পাসে সকল রাজনৈতিক দলের স্থিতিশীল আচরণ ও নতুনদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরী করা।”
দলনেতা হিসেবে বৃত্ত মঞ্চে উঠে ভাষণ দিচ্ছে। তার এ রাজনৈতিক মারপ্যাচের ভাষণও ভীষণ মনোযোগ সহকারে শুনছে ক্যাম্পাসের কতিপয় মেয়ে, যারা বৃত্ত’র নাম বলতেই অজ্ঞান হয়। অথচ ভাষণের সারমর্ম, বিষয়বস্তু ঠিকঠাক মাথায় ঢুকছে না তাদের। কিন্তু বৃত্ত’র কথা বলার সেই গাম্ভীর্যপূর্ন ভঙ্গি, দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, বড় বড় নেতাদের মতো হাত নাড়ানো সবটাই উপভোগ করছে মেয়েগুলো। বৃত্ত’র পরনে আজ কুচকুচে কালো রঙের এক পাঞ্জাবি আছে। তার শ্বেত কাঞ্চনের ন্যায় গৌরবর্ণের শরীরে কালো রঙটা চোখের পড়ার মতো ফুটে উঠেছে। তীব্র গরমে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তার এ রুপেই ফের কাত হয়েছে উপস্থিত কয়েকটা মেয়ে।
মেয়েগুলো সমাবেশের শামিয়ানার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরই পাশ দিয়ে যেতে যেতে মারিয়ার চোখে পড়লো বৃত্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছে। বৃত্তকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে বিন্দু থামিয়ে উৎসুক কণ্ঠে বললো,
” ঐ দেখ, তোর নেতা সাহেব মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছে।”

মারিয়ার কথায় তৎক্ষনাৎ থমকে দাঁড়ালো বিন্দু। দৃষ্টি রাখলো মঞ্চের উপর। এখানে দাঁড়িয়ে বৃত্তকে স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে। বিন্দু কিছু সময় আনমনে নিষ্পলক চেয়ে রইলো বৃত্ত’র পানে। বৃত্ত যে তাকে মুগ্ধ করছে এ নিয়ে সে অজ্ঞাত।
বৃত্তর পানে চেয়ে থাকতে থাকতে অকস্মাৎ মারিয়ার একটি কথা বিন্দুর কানে বাড়ি খেলো,
” কথা বলার ধরণ দেখেই বুঝা যায়, রাজনীতিতে ভবিষ্যত নেতা হবে বৃত্ত ভাইয়া।”

বিন্দু তৎক্ষনাৎ যেনো বাস্তবে ফিরে এলো। সকল চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে মারিয়ার হাত ধরে বললো,
” চল তো এখান থেকে। এসব ভাষণ, রাজনীতি দেখলে মেজাজ গরম হয়ে যায়। সহ্য করতে পারি না এসব।”
®সারা মেহেক

#চলবে