বেসামাল প্রেম পর্ব-৩৮+৩৯

0
230

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩৮
দু’দিন পর সূচনার তেইশ তম জন্মদিন। তাই রুদ্রর সঙ্গে মাহের পরিকল্পনা করেই ঢাকাতে এসেছে। বিয়ের পর বউয়ের প্রথম জন্মদিন। বিশেষ ভাবে এ দিনটাকে উদযাপন করতে চায় মাহের। সূচনার খুব ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের প্রতিটি ভ্রমণ উপযোগী স্থানে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি রুদ্রর জন্য৷ বোনের প্রতি অতিরিক্ত পসেসিভনেস থাকার কারণে দু একটা জায়গা ব্যতীত কোথাওই যেতে দেয়নি রুদ্র। সে বার রুদ্র কাজিন ব্রাদার্সদের নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এলো। সূচনা কত অনুরোধ করল তাকে নিয়ে যেতে। রুদ্র রাজি হয়নি। সেই যে মেয়েটা মন খারাপ করল সেই মন খারাপ এখনো ভালো হয়নি। তাই তো সে বারের পর আর কখনো ভাইয়ের কাছে আবদার করেনি কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবার। অভিমানী বোনের অভিমান ঠিক টের পেয়েছে রুদ্র। তাই এ বছর বোনের জন্মদিন উপলক্ষে আকাশপথে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বোন, বোন জামাইকে তার তরফ থেকে গিফট বলা চলে। মাহের যদিও এতে নারাজ ছিল পরবর্তীতে স্বাভাবিক হয়েছে। শত হোক ভাইয়ের ভালোবাসা থেকে তো বউটাকে বঞ্চিত করতে পারে না। আগামীকাল বিকেল পাঁচটা পাঁচ মিনিটে তাদের চারজনের ফ্লাইট। এ ব্যাপারে শুধু রুদ্র, মাহের আর হৈমী জানে৷ সূচনা জানবে আগামীকাল ঠিক পাঁচটা পাঁচ মিনিটে৷ তার আগ পর্যন্ত শুধু বিষয়টা কৌশলে গোপন রাখার পালা। রুদ্র হৈমীর মতো পেট পাতলা মানুষটাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত রয়েছে। তাই সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছে৷ মুখ ফস্কে একবার যদি বলে দেয় তাহলে পুরো পরিকল্পনাটাই বরবাদ হয়ে যাবে। লাঞ্চ শেষে সূচনা কিছু ভেজা কাপড় শুকাতে ছাদে যাচ্ছিল সঙ্গে হৈমী। রুদ্র রুম থেকে হৈমীকে সূচনার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত যেতে দেখেই হাঁক ছেড়ে ডাকল,

– ” হৈমী, অ্যাঁই হৈমী আমার ওয়ালেট কোথায়? ”

সহসা রুদ্রের এমন কাণ্ডে রীতিমতো ওরা দুজনই অবাক হলো। হৈমী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সূচনার দিকে তাকাল। সূচনা মুচকি হেসে বলল,

-” যাও ভাইয়ার ওয়ালেট খুঁজো গিয়ে। ”

-” বা রে, আমি উনার ওয়ালেট কোথায় পাবো। উনার জিনিস আমি রাখি নাকি। ”

-” ডাকছে যখন যাও না দু’জন মিলে একসঙ্গে খুঁজে বের করো। আমি এগুলো ছাদে মেলে দিয়েই আসছি। ”

একটু সুযোগ মিলেছিল ছাদে যাওয়ার খাটাশ লোকটার জন্য আর যাওয়া হলো না৷ চোখেমুখে তীব্র রাগ ফুটিয়ে রুমে এলো হৈমী। এক প্রকার চিৎকার দিয়েই বলল,

-” আপনার সমস্যা কী? আপনার ওয়ালেট কোথায় আমি জানব কী করে? ”

প্যান্টের পকেটে ওয়ালেট ঢুকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রুদ্র। হৈমী হতভম্ব হয়ে গেল তার কাণ্ড দেখে৷ রাগে, দুঃখে মাথার সবগুলো চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল৷ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে এগিয়ে এসে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-” এটা কী হলো! ওয়ালেট হাতে নিয়ে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন, হৈমী আমার ওয়ালেট কোথায়? আপনি এত খারাপ কেন। ”

ভ্রু কুঁচকে দৃঢ় পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল রুদ্র। অল্প আওয়াজ তুলে দরজা লক করে পুনরায় ফিরে তাকাল হৈমীর দিকে। হৈমীর ইচ্ছে করল রুদ্রর পেছনে বাঁধা ছোট্ট ঝুঁটিটা মুঠো ধরে আস্ত রুদ্রর শরীরটাকে একশটা আছাড় দিতে৷ কিন্তু সেই ইচ্ছে ইহজন্মে পূরণ হবার নয় বলে ব্যর্থ শ্বাস ফেলল। রুদ্র ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে এসে রাশভারি স্বরে জিজ্ঞেস করল,
– ” মানুষ কীভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচায়? স্পিক আউট !

