নীরবে নিভৃতে পর্ব-৩৫

0
166

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

রোজী গত দুইটি বছর সবুরের সাথে শুধু অভিনয় করে গেছে। হ্যাঁ ভালোবাসার অভিনয়। আর সুযোগ বুঝে ডাকাতদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে সে। বিষয়গুলো ভাবতে গেলে সবুর বারবার অবাক হতো। কতো সুন্দর সময় কাটিয়েছিল দু’জনে। কিন্তু হঠাৎ একদিন বুঝে গেলো সবকিছু ছিলো মিথ্যা। ভাবতেই আশ্চর্য লাগে এতগুলো দিন কী নিখুঁত অভিনয় করেছিল মেয়েটা!

” বাবা আসবো?”
ছেলের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলেন সবুর হোসেন। অতীতের স্মৃতি হাতড়ে দিশেহারা হয়ে গেছেন কিছুটা। তবে ছেলের এমন আচরণে এরমধ্যেও কিঞ্চিৎ অবাক হলেন।
” হ্যাঁ এসো। তা আজ হঠাৎ অনুমতি নিলে? শরীর খারাপ ঠিক আছে তো ! ”
রোশন বাবার সামনের চেয়ারে বসে মুচকি হাসলো। সবুর হোসেনও সাথে তাল মেলালেন।
” ভালো হলেও দেখছি সহ্য হয় না তোমার। ”
” বুঝলাম। তা কেমন আছো? কেমন কাটালে এতদিন? ”
পকেট থেকে লাইটার বের করে ঠোঁটের কোণে সিগারেট গুঁজে আগুন ধরাল রোশন।
” অনেক ভালো। জঙ্গলের বাইরে যে এতো সুন্দর একটা জীবন রয়েছে আগে কখনো বুঝিনি। ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন সবুর,
” বুঝলেও কী লাভ রোশন? আমাদের জগত এই জঙ্গলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমরা চাইলেও বাইরের দুনিয়ায় স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারবো না। ”
বাবার কথাগুলো অমূলক নয় তা ভালো করে জানে রোশন। কিন্তু মেহেককে নিয়ে আর পাঁচটা দম্পতির মতো সহজ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করার লোভও তো সংবরণ করতে পারছে না ও।
” তা ঠিক। আচ্ছা বাবা ক’দিন ধরেই একটা প্রশ্ন করবো করবো করেও করা হচ্ছিল না। তারমধ্যে গেলাম ও বাড়িতে! তাই এখুনি জিজ্ঞেস করবো। ”

সবুর হোসেন নড়েচড়ে বসলেন। ছেলের হাবভাব বেশ সিরিয়াস।
” হ্যাঁ জিজ্ঞেস করো, কী জিনিস করার আছে। ”

” বাবা আমি কি পড়ালেখা করেছিলাম? না মানে আমি তো মোটামুটি ইংরেজি পড়তে পারি। কলেজে না পড়লে তো এসব পারার কথা না! তাছাড়া আমার তো কিছু মনেও পড়ে না। আমার ছোটোবেলা, কৈশোর কিচ্ছু মনে নেই আমার। শুধু এই জঙ্গল থেকেই সবকিছু শুরু! ”

রোশনের প্রশ্নে হতচকিত হয়ে গেছেন সবুর। তিনি কখনো আশা করেননি রোশন কখনো এসব নিয়ে ভাববে। কিন্তু এখন কী উত্তর দিবেন তিনি? সবকিছু জেনে ফেললে যদি রোশন উনাকে ঘৃণা করে? কিংবা এখান থেকে চলে যায়! নাহ এসব কিছুই সহ্য করতে পারবেন না সবুর হোসেন। রোজীকে হারিয়ে এই রোশানকেই এ জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে। বাবার নীরবতা দেখে রোশন ফের শুধালো,
” বাবা? ”
” হ্যাঁ। ”
” কিছু বলছো না কেনো?”
” আসলে বছর পাঁচেক আগে তোমার একবার মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছিল। সেজন্য শর্ট টাইম মেমোরি লস হয়েছে। ডাক্তার বলেছিল যেকোনো সময় সবকিছু মনে পড়ে যাবে। এ কথা তো তোমাকে তখনও বলেছিলাম আমি! তুমি ভুলে গিয়েছিলে রোশন। ”
বাবার কথায় স্মৃতির পাতা হাতড়ে যাচ্ছে রোশন। আসলেই এমনকিছু হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না ওর। তবে বাবা যখন বলেছেন এটাই সত্যি ভেবে নিজেকে শান্ত করলো রোশন।
” ও তাই বলো। কিন্তু আমি কোথায় পড়ালেখা….. ”

রোশনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরের বাইরে থেকে মেহেকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

” বাবা! রোশন আপনারা খেতে আসুন। ”
” মেহেক খেতে ডাকছে। চল চল আগে খেয়ে আসি। ছেলের বউয়ের হাতের রান্না মিস করা যায় না। ”

সবুর হোসেন রোশনের আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রোশনও বিষয়টা বাদ দিয়ে বাবার পেছন পেছন ঘর থেকে বেরুলো। আজকে আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি হয়নি। সেই সুযোগে সবাই মিলে ইটের চুলোয় প রান্না করে খাওয়ার আবদার করেছিলো মেহেকের কাছে। মীরার হাতের রান্না খেতে খেতে সকলেই একটু-আধটু বিরক্ত। তাই শেষ বিকেলেই রান্না করতে বসেছিল মেহেক। মীরা সাথে সাহায্য করেছে ওকে। গরুর মাংস, মুরগির মাংস, পোলাও সবকিছুই রান্না হয়েছে আজ। বলতে গেলে জঙ্গলে মহা ভোজ আজ।
” এতজনের রান্না করতে কষ্ট হয়েছে সুন্দরী? ”

পাশাপাশি হাঁটছে রোশন ও মেহেক। সবুর হোসেন আগেভাগে গেছেন খাবারের জায়গার দিকে।
” আরে না। মীরা আপু সাহায্য করেছে তো। সেজন্য তেমন কষ্ট হয়নি। ”
” বুঝতে পেরেছি। এরপর থেকে আর কখনো এতে কষ্ট করতে হবে না তোমাকে । ”
” এতো আহ্লাদী হতে হবে না। তাড়াতাড়ি চলুন, সবাই খাওয়াদাওয়া করার জন্য অপেক্ষা করছে।”
” যথাআজ্ঞা সুন্দরী আমার। ”
মেহেক মুচকি হেসে এগোতে লাগলো,সাথে রোশনও।

চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক। মাঝে মধ্যে ব্যাঙও ডাকছে। রাতের আঁধার কাটাতে অনেকগুলো মোমবাতি জ্বলছে চারদিকে। সাথে কয়েকটা চার্জার লাইট। এগুলো চার্জ দেওয়ার জন্য আলাদা লোক রাখা আছে ওদের। সবাই আজ একসাথে খাবে বলে মাটিতেই হোগলায় বসেছে। কারণ একসাথে এতজন তো চেয়ার,টেবিলে বসা সম্ভব না। সবাই দুই সারিতে বসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে। মেহেক আর মীরা সবাইকে এক এক করে খাবার পরিবেশন করছে। সবাই আস্তে আস্তে খেতে শুরু করেছে। সবার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে।
” ভাবি এদিকে একটু মুরগির মাংস দিন। ”
লিমন প্লেট এগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো। মেহেকও সহাস্যমুখ করে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। লিমনের দেখাদেখি আরে কয়েকজন তরকারি নিলো সাথে পোলাও। সবার খাওয়াদাওয়া দেখে বেশ স্বস্তি পাচ্ছে মেহেক। শেষমেশ ডাকাতদের সাথে সংসার জুড়ে বসলো মেয়েটা!

বহুতল ভবনের সামনে গাড়ি থামিয়ে আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলেন নাহিদ আলম। বয়স আনুমানিক চল্লিশ, দেখতে শ্যামবর্ণ, আপাদমস্তক ভদ্রলোক। গাড়ি থেকে নেমে সোজা সামনের বিল্ডিং প্রবেশ করলেন তিনি। গার্ডরা উনাকে দেখা মাত্র কাউকে কল করে। একজন ভদ্রলোক এসেছেন নাহিদকে এগিয়ে নিতে। পরিচিত কাউকে দেখে নাহিদ আলম মুচকি হেসে তার সাথেই মিটিং রুমের দিকে অগ্রসর হয়৷ চার তলার উত্তর দিকের বৃহৎ রুমে জরুরি মিটিং আজ। নাহিদ আলম রুমে প্রবেশ করতেই সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করে। সবাইকে বসতে বলে নিজেও বসেন।
” স্যার আমরা সব প্ল্যান করে ফেলেছি। আগামীকাল থেকেই আমাদের মিশন শুরু করতে চাচ্ছি। আপনার সামনে রাখা ফাইলে সবকিছু ডিটেইলস আছে। ”
নাহিদ আলমকে উদ্দেশ্য করে বললেন রিজভী আহমেদ। নাহিদ আলম সবার দিকে দৃষ্টিপাত করে শুধলেন,
” আয়েশা সিদ্দিকী এখনো সেখানেই আছে? ”
” হ্যাঁ স্যার। ”
কবির খানের সংক্ষিপ্ত উত্তর। নাহিদ আলম আজকের মতো ফাইলের সবকিছু চেক করে সবাইকে অনুমতি প্রদান করে আবারো গাড়ি চেপে বসেন। উদ্দেশ্য শহরের অন্য একটা মিটিং -এ জয়েন করা।

আহনাফ মিষ্টির জীবনে আসার পর মিষ্টির জীবনটা ওর কাছে স্বপ্নের মতো সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিনের সব অন্ধকারের মধ্যে আহনাফ এক টুকরো আলো। যেই আলোর বিচ্ছুরণ ধীরে ধীরে মিষ্টির জীবনের সমস্ত অন্ধকার শেষ করে দিচ্ছে। আহনাফের বাবাও খুব ভালো মানুষ। আহনাফ যখন বাড়িতে থাকে না, তখন উনার সাথে গল্প করেই সময় কাটে মিষ্টির। তাছাড়া আহনাফ ওকে প্রতি সপ্তাহে একবার বাবার বাড়ি দিয়ে আসে। মেয়ের সুখে মিষ্টির বাবা-মাও খুশি।

বিছানায় একা একা শুয়ে আছে মেহেক। রোশন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। মন মানসিকতা বিশেষ ভালো না। লোকটার। কীভাবে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিকভাবে বাঁচা যায় সেই নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকে রোশন। নিজে এই জীবন কাটালেও রোশন চায় না ওর সন্তানও এইসব অনৈতিক কাজকর্ম করুক। আজকাল রোশন ডাকাতি খুব কম করে। একেবারে যেখানে না গেলেই নয় সেখানে যায়। সবুর হোসেন বলেছিলেন এ প্রসঙ্গে,
“সবাই যদি ডাকাতি ছেড়ে দেয় এখন তাহলে খাবে কী? ”
আর প্রশ্ন যে কতটা যুক্তিযুক্ত তা তো রোশন নিজেও জানে।

” কী হয়েছে আপনার?”
মেহেক শোয়া থাকা অবস্থায়ই শুধালো। রোশন পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলে,
” কিছু না। তুমি ঘুমাও। আমি সিগারেট শেষ করে আসছি। ”
অন্য সময় হলে মেহেক সিগারেটের জন্য রাগারাগি করতো। কিন্তু এখন রোশনের মনমেজাজ খারাপ বলে কিছু বললো না। সত্যি বলতে মেহেক নিজেও তো এসব নিয়ে চিন্তিত থাকে। কিন্তু সব সময় চিন্তা করলে তো কোনো সমাধান হবে না। মেহেক শোয়া থেকে উঠে ধীর পায়ে রোশনের পেছনে এসে দাঁড়াল। রোশন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদ দেখছে না-কি তারা গুনছে বোঝা মুশকিল! তবে হঠাৎ করে মেহেক ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় সব চিন্তাভাবনা উধাও হয়ে গেলো। আজ পর্যন্ত মেহেক স্বজ্ঞানে কখনো রোশনকে জড়িয়ে ধরেনি।
” অহেতুক চিন্তা করে শরীর খারাপ করবেন না।”
মেহেকের কথায় মুখোমুখি ফিরে দাঁড়াল রোশন। মেহেক আবারো জড়িয়ে নিলো ওকে। রোশন চোখ বন্ধ করে পিঠে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো মেহেককে। মেহেক রোশনের বক্ষে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই কেঁপে উঠল রোশন।
” সুন্দরী? কী করলে এটা! বউ আমার জীবনে প্রথম আদর করলো! ”
মেহেক রোশনকে আরেকটু চমকে দিতে পায়ের উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে একটু উঁচু হয়ে নিলো। নাকে নাকে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো মেয়েটা,
” হ্যাঁ। আজকে আপনার বউ আপনাকে আদর করবে মিস্টার হটসট ডাকাত রসুন!”
রোশন ফিক করে হেসে দিলো এমন অদ্ভুত নাম শুনে। মেহেক হাসলো না, বরং রোশনের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় স্থির হয়ে গেছে রোশন। বেচারা রেসপন্স করতেও যেনো ভুলে গেছে। মেহেক পায়ে একটু জোরে চাপ দিতে নড়েচড়ে উঠলো রোশন।

চলবে,