বেসামাল প্রেম পর্ব-৪৪+৪৫

0
112

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৪
__________________________
এক সপ্তাহ পর হৈমীর পরীক্ষা শুরু। সে কথা মাথায় রেখে নিজের কর্তব্য পূরণ করে রুদ্র। রুদ্রর পাঠানো পার্সেল সূচনা হৈমীকে দিতেই সে সেগুলো গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ে জেদ দেখিয়ে বলে,

-” যে মানুষটা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। তার দেওয়া কোনো কিছুই নিতে আমি রাজি নই। ”

হৈমীর বক্তব্য রুদ্রকে জানালে সে দ্রুত মিটিং শেষ করে সরাসরি ভিডিয়ো কল দেয় হৈমীকে। হৈমী তখন গোসল করে চুল আঁচড়াচ্ছে। ফোন রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ফরমাল পোশাকে রাশভারি রুদ্রর মুখ দেখতে পায়। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে মুহুর্তেই। তাচ্ছিল্য করে বলে,

-” শুনেছি জাঁতায় পড়লে বাঘও ধান খায়। ”

সদ্য স্নান করা হৈমীর স্নিগ্ধ মুখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রুদ্র। বস চেয়ারে হেলান দিল সন্তর্পণে। অধরে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে পাল্টা জবাব দিল সেও,

-” বাঘ ধান খায় কি খায় না সে বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু রুদ্র শেখ ধানকে ভাত বানিয়ে খেতে জানে। ”

ঢোক চিপল হৈমী৷ তর্জনী উঁচিয়ে বলল,

-” দেখুন আপনি কিন্তু খুব খারাপ৷ কতগুলো ফোন দিয়েছি আমি? কতগুলো ম্যাসেজ করেছি জানেন? ”

-” জানি। ”

সোজাসাপটা উত্তর দিল রুদ্র। মুখ হা হয়ে গেল হৈমীর। চোখ কটমট করে তাকিয়ে রইল সে। রুদ্র সেসবে তোয়াক্কা না করে বলল,

-” আমার অফিসে বেশ চাপ। আপাতত আসতে পারছি না। তবে সিয়র থাকো পরীক্ষার মাঝেই গিয়ে দেখা করে আসব একদিন। ”

এ কথায় সন্তুষ্ট হলো হৈমী। মনটাও ভালো হয়ে গেল তার। খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” কেমন আছেন আপনি? ”

-” ঠিকভাবে পড়াশোনা করবে, ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করবে। আশানুরূপ রেজাল্ট না পেলে লজ্জায় তোমার ভাই মুখ দেখাতে পারবে না৷ একজন লেকচারারের বোন তুমি আশা করি এটা মাথায় থাকবে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এত ফোন, ম্যাসেজ করে প্রেম দেখাতেও হবে না। সময় করে আমিই ফোন করব। যতদিন পরীক্ষা চলবে ঠিক ততদিন এই কথাগুলো মাথায় রাখবে। রাখছি রাতে ফোন করব। ”

টুট টুট করে ফোনটা কেটে গেল৷ হৈমী স্তব্ধ হয়ে বসে কিয়ৎক্ষণ। ঢোক চিপে বিরস বদনে আফসোস মিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেলল। বিরবির করে বলল,

-” ধূর ছাঁই। এতদিন পর ফোন করেছে। কোথায় মান, অভিমান করব। দু’জন দুজনের খবর নিব। কথা চলতে চলতে একটু রোমান্টিক মুডে চলে যাব। তা না ঠাশঠুশ বকবক করে কেটে দিল! আনরোমান্টিক জামাই একটা! ”

রাতে ফোন করবে রুদ্র। তাই দুপুরে খেয়েদেয়ে পড়তে বসল হৈমী। রাত পর্যন্ত পড়ে সময় কাটাবে৷ এরপর রুদ্র ফোন করলে ভালোমন্দ দু’টি কথা বলবে। হৈমীর চোখ, মুখের উজ্জ্বল ভাব দেখেই সূচনা বুঝতে পারল রুদ্রর সঙ্গে কথা বলে তার মন ভালো হয়ে গেছে৷ তাই রুদ্রর পাঠানো জিনিস গুলো রুমে এসে দিয়ে গেল। হৈমী সেগুলো খুলে দেখল, দু’টো শাড়ি, দুটো সেলোয়ার-কামিজ, পনেরো হাজার টাকা। এছাড়াও পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। যা দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায়, সে খুবই দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তি। সবকিছু গ্রহণ করলেও পনেরো হাজার টাকা সে সূচনাকে দিয়ে দিল। বলল,

-” টাকা দিয়ে আমি কী করব এগুলো আমার লাগবে না। ”

সূচনা হৈমীর হাত চেপে ধরে বলল,

-” টাকা দিয়ে কী করবে তুমি ভালো জানো। শোনো আমার ভাইয়ের বউয়ের খরচ তার বাবার বাড়ির লোক বহন করবে এটা কিন্তু ভালো দেখায় না৷ ঠিক যেমন আমার খরচ তোমার ভাইয়া দিচ্ছে তোমার খরচও আমার ভাইই দেবে৷ এটাই নিয়ম। ”