শেষ শব্দ দু’টো ধমকেই বলল। ফলশ্রুতিতে কেঁপে ওঠল হৈমী৷ কাঁপা গলায় বলল,

– ” অকারণে আমাকে চেঁচিয়ে ডেকেছেন। তাই রাগ করে বলেছি। ”

কী ইনোসেন্ট উত্তর। এরপরও কি রেগে থাকা যায়? যায় না, তাই রুদ্রও আর রাগ করল না৷ সে অকারণ ডাকটাকে কারণে পরিণত করার জন্য বেশ আয়েশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল৷ হৈমীর দিকে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাত উঁচিয়ে কাছে ডাকল৷

-” কাছে এসো মাথাটা টিপে দাও। ঘুমাব কিছুক্ষণ। ”

অবাধ্যতা করতে পারল না হৈমী। কেমন শান্ত হয়ে চলে এলো রুদ্রর শিয়রে৷ ছোটো ছোটো নরম তুলতুলে হাত দিয়ে মাথা টিপে দিতে শুরু করল। আরামে চোখ বুজে এলো রুদ্রর। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

-” পরীক্ষার সময় খুব কাছাকাছি। কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসার পর আর সময় নষ্ট করা যাবে না। মনে থাকবে? ”

অল্প আওয়াজে উত্তর দিল হৈমী,
– ” থাকবে৷ ”

মৃদু হাসল রুদ্র। সহসা বলে ওঠল,

-” শার্টের বোতাম খোলো। ”

-” হুহ। ”

চমকে ওঠল হৈমী। আমতা আমতা করে বলল,
-” মানে! ”

-” আরে বাবা বাংলাই তো বললাম শার্টের বোতাম খোলো। ”

অধর উল্টে চোখ দু’টো ছোটো করে তাকাল মেয়েটা। রুদ্র সহসা চোখ মেলে কঠিন স্বরে আদেশ করল,
-” শার্টের বোতাম গুলো খুলে দাও কুইক। ”

ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে রুদ্রর বলিষ্ঠ হাত দু’টো দেখে নিল হৈমী। মনে মনে বলল,

-” নিজের এত বড়ো বড়ো হাত থাকতে আমার মাসুম হাতগুলোকে লোকটা শুধু শুধু পরিশ্রম করায়। ”

ধীরেধীরে সবগুলো বোতাম খোলার পর রুদ্রর শরীর থেকে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ ভেসে এলো। আচমকাই নাক টেনে ঘ্রাণটুকু গাঢ় ভাবে শুষে নিল হৈমী। রুদ্র সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে সেন্ডো গেঞ্জিটা নিজেই খুলে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল৷ হৈমী বিস্মিত হয়ে কিঞ্চিৎ সরে বসল৷ লজ্জায় গাল দু’টো লালে লাল হতে লাগল তার। নিঃশ্বাস হয়ে ওঠল ভারী৷ শুকনো গলায় ঢোক গিলতে লাগল ক্ষণে ক্ষণে। প্রচণ্ড আড়ষ্টতায় ভুগতে লাগল আকস্মাৎ। অকপটে রুদ্র বলল,

– ” শরীর টিপে দাও। ”

আবারো চমকাল হৈমী। চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে কয়েক পল তাকিয়ে রইল পেশিবহুল দেহটার দিকে। বুকের ভিতর কেমন কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার। ধক ধক শব্দে মন মাতোয়ারা হয়ে ওঠছে। পুরো শরীরটা অসুস্থ অসুস্থ লাগছে৷ চোখ দু’টোতে ভর করছে রাজ্যের ঘুম। এমন ঠেকছে কেন তার? রুদ্রর পেশি বহুল উন্মুক্ত পিঠটা দেখে তার এমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে কেন? হাই তুলতে তুলতে কাঁধে আলতো করে হাত রাখল সে। মৃদুভাবে কাঁধ টিপতে শুরু করলে রুদ্র বলল,

-” শরীরে কী জোর নেই? জোর আনো হাতে। শরীর ব্যথা করছে, ব্যথা কমিয়ে দাও। বউ যখন হয়েছে বরের শরীরের সব অসুখ সারাতে হবে তোমায়। ”

হৃদয়টায় টনটন করে ওঠল হৈমীর৷ হাতের জোর বাড়তে গিয়েও সহসা হাত অবশ হয়ে এলো। এতক্ষণের মুখে ছড়ানো লজ্জাটুকু সারা অঙ্গে মেখে একাকার হয়ে গেল৷ না পেরে ওঠে যেতে উদ্যত হলো সে। টের পেয়ে সহসা হেঁচকা টান দিয়ে বিছানায় শুইয়ে ফেলল ওকে রুদ্র। ত্বরিতগতিতে উপর দিয়ে কম্বল টেনে নিজেদের ঢেকেও ফেলল। হৈমী ছটফট করার চেষ্টা করতেই রুদ্র ওর ঠোঁটজোড়া আঙুলের সাহায্যে চেপে ধরে ভরাট স্বরে বলল,

-” কাজ দিয়েছি পারোনি তাই অকাজ করার সাহসও দেখাবে না। চুপচাপ একঘন্টা ঘুমাবে আমার সঙ্গে। ”

নিমিষেই শান্ত হলো হৈমী৷ রুদ্র ঠোঁটে চেপে রাখা আঙুলটি সরাতেই সে বলল,

-” আমি ঘুমাব না। ”

-” তাহলে আমাকে ঘুমাতে সাহায্য করো। ”

