কন্ট্রোললেস পর্ব-২৫

0
285

#কন্ট্রোললেস
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৫]

ঝিরঝির বৃষ্টি থেকে আকাশের হাঁক।ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা রুমু হঠাৎ থমকে গেল।শ্বাস প্রশ্বাসের আন্দোলন ব্যাপক বাড়ল।রুমু জিহ্বের সাহায্যে ঠোঁট ভেজাল উজ্জ্বলের বুকে হাত বাড়িয়ে বলল,

” এসব কি বলছেন?”

” একটা প্রশ্ন করলাম অস্থির হচ্ছিস কেন?”

” এটা কেমন প্রশ্ন?”

” প্রশ্নের ধরণ কেমন তা আমি জানি না।তোকে জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে।”

রুমুর চোখ ভিজে উঠল।

” আমি আপনাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা।আমি বিয়ে করেছি আপনাকে ছাড়তে নয়।ছাড়বো কেন?কারণটা তো অন্তত দরকার,ছাড়ার মতো কোন কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না।”

“অনেকেই বলল তুই আমাকে ছেড়ে যাবি এই যে তুই নিখোঁজ যখন ফিরবি তখন নাকি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরবি।”

” তাদের আপনি কি বললেন?”

” বলেছি আমার রুমু আমাকে ছাড়বে না।এবার ঘুমা।”

উজ্জ্বল বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে রুমুর চোখ মুছে দিল।অনেকটা সময় পর ঘুমিয়ে পড়ল দু’জনে যখন ভোর হলো তখন সৈয়দ বাড়ির সকলের ঘুম ভাঙলো হট্টগোল চিৎকার চেচামেচিতে।উজ্জ্বলদের লোহার গেটে দেদারসে পদাঘাত করছে রাশেদ সেই সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগালি।তখনো বৃষ্টি কমেনি ঝিরঝির বৃষ্টি চলমান।সৈয়দ শামসুল রেগে গেলেন ছাতা হাতে বেরিয়ে এসে বলেন,

” রাশেদ এটা ভদ্র লোকের বাড়ি কোন জন্তু জানোয়ারের না।সাত সকালে এসব তামাশা কেন শুরু করেছিস?”

” তামাশা আমি করছি নাকি তোরা?রুমুকে আসতে বল, আসতে বল রুমুকে।”

চাচার সাথে তুইতোকারি!ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?উজ্জ্বল ঘুমঘুম চোখে সবটাই শুনল রক্ত তখনো তার টগবগিয়ে ফুটছে।উজ্জ্বল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রুমুকে যখন পাওয়া গেল তখন আর কোন রাগ জেদ নয় রাশেদের সাথে যত কথা কাটাকাটি হবে ততই জল ঘোলা হবে সব মিলিয়ে উজ্জ্বল যখন তার রাগকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল তখনি রাশেদের তুইতোকারি তার রাগ বাড়াল।বড় বড় পা ফেলে উঠনে গিয়ে চিৎকার করে বলে,

” রাশেদ ঝামেলা চাই না চলে যা।”

” তোর কথা শোনার জন্য বসে আছি?রুমুকে আসতে বল।”

“রুমু আমার স্ত্রী।আমার স্ত্রী কোথায় যাবে কোথায় থাকবে সেসব সিদ্ধান্ত একমাত্র আমি নেব।রুমু এখানে আসবে না।”

” উজ্জ্বল তোকে সাবধান করলাম খু *ন করে ফেলবো।”

” চেষ্টা করতে পারিস।”

” সাহস থাকলে গেট খোল।”

” ওকে,এবার তাহলে লড়াই হয়ে যাক।”

উজ্জ্বল যখনি গেটের কবজায় হাত রাখল তখনি সৈয়দ ইসমাইল বাইরে থেকে চেচিয়ে বলেন,

” খবরদার উজ্জ্বল এই ভুল করিস না।রাশেদের কথায় গেট খোলার কোন দরকার নেই।তোরা সবাই ঘরে যা এদিকটা আমি দেখছি।”

উজ্জ্বল কথা বাড়ায় না।সে চায় না ঝামেলা বাড়ুক এতদিনের ধকলে সে বড্ড ক্লান্ত।রুমু দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিল সবটা, সে কেমন অপরাধবোধে নিংড়ে যাচ্ছে। অবচেতন মন বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছে তুই যদি বিয়েটা না করতি ঝামেলা এতদূর আসত না।
.
বৃষ্টি থেমে গেছে পরিবেশটা এখন শীতল শান্ত।রুমু উজ্জ্বলের পানে তাকিয়ে বলে,

” উজ্জ্বল.. ”

” হুম।”

” আপনি শুকিয়ে গেছেন।চোখটা দেবে গেছে।”

” আমার দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকা শরীরের কি হাল হয়েছে।”

” আমি বেঁচে আছি এইতো অনেক।”

” তোর ভাই মা পাষাণ।”

” জানি।”

” মারল কেন?”