হৈমী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। সূচনা তার পার্স বের করে সেখানে টাকা রেখে বলল,

-” পড়াশোনা করছ। যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে সেদিন চাইলে তুমিও এভাবে তাকে দিতে পারবে৷ স্বামীর টাকার ওপর যেমন স্ত্রীর হক আছে তেমনি স্ত্রীর টাকার ওপর স্বামীরও হক আছে বুঝলে। যেহেতু এখন আমরা কেউ নিজের পায়ে দাঁড়াইনি সেহেতু তাদের কর্তব্যটুকু সন্তুষ্টির সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। ”

মাথা নাড়ল হৈমী। অর্থাৎ সূচনার কথা সে বুঝতে পেরেছে। মিষ্টি করে হেসে সূচনা বলল,

-” আমি যাই তুমি মন দিয়ে পড়ো৷ ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু। ”
________________
একমাস পর,
বিকেলবেলা রুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে সূচনা। মাহের রুমে ঢুকে লাইট অন করতেই নাক টানার শব্দ পেল। চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানায় তাকাতেই দেখল, সূচনা চোখের পানি আড়াল করে ধাতস্থ হয়ে বসল। ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো মাহের৷ বিছানায় বসে থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-” কী হয়েছে সূচনা? ”

মাহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা হুহু করে ওঠল সূচনার। লুকিয়ে ফেলা কান্নাগুলোও বেরিয়ে এলো আচমকা। হতভম্ব হয়ে গেল মাহের। সহসা সূচনার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করল,

-” অ্যাঁই মেয়ে এভাবে কাঁদছ কেন? ”

সম্পর্কে উন্নতি ঘটেছে অনেক। আপনি থেকে তুমি সম্পর্কে পদার্পণ করেছে উভয়ই। বেড়েছে একে অপরের মনের মিলনের গভীরতাও।

-” হলো না মাহের হলো না! ”

বুঝতে না পেরে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল মাহের। ধীরেধীরে সূচনাকে বুকে আগলে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” কী হয়েছে বলবে তো এভাবে কেন কাঁদছ। কী হয়নি বলো? ”

-” আমি আবারো ব্যর্থ। ”

ক্রন্দনরত কণ্ঠে সূচনা এটুকু উচ্চারণ করতেই চমকে ওঠল মাহের। সহসা সূচনার কাঁধ ধরে মুখের দিকে দৃষ্টি রাখল। চোখে চোখ পড়তেই সূচনা বলল,

-” এবারেও ও এলো না। ”

হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাহের সূচনার দুই গালে আলতো স্পর্শ করল। মুখোমুখি হয়ে আদুরে সুরে বলল,

-” কী বোকা মেয়ে! সামান্য বিষয়টা নিয়ে এভাবে কেউ কাঁদে? অ্যাঁই আমরা বিয়ে করেছি কতদিন হুম? আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই গড়ে ওঠেছে মাত্র দু’মাস। তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? হায় আল্লাহ! একে নিয়ে আমি কী করি। ”

সূচনার চোখের পানিগুলো বাঁধনহারা। মাহের তাকে গভীর করে বুকে জড়িয়ে নিল। মাথায় চুমু খেয়ে স্বান্তনা দিল,

-” আমাদের পুচকো আসবে সূচনা শীঘ্রই আসবে। আল্লাহ তায়া’লার আমাদেরকে বিশেষ সময়েই বিশেষ উপহারটা দিবেন৷ তুমি একটু ধৈর্য্য ধরো প্লিজ। ”

ধীরেধীরে শান্ত হলো সূচনা৷ মাহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,

-” আমি জানি সূচনা মা তোমাকে বংশধর আনার জন্য তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু আমার এত তাড়া নেই। আল্লাহ যখন চাইবে তখনি আমাদের সন্তান আসবে৷ এখানে তোমার হাত নেই৷ সন্তান বাজারের কোনো পণ্য নয় যে চাওয়া মাত্রই পেয়ে যাব। মা কেন অবুঝতা করছে বুঝতে পারছি না কিন্তু এসবের জন্য তোমার পড়াশোনা আর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এটা ঠিক বুঝতে পারছি। ”
_________________
হৈমীর পরীক্ষা আগামীকাল শেষ। কথা অনুযায়ী রুদ্র পরীক্ষার মাঝে একটা দিন সময় করে ওঠতে পারেনি৷ দেখা করতে পারেনি হৈমীর সাথে। তাই শেষ পরীক্ষার আগের দিন রাত আটটার মধ্যে অফিসিয়াল সব কাজ শেষ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে৷ সারাদিন অফিস করে রাতে নিজেই ড্রাইভ করে ফেরার পথে ছোট্ট একটি দূর্ঘটনা ঘটায়৷ মাথায় আর হাতে চোট পেয়ে টাঙ্গাইল না গিয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যায়। সেখানে তার বান্ধবী সুবর্ণা ছিল। সে তার মাথায় ব্যান্ডেজ করে হাতে দুটো সেলাই করে দেয়। কিছু মেডিসিন লিখে দিলে সে ফেরার জন্য উদ্যত হয়৷ হসপিটালের করিডোরে তখনি অল্পবয়সী এক যুবকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে তার। এক দিকে শরীরের শোচনীয় অবস্থা অপরদিকে মাথার ভেতর চলছে তাকে রাতের মধ্যে টাঙ্গাইল ফিরতে হবে। সকালে হৈমীকে পরীক্ষা দিতে সে নিজেই নিয়ে যাবে। তারওপর এভাবে বেখেয়ালি যুবকটি ধাক্কা খেল! প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে তাই যুবকটিকে ধমকে মারতে উদ্যত হলো সে। বা হাতে কলার চেপেও ধরল। যুবকটিও কম নয়। অগ্নি চক্ষুতে তাকিয়ে কাঁধ চেপে ধরল রুদ্রর। মুহুর্তেই ছোটোখাটো হট্টগোল বেজে গেল। যুবকটি যে পথ দিয়ে এলো সে পথেই উপস্থিত হলো একজন মাঝবয়েসী মহিলা। ভীতিকর কণ্ঠে সে বলল,