বলতে বলতেই পুরো হৈমীটাকে নিজের দ্বারা আবদ্ধ করে নিল। ছোট্ট দেহটার থরথর কম্পন অনুভব করল নিগূঢ় ভাবে। হৃদয় জুড়ে ছুঁয়ে গেল সুখের উষ্ণ হাওয়া। আবেশে চোখ বুজে হৈমীর ছোট্ট বুকে মাথা রাখল সে। ঠোঁট নাড়িয়ে উচ্চারণ করল,

-” যতক্ষণ ঘুমাব ততক্ষণ নড়াচড়া করবে না। ”

রুদ্রর মুখের উষ্ণ নিঃস্বাস বক্ষ বিভাজনে পড়তেই নড়েচড়ে ওঠল হৈমী। রুদ্র তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সে ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

-” আমার সুরসুরি লাগছে এভাবে থাকতে পারছি না। দম আটকেও আসছে। ”

বিরক্তি প্রকাশ করে রুদ্র বলল,

-” উমহ যা ইচ্ছে লাগুক, যা ইচ্ছে আটকাক আমি ছাড়ছি না। এভাবে থাকার অভ্যাস করো মাই জান। ”

রুদ্রের মুখে এমন আদুরে কথা শুনে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাটাও এবার বনবন করতে লাগল হৈমীর৷ কী সাংঘাতিক কাণ্ড হচ্ছে!
______________
সন্ধ্যার পর সূচনা মাহেরকে জানালো সে বাইরে যাবে। টুকটাক কেনাকাটা করে ফুচকা খেয়ে তবেই ফিরবে। মাহের মনে মনে চিন্তা করছিল ব্যাগপত্র গোছাবে কখন। এরপর মনস্থির করে ফেলল সূচনা ঘুমানোর পরই সব গোছাবে। আপাতত রুদ্রর সঙ্গে টুকটাক জরুরি কথা বলতে হবে। এরই মধ্যে সূচনার আবদার এসে পড়ল। সে তার কথা জানিয়ে তৈরি হতে শুরু করেছে। মাহের দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,

-” সূচনা আমরা কাল বাইরে যাই? ”

আয়না থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মাহেরে দিকে তাকাল সূচনা। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই মাহের বলল,

-” শরীরটা ভালো লাগছে না আজ। ”

আঁতকে ওঠে এগিয়ে এলো সে। ব্যস্ত গলায় শুধালো,
-” ভালো লাগছে না মানে কী হয়েছে আপনার? ”

কথাটা বলতে বলতেই চট করে মাহেরের কপালে হাত রাখল। তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে নিয়ে বলল,

-” কেমন লাগছে বলুন প্লিজ। ”

– ” আপনি অস্থির হচ্ছেন কেন তেমন কিছুই নয়। প্লিজ শান্ত হন। ”

সূচনার মুখ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা। মাহেরের কিঞ্চিৎ খারাপ লাগল কিন্তু এই খারাপ লাগা, এই মেঘ যখন কেটে যাবে তখন তাদের থেকে সুখী বোধহয় পৃথিবীর আর কেউ হবে না৷ এটা ভেবেই প্রলম্বিত নিঃশ্বাসও ছাড়ল। ধীরেসুস্থে সূচনাকে নিজের পাশে বসিয়ে ওর চিবুকে আলতো ছুঁয়ে বলল,

-” আজ বাসাতেই আপনার হাতে বানানো কিছু খাই?”

-” কী খাবেন বলুন আমি করে আনছি। ”

-” আপনার যা খুশি একটা করুন, হৈমীকে বলুন সাহায্য করতে। ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল সূচনা বলল,

-” আপনি আরাম করুন। আমি যাচ্ছি। ”

সূচনা রান্নাঘরে যাওয়ার পূর্বে হৈমীকে দু’বার ডাকল। রুদ্রর ঘুমটা তখনি ছেড়ে যায়। দেখতে পায় হৈমী তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে ওকে ছেড়ে পাশের বালিশে মাথা রাখে বলে,

-” সূচনা ডাকছে, চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে ওর কাছে যাও। ”
_________
ড্রয়িংরুমে বসে রুদ্রর সঙ্গে কথা বলছিল মাহের। আগামীকালের আলোচনা শেষ করে হঠাৎই মাহের বলল,

-” হৈমীর পরীক্ষা তো অতি নিকটে। মা বলছিল পরীক্ষাটা আমাদের বাড়ি থেকে দিক। এরপর ছোটোখাটো আয়োজন করেই না হয় ওকে আপনাদের বাড়ি পাঠানো হবে। শুনেছি আপনার দাদিরও তাই ইচ্ছে। বাবার সঙ্গেও গতকাল কথা হয়েছে উনি আপনাকেও নিশ্চয়ই বলেছেন। ”

মাহেরের কথায় রুদ্র গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,

-” আমি বাবাকে না বলে দিয়েছি। ”

মাহের জানত বিষয়টা। কারণ শশুরের সঙ্গে গতরাতে এ বিষয়ে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে তার৷ সে যে এ বিষয়ে অবগত তা রুদ্রকে বুঝতে না দিয়ে বলল,

-” দেখুন প্রতিটা সন্তান নিয়ে বাবা, মায়ের সপ্ন থাকে। হৈমীকে নিয়েও আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা পুরোপুরি দুঃস্বপ্ন হোক আমি চাই না। আপনারও বোন আছে আশা করি আপনি আমার জায়গাটা বুঝবেন। ”

সূচনাকে ইঙ্গিত করতেই রুদ্রর জেদ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। দ্বিধান্বিত হয়ে বসে রইল সে। টের পেয়ে মাহের সম্পূর্ণ আস্থার সঙ্গে বলল,