” আপনাকে ছাড়তে বলল কিন্তু আমি রাজি হইনি।”

” তুই আমাকে ছাড়লে তাদের লাভ কী?”

” কাবিনের টাকাটা…”

উজ্জ্বল চমকে গেল।এতক্ষণ সে রুমুর কাটা ছেড়া স্থানে গলায় যত্ন নিয়ে মলম লাগাচ্ছিল রুমুর কথায় থেমে গেল তার হাত।

” কাবিনের টাকা মানে?”

” আপনি আমাকে ছেড়ে দিলে যে কাবিনের টাকাটা দেওয়া হবে সেই টাকার জন্যই এতসব।”

” তোর ভাইয়ের এত বুদ্ধি!বোন নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে নাকি?”

” আমার কোন ভাই নেই।আচ্ছা আমরা কি একই মায়ের পেটের ভাই বোন?”

রুমুর গলা ধরে এলো।উজ্জ্বল পুনরায় তার কাজ চালিয়ে গেল।

” কত জায়গায় মলম লাগাবো?সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত।”

“জানেন, আমি যেদিন পালিয়ে আসলাম সেদিন আমাকে পালাতে কে সাহায্য করেছে?”

” কে আর চাচাজান?”

” না।রাশেদ ভাই।”

উজ্জ্বল দ্বিতীয়বার চমকালো।রাশেদ রুমুকে পালাতে সাহায্য করেছে!এতো বড় আশ্চর্যের ব্যাপার।

” রাশেদ তোকে পালাতে সাহায্য করলে হিমেলের সাথে বিয়ে কেন ঠিক করল?”

” হলুদের আয়োজন শেষে মাঝ রাতে আমি যখন কাঁদছিলাম তখন ভরসার হাত বাড়ায় রাশেদ ভাই।আমাকে বলল, পালিয়ে যেতে তবে কিছু শর্ত আছে।”

” কী শর্ত?”

” আমি পালিয়ে আপনার কাছে যাব।সকালে যখন জানা যাবে আমি নিখোঁজ তার একদিন পর থানায় মামলা করা হবে আপনার নামে।”

” আরেহ বাহ!”

” সেদিন আমার উদ্দেশ্যে ছিল কিভাবে এই নরক থেকে মুক্তি পাব তাই রাশেদ ভাইয়ের কথার সাথে সামিল হই তবে আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধু একবার বের হই আর পিছু ফিরে আসব না আর আপনাকে বিয়ে করে তবেই নিশ্চিন্ত হব।
যখন গেটে ছেড়ে বেরিয়ে যাই আর দৌড়াতে থাকি তখনি আব্বা ফোন করলেন।আব্বা নাকি দেখেছেন রাশেদ ভাই আমাকে বের হতে সাহায্য করেছেন তবে এর পেছনে কি উদ্দেশ্য আছে আব্বা জানতে চাইলেন।আমি সত্যটা জানালাম আর আমার সিদ্ধান্ত জানালাম।আব্বা শুধু একটা কথাই বললেন,উজ্জ্বলকে ঠকালে তুই নিজের কাছে ঠকে যাবি।”

” বিয়ের পরেও রাশেদের সাথে তোর যোগাযোগ ছিল।”

” হ্যাঁ ছিল।বিয়ের বেশ কয়েকদিন পর যোগাযোগ হয় আমি জানিয়েছিলাম আমাদের বিয়ের কথা রাশেদ ভাই ভীষণ রেগে যায়।যখন আমার কাছে কাবিনের টাকার কথা জানতে চায় আমি সত্যটা বলি এটাও বলি আমি উজ্জ্বলকে ছাড়ব না যত যাই হয়ে যাক।রাশেদ ভাই রেগে গেলেন আমাকে বললেন উর্মি আপার সংসারে ঝামেলা করবেন আরো কত কি হুমকি দিলেন।বিশ্বাস করেন আমি ভয় পেয়ে যাই।”

” আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না!”