-” এই রিমন কী হয়েছে? এই ছেলে আমার ছেলেকে মারছ কেন তুমি? ”

তীব্র ক্রোধান্বিত চোখ দু’টো সহসা তুলতেই সম্মুখে দণ্ডায়মান নারীটিকে দেখে আচমকা যুবকটির কলার ছেড়ে দিল রুদ্র। কান দু’টো সজাগ হলো। চোখ দু’টো বিস্মিত। মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে গেল শীতল স্রোত। যুবকটিকে কিছু বলতে গিয়েও ঠোঁট কেঁপে ওঠল। সম্মুখের নারীটিকে আপাদমস্তক দেখে অবচেতনেই হৃদয় টনটন করে ওঠল। হাহাকার করে বের হতে চাইল একটি শব্দ,
-” মা! ”

কিন্তু তীব্র ঘৃণায় সেটুকু আর বের করতে পারল না। সম্মুখের নারীটিও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে। নিজের প্রথম সন্তানকে চিনতে সে একটুও ভুল করেনি। ছবিতে যেমনটা দেখেছিল তার চেয়েও বেশি সুদর্শন তার প্রথম সন্তান রুদ্র শেখ। মনে মনে ভাবতেই ডুকরে ওঠল সে। চোয়ালদ্বয় শক্ত করে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে রুদ্র বলল,

-” মিসেস সুরভী! ”

সুরভী বেগম হাত বাড়াল রুদ্রর দিকে। একটি ছোঁয়ার আশায়। ছিটকে দূরে সরে গেল রুদ্র। তীব্র ঘৃণায় চোখ খিঁচিয়ে বলল,

-” ডোন্ট টাচ মি, ডোন্ট টাচ মি। ”

রিমন ভ্রু কুঁচকে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল। রুদ্রর প্রতি হওয়ার কঠিন রাগটা নিমিষেই কমে এসেছে তার। মনে জেগেছে কৌতুহল। সে কৌতুহল থেকেই মা’কে জিজ্ঞেস করল,

-” আম্মু বড়োভাই? ”

সুরভি মাথা নাড়াল। রুদ্র রিমনের দিকে অসহনীয় ঘৃণায় তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। সুরভি বেগম রুদ্রর দিকে এগিয়ে এসে বলল,

-” তোর কী হয়েছে বাবা? মাথা, হাতের এ কি অবস্থা। এই রুদ্র! ”

আচমকা সুরভি বেগম রুদ্রর বাহুতে চেপে ধরলেন৷ তৎক্ষনাৎ রুদ্র হিংস্রতার সঙ্গে এক ঝটকায় হাত ছাড়াল। বিষয়টা এতটায় ক্রোধের সঙ্গে ঘটল যে সুরভি তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গেলেন। মাকে পড়ে যেতে দেখে রিমন এসে ধরল। মেজাজ খারাপ করে রুদ্রর দিকে তাকাল। বলল,

-” এটা কী ধরনের আচরণ! ”

রুদ্র সহসা তর্জনী উঁচিয়ে বলল,

-” অ্যাঁই আচরণ শিখাবি না…”

এটুকু বলে সহসা থেমে গেল। বাকিটুকু আর উচ্চারণ করতে পারল না। একরাশ ঘৃণা নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল তার দেখা নিকৃষ্ট একজন মায়ের সামনে থেকে। সুরভি বেগম তার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে মুখে আঁচল চেপে ডুকরে ওঠলেন। রিমনের বুকে মুখ গুঁজে অশ্রুপাত করলেন বিরতিহীন।
________________
রুদ্রর বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফজরের আজান দিয়ে দিল। অসহনীয় দুঃখ, কষ্টে জর্জরিত বুকটা নিয়ে ঘরে ফিরল সে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই বুঝল গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে… মস্তিষ্কে জুড়ে সুরভি বেগমের মুখ গিজগিজ করছিল এরই মধ্যে সহসা হৈমীর মুখটা মনে পড়ল। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে শুধু অস্ফুট স্বরে বলল,

