সে আমার অপরাজিতা পর্ব-২৯

0
120

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_২৯
#সারা মেহেক

বিন্দু থমকে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার হাত আকস্মিক বিরতি নিলো। মস্তিষ্কে বৃত্তর কথাগুলো গভীর ছাপ ফেললো। ক্ষণিক সময় নিলো কথাগুলোর অর্থ পুনরুদ্ধার করতে। অতঃপর যখন সে বুঝলো তখন বিস্মিত কণ্ঠে শুধালো,
” আমার জন্য আপনার এ অবস্থা বৃত্ত! ”

বৃত্ত কিছু বললো না৷ নির্বাক চেয়ে রইলো বিন্দুর ঐ কোমল আঁখিজোড়ার পানে। অশ্রু কণা ছলছল করছে ঐ স্নিগ্ধ আঁখিজোড়ায়। বৃত্ত আপনমনে ঈষৎ চমকে উঠলো। বিস্মিত কণ্ঠে তৎক্ষনাৎ বিন্দুকে শুধালো,
” বিন্দু! কাঁদছো তুমি?!”

বিন্দু প্রত্যুত্তর করলো না। তবে টুপ করে তার গাল গড়িয়ে অশ্রুকণা ঝড়ে পড়লো। তার দৃষ্টিতে দেখা মিললো অভিমান, অপরাধবোধ, উদ্বিগ্নতা ও কিঞ্চিৎ ক্রোধ। এই খানিক সময়ের জন্য বৃত্ত ও তার দৃষ্টি মিলিত হলো। কিছু বললো না সে। গালের নোনাজলও মুছলো না। তবে মুখ ভঙ্গিমায় অভিমানী ভাব ফুটিয়ে তুললো। সেই হাতে তখনই বৃত্তকে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিলো। ব্যান্ডেজের অবিশিষ্টাংশ টেবিলের উপর রেখে পিছে ফিরে চলে যেতে নিলো। কিন্তু তৎক্ষনাৎ বৃত্ত তার হাত ধরে পথ রোধ করলো। বিন্দু অনুচ্চ গলায় বললো,
” আমাকে যেতে দিন বৃত্ত।”

বৃত্ত উঠে দাঁড়ালো। তবে হাত ছাড়লো না। বললো,
” আমার প্রশ্নের জবাব পেলাম না বিন্দু। ”

হঠাৎ বিন্দুর কি মনে হলো কে জানে। অন্তঃ অভিমানের বহিঃপ্রকাশ করলো কথার মাধ্যমে।
” কান্না জিনিসটা এতোটা লুকিয়ে রাখার মতোও না। চোখ থাকলে মানুষ ঠিকই দেখতে পায়। হাত ছাড়ুন। কাজ আছে।”

” এই রাত দুটোর সময় কিসের কাজ? ”

” আছে। কাজ করার মতো অনেক কিছুই আছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিন। ”

বৃত্ত কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরব রইলো। অতঃপর কণ্ঠে সামান্য দৃঢ়তা মিশিয়ে বললো,
” আমার দিকে ফিরো বিন্দু। ”

বিন্দু ফিরলো না। তবে কোনো কথাও বললো না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। ওপাশে তার একটু একটু করে অশ্রু দানা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তার অনড় ভাব দেখে বৃত্ত ফের একই কথা বললো না। তবে এবার বিন্দুর প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই বৃত্ত এক ঝটকায় বিন্দুর হাতে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের নিকটে নিয়ে এলো। অপর হাত দিয়ে শক্ত হাতে কোমড় চেপে ধরলো। অকস্মাৎ এ ঘটনায় বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ ও হতবিহবল হয়ে পড়লো বিন্দু। তার বিস্মিত দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো বৃত্তর পানে।
দুজনের মাঝে দূরত্ব খুবই নগন্য। বৃত্তর এতোটা কাছে এসে বিন্দুর হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পেলো। নিঃশ্বাসও বুঝি থমকে গেলো। ভেতরটায় অস্থিরতা বাড়লো। এবার আর সে বৃত্তর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। এতোটা কাছে এলে কি করে সম্ভব! কিন্তু বৃত্তর দৃষ্টি বিন্দু বরাবর। তার অক্ষিগোলক যেনো বিন্দুর সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে ঘুরছে।

বৃত্ত যে হাতে বিন্দুর হাত ধরেছিলো তা ছেড়ে দিয়ে বিন্দুর কপালের নিকট নিয়ে এলো। সেই অবিন্যস্ত চুলগুলো ফের কানের পিছনে গুঁজে দিলো। আলতো হাতে দু গালের নোনাজল মুছলো। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে গমগমে গলায় বললো,
” এই কান্না কিসের জন্য? আমার শরীরের ক্ষতের নাকি তোমার মনের ক্ষতের? ”

বিন্দু এবার সামান্য দৃষ্টি তুললো। তবে সম্পূর্ণ দৃষ্টি বৃত্ত বরাবর রাখার সাহস পেলো না। তাই চিবুক বরাবর দৃষ্টি রেখে দুরুদুরু বুক নিয়ে বললো,
” আমার সমস্তটা জুড়েই এখন ক্ষত, বৃত্ত। এ ক্ষতের ব্যাথা সয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কারণে আপনার এই করুণ অবস্থা, এটা আমি মেনে নিতে পারবো না। যথেষ্ট সহ্য করেছি আমি। আর নয়।”

” আর সহ্য করতে হবে না তোমায়। তোমার দুর্দিনের সূর্যাস্ত হয়েছে বিন্দু। পাপীকে পাপের দুনিয়াবি শাস্তি দিয়ে এসেছি আমি। ”

বিন্দু এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি তুলে চাইলো। ভেতরটায় আর অস্থিরতা নেই। শান্ত হয়ে এসেছে খানিকটা। বললো,
” আদৌ কি সূর্যাস্ত হয়েছে বৃত্ত? সবটা কি এতোটাই সহজ? আপনি হয়তো বিয়েটা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। কিন্তু আমি এখনও স্বাভাবিক হতে পারছি না। থেকে থেকে সেই দুঃসহ অতীতগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ”

বৃত্তর কণ্ঠস্বর এবার পূর্বের তুলনায় মোলায়েম হলো। বললো,
” অতীত মুছে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। থাকলে সবার আগে তোমার খারাপ অতীতগুলো মুছে দিতাম। কিন্তু আমাদের বিয়ের অতীত কখনোই মুছতে দিতাম না। কেননা, এ বিয়ে আমি সম্পূর্ণ মন থেকে করেছি। তোমাকে পরিপূর্ণভাবে মেনে নিয়েছি। আমি জানি, তুমি আমাকে এখনও মেনে নিতে পারোনি। তবে খুব শীঘ্রই পারবে। আর এই মেনে নেওয়ার সূত্রপাত কিন্তু ইতোমধ্যে ঘটে গিয়েছে। কি? ঘটেনি?”

বিন্দুর দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসার দেখা মিললো। বৃত্ত পুনরায় বললো,
” আজ আমার জন্য তোমার যে চিন্তা, উদ্বেগ দেখেছি তাতে এটুকু নিশ্চিত আমি, যে ভবিষ্যতে তোমার সমস্ত জুড়ে শুধু আমি থাকবো। স্বামী- স্ত্রীর বন্ধন কোনো সাধারণ বন্ধন না বিন্দু। এটা তুমিও জানো। দ্রুতই এর প্রভাব বুঝবে।”
বলেই সে হাতের বাঁধন আলগা করলো। দু কদম পিছিয়ে এসে বললো,
” তোমার উপর কোনো জোরজবরদস্তি নেই বিন্দু। আর আমি জানি, জোরজবরদস্তি করতেও হবে না৷ তুমি নিজ থেকেই আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবে। খুব শীঘ্রই। ”
এই বলেই সে ওয়াশরুমে চলে গেলো। পাছে বিন্দু ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। আজ সারাদিন সে বৃত্তকে নিয়ে ভেবেছে। নিজ মন মস্তিষ্কের সাথে নানা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে এক পর্যায়ে খানিকটা মেনেও নিয়েছে এ সম্পর্ক। কিন্তু অকস্মাৎ ঝড়ের ন্যায় দমকা হাওয়া আবারও তার অতীত ঘটনাগুলো চোখের সামনে নিয়ে আসছে। অবচেতন মন বলছে, এ ঘটনার সূত্রপাত বৃত্তর দ্বারাই হয়েছে। আজ যদি তাদের দুজনের মাঝে কোনোপ্রকারের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকতো তবে এমন ঘটনা কখনোই হতো না৷ কিন্তু ভাগ্য বলেও একটা শব্দ আছে। ভাগ্যের লেখা কখনোই খণ্ডিত হয় না। ভাগ্যে যা লেখা আছে, ঘুরেফিরে যেভাবেই হোক তা ঘটবে।
বিন্দুর মন ও মস্তিষ্ক একে অপরের সাথে বহুক্ষণ এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে থেকে অতঃপর এক স্থানে মিলিত হলো। বৃত্তকে নিজ ভাগ্যের লেখা বলে মেনে নিলো সে। এখন শুধু এই ক্ষতে কিছু সময়ের প্রয়োজন। কথায় বলে, সময়ের সাথে সাথে সকল প্রকার ঘা শুকিয়ে যায়। বিন্দুরও সে ঘা শুকিয়ে যাবে। শুধু প্রয়োজন কিছু সময় ও বৃত্তর ভালোবাসা।

—-

পরেরদিন খবরের চ্যানেলগুলোর স্থানীয় সংবাদের শিরোনামে লেখা উঠলো,
” গতকাল রাতে দূ’ র্বৃ’ ত্ত’ দে’ র দ্বারা মারাত্মকভাবে জ’ খ’ ম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা আশরাফ ও তার দলবল।”

আফতা হোসাইন ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছিলেন ও পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন। এই শিরোনাম দেখা মাত্রই গরম চায়ে হুট করে তাঁর জিব পুড়ে গেলো।দ্রুত হাত হতে চায়ের কাপ নামিয়ে সামনের টেবিলে রাখলেন। বিড়বিড় করে আপনমনে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,
” বৃত্তকে বলেছিলাম নির্বাচনের আগে যেনো কোনো ধরণের ঝামেলা না করে। এখন আশরাফ মুখ খুললে বড় বিপদ হয়ে যাবে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। ”
#চলবে