” আমি সাহস নিয়ে বলতে পারিনি।রাশেদ ভাই বলল যদি আপনাকে ডিভোর্সদি আর টাকা আদায় করতে পারি তবে আমাদের উভয় জনের লাভ।”

” তো ডিভোর্স দিলি না কেন? ”

রুমু হেসে ফেলল।

” আমি আপনাকে ডিভোর্স দিতে বিয়ে করিনি।বলেছিনা?আমি আপনাকে সৎ নিয়তে বিয়ে করতে পালিয়েছি।
ডিভোর্স দিব দিব করেও যখন আমি রাশেদ ভাইকে ঘুরালাম শেষ পর্যন্ত জানিয়ে দিয়েছিলাম আমি ডিভোর্স দিব না তখনি পাষাণের মতো কাজটা করল।”

” তোর কি মনে হয় না এসবের জন্য তুইও দায়ী?শুরুতে আমাকে জানালে এমনটা হতো?”

” আমি চেয়েছি রাশেদ ভাইকে দমিয়ে রাখতে আপনাদের উভয়পক্ষের রেষারেষি আর ভালো লাগেনা।”

” বাড়িতে নিয়ে তোকে কি করল?”

” ডিভোর্স দেওয়ার জন্য জোরাজোরি করছিল কিছুতেই রাজি হইনি মেরে বেঁধে ফেলে এসেছিল চিলেকোঠার ঘরে।এতটা সাহস করার কারণ আব্বা বাড়ি ছিলেন না তাই…”

” এরপর থেকে একা একা আধা চালাকি করবি না।”

“তারপর বলেন, আমাকে ছাড়া দিনগুলো আপনার কেমন ছিল?”

” দেখে বুঝতে পারছিস না কেমন ছিল?পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।”

উজ্জ্বল রুমুকে যত্ন নিয়ে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিল।সারা শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা ছোপ ছোপ দাগ তার মাঝে কাটা ছেড়া।

” আমি তোকে কতটা যত্নে রাখি আর পাষাণরা এক নিমিষেই… ”

উজ্জ্বল কথা শেষ করার আগে রুমু তার গায়ে থাকা ঢিলেঢালা টি-শাটটা টেনে খুলে ফেলল।উজ্জ্বল হতবাক হতভম্ব।

” রুমু তুই ঠিক আছিস?”

” নাহ।কাছে আসুন।”

” হোয়াট দ্যা…নিজের শরীরের অবস্থা দেখেছিস?এই অবস্থায় এসব… কোন প্রয়োজন নেই।”

” এখনি প্রয়োজন।”

উজ্জ্বল ধমক দেওয়ার আগে রুমু ঘুরে বসে।তৎক্ষণাৎ তার চোখে যায় রুমুর পিঠে লম্বালম্বি একটি কাটা দাগ।কাটা জায়গাটার ক্ষত স্থান লাল হয়ে আছে।

” পিঠে ভীষণ ব্যথা এই ক্ষতটা বেশি জ্বালাচ্ছে।”

” এটা কি করে হলো!”

” জানি না।”

উজ্জ্বলের বুক কেঁপে উঠল।রুমুর ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে মলম লাগাতে রুমু বলে,

“জামা খুললাম বলে কি ভেবেছেন?”

” ইয়ে মানে..কিছু না।”

” বি পজেটিভ ওকে?”

” নো।”

রুমু ঘুরে বসে উজ্জ্বলের গায়ে হাত রেখে নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকায় এই দৃষ্টি উজ্জ্বলকে দূর্বল করতে বাঁধ্য।উজ্জ্বল ঢোক গিলে নিজেকে এতটা কন্ট্রোললেস হলে চলবে না।সে যখন নিজের মনের সহিত যুদ্ধ করছিল তখনি রুমু তার ধৈর্যটার বাঁধ ভেঙে দিল।মেয়েটা মিশিয়ে দিল তৃষ্ণাপীড়িত দুটো ঠোঁট, উপস্থিত যত ঝুট ঝামেলা দুটি সত্তা ভুলে গেল এক নিমিষে।উজ্জ্বল যতটা আঁকড়ে ধরতে চাইল রুমু তার থেকেও বেশি আঁকড়ে ধরল, কয়েক মিনিটে রুমু হাঁপিয়ে উঠল।

“উজ্জ্বল..”

” হু?”

” কিছু না।”

পুনরায় রুমু উজ্জ্বলের ঠোঁটে ঠোঁট মেশাল উজ্জলের ঘাড়ে হাত রেখে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করল।উজ্জ্বল খেই হারিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতেই চাপা আর্তনাদে গোঙানি দিল।তৎক্ষনাৎ সতর্ক হলো সে।রুমুকে ছাড়তে চাইলেও রুমু তাকে ছাড়ল না।
চলবে…