সে আমার অপরাজিতা পর্ব-২৪

0
120

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_২৪
#সারা মেহেক

বিন্দু এখনও স্তম্ভিত চাহনিতে চেয়ে আছে। এসব ঘটনার পিছনের কারণ এখনও তার অজানা। মহিলাগুলোর অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারের কারণও তার অজানা। সে তো খারাপ কিছু করেনি। তাহলে এসব বলছে কেনো তারা!
বিন্দু জোর গলায় বললো,
” সমস্যা কি আপনাদের? এমন বাজে আচরণ করছেন কেনো!”

তন্মধ্যে একটি মহিলা তেরছা সুরে বললো,
” মাইয়ার গলার জোর দেখছো? পরপুরুষের লগে শুইয়া আইসা কেমনে কথা বলতাছে!”
বলেই মহিলাটি বিন্দুর ঠিক পাশেই ইচ্ছাকৃতভাবে থু থু ফেললো। বিন্দু মহিলাটির এমন আচরণে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এ কি শুনছে সে! তার চরিত্রের উপর সরাসরি দাগ লাগিয়ে দিচ্ছে অপরিচিত কিছু মহিলা!
বিন্দু আকাশসম বিস্ময় নিয়ে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” এসব কি বলছেন আপনারা! মুখের ভাষা ঠিক করুন।”
বলেই সে বৃত্ত’র পানে চাইলো। বৃত্ত তৎক্ষনাৎ বললো,
” ওসব কথায় কান দিও না বিন্দু। আজেবাজে বকছে ওরা।”

বৃত্ত’র এ কথা বলতে দেরি। কিন্তু লোকগুলোর আক্রমণ করতে দেরি হলো না। একটি লোক বৃত্ত’র ঠিক হাঁটুর উপর লাঠি দিয়ে বাড়ি দিলো। ব্যাথায় তৎক্ষনাৎ দু হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো সে। তার এহেন করুণ পরিণতি দেখে বিন্দু দৌড়ে বৃত্ত’র নিকট যেতে নিলো। কিন্তু মহিলাগুলো এবার বিন্দুকেও ধরে ফেললো। বললো,
” নাগররে মারছে দেখে ব্যাথা লাগতেছে তাই না?”

বিন্দু তাদের কথা কানে তুললো না। বৃত্তকে দেখে তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। সে বৃত্তর এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছে না। বোধ হচ্ছে এখনও সে কোনো বিভ্রমে আছে। তার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ো আসছে।
এদিকে বৃত্তকে একবার আঘাত করার পর বৃত্ত শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তন্মধ্যে একটি লোককে সোজা নাক বরাবর ঘু’ষি মা’র’লো। তার আক্রমণাত্মক আচরণে লোকগুলো আরোও হিংস্র হয়ে উঠলো। নিজেদের লাঠিসোটা নিয়ে পুনরায় বৃত্ত’কে মারতে প্রস্তুত হলো। কিন্তু গরম পরিবেশকে আচমকা বদলে দিয়ে সে রাস্তায় বাদলের গাড়ি প্রবেশ করলো। গাড়ি থেকে নেমেই সে সোজা বৃত্ত’র দিকে দৌড়ে গেলো। আগেপিছে না ভেবে তার সামনের লোকটিকে অকস্মাৎ ঘু’ষি মা’র’লো। বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় বাদলের উপস্থিতি দেখে সকলে ভীমড়ি খেলো। তবে বৃত্ত’র ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো হাসি।
একটি লোক লাঠি উঠিয়ে বাদলকে মা’র’তে উদ্যত হলো। কিন্তু মুহূর্তেই বাদল তার প্যান্টের পিছন থেকে পি’ স্ত’ ল বের করে লোকগুলোর দিকে তাক করলো। সাথে সাথেই লোকগুলো ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। মহিলাগুলোও ওপাশ থেকে বিন্দুকে ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পড়লো।

বাদল হিংস্র কণ্ঠে বললো,
” নিজের জায়গা থেকে এক কদম কেউ নড়েছিস তো এই গু’লি সোজা বুকে গিয়ে বিঁধবে।
তোদের সাহস কি করে হয় বৃত্ত হোসাইনের গায়ে হাত তোলার? জানিস বৃত্ত হোসাইনের পরিচয়?”

তন্মধ্যে অপেক্ষাকৃত সাহসী লোকটি এক কদম এগিয়ে এসে আমতাআমতা করে বললো,
” মেয়রের পোলারে কে না চিনবো! কিন্তু হেতে কি করছে হেইডা তো জানেন না মনে হয়!”

বাদল বললো,
” কে কি করেছে তার উপর বিবেচনা করে তোরা গায়ে হাত তুলবি! বয়সে তোরা আমার বড়। কিন্তু তোদের সম্মান করতেও ঘৃণা করছে!”

