বড়ো আপা পর্ব-১১+১২

0
75

#বড়ো আপা
#পর্ব- ১১
#শারমিন আঁচল নিপা

অবিচ্ছন্ন ভাবনা গুলো আমাকে ভীষণ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অনন্যা কী সত্যিই আত্ম/হত্যা করেছিল? আপার জন্য আজকে আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে৷ আপা কী সত্যি খু/ন হয়েছে? আপার খু/নের সাথে কী বাবা মায়ের কোনো সম্পৃক্ততা আছে?
পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কী ভাবছি এসব আমি! শত হলেও বাবা আর মা তারা তো আর সন্তানকে খুন করতে পারবে না। এসব কেনই ভাবছি আমি? কিন্তু সে মেয়েটা কে? আমার চোখ মিথ্যা হতে পারে তবে বাবার চোখ তো মিথ্যা হতে পারে না। বাবাও তো দেখেছে তাকে। সবার আগে আমার সেই মেয়েটা খুঁজে বের করতে হবে। কীভাবে তার দেখা পাব আমি? এসব ভাবতে লাগলাম।

দিন পেরিয়ে রাত নেমে গেল। আমার ভাবনা গুলো আমার ভেতরে আরও প্রখর হলো। রাতের আকাশে অমাবস্যা। অন্ধকারে চারদিকে ছেয়ে আছে। এ আঁধার ঘুটিয়ে কখন আলোর খোঁজ মিলবে সেটাই ভাবছি। আপা যদি সত্যিই বেঁচে থাকে তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি অন্য কেউ হবে না। আচ্ছা আপার আত্মা কী ঐ মেয়েটা? ভাবনা গুলো যেন কোথায় থেকে গিয়ে কোথায় ডানা মেলছে তার অন্ত নেই। কখন যে ঘুমেরা এসে চোখে ডানা মেলল বুঝতে পারিনি।

পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। ঘরটাতে আর ভালো লাগছে না। তাই একটু হাত মুখ ধুয়েই বাইরে বের হলাম হাঁটতে। হাঁটতেই হাঁটতেই আবার আপাকে দেখলাম। আপাও হাঁটছে আমার পাশে পাশেই। এটা সেই মেয়েই যাকে সেদিন দেখেছিলাম। এই সুযোগ তার সাথে কথা বলার। আমি হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে তাকালাম। আচমকা তার হাতটা চেপে ধরলাম। বেশ উত্তেজিত আর অস্থির গলায় বললাম

“আপনি আমার বড়ো আপার মতো হুবুহু দেখতে। একটা মানুষের সাথে একটা মানুষের এত মিল কী করে হয়? আপনার সাথে আপার কোনো অমিল নেই। আমার আপা মারা গেছে বারোটা বছর হয়ে গেছে। তাহলে আপনি কে? কেনই বা আপনি আমার বাবাকে বলেছেন আপনি এসেছেন প্রতিশোধ নিতে? আপনি কী আপাকে চিনতেন? কে আপনি? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমার আপার সাথে কী আপনার কোনো যোগসাজোগ আছে? প্লিজ বলেন।”

সে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল

“আমার হাতটা কী ঠান্ডা নাকি গরম?”

আমি তার হাতটা চেপে ধরে বললাম

“একদম ঠান্ডা।”

সে আরেকটু হেসে বলল

“জীবিত মানুষের হাত কী এত ঠান্ডা হয়? এখনও কিছু বুঝছিস না ফিয়না?”

আমি ভয়ে হাতটা ছেড়ে দিলাম। তাহলে সে কী আপার আত্মা? আমি ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম

“কে তুমি? আমার নাম জানলে কী করে? আমার আপার মতো সবকিছু।”

সে এবার হেসে জবাব দিল

“কাউকে কী পুরোপুরি কপি করা যায়। আমি তোর আপা। যাকে তুই জাম গাছে ঝুলতে দেখেছিলি। সেদিন আমার দেহটা দেখেছিলি কষ্টটা দেখিস নি। অন্তরটা কতটা বিক্ষত দেখবি?”