-” কথা রাখতে পারলাম না। এরজন্য আমি একটুও সরি নই। তোমার কপাল খারাপ। কারণ আমি মানুষটাই খারাপ। আমি কেন খারাপ জানো? কারণ আমাকে যিনি জন্ম দিয়েছেন ঐ একটা খারাপ। ওকে আমি খু”ন করব খু”ন। ”
_________________
পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফিরে গোসলে ঢুকেছে হৈমী। এমন সময় সূচনার কাছে ফোন এলো দাদিনের। জানালো রুদ্রর অবস্থা খুব খারাপ, এক্ষুণি তাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছে। সে যেন হৈমী আর মাহেরকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসে। গোসল করে বের হওয়ার পর খবরটা শোনামাত্র হৈমীর চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত জল গড়াতে লাগল। একদিকে সূচনা আরেকদিকে হৈমী। একসঙ্গে দু’জনকে সামলে বিশ মিনিটের পথ শেষ করল মাহের। হাসপাতালে যাওয়ার পর শুনতে পেল গতকাল রুদ্র কখম বাড়ি ফিরেছে কেউ জানত না৷ দুপুর বারোটার দিকে দাদিন রুমের দরজা খোলা দেখতে পেয়ে রুমে যায়। রুদ্রকে মেঝেতে সেন্সলেস অবস্থায় পায়। হাসপাতালে আনার পর ডক্টররা জানায় অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে ঘুমের ঘোরে মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে তার। যা বড়ো ধরনের স্ট্রোকের পূর্বলক্ষণ। এ বয়সে এ ধরনের রোগ খুবই দুঃখজনক বলে আফসোস করছে ডাক্তাররা।

চলবে…

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৫
দুদিন পর৷ রুদ্রকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। দুই পরিবারের মধ্যে কথা হয়েছিল হৈমীর পরীক্ষার পর আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শেখ বাড়িতে আনা হবে হৈমীকে। আকস্মাৎ রুদ্র অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই সিদ্ধান্ত ভঙ্গ হলো। রুদ্রর বাবা জানালেন তার ফিরতে তিনমাস লাগবে। এসে ছেলে, ছেলে বউয়ের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। এ মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রুদ্রর সুস্থতা। পারিবারিক চিন্তা, বিজনেস সবকিছু থেকে দীর্ঘসময় ছুটি দেয়া হলো রুদ্রকে। বিজনেসের পুরো দায়িত্ব গিয়ে পড়ল বড়ো চাচার ছেলে রাদিফ, আর ছোটো চাচা রিজওয়ান শেখের ওপর৷ রুদ্র মানতে চাইল না। দাদিন বকাঝকা করল। ফাঁকা বাড়িটা হুট করেই মানুষে ভরে ওঠল। বড়ো চাচি, ছোটো চাচা, চাচি, চাচাত ভাইরা উপস্থিত হলো বাড়িতে।

সন্ধার পর মুহুর্ত। বেডরুমে আধশোয়া হয়ে বসে রুদ্র। চোখ দু’টো স্থির সামনের দেয়ালে। ক্লথ ব্যাগ থেকে নিজের কাপড় বের করে, সেগুলো গুছিয়ে কাভার্ডে রাখছে হৈমী। রুদ্রর গায়ে শুধু টি-শার্ট, ট্রাউজার। স্মরণ হতেই একটি হুডি সোয়েটার বের করল হৈমী। রুদ্রর পাশে এসে দাঁড়িয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল,

-” এটা পরে নিন। ”

গম্ভীর মুখটা হৈমীর দিকে ফেরাল রুদ্র। কিয়ৎক্ষণ চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। হৈমী আহত মনে তার পাশে এসে বসল। বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজেই সোয়েটারটা পরিয়ে দিতে উদ্যত হলো। সহসা রুদ্র চমকে ওঠে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেল। হৈমীকে সোয়েটার পরিয়ে দিতে সাহায্য করল সে। যেন একটু স্বস্তি পেল হৈমী। নিঃস্বাস ফেলল স্বস্তি সহকারে। দরজার বাইরে থেকে হামিদা ডাকল হৈমীকে,

-” হৈমী আছিস? ”

রুদ্রর মাথায় হুডি তুলে দিয়ে সরে এলে হৈমী। বলল,

-” আছি আম্মু ভেতরে এসো তুমি। ”

হামিদা ভেতরে এলেন। নড়েচড়ে পূর্ণ গম্ভীরতা বজায় রেখে ঠাঁই বসে রইল রুদ্র। মা’কে হৈমী একটি চেয়ার টেনে দিল। চেয়ারে বসে রুদ্রর দিকে স্নেহময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন হামিদা। বললেন,

-” বাবা তোমার বয়স অল্প। এই বয়সে আমোদে মেতে থাকবা। তা না করে এত কি চিন্তা করো? সব দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলো। নেশাপানি আগে খেয়েছ এখন ওসব ছেড়ে দাও৷ দেখলে তো কী বিপদ ঘটল?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। না ফিরে তাকাল আর না কোনো জাবাব দিল। হামিদা হৈমীর ফ্যাকাশে মুখটার দিকে এক পলক তাকাল৷ এরপর রুদ্রর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

-” আমার মেয়েটার চেহেরার কী হাল হয়েছে দেখেছ? কত বয়স ওর? এই বয়সটা কি স্বামী নিয়ে চিন্তা করার বয়স তুমি বলো? মুখটা একদম রক্তশূন্য হয়ে গেছে৷ ”

চকিতে হৈমীর দিকে দৃষ্টি তুলল রুদ্র। বুকের ভিতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে যেন গলায় আটকাল হৈমীর। মাথা নিচু করে ফেলল সে। হামিদা বললেন,

-” বাবা, আমার মেয়েটার দায়িত্ব নিয়েছ তুমি। তোমার নিজের জীবনই যদি ঠিক না থাকে ওর জীবন ঠিক থাকবে? এতদিন তুমি একা ছিলে। যেভাবে খুশি বেঁচেছ এখন তো একা নেই। তোমার সঙ্গে হৈমীও জড়িত এখন। তোমার ভালো, মন্দ যা কিছু ঘটুক সবটার প্রভাব ওর ওপর পড়বে। ”

রুদ্র ঘনঘন চোখের পলক ফেলে হৈমীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। হামিদা বলতেই থাকলেন,

– ” দু’দিন ধরে মেয়েটার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে মা হয়ে আমিত টের পাচ্ছি। ও খুব বোকাসোকা বাবা৷ কিন্তু ওর মনে মানুষের জন্য অগাধ মায়া ভালোবাসা। যাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তাদের কষ্টেও কতটা কষ্ট পায় আমি জানি৷ তুমি তো ওর স্বামী ওর চোখ দু’টোই বলে দেয় ও তোমাকে কতটা ভালোবাসে। আমার হৈমী ভালো নেই বাবা। তোমার জীবনে কী হয়েছে না হয়েছে ওসব আমি বুঝতে চাই না৷ তুমিও সেসব কামড়ে বেঁচে থেকো না৷ আমি তোমার কাছে একটা সুস্থ, সুন্দর জীবন ভিক্ষা চাই আমার মেয়ের জন্য৷ ”

সহসা রুদ্রর একটি হাত চেপে ধরলেন হামিদা। ডুকরে ওঠলেন মুহুর্তেই। হৈমীর চোখ দিয়ে টপটপিয়ে জল গড়াল। নাক টানার শব্দ পেল রুদ্র। ক্রন্দনরত কণ্ঠে হামিদা বললেন,

-” বাপ মরা মেয়ে আমার। তুমিই এখন শেষ ভরসা। আমি তোমার কাছে আমার মেয়ের সুষ্ঠু জীবন ভিক্ষা চাই। আমার মেয়েটা খুব ভালো বাবা। আমার বিশ্বাস ও তোমাকে সুখী করতে পারবে৷ তুমি শুধু স্বাভাবিক জীবনে ফেরো। আগুনের শিখার মতো জ্বলজ্বল করা মেয়েটার এমন নিভে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারি না বাবা। ”

রুদ্রর নিঃশ্বাসের গতি বাড়ল৷ আচমকা হৈমী তার মা’কে সামলালো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বলল,

-” আম্মু চুপ করো। ডাক্তার উনাকে উত্তেজিত করতে নিষেধ করেছে। আর কিছু বলো না প্লিজ। ”

নিজেকে সামলাতে না পেরে ওঠে গেলেন হামিদা। চোখ বুঝে ঘনঘন শ্বাস নিল রুদ্র। মায়ের দিকে আর খেয়াল দিল না হৈমী। রুদ্রর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখল। বলল,

-” আপনার কি খারাপ লাগছে? আমি ভাবি কে ডাকব? পানি খাবেন? ”

শেষ বাক্যে মাথা নাড়ল রুদ্র। অর্থাৎ সে পানি খাবে। এক মুহুর্ত দেরি না করে পানি আনল হৈমী৷ নিজহাতে রুদ্রকে পানি খাওয়াল সে। নিজের ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে দিতে নিলে রুদ্র কিঞ্চিৎ চমকাল। তার মনে হলে মাত্র দু’দিনে মেয়েটা অনেক বেশি বড়ো হয়ে গেছে। অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়েছে।

রাত বাড়তে লাগল। হামিদা, মাহের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সূচনা কিছুদিন বাবা বাড়িতে, ভাইয়ের কাছে থাকবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপত্তি করেনি মাহের। বরং সে যতদিন থাকবে মাহেরও মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে বলে স্বান্তনা দিয়েছে। রাত নটার দিকে ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে রুমে এলো সূচনা৷ হৈমীকে বলল,

-” ভাইয়াকে আজ আমি খাওয়িয়ে দেই৷ এরপর আমরা দু’জন মিলে খেয়ে নিব। ”

মাথা কাত করে সম্মতি দিল হৈমী। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল বিছানায়৷ সূচনার দিকে তাকিয়ে রুদ্রর দম বন্ধ হয়ে এলো। তার ভেতরে জমানো কথা গুলো গুমোট ধরল। দু’দিন আগে তার সঙ্গে কাদের দেখা হয়েছিল কেউ জানে না। জানলে সবার প্রতিক্রিয়া কী হবে সে জানে না। কিন্তু সূচনার প্রতিক্রিয়া ঠিক আঁচ করতে পারে৷ গোপনে গোপনে একাধারে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করল সে। ভাইকে খাওয়িয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়িয়ে, ভালোমন্দ কথাবার্তা বলে চলে গেল সূচনা। হৈমীকে বলে গেল নিচে যেতে দু’জনে একসঙ্গে খাবে। রুদ্রর সব ওষুধ খাওয়ালেও ঘুমের ওষুধটা খাওয়া হয়নি। সূচনা দিতে নিলে রুদ্র বলেছে আরেকটু পর খাবে। হৈমী নিচে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল,

-” পানি রেখে যাব? নাকি আমি এলে ঘুমের ওষুধ খাবেন। ”

থম মেরে হৈমীর শান্ত দু’টো চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্র। ফ্যাকাশে মুখটায় প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল,

-” তুমি এসো তারপর খাব।”

হাসপাতাল থেকে ফেরার পর হৈমীর সঙ্গে প্রথম এই কথাটা বলল রুদ্র। হৈমীর অশান্ত হৃদয়টা এটুকুতেই শান্ত হলো। ফ্যাকাশে মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হলো হৈমীর। ধিকিধিকি বুকটা নিয়ে সন্তর্পণে চলে গেল নিচে। নিচে যেতেই দেখা হলো বড়ো চাচি জেরিন, ছোটো চাচি রিনার সঙ্গে। সাদমান, সোহান, রোশান টিভি দেখছে। হৈমী তাদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” ওরা খেয়েছে? ”

বড়ো চাচি বললেন,

-” সবাই খেয়েছে তুমি আর সূচনাই বাদ আছ। চটজলদি খেয়ে নাও। এখানে বেশ শীত। ”

ছোটো চাচি সহসা হৈমীকে বললেন,

-” তুমি ঘরের কাজ পারো না? ”

হৈমী খেতে বসতে বসতে মাথা নাড়াল,

-” খুব একটা না। ”

ছোটো চাচি বললেন,

-” এসেছ থেকে ঘরেই বসে আছ। কাজ না জানলেও শশুর বাড়িতে এসে ঘরে বসে থাকা ঠিক না। আমার এত বছর হলো বিয়ের। কতদিন পর পর এখানে আসি। তবুও তো ঘরে বসে থাকি না। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই সব হয়তো বোঝো না। আমি হলাম চাচি শাশুড়ি। আমার কথা শুনতে খারাপ লাগতে পারে৷ কিন্তু আমি যা বলব মুখের ওপরই বলব। কাল থেকে আমাদের হাতে হাতে কাজ করবে বুঝেছ। ”

হৈমীর মুখটা চুপসে গেল। সে মাথা কাত করে খেতে মনোযোগ দিল। সূচনা চাচিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-” ছোটো কাকি, শাশুড়ি হলেই কি এভাবে কথা শোনাতে হবে? কই আমার শাশুড়ি তো এভাবে কথা শোনায় না। আমাদের হৈমী তো ছোটো আস্তেধীরে সব শিখে নেবে। ভাইয়া অসুস্থ সবে আসল বাড়িতে৷ এখনি কী কাজ করবে ও? ”

-” যে করার শুরু থেকেই করে গো। আর তোমার শাশুড়ি কথা শোনাবে কীভাবে তুমি তো সব পারো। এ বাড়িতে থাকাকালীনই নিজের সব কাজ নিজে করেছ। দাদিন, ভাইয়ের খেয়াল রেখেছ। ও বাড়িতেও নিশ্চয়ই সব কাজে তুমি এক্টিভ। ”

মৃদু হাসল সূচনা বলল,
-” না গো কাকি। আমি সব পারি না। আমারো ভুল হয় মা সবকিছু শিখিয়ে পরিয়প নিচ্ছে। তোমরাও হৈমীকে সব শিখিয়ে পরিয়ে নিও। ”

টুকটাক কথা চলতে থাকল৷ হৈমী চুপচাপ খাচ্ছিল। ছোটো চাচি খোঁচা দিয়ে হঠাৎ বলল,

-” আমার বিয়ের সময় তো আমি কত আতঙ্কে ছিলাম। বাবা মা বিয়ে দিচ্ছে তবুও কত ভয়, কত লজ্জা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো একা একাই বিয়ে করে সংসার শুরু করে। তবে যাই বলো সূচনা, হৈমীর সাহস আছে বলতে হবে। একা বিয়ে আবার ঢাকা গিয়ে কতদিন থেকে এলো। মনে বোধহয় মায়া, ভালোবাসা কম। নয়তো এভাবে নিজের পরিবার ছেড়ে কেউ থাকতে পারে? ”

রিনার অতিরিক্ত কথা কেউই পছন্দ করল না। বড়ো চাচি বিরক্ত হয়ে চলে গেল৷ সূচনা রিনাকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল। হৈমীর চোখ দু’টো টলমল করছে। সে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে চোখ গলে যেন অশ্রু না বের হয়। এরই মধ্যে রিনা আচমকা সূচনাকে বলল,

-” একটা জিনিস খেয়াল করেছ সূচনা। রুদ্র এর আগে কখনো এতটা অসুস্থ হয়নি। বিয়ের কদিন যেতে না যেতেই কী ভয়াবহ অসুস্থ হলো বলো? আচ্ছা হৈমী তুমি কি ওর সঙ্গে ঝগরা করেছিলে? ”

আঁতকে ওঠল হৈমী। গলায় খাবার আঁটকে গেল তার। ত্বরিত পানি খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। থমথমে গলায় বলল,

-” সেরকম কিছু হয়নি। ”

রিনা বলল,

-” কী জানি বাবা। ছেলেটা কোন চাপে এই বয়সে স্ট্রোক করে বসল। বিয়ে করল বউ নিয়ে খুশি হওয়ার বদলে এই অবস্থা কেন হলো বুঝলাম না। ”

ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল সূচনার। কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয়ে বলল,

-” আপনি একটু চুপ করবেন কাকি। ওকে এসব শোনাচ্ছেন কেন? প্লিজ অযথা কথা বাড়াবেন না। ভাইয়া ওকে নিয়ে অবশ্যই হ্যাপি। তাছাড়া ভাইয়ার দুঃশ্চিন্তা কী নিয়ে হতে পারে আমার থেকে ভালো কেউ জানে না৷ তাই এ ব্যাপারে হৈমীকে দোষারোপ করবেন না। ”

অসন্তুষ্ট হলো রিনা। গজগজ করতে করতে চলে গেল সে। সূচনা হৈমীকে বলল,

-” কিছু মনে করো না হৈমী৷ ছোটো কাকি একটু বেশি কথা বলে। মুখে কোনো লাগাম নেই। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগরা করার স্বভাব উনার। এখানে এসে দু’দিনও টিকতে পারে না। দাদিনের সাথে খুব লেগে যায়। তুমি মন খারাপ করো না। সব জায়গায়তেই ভালো মন্দ মিশিয়ে মানুষ আছে। এগুলো ব্যাপার না। ”

হৈমী জোরপূর্বক হাসল। বলল,

-” কিছু মনে করিনি। ”

-” তুমি খুব টেনশন করছ তাই না? কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছ। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখো। তুমি শুধু ভাইয়ার সঙ্গে সময় কাটাও। ওকে টেনশন করার সুযোগ দিও না। ডাক্তার কী বলেছে মনে আছে তো? এ মুহুর্তে ভাইয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমাকে। মনে রেখ একজন স্ত্রীই তার স্বামীকে মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিকে শান্তি দিতে পারে। ”

হৈমী মন দিয়ে সূচনার কথা শুনছিল৷ সূচনা আকস্মাৎ প্রশ্ন করল,

-” তোমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে তো? ”

মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোঝাল হৈমী। সূচনা প্রচণ্ড খুশি হয়ে বলল,

-” এখন তো পরীক্ষা শেষ। আপাতত পড়ার ঝামেলা নেই। এবার দু’জন দু’জনকে পূর্ণ সময় দাও। আর হ্যাঁ স্বামীর মনের সব কথা, সব ব্যথা শুষে নেয়ার চেষ্টা করো। এতে ভাইয়ার মন থেকে চাপ কমবে তুমিও জানতে পারবে কী নিয়ে এত টেনশন করছে ওর জীবনে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। হলে সেই সমস্যা টা কী? আমার চাপা স্বভাবের ভাইটার ভিতরের কথা শুষে নিতে পারলে তুমি সার্থক হৈমী। ”

নির্নিমেষে সূচনার দিকে তাকিয়ে ছিল হৈমী। পূর্ণ মন দিয়ে শুনছিল প্রতিটি কথা। এক পর্যায়ে তীব্র জেদ তৈরি হলো মনে৷ রুদ্রর মনে ঠিক কী চলছে? কী নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করে হঠাৎ এতবড়ো অঘটন ঘটাল? প্রত্যেকটা কথা তাকে জানতে হবে জানতেই হবে। রুদ্র যদি তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে থাকে অবশ্যই তার সঙ্গে সবটা শেয়ার করবে।
____________________
ছোটো চাচির বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমে এলো হৈমী৷ এসে দেখল রুদ্র সিগারেট খাচ্ছে। অমনি তার বুকটা কেঁপে ওঠল। একছুটে এসে রুদ্রর হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল। মেঝেতে। হাতে ছ্যাঁকাও খেল একটু। রুদ্র হতভম্ব হয়ে চাপা আর্তনাদে বলল,

-” এটা কী হলো! ”

আচমকা কেঁদে ওঠল হৈমী৷ বলল,

-” ডাক্তার এসব নিষেধ করেছে আপনাকে। আপনি তবুও এটা খাচ্ছেন। কী চাচ্ছেন আপনি বলবেন? মরে যেতে চাচ্ছেন? আমাকে একা করে দিতে চাচ্ছেন? ”

বিছানায় ধপ করে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল হৈমী। রুদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল৷ চোখের পলক ফেলল ঘনঘন। কয়েক পল পর বলল,

-” ওকে ওকে কাঁদতে হবে না। আর খাব না রিলাক্স।”

আচমকা হাত বাড়িয়ে দিল হৈমী। গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়াল। ভাঙা আওয়াজে বলল,

-” আমাকে ছুঁয়ে কথা দিন আর কখনো সিগারেট বা অন্য কোনো নেশা জাতীয় কিছু খাবেন না। ”

মৃদু ধমকে রুদ্র বলল,

-” পাগলামি করছ হৈমী। বললাম তো খাব না। ছুঁয়ে কথা দিতে পারব না। ”

-” ছুঁয়ে কথা দিন নয়তো ঠিক আপনি এসব খাবেন। ”

রুদ্র ছুঁয়ে কথা দিতে রাজি হলো না। হৈমী হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। রুদ্রকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়ল সে। ওষুধ খেয়ে কম্বলের নিচে চলে এলো রুদ্রও। সন্তর্পণে পাশফিরে শোয়া হৈমীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। মুখ গুঁজে দিল কানের নিচে ঘাড়ে। সহসা কেঁপে ওঠল হৈমী। চোখ বেয়ে পড়ল নোনাপানির ধারা। অভিমানী কণ্ঠে সে আবারো বলল,

-” কথা দিন আর কখনো ওসব খাবেন না। ”

আলগোছে হৈমীর কামিজ ফালি ওঠিয়ে উষ্ণ নরম পেটে হাত রাখল রুদ্র। জিজ্ঞেস করল,

-” পেট ভরে খেয়েছ? ”

উত্তর দিল না হৈমী। রুদ্র বুঝল কথা না দেয়া অবধি উত্তর পাবে না সে। এত্তো রাগ? এত্ত জেদ? ভেবেই স্কন্ধে আলতো কামড় বসালো। গা শিউরে ওঠল হৈমীর। এক হাতে গায়ে জড়ানো কম্বলটা খামচে ধরল সে। রুদ্র ধীরেধীরে তাকে নিজের দিকে ফেরালো। ঘুম জড়ানো চোখ দু’টো হৈমীর মুখে স্থির করে সে বলল,

-” এত তাড়াতাড়ি ঘুম পেয়ে গেল! ”

-” ঘুমিয়ে পড়ুন। ডাক্তার বলেছে রাত না জাগতে। ”

-” কেন ওরা কি বউ পাশে রেখে সব সময় ঘুমায়? ”

-” ওরা সুস্থ আপনি অসুস্থ। ”

-” আমি একদম সুস্থ। তার প্রুফ নিশ্চয়ই সেদিন পেয়েছ? ”

ভ্রু কুঁচকে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল হৈমী। বলল,

-” কী নির্লজ্জ! আমি ওসব নিয়ে বলেছি নাকি? ”

আলতো হেসে ঠোঁট এগিয়ে হৈমীর ঠোঁটে চুমু খেল রুদ্র। হৈমী চোখ বুজল আচমকা। রুদ্র আলগোছে তার উষ্ণ বুকে মাথা রেখে বলল,

-” কথা দিলাম তোমার অনুমতি না নিয়ে আর ওসব খাব না। ”

বিস্মিত হয়ে চোখ খুলল হৈমী। বলল,

-” এর মানে? ”

-” যখনি খাব তোমার অনুমতি নিয়ে খাব। ”

-” আমি কক্ষনো অনুমতি দিব না। ”

-” সেটা পরে দেখা যাবে। ”

বলতে বলতেই হৈমীর বক্ষ বিভাজনে নাক ঘষতে শুরু করল সে। সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল হৈমীর। ছটফটিয়ে ওঠল সে। শ্বাসরোধ করে বলল,

-” আপনার ঘুম প্রয়োজন। ”

-” উহুম তোমাকে প্রয়োজন। ”

স্বামী – স্ত্রী যখন একে অপরকে খুশি রাখার চেষ্টা করে পৃথিবীর সব সুখ যেন সেই দম্পতির মধ্যেই নিহিত থাকে। হৈমী জানে রুদ্রর তাকে প্রয়োজন। রুদ্র জানে চঞ্চলা হৈমীর হঠাৎ নিশ্চুপতা ভাঙতে একমাত্র সেই পারে। তার ভালোবাসা দিয়ে। জীবনে কিছু ঝড় আসে। যে ঝড় সবটা লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। আমরা মানুষরা কি টের পাই এই ঝড় না এলে নতুন করে শুরুর কথা ভাবা হতো না?

চলবে..