কন্ট্রোললেস পর্ব-০১

0
215

#কন্ট্রোললেস
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১]

” জোর করে বিয়ে করলেই হয়ে গেল?আপনি জোর করে বিয়ে করুন লাভ নেই আমি এই বিয়ে মানবো না।”

” মানবি না?”

” না।”

” আবার বল।”

” মানবো না।”

” কী মানবি না?”

” বিয়ে।”

” কী?শুনতে পাচ্ছি না আবার বল।”

বিরক্তে মুখ কুচকে ফেললো রুমু।উজ্জ্বল ভাই ইদানীং বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।শুধু বাড়াবাড়ি নয় একটু বেশি বাড়াবাড়ি।পথে ঘাটে যেখানে পাচ্ছেন দাঁড় করিয়ে এটা ওটা প্রশ্ন করছেন।এদিক সেদিক হাজার খানেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছেন।কলেজে উঠার পর থেকে তো তার জীবনটা ফাগুনের রৌদ্রতাপের ন্যায় সব খাঁখাঁ করে দিচ্ছেন।এসব কি মানা যায়?যে সম্পর্ক গড়ার আগে ভেঙে যায় সেই সম্পর্ক নিয়ে এতটা ব্যাকুল হয়ে লাভ নেই।তাছাড়া উজ্জ্বল ভাইয়ের কিছু বদ অভ্যাস আর দশ বারোজন মানুষের চোখে না পড়লেও রুমুর কাছে এসব ঠিকি ধরা পড়ে।
ধরা পড়বে না কেন?রুমুর কাছে উজ্জ্বলের কোন নকল মুখোশ নেই।সে যেমন ঠিক তেমনটা উপস্থাপন করে নিজেকে।

” রুমু চুপ হয়ে গেলি কেন? ”

” উজ্জ্বল ভাই বাড়ি যাব।”

” চুপ।”

উজ্জ্বলের এক ধমকে কেঁপে উঠলো রুমু।গলা শুঁকিয়ে গেল তৎক্ষনাৎ।মেয়েটার ভীত চাহনি উজ্জ্বল বুঝতে পারলো চটজলদি গ্লাস ভরতি পানি নিয়ে মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিল।

” পানিটা শেষ করে কাজের কথা বল ডার্লিং।”

” ছিহ!এসব কি ধরনের ডাক?”

” প্রেমের ডাক।বুঝতে পারছো না জান?”

” এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

উজ্জ্বল থেমে গেল।আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে নিজের দু’হাতের আদলে রুমুর নরম হাত পুরলো।

” প্লিজ জেদ করিস না।তুই আমার ইমোশন।কত বছরের সাধনা।তুই আর আমি এক হলে আমাদের দুই পরিবার একত্র হবে।তুই কি চাইছিস না আমাদের পরিবার এক হোক?”

উজ্জ্বলের হাত ছিটকে সরিয়ে দিল রুমু।রুমুর বড় ভাইয়া একবার যদি জানে উজ্জ্বলের সাথে তার যোগাযোগ আছে তবে থাপড়ে থাপড়ে হাসপাতালে পাঠাবে।তাছাড়া উজ্জ্বল প্রচন্ড ত্যাড়া জেদি ত্যাঁদড় ছেলে।এমন ছেলেকে কোন মেয়ে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে?

” বিয়ে আমি বাবার পছন্দের ছেলেকেই করবো।”

” সত্যি?”

” তিন সত্যি।”

” তাহলে তোর গোপন প্রেমিক মাহমুদকে যে কথা দিয়েছিস তুই নাকি তাকেই বিয়ে করবি?”

উজ্জ্বলের মুখ থেকে মাহমুদের কথা শুনে ভয়ে ঢোক গিললো মেয়েটা।যতবার যত ছেলের প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে এই বেয়াদব উজ্জ্বল সবাইকে মে রে হাত-পা ভেঙেছে।এসব ভয়ে রুমু প্রকাশ্যে প্রেম করার সাহস করেনি।শেষ ভরসা মাহমুদ।কলেজে উঠে একটুআধটু পাখা সবারি গজায়।প্রেমের হাওয়া গায়ে লেগে যায়। বেচারি রুমুর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়।

” কথা বের হচ্ছে না কেন ডার্লিং?”

” বাড়ি যাব।”

” যেতে দিব, বল ভালোবাসি।”

” ভালোবাসি না।”

” কাকে বাসিস?”

” আপনাকে বলবো কেন?”

উজ্জ্বল বিরক্ত হয়ে গেল।রুমুর হাত চেপে কাছে টানলো।

” এত জেদ তোর!”

” জেদ কি একা আপনার আছে আর কারো নেই?”

” না নেই।তোর জেদ আছে এতেই আমি খুশি।সৈয়দ উজ্জ্বল হাসানের বউ যে হবে তার তো জেদ থাকতেই হবে।তুই জেদ করবি আমি তোর গাল চেপে দেব,আদর করবো মান ভাঙাবো।ডার্লিং রাজি হয়ে যা আর থাকা যায় না।”

হঠাৎ দরজায় করাঘাতে কেঁপে উঠলো রুমু।সেই সাথে সতর্ক হলো উজ্জ্বল।বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে তার বন্ধু সিয়ামের গলা।ছেলেটা এখন তার প্রেম আলোচনায় বাঁধা দিচ্ছে কেন?অবুঝ ডার্লিংটাকে বোঝাচ্ছে উজ্জ্বল তাকে ছাড়া কতটা বেসামাল অথচ বন্ধু বুঝেও বিরক্ত করছে!

উজ্জ্বল উঠে দাঁড়ালো চটজলদি দরজা খুলে দরজা ঠেসে দাঁড়ালো।সিয়ামের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলে,

” কি সমস্যা সিয়াম?”

” তুই এতক্ষণ রুমে কি করছিস?ভাই আল্লার ওয়াস্তে বের’হ।আম্মা এসে যাবে।”

“তোর ভাবীর সাথে মিটিং করছি।”

” এখনো মেনেছে কিছু? ”

” একদমি না।আশ্চর্য!ছোট থেকে বড় করেছি চকলেটের লোভ দেখিয়ে। এখন বড় হয়েছিস আদর সোহাগ প্রেমের লোভ দেখিয়েও এই মেয়েকে মানাতে পারছি না।কিছু কর ভাই দম বন্ধ হয়ে ম রে যাব।তোর ভাবীর চোখ ইদানীং অন্যদিকে যাচ্ছে।

” এত হতাশ হচ্ছিস কেন?নতুন নতুন কলেজে উঠলে যে রঙিন হাওয়া গায়ে লাগে বুঝিস না?তুই একদম জোরাজোরি বকাঝকা করবি না।তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের’হ।”

সিয়াম কথা শেষ করতে রুমু এসে উজ্জ্বলের পিঠ খামছে ধরলো।আকস্মিক ব্যথায় উজ্জ্বল সরে দাঁড়াতে রুমু কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।মেয়েটা এখানে স্থির হয় না এক ছুটে পালিয়ে যায় অন্য কক্ষে।দিশাহীন হয়ে খুঁজতে থাকে তার বান্ধবী সুরাইয়াকে।

সুরাইয়া কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিল রান্নাঘরে রুমু দেখে চটজলদি এগিয়ে বলে,

” ঠিক আছিস তুই?”

” বেইমান কোথাকার।তোর বাসায় এসেছিলাম নোটসগুলো নিতে আর তুই আমাকে হা-য়-নার মুখে ছেড়ে দিলি।”

” কসম করছি আমি জানতাম না উজ্জ্বল ভাইয়া আমাদের বাড়ি আসবে।এর আগে কখনো আসেনি উজ্জ্বল ভাইকে দেখে আমি নিজেও ভড়কে গেছি।”

” আমি বাড়ি গেলাম।তোর সাথে আমার আর কোন কথা নেই ইতর মেয়ে।”

রুমু রাগ ঝেরে বেরিয়ে গেল।কোন মতে রাস্তায় উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলো।উজ্জ্বল তাকে ছোট বেলা থেকেই আদর যত্ন করে।তাদের দুই পরিবারের আকাশ পাতাল ঝগড়া বিবাদের মাঝে রুমুর প্রতি উজ্জ্বলের আন্তরিকতা ছিল অন্যরকম কিন্তু এই ব্যটার মনে যে এতটা ছিল তা মোটেও আন্দাজ করেনি সে।
.
পরের দিন সকালে রুমুর ঘুম ভাঙতে দেখতে পেল তার মাথার কাছে একটি প্যাকেট।কক্ষে সে একাই থাকে, এই প্যাকেট হঠাৎ তাকে কে দিল?আজ তো তার জন্মদিন নয় যে কেউ উপহার দিয়ে যাবে।হাতের প্যাকেটটি উলটে পালটে দেখতে এমন সময় কক্ষে আসে তার বড় ভাবী আনিকা।রুমুর প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলেন,

” সুরাইয়া এসে তোকে এটা দিতে বললো।আমাকে খুলতে বারণ করেছে তোর জন্য নাকি স্পেশাল গিফট।”

আচমকা মুখটা খুশিতে ভরে গেল রুমুর। সুরাইয়ার মাধ্যমে তার প্রেমিক মাহমুদ ছাড়া আর তো কেউ উপহার পাঠায় না।তবে কি মাহমুদ পাঠিয়েছে?আনন্দে পুলকিত হয়ে দ্রুত বিছানা ছাড়লো মেয়েটা।আনিকা কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দ্রুত দরজা বন্ধ করে বসলো সে।একটি শপিং ব্যাগ বেশ পরিপাটি করে পিন লাগানো।দ্রুত হাতে পিন খুলতে দেখতে পেল একটি শার্ট।শার্টটি হাতে তুলতে চমকে যায় মেয়েটা।কি বীভৎস!হলুদ রঙা শার্টটা রক্তে মাখামাখি।

কয়েকটা জায়গা ছিঁড়ে আছে।সকাল সকাল ঘুম ভাঙতে এমন পরিস্থিতিতে মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগলো তার।সুরাইয়া এসব কেন পাঠালো?কোন উদ্দেশ্যে পাঠালো?
.
উজ্জ্বলের হাতের রক্ত শুকিয়ে আছে।কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে জুলপি বেয়ে নামছে।তার রাগ হাঁসফাঁস এখনো কমেনি।সিয়াম উজ্জ্বলের কাঁধে হাত রাখতে তেতে উঠে ছেলেটা।

” কি সমস্যা?”

” আর কতক্ষণ বসে থাকবি?উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে নে।”

উজ্জ্বল উঠলো না।তার আশেপাশে থাকা বন্ধুরা সবাই একে অন্যের নজর বুলালো।দিপু বিরক্ত হয়ে বলে,

” উজ্জ্বল তোকে বলেছিলাম আমরা মা/রি শা-লাকে একদম চটকে দেব।তুই একা কেন মা র লি?তোর কোন কন্ট্রোল নেই মাথায় যা আসবে তাই করবি।”

” শান্তি বুঝিস?মনের শান্তি।দুইবার ওয়ার্নিং দিলাম শুনলো না।”

“ওঁকে মেরে কি হবে?রুমু তো নিজেই এসব করছে।মাহমুদ চলে গেলে আরেকজনকে ধরবে।আশ্চর্য ওর বড় ভাই কি এসব দেখে না?নাকি বোনের খেয়াল রাখে না।”

উজ্জ্বল কিছু বললো না।দ্রুত উঠে গিয়ে ওয়াশরুমে গেল সেই সাথে ডাকলো দিপুকে।

” হ্যান্ডওয়াশটা পুরো খোল।”

” পুরোটা খুলে কি হবে?”

” ঢেলে দে আমার হাতে।”

” এহ!এই এটা একদম নতুন গতকাল এনেছি।অপচয় করে না দোস্ত আম্মা যদি দেখে হ্যান্ডওয়াশ গায়েব আমাকে উড়ে ছুড়ে মা র বে।”

উজ্জ্বল প্রচন্ড বিরক্ত হলো।নিজ হাতে বোতলটি খুলে ঢেলে দিল সবটা নিজের হাতে যেন কত বছরের লেগে থাকা ময়লা সে সাফ করছে।

হাত ধোয়া শেষে মুখে ক্রমশ পানির ছিটা দিল উজ্জ্বল।অস্বস্তি ছাড়িয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল শরীরে।আয়নায় নিজেকে একবার পরখ করে ক্রুদ্ধ হাসলো সে।

“আমাকে প্রজ্বলিত করে তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো?বোকা মেয়ে।এই উজ্জ্বলের বদৌলতে তোমার জীবন যে উজ্জ্বলের আলোয় ভরে যাবে।তোমার জীবনে উজ্জ্বল আছে তো আলো আছে,উজ্জ্বল নেই আলো নেই।”
.
রাতে চুপচাপ ছাদে বসে রুমু।প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম পড়ছে ইলেক্ট্রিসিটি ইদানীং বেকাদায় ফেলছে সবাইকে।এই আছে তো এই নেই।গরকম জনজীবন অস্থির।
সকাল থেকে মাথায় দুশ্চিন্তা ঘুরছে রুমুর। মাহমুদের খোঁজ তার নেওয়া হয়েছে।তাকে যে উজ্জ্বল পিটিয়েছে তার আর বুঝতে বাকি নেই।
হঠাৎ আবছা আলোয় মানব অস্তিত্ব টের পেতে ভয়ে কুঁকড়ে যায় রুমু।এই মুহূর্তে ছাদে কেউ থাকার কথা নয়।থাকলেও নিশ্চয়ই সিড়ি দিয়ে উঠবে কিন্তু অস্তিত্বের দেখা মিললো ছাদের এক কোনায়।সে চাঁদের আলোয় বাড়তি লাইট আনার প্রয়োজনবোধ করেনি কিন্তু এখন তো পড়েছে মহা বেকায়দায়।
কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে,

” কে?”

অপরপাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।ভয় বাড়লো মেয়েটার।দোয়া দরুদ পড়ে পিটপিট পায়ে এগিয়ে যায় সিড়ি ঘরের দিকে।সে যতবার পা বাড়াচ্ছে মানব ছায়াও তার দিকে এগিয়ে আসছে।দ্রুত পায়ে সিড়িতে পা ফেলতে আচমকা অজ্ঞাত কেউ চেপে ধরলো তাকে।টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেল ছাদের অন্যপাশে।খলবলিয়েও মেয়েটা নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ।
..চলবে….