আমার ভয়টা আরও বেড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বললাম

“মৃ/ত মানুষ ফিরে আসে কী করে? আপনি কে সত্যি করে বলুন।”

সে আবার জোর গলায় বলল

“আমিই তোর আপা। আমার বিক্ষত হওয়া ক্ষতটা দেখবি না? এই দেখ আমার ক্ষত।”

বলতেই তার মুখটা পুরোপুরি বিভৎস কালো হয়ে গেল। এত ভয়ংকর হয়ে গেল যে আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। বুকটা ধুকধুক করছে। তার মানে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। এসব ভেবে ঘুমিয়েছিলাম তাই এমনটা দেখেছি। আমার সারা শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠেছে। পাশে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে আমি পানি খেলাম। পানি খাওয়ার পর ভাবতে লাগলাম এই কী স্বপ্ন দেখলাম আমি। সত্যিই কী এই স্বপ্নের কোনো ব্যখ্যা আছে৷ আমি আর ভাবতে পারলাম না। আবারও ঘুমিয়ে গেলাম।

সকাল ৯ টা বাজে। মা আমাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলল। চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেছে। পাশের বাড়ির সোনিয়া গলায় দঁড়ি দিয়েছে, আমাদের বাসার সামনে থাকা আম গাছে। আমি দৌঁড়ে গেলাম সেখানে। মেয়েটি আমগাছে ঝুলছে। আমার আবার আপার কথা মনে হলো। তবে মেয়েটিকে দেখার পর আমার মাথায় অন্য একটা প্রশ্নের উদ্ভব হলো। এ মেয়েটার গলায় নিজের নখের দাগ। তার মানে মেয়েটা দঁড়ি দেবার পর নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। যতদূর জানি সকল গলায় দঁড়ি দেওয়া মানুষেই এ কাজ করে। কিন্তু আপার ক্ষেত্রে এমন ছিল না। আপার শরীরে কোনে নখ বা খামচির দাগ ছিল না। গলায় কোনোরকম দাগ ছিল না। তবে মাথার পেছনটা বেশ ফোলা ছিল। যতদূর বুঝতে পারছি হয়তো কেউ আপাকে জোরে আঘাত করেছে। তখন অল্প বয়স হওয়ায় এসব নিয়ে চিন্তাও করিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপাকে খু/ন করা হয়েছে৷ আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম খু/নের রহস্য আমি উদঘাটন করবই যে করেই হোক।

এর মধ্যেই পুলিশ এসে সোনিয়াকে নামাল। সোনিয়া বেশ চটপটা আর হাসিখুশি ছিল। তার সাথে আমার অন্তরঙ্গতা না থাকলেও পরিচয় ছিল ভালো। সে একটা ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসত। আর ছেলেটা অন্যত্র বিয়ে করে। এ বিষয়টা মানতে না পেরে আত্মহ/ত্যা করে। এ দুনিয়ায় এরকম হাজারও মেয়ে আছে যারা প্রিয়জন হারিয়ে জীবনমৃত হয়ে বসবাস করছে। দুনিয়াটা বড়োই অদ্ভুত। কিছু মানুষ হাজার হাজার টাকা খরচ করে সুস্থতার পেছনে,, বেঁচে থাকার জন্য। আর কিছু কিছু সুস্থ মানুষ নিজেকে শেষ করে দেয়.. না পাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য।

সোনিয়ার লাশটা পুলিশ নিয়ে গেল। সবকিছু যেন কাকতালীয় ভাবে পর্যায়ক্রমে হচ্ছে। এটা কীসের ইঙ্গিত? মায়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম মা কাঁদছে। অনেকদিন পর মাকে কাঁদতে দেখলাম। মাকে হালকা৷ গলায় জিজ্ঞেস করলাম

“কাঁদছো কেন?”