-” আমরা সবাই এখন এই সম্পর্কটাকে মেনে নিয়েছি। বিয়ের পর এতগুলো দিন একসাথে রয়েছেন আপনারা। তাই সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা বাঁধ্য৷ শুধু পরিবারের দিকে তাকিয়ে হৈমীর দিকে তাকিয়ে হলেও রাজি হয়ে যান। আমি এবং সূচনা দু’জনই চাই হৈমী আমাদের সঙ্গে ফিরে যাক। পরীক্ষা শেষে দু পরিবারের সন্তুষ্টি নিয়ে নতুন জীবন শুরু করুক। ”

মাহেরকে সরাসরি আর না করতে পারল না রুদ্র। শুধু বলল,

-” আমার সিদ্ধান্ত পরে জানাব। ”

মাহের বলল,

-” আশা করি হ্যাঁ বোধক সিদ্ধান্ত হবে। ”

সাত সকালে হঠাৎই রুদ্র সিদ্ধান্ত নিল সে কক্সবাজার যাবে না। সে যাবে না মানে হৈমীও যেতে পারবে না। এ ব্যাপারে মাহের প্রথমে বিচলিত হলেও রুদ্রর সঙ্গে একান্তে কথা বলার পর শান্ত হলো। রুদ্রর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টও হলো সে। পূর্ণ বিশ্বাস রেখে বোনকে বোঝানোর দায়িত্ব রুদ্রর ওপরই ছেড়ে দিল। দুপুর পরই সূচনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। সূচনা যতবার জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছে। মাহের ততবারই উত্তর দিল,

-” কোনো প্রশ্ন নয় দু ঘন্টার জন্য কোনো প্রশ্ন করবেন না। দু ঘন্টা পর যতখুশি প্রশ্ন করবেন। এই দুঘন্টা চুপচাপ আমাকে অনুসরণ করুন, আমি যা বলি তাই শুনুন। ”

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই হৈমী রুমের দরজা আঁটকে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আজ রুদ্রর ওপর ক্ষোভটা তার আকাশ ছুঁয়েছে। দরজার বাইরে থেকে অনেক ডাকাডাকি করেও হৈমীকে দিয়ে দরজা খোলাতে পারল না। শেষে ডুপ্লিকেট চাবির সহায়তায় লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করল সে। দেখতে পেল বিধ্বস্ত মুখে মেঝেতে বসে আছে হৈমী। অস্থির হয়ে সে এগিয়ে এলো, চট করে পাঁজা কোলে তুলে নিল ছোট্ট দেহটাকে। বলল,

-” আরে বাবা বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেন? আমার কথাটা শোনো কান্না থামাও, আমি তোমাকে পুরো বিষয়টা বলছি। কেন হঠাৎ যাওয়া ক্যানসেল করেছি সেটা শোনো। কক্সবাজার যাওয়া ক্যানসেল করলেও একদিনের ছুটিও ক্যানসেল করিনি, সব তোমাকে…”

আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না রুদ্র। তীব্র ক্রোধের বশীভূত হয়ে, হিংস্র বাঘিনীর মতো তাকে আক্রমণ করে বসল হৈমী। দু’হাতে অসংখ্য কিল, ঘুষি দিল বুক পাটাতে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলল প্রায়। শেষ পর্যায়ে সামনের দু পাটি দাঁত দিয়ে সজোরে কামড় বসালো রুদ্রর বুকের বা’পাশে। ব্যথায় অকুলান হয়ে ওর ছোট্ট শরীরটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলতে বাধ্য হলো রুদ্র। ত্বরিতগতিতে টিশার্ট খুলে বিস্মিত হলো সে। গলগলিয়ে রক্ত ঝড়ছে বুক থেকে। উফফ কী যন্ত্রণা! বিস্মিত হয়ে তাকাল হৈমীর ক্রোধান্বিত মুখের দিকেও৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

– ” আমার সঙ্গে ফাইট করবে? খুব ইচ্ছে আমার সঙ্গে ফাইট করার? ওকে ফাইন, প্রস্তুত হও তবে। ”

বুকে হাত চেপে চিকিৎসা বাক্স নিয়ে রুম ত্যাগ করল রুদ্র। মানাতে চেয়েছিল হৈমীকে। কিন্তু সুযোগ দিল না হৈমী নিজেই। তাই বাধ্য হয়ে সমঝোতা না করেই দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি একাই নিয়ে ফেলল।

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩৯
এয়ারপোর্ট থেকে কক্সবাজারের কলাতলী পয়েন্টে অবস্থিত একটি পাঁচ তারকা রিসোর্টে এসে ওঠল মাহের, সূচনা দম্পতি। রিসোর্টটির নাম সায়মন বিচ রিসোর্ট। বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নত মানের রিসোর্ট গুলোর মধ্যে সায়মন বিচ অন্যতম৷ রিসোর্টের সম্মুখে এসে দাঁড়াল তারা। সূচনা আচমকাই শক্ত করে মাহেরের একটি হাত চেপে ধরল। ক্ষণিকের জন্য চমকাল মাহের। অবাক চোখে তাকাল সূচনার বিস্ময়ান্বিত মুখ পানে। রুদ্ধশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। সেই যে এয়ারপোর্টে সূচনাকে জানিয়েছিল,

– ” সূচনা আমরা দুদিনের জন্য কক্সবাজার যাচ্ছি। বিয়ের পর আপনাকে নিয়ে তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি৷ তাই ভাবলাম ঢাকা যখন এসেছি, আপনার অভিলষণীয় জায়গায়টায় একটু ঘুরে আসি৷ তারপর ফুরফুরে মেজাজে দু’জনে বাড়ি ফিরব। ”

কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিল সূচনা৷ চোখের পলক ফেলছিল মিনিট দুয়েক পর পর। মাহের পুনরায় যখন বলেছিল,

-” আপনি খুশি হননি? রুদ্রর কাছে শুনেছি আপনার অনেক দিনের শখ ছিল। কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার? সব ব্যবস্থা রুদ্রই করেছে আমি নিষেধ করেছিলাম শোনেনি। বলেছে আমার তরফ থেকে আপনাকে আর যাই দেই এই জিনিসটা সে দিতে চায়। কারণ সে আপনার বহুদিনের জমিয়ে রাখা অভিমান ভাঙাতে চায়। ”

মাহেরের মুখে কথাগুলো শুনে নিরুত্তর হয়ে ছিল সূচনা৷ চোখ দুটো চিকচিক করছিল ঠিকি তবুও বুকভরে শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল। মনে মনে ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল খুব। একদিন পরই তার জন্মদিন। জন্মদিনের উপহারটা দারুণ লেগেছে তার৷ মাহের এখন পর্যন্ত বলেনি এটা তার বার্থডে গিফট তবুও বুদ্ধিমতী সে বুঝে নিয়েছে। মাহেরও বুঝি তাকে কোনো অসাধারণ উপহার দিয়ে চমকে দেবে এবার? এমন অহরহ উত্তেজনাময় ভাবনা ভাবতে ভাবতে একটা শব্দও বিনিময় করেনি সে। মাহের ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। সূচনা কিছুতে অসন্তুষ্ট হয়নি তো। তার সে চিন্তা দূর হয়ে গেল এভাবে শক্ত করে হাতটা ধরাতে। এরপর শান্তি মিলল সূচনার বলা বাক্যটিতে। সে অবিশ্বাস্য সুরে তাকে শুধালো,

– ” আমিত বিশ্বাসই করতে পারছি না মাহের। আপনার সঙ্গে আমার এখানে এভাবে আসা হবে৷ আমি কি স্বপ্ন দেখছি ? একটু চিমটি কাটুন তো আমায়। ”

মাহেরের হাত নাড়িয়ে কথাগুলো বলল সে। মাহের মুচকি হেসে চিমটি না কেটে সহসা তাকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

-” এটা স্বপ্ন নয় সত্যি। বিয়ের পর এটা আমাদের প্রথম হানিমুন ডিয়ার। ”

পুরো শরীর জুড়ে শীতল হাওয়া দোল খেল সূচনার। কনকনে শীতের মাঝে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিল ওদের। সূচনা লজ্জায় মুখ দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নুইয়ে পড়া কণ্ঠে বলল,

-” ওরা দেখছে মাহের প্লিজ সরুন, ছাড়ুন আমায়। ”

ওরা সায়মন রিসোর্টর প্রবেশদ্বার এরিয়াতে দাঁড়ানো। সূচনার কথাটি শুনে সহসা মাহের তাকে ছেড়ে দিয়েছে। ডান দিক বাম দিক, সামনে পেছনে তাকিয়ে সে মাত্র তিনজন লোক দেখতে পেল৷ এদের রয়েছে দু’জন কাপল আরেকজন সিঙ্গেল ম্যান৷ তারা ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে৷ কাপলদের মধ্য থেকে ছেলেটা ওদের উদ্দেশ্য করে বলল,

-” হায়, আমরা নব দম্পতি আপনারা? ”

মাহের সৌজন্যপূর্ণ হেসে জবাব দিল,

-” হ্যালো, সেম টু ইউ। ”

সূচনা লজ্জায় গাল দু’টো লাল করে নত মুখে দাঁড়িয়ে। মাহেরও কিঞ্চিৎ লজ্জায় অধরে হাসি ছড়াল৷ মাথা চুলকে একহাতে লাগেজ অপর হাতে সূচনার নরম হাতটা চেপে ধরে এগিয়ে গেল ভিতরে। সূচনার মস্তিষ্ক জুড়ে আন্দোলন হতে লাগল মাহেরের বলা একটি বাক্যই, ” বিয়ের পর এটা আমাদের প্রথম হানিমুন ডিয়ার ” হানিমুন! শব্দটা হৃদয়ে যেন ধড়াক ধড়াক করে ওঠল৷ তাকে নিয়ে মাহেরের পরিকল্পনা এতদূর এগিয়ে গেল অথচ সে জানতেও পারল না? কোনোভাবে তার মনের চলা অনুভূতি টের পেয়ে গেছে নাকি? যেই ভবিষ্যৎ চিন্তা শাশুড়ি মা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে তা কী টের পেয়েছে মাহের? পাক টের সে তো এটাই চাইছে শুধু মুখ ফুটে বলতে পারছে না৷ এবার সত্যি সত্যি তার সংসার টা হোক৷ তার আর মাহেরের সম্পর্কটা পূর্ণতা পাক। ভালোবাসার ছোঁয়া পড়ুক তাদের দাম্পত্য জীবনে৷ যেই ভালোবাসা সুখের হাতছানি দিক। তাদের পরিপূর্ণ মিলন ঘটুক। তার কোল আলো করে আসুক ফুটফুটে একটি শিশু। যে তাকে মা বলে ডাকবে, মাহেরকে ডাকবে বাবা বলে। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন! সেটাও পূরণ হোক। এতকাল শুনে আসা প্রবাদটা এবার নিজ জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে চায় সে৷ যে নারী রাঁধতে জানে সে নারী চুলও বাঁধতে জানে। নারীরা অনেক বেশি শক্তিশালী, ক্ষমতাবান৷ নারীর তুলনা নারী নিজেই। নিজের তুলনা নিজেই হয়ে দেখাবে সূচনা।
__________
সন্ধ্যার পর রুমে ফিরল রুদ্র। হৈমীকে দেখল বেঘোরে ঘুমাতে। মাথাটা বেশ ঠাণ্ডা এখন। তাই ঠাণ্ডা মাথায় একটি নিখুঁত পরিকল্পনা করেছে সে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী হৈমীকে ডেকে তুলল। ঘুমের ঘোরে ওঠে বসল হৈমী। ঢুলুনি খেতে লাগল অবিরত। রুদ্র হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। সাইট টেবিল থেকে জগের পানি গ্লাসে ভরল। এরপর তা হৈমীর সামনে ধরে শান্ত গলায় আদেশ করল,

-” পানিটা খাও। ”

হৈমী হাই তুলতে তুলতে রুদ্রর দিকে অদ্ভুত করে তাকাল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-” দরদ দেখাচ্ছে দরদ। আমার কারো দরদের প্রয়োজন নেই। ”

অস্ফুটে হলেও রুদ্র কথাটা বুঝতে পারল৷ দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন করে কয়েক পল তাকিয়েও রইল৷ হৈমী বিরবির করে আরো কিছু বলছিল৷ রুদ্র সেদিকে কান দিল না৷ সহসা বাম হাত দিয়ে হৈমীর ঘাড়টা চেপে ধরল। ডান হাতে গ্লাসটা মুখের কাছে চেপে ধরে দৃঢ়স্বরে বলল,

– ” পানিটা খাও ভালো লাগবে। ”

রুদ্রর সঙ্গে সংসার মানেই পরতে পরতে বিপদ৷ এই দুঃখ বুকে চেপে পানিটা সম্পূর্ণ শেষ করল হৈমী। রুদ্রর থেকে মুক্তিও মিলল। তার বীর বাহাদুর সাহেব এবার আরো একটি আদেশ ছুঁড়ে দিল।

-” খাবার গরম করো গিয়ে আজ তাড়াতাড়িই খাব আমরা। ”

খাবার গরম করে রুদ্রকে ডাকতে এলো হৈমী। বলল,

-” খাবার হয়েছে খেতে মন চাইলে আসতে পারেন। ”

রুদ্র ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে দেখল হৈমী যেই স্পিডে এসেছিল সেই স্পিডেই চলে গেল। বাঁকা হেসে সেও ডাইনিং রুমে গেল। হৈমী খাবার বেড়ে বসে আছে৷ রুদ্র চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

-” এ পাশে এসে বসো। ”

ভ্রু কুঁচকে হৈমী জবাব করল,

-” আমি কারো পাশে বসতে আগ্রহী নই আমি। ”

-” আগ্রহ করে নাও ডার্লিং। একটু পর আমার বুকের নিচে শুতেও হবে। ”

আকস্মাৎ চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে দাঁড়িয়ে পড়ল হৈমী। কী সাংঘাতিক কথাবার্তা। মুহুর্তেই আবার দমে গেল। বুকের নিচে শোয়া মানে অশালীন কিছু হয়তো বোঝায়নি। বুকে নিয়ে ঘুমানোর কথাও বোঝাতে পারে। সে শুধু শুধু হাইপার হয়ে গেছে। ভেবেই পুনরায় বসল। রুদ্র একধ্যানে তাকিয়ে তার কাণ্ড দেখছিল। সেভাবে ভ্রু নাড়িয়ে বলল,

-” কী হলো পাশে এসো খাওয়িয়ে দাও। হাত দিয়ে খেতে ইন্টারেস্ট পাচ্ছি না। ”

ঠোঁট উল্টে বিচলিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল হৈমী। মনের কোণে কক্সবাজার যেতে না পারার কষ্টটা কাঁটা দিয়ে ওঠল। মেজাজ দেখিয়ে বলল,

-” পারব না। আপনি আমার অনেক প্ল্যানকে গলা টিপে হত্যা করেছেন। আপনাকে আমি আর আদর করব না। ভালোও বাসব না। ”

বাঁকা হেসে রুদ্র শুধালো,

-” এমন করে বলছ যেন আদর করে, ভালোবেসে আমাকে ভাসিয়ে ফেলেছ। ”

-” তার মানে আমি আপনাকে আদর করিনি? ভালো বাসিনি? আপনি একটা, উমম আপনি একটা মীর জাফর। না না আপনি একটা বেইমান। কলিজা টুকরা করে ভুনা করে খাওয়ালেও আপনি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবেন না৷ বলবেন লবণ কম পড়েছে। ”

-” লবণ কম দিলে তা তো বলবই। ”

রাগে ফুঁসতে শুরু করল হৈমী। রুদ্র শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

-” আরমাত্র তিন দিন আছ। এই তিনদিন প্রত্যেকবেলা আমাকে খাওয়িয়ে দেবে, ঘুম পাড়িয়ে দেবে, যতটা আদর দিতে পারো দেবে, যতটা ভালোবাসতে পারো বাসবে। ”

সহসা হৈমীর জীবনের সমস্ত বাতি যেন এক দমকা হাওয়ার তোড়ে নিভে গেল। সে আঁতকানো কণ্ঠে বলল,

-” মানে! ”

তার এই কণ্ঠস্বর, ভীত দৃষ্টিজোড়া দেখে অনেকটাই অবাক হলো রুদ্র। হৈমী কি তাকে হারানোর ভয় পেল? বা তাকে ছেড়ে যেতে নারাজ বলে এমন রিয়াকশন দিল? মস্তিষ্কে বিচরণ করা প্রশ্ন গুলোর উত্তর মেলাতে মুহুর্তেই একটি কৌশল অবলম্বন করল সে। বলল,

-” তুমি মাহের আর সূচনার সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাবে। এটাই মানে। ”

-” কেন! ”

সহসা কেন শব্দটির উচ্চারণ করল হৈমী। মুখটা তার থমথম। রুদ্র মনে মনে ব্যাপক হাসি হাসল বলল,

-” আসলে হয়েছে কী আমাদের এভাবে বিয়েটা দু বাড়ির কেউই মেনে নিতে পারেননি৷ বিশেষ করে দাদিন আর তোমার মা। তোমার মা আমার প্রতি এতটাই অসন্তুষ্ট যে বোনের সঙ্গে তার সম্পর্কের দিন দিন অবনতি ঘটছে। ভাই হয়ে বোনের এতবড়ো সর্বনাশ তো আমি হতে দিতে পারি না তাই না? ”

-” আমার আম্মু অমন নয়। ”

প্রায় কেঁদে ফেলবে এমন করে বলল হৈমী। রুদ্র বলল,

-” নিজের মাকে নিয়ে নেগেটিভ কিছু তোমার চোখে পড়বে না হৈমী৷ কিন্তু সূচনার চোখে পড়েছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে ফেরত পাঠিয়ে দিব।”

-” একেবারে? ”

ভীত স্বর হৈমীর। রুদ্র ভীষণ সিরিয়াস হয়ে বলল,

-” হু। ”

-” আমি যাব না। আমি আপনার বউ আমি একটুও যাব না। ”

-” উমম বায়না করে না। তোমাকে পুরোটাই যেতে হবে হৈমী৷ সূচনার সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। তোমাকে ছেড়ে দিতেও কষ্ট হবে না আমার। ”

সহসা কেঁদে ফেলল হৈমী। বলল,

-” আমাদের যে বিয়ে হলো তার কী হবে? আমরা সংসার করব না? ”

-” না। ”

-” আপনিই তো আমাকে জোর করে সব করলেন৷ তাহলে এখন এমন করছেন কেন? ”

উতলা স্বর হৈমীর৷ রুদ্র বিরক্ত কণ্ঠে বলল,

-” কারণটা বললাম তো। ”

-” আমি আম্মুকে বলব ভাবিকে বেশি বেশি ভালোবাসতে। ”

সহসা রুদ্র ধমকে ওঠল। বলল,

-” আহ এত কথা কেন? আমার জন্য তোমার জীবনটা তো অতিষ্ট, ফিরে যাচ্ছ এতে খুশি হবার কথা মুখটা শুকিয়ে গেল কেন? চোখেই বা পানি কেন? ”

করুণ মুখে তাকিয়ে রইল হৈমী। রুদ্র বলল,

-” চলেই তো যাবে শেষ কটা দিন আমার কথা মতো চললে ভালো লাগত। ”

হৈমীর বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। দুচোখ গলে বেরিয়ে এলো অজস্র অশ্রুকণা৷ রুদ্র নির্নিমেষে তাকিয়ে দেখল প্রতিটা জলকণা। থমকানো সুরে বলল,

-” পাশে এসে বসো। খিদে পেয়েছে নিজ হাতে খাওয়িয়ে দাও। এটাকে না হয় তোমার আদর ধরে নিব। ”

বুকের ভিতর ঝড় ওঠল হৈমীর। সমস্ত দুষ্টি বুদ্ধি এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল তার। চোখে মুখে ভর করল রাজ্যের বিষণ্নতা। বুকের ভিতর কষ্ট গুলো তীব্র হতে লাগল। মনে মনে বলল,

-” আমিত আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি রুদ্র বেয়াই। আমিত আপনার বউ। তাহলে কেন আমাকে ফিরিয়ে দেবেন। আমার সাথে কেন সংসার করবেন না। আমি বোকা বলে? বেশি বকবক করি বলে? আমি আর বকবক করব না। আমি চালাক হতে চেষ্টা করব। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আপনাকে বড়ো ভালোবাসি রুদ্র বেয়াই। ”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল সে। রুদ্রর পাশে গিয়ে বসে ভাত মেখে রুদ্রর মুখে ধরতেই চোখ গলে পড়তে লাগল নোনাপানির ধারা। সেদিকে তাকিয়ে মুখে খাবার নিল রুদ্র। আয়েশ করে খাচ্ছে সে আর হৈমী একাধারে কাঁদছে আর তাকে খাওয়িয়ে দিচ্ছে। এ এক বিস্ময়কর দৃশ্য। মেয়েটা সত্যি বোকা, সত্যি বাচ্চা। আজো পৃথিবীতে এমন বৈশিষ্ট্যের কিছু মেয়ে আছে। যাদেরকে হঠাৎ কেউ যদি মজা করে বলে আজকে তোমায় দেখতে বিশ্রী লাগছে৷ তাহলে সেই কথা ধরে মেয়েগুলো মন খারাপ করে। বার বার আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে ঠিক কতখানি বিশ্রী লাগছে মাপে। এরা এতটাই সরল হৃদয়ের হয় যে সাধারণ বিষয় গুলো সব সময় অসাধারণ ভাবে বিচার করে। কষ্ট পায়, চিন্তা করে। ঠিক যেমন রুদ্রর মজার ছলে বলা কথাগুলো খুব সিরিয়াস ভাবে নিল হৈমী। মনে মনে আকাশ, মাটি কাঁপানো দুঃখ পেতে শুরু করল৷ ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে দুচোখে নামাল ঝরনা ধারা। এ ধরনের মেয়েরা মানুষকে প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারে। ব্যক্তিগত মানুষটাকে ভালোবাসে মন প্রাণ উজার করে৷ এদের কাছে থাকে ভালোবাসা নামক জাদুর মেশিন। মন ভালো করা জাদুর মেশিন৷ মন খারাপ করা জাদুর মেশিনও থাকে। তবে সেই মেশিন শুধু নিজেদের বেলায় প্রয়োগ করে। অন্যদের নয়। সর্বপরি, মানুষ নামক পাথরে হৃদয়ে প্রেমের ফুল ফোটানোর ঐশ্বরিক ক্ষমতার মেশিনও থাকে।

রুদ্রকে খাওয়িয়ে হৈমী না খেয়েই ওঠে যাচ্ছিল। তৎক্ষনাৎ ওর হাত টেনে ধরে রুদ্র। বলে,

-” আমার সামনে বসে সুন্দর করে প্রতিটি পদ দিয়ে ভাত খাও তো। আমি চাচ্ছি এই তিনদিন তোমার করা প্রতিটি কাজ মনোযোগ দিয়ে দেখতে। যাতে চলে যাবার পর এগুলো স্মৃতিচারণ করতে পারি। ”

থেমে যাওয়া কান্নাটা হুহু করে ফিরে এলো। রুদ্র বলল,

-” আহ চলেই তো যাবে। যাওয়ার আগে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ কেন? এ পৃথিবীতে দুটো মেয়ের কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। এক সূচনা দুই তুমি। ”

অধর কামড়ে কান্না আটকালো হৈমী। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইল না। জোরপূর্বক পানির সাহায্যে গিলল সে। খাওয়া শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই সহসা রুদ্র একটি ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিল। বলল,

-” তোমাকে শাড়িতে দেখতে মন চাচ্ছে। শাড়ি পড়তে পারো না জানি, তবুও যেভাবে পারো পরে নাও। আর হ্যাঁ ভিতরের পেপার গুলো ভালোভাবে দেখে নিও। ”

কথাগুলো বলে রুম থেকে চলে যেতে উদ্যত হলো। আবার থেমে গিয়ে বেরোনোর পূর্বে বলে গেল,

-” শাড়িটা পরে পেপার গুলো ধরবে এর আগে নয়। ”

কোনোরকমে শাড়ি পরে হন্তদন্ত হয়ে পেপার গুলো দেখল। ভেবেছিল ডিভোর্স পেপার। মনে মনে ঠিক করেছিল ডিভোর্স পেপার হলে এগুলো পুড়িয়ে দেবে। কিন্তু নাহ এগুলো ডিভোর্স পেপার নয়। ব্যাংকের কাগজপত্র। যতটুকু বুঝল তার নামে একটি একাউন্ট খোলা হয়েছে আর সেখানে বেশ বড়ো এমাউন্টের টাকাও আছে। মুহুর্তেই আঁতকে ওঠল সে। কীসের টাকা এগুলো। মানুষের ডিভোর্স হলেও জামাই টাকা দিয়ে দেয় শুনেছে। তাহলে কি সেটাই? হৃদয়টা আবারো খানখান হয়ে গেল তার। রাগে, দুঃখে ছুঁড়ে ফেলল পেপার গুলো। অমনি চোখ পড়ল আরো একটি পেপারে। যেখানে গোটাগোটা অক্ষরে কিছু লেখা। সে ধাতুপাত করে পেপারটা হাতে নিল। লেখা গুলো পড়তে পড়তে তার শরীরটা আচমকা অসাড়ে অনুভূত হলো।

-” মিসেস ডার্লিং, মাই সুইট প্যারোট, হটেস্ট জান, লিটল ওয়াইফ, আপনার দেনমোহরের পুরো টাকাটাই পরিশোধ করা হয়েছে। এগুলো হয়তো আপনার মাথায় খুব একটা ঢুকবে না। প্রয়োজনও নেই। শুধু প্রস্তুত থাকুন। আর হ্যাঁ সরি টরি আমার দ্বারা হবে না। আরো একটি হুশিয়ারী দিই , যা কিছু হবে সব স্বাভাবিক, আজ আপনি যে রুদ্রকে পেতে চলেছেন সেই রুদ্রই চিরকাল আপনার জীবনে ধ্রুব সত্য হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ । ”

চলবে…