” আমাগোর ঘিন্না না কইরা আপনের ভাইরে ঘিন্না করেন। ঐ মাইডারে নিয়া কি করছে জানেন? স্বামী ইস্তির মতো চলেফেরে৷ আপনাগো দেইখা আমাগোর মাইয়া পোলা কি শিখবো! নোংরামি বাদে তো কিছুই শিখবো না।”

বাদল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” তোদের ছেলেমেয়ে কি ফিডার খাওয়া বাচ্চা যে অন্যজনের কাজ দেখে নিজেরাও সে কাজ করবে? শিক্ষা দিতে পারিসনি নিজের ছেলেমেয়েদের? কোনটা ভালো কাজ আর কোনটা খারাপ?”
বলেই সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিন্দুর পানে চাইলো। পুনরায় বললো,
” তোদের জন্য কি মানুষ বিয়ে করা বউকে নিয়েও কোথাও যেতে পারবে না! এখানে কি তোদের মতামত নেওয়া লাগবে?”

বাদলের কথা শুনে বিস্মিত হলো উপস্থিত প্রতিটি লোক। তবে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলো বিন্দু। ‘বিয়ে’ ও ‘বউ’ শব্দ দুটো শুনে সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এসব কি বলছে বাদল! আশ্চর্য, এ পর্যন্ত কি কি ঘটছে তার কিছুই সে পুরোপুরি জানে না। অথচ তাকে ঘিরেই প্রতিটি ঘটনা ঘটছে!

সেই লোকটি জিজ্ঞেস করলো,
” হেরা যে স্বামী ইস্তির,প্রমাণ আছে কুনু?”

এবার বৃত্ত কাল বিলম্ব করলো না। বাদলের কাছ থেকে কাবিননামার কাগজ নিয়ে লোকটির মুখের সামনে ধরে বললো,
” আর কোনো প্রমাণ চাই?”

লোকটি ভারী বিস্ময় নিয়ে বৃত্ত’র হাত থেকে কাগজটা নিলো। বড় বড় চোখে পুরো কাগজে দৃষ্টি বুলালো। বিড়বিড় করে বললো,
” হেরা স্বামী ইস্তির ক্যামনে হইলো! ”

লোকটির ভীমড়ি খাওয়া চেহারা দেখে বৃত্তর ঠোঁটের কোনে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো। সে বললো,
” আর কোনো প্রমাণ চাই? আশা করি এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর লাগবে না।”

লোকটি দৃষ্টি তুললো। আমতাআমতা করে বললো,
” খবরে যে দেখছিলাম……”

বৃত্ত তৎক্ষণাৎ লোকটিকে থামিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” রেডি থাকিস। কাল সকালের আগেই সব ক’টা জেলের মধ্যে থাকবি।”
বলেই সে বিন্দুর দিকে এগিয়ে গেলো। নম্র সুরে বললো,
” বিন্দু, গাড়িতে বসো।”

বিন্দু যেনো এখনও এক ঘোরের মাঝে আছে৷ সে বুঝে উঠতে পারছে না আদতে এখানে হচ্ছে কি। সে সিক্ত নয়নে বৃত্তর পানে চাইলো। এই তো সেই ঘোরের ধোঁয়াশা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিটি তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই সে দেরি না করে তৎক্ষনাৎ শুধালো,
” এসব কি হচ্ছে? আমাকে বলুন প্লিজ।”

” তুমি গাড়িতে বসো। সবকিছু বলছি তোমাকে।”

বিন্দু নড়বড়ে পায়ে গাড়িতে বসলো। বৃত্ত গিয়ে বাদলকে বললো,
” বাদল, তুই এদিকটায় সামলে নিস। আমি বিন্দুকে হোস্টেলে রেখে আসি।”

” আচ্ছা ভাই। কিন্তু শোনো, বাবা কিন্তু সব জেনে গিয়েছে। ”

বৃত্ত চকিত গলায় বললো,
” কিহ! বাবা কিভাবে জানলো? কে জানিয়েছে?”

” তা জানি না ভাই। ভিডিও পাবলিশ হওয়ার দশ মিনিটের মাঝে আমি সরিয়ে দিয়েছি। বাবার দেখার কথা নয়। কারণ বাবা তখন পার্টির লোকেদের সাথে মিটিং এ ব্যস্ত ছিলো। আর অফিসের সবাইকে বলে দিয়েছি বাবার কানে যেনো এ সংবাদ না যায়৷ তবুও হয়তো কেউ জানিয়ে দিয়েছে। খুঁজে বের করতে হবে।
তুমি বিন্দুকে নিয়ে চলে যাও ভাই৷ আর বাবাকে কি বলে ম্যানেজ করবে চিন্তা করো। ”

বৃত্ত এবার দুশ্চিন্তায় পড়লো৷ ঠোঁট কামড়ে মনে মনে বললো,
” সব বিপদ এক দিয়ে কেনো আসলো! এখন কাকে রেখে কাকে সামলাবো!”
বলতে বলতে সে গাড়িতে গিয়ে বসলো। পাশে চেয়ে একবার বিন্দুকে দেখলো। বিন্দুর বিধ্বস্ত চেহারাখানা দেখে ভীষণ মায়া লাগছে। মেয়েটা এখনও জানে না তার জীবনের সাথে কি ঘটে গিয়েছে। জানলে বোধহয় এতোটা শান্ত থাকতে পারবে না!

বৃত্ত গাড়ি চালানো আরম্ভ করলো। কিছুদূর যাওয়ার পর বিন্দু ভার গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” এবার তো বলুন। কি হচ্ছে এসব! আমার আপনার বিয়ের কাগজ আসলো কোথা থেকে? আর মহিলাগুলো আমাকে এতো বাজে কথা কেনো বলছিলো?”

বৃত্ত শুকনো একটা ঢোক গিললো। কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললো,
” আসলে কেউ একজন তোমার আর আমার কিছু ভিডিও বিকৃত করে বের করেছে।”

বিন্দুর পা থেকে যেনো মাটি সরে গেলো। সে ভয়ার্ত গলায় বললো,
” এসব কি বলছেন আপনি! ”

বৃত্ত আর কথা বললো না। নিজের ফোন বের করে সেভ করা ভিডিওটা বিন্দুর দিকে এগিয়ে দিলো। ভিডিও চলছে। বিন্দু দেখলো, এটা সেদিনের ভিডিও যেদিন বৃত্ত তাকে নিয়ে তার খালুর জন্য হসপিটালে গিয়েছিলো। কেউ একজন বৃত্তর গাড়িতে উঠার সময় বিন্দুর ভিডিও করে। পরবর্তীতে দেখা যায় বৃত্ত ও বিন্দু সেদিন যে পোশাকে ছিলো সেই একই পোশাকে একটা ছেলে ও একটা মেয়ে একে অপরের হাত ধরে অপরিচিত এক হোটেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হোটেলটি শহরের এক ঘুপচি এলাকার মধ্যে। যে হোটেলটি নিয়ে প্রায়শই টুকটাক আলোচনা হয়। এর পরে দেখা যায় সেই মেয়েটি ও ছেলেটি একটি রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দেয়। এরপরই ভিডিওটি শেষ হয়।

বিন্দু হতভম্ব হয়ে এখনও স্ক্রিনের দিকে চেয়ে। তার বুঝতে সমস্যা হয়নি ভিডিওটি কি ইঙ্গিত দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। এখন সে মহিলাগুলোর বলা কথার মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম হয়েছে।
বিন্দুর নয়নজোড়া অশ্রুে টলমল করছে। মুহূর্তেই তার দু নয়ন বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে লাগলো। কানের আশেপাশে বারংবার সেই অশ্রাব্য গালিগুলো শুনতে লাগলো সে। এই ঘোরে থাকার ফলে সে বৃত্ত’র কথা শুনতে অক্ষম হলো।

বৃত্ত বললো,
” তুমি চিন্তা করো না বিন্দু। ভিডিওটা ছড়ায়নি। আর আমি খুঁজে বের করবো যে ভিডিওটা কে করেছে।
আর আমাদের কাবিননামা নিয়ে ভেবো না। ওটা নকল বানিয়েছি৷ যাস্ট এমন সিচুয়েশন থেকে রেহাই পেতে।”

বিন্দুর কর্ণকুহরে এ জগতের কোনো শব্দ প্রবেশ করছে না। তার দৃষ্টির সম্মুখে ভিডিওটা ভাসছে। কানে এসে বাড়ি খাচ্ছে মহিলাগুলোর বলা কথা।

——-

” কাজ হয়েছে?”
ওপাশ হতে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো। গ্রামের সেই লোকগুলো মাঝে একজন ফোনে আছে। সে বলল,
” স্যার, আপনি না কইছিলেন মেয়রের পোলা আর ঐ মাইয়া স্বামী ইস্তির না। ”

” হ্যাঁ বলেছিলাম। কেনো?”

” ঐ পোলায় দেহি বিয়ার কাজ নিয়া আইছে।”

ওপাশের লোকটি বিস্ময়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়লো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললো,
” কি বলো! বিয়ের কাগজ মানে!”

” জি স্যার। বিয়ার কাগজ দেহাইলো আমাগোর। হেরপর আমরা কিছু কইতে পারিনি। মাইডারে নিয়া চইলা গ্যাছে। কিন্তু যাইবার আগে ধমকাইয়া গ্যাছে। আমাগোর পুলিশে দিয়া দিবো। স্যার আমাগোর বাঁচান। আপনার কাম করতে গিয়া আমাগোর এই অবস্থা হইছে।”

ওপাশের লোকটি আর কথা বললো না। মুহূর্তেই কল কেটে দিলো।

#চলবে