মা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বলল

“অনন্যার কথা খুব মনে পড়ছে। আমার মেয়েটাও তো এভাবে চলে গিয়েছিল। এভাবেই আমার মেয়েটা ঝুলেছিল। আমার মেয়েটাকে হারিয়ে কেমন লেগেছিল আমি জানি। তবে বাস্তবতা তো মেনে নিতেই হবে। আমরা তো দোষী ছিলাম ওকে বিয়ে দিয়েছি। তবে সে কী পারত না একটু রয়েসয়ে সংসার করতে। সংসার হয়নি ঠিক আছে তাই বলে এরকম করে আমাদের গ্রাম ছাড়া করবে। মেয়েটা মরেও আমাদের শান্তি দিল না।”

মায়ের কথা শুনে আমার গা টা আবার জ্বলে গেল। বজ্রকণ্ঠে বললাম

“ঘুরে ফিরে সব আপার দোষ। আর তোমরা তো দুধে ধুয়া তুলসি পাতা। আপার মরার জন্য তোমরা দায়ী। যত্তসব।”

কথাটা বলেই আমি হাঁটতে লাগলাম আনহারি ভবনের দিকে। আমার একটাই চিন্তা সেটা হলো যে করেই হোক আমি সেই মেয়ের সাথে দেখা করব। আমি জানব মেয়েটা কে? কে এই মেয়ে যে আমার আপার সকল কিছু বহন করছে। আমি চলে গেলাম আনহারি ভবনের কাছে। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি। মেয়েটার নাম জানি না। তবে দেখতে অনেক সুন্দীর। চোখগুলো স্রোতসীনি হরিণের বাক। নাকটা বেশ খাড়া। আপা দেখতে যেমন ঠিক তেমনটায় বর্ণণা করেছি।

লোকটি এবার যে তথ্য দিল তা শুনে আমি পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলাম।

#বড়ো আপা
#পর্ব- ১২
#শারমিন আঁচল নিপা।

লোকটি আমার কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন

“যে বর্ণণা দিয়েছেন সেটা স্বয়ং আনহারি ম্যাডামের। আনহারি ম্যাডাম তো দুই বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। সে কী করে এখানে আসবে? আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। এ শোক কাটাতে পারেনি বলে ম্যাডামের মা এখনও অসুস্থ। একটায় মেয়ে ছিল তাদের। এত বড়োলোকের ধন এবার পিঁপড়ায় খাবে। এ ধনসম্পত্তি দিয়ে কী করবে বলুন যদি মেয়েই না থাকে। কিন্তু আপনি কে? হঠাৎ করে উনাকে খুঁজছেন কেন?”

আমি উনার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কী বলছে উনি এসবেই ভাবতে লাগলাম। আমার চোখ কী করে ভুল হয়। দুজন হুবুহু দেখতে মানুষ। একজন বারো বছর আগে মারা গেছে আরেকজন দুই বছর আগে। এটা কী করে সম্ভব? এটা কী আদৌ সম্ভব? আমি স্মিত গলায় বললাম

“এটা কী করে সম্ভব? আমি উনাকে দেখেছি নিজের চোখে। আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।”

উনি রেগে গিয়ে উত্তর দিলেন

“আপনার ভুল হচ্ছে। হয়তো আপনি কাউকে নিয়ে চিন্তা করছেন তাই এমন বলছেন। মৃ/ত মানুষকে নিয়ে মিথ্যা কেন বলব?”

আমার শরীর কাঁপতে লাগল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। আমি আশাহত হয়ে বিগলিত গলায় বললাম

“আমি আনহারি ম্যাডামের মায়ের সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ আমাকে নিয়ে যান। আমাকে একটাবার সুযোগ দিন।”

“এভাবে উনার সাথে দেখা করা যাবে না। আগে থেকে পারমিশন নিয়ে আসতে হবে।”

“তাহলে উনার সাথে যোগাযোগ করার নম্বরটা দেন প্লিজ। আমি অনুমতি নিয়েই দেখা করতে আসব।”

আমার কথা শুনে তিনি রেগে গিয়ে বললেন

“আপনি কী আমার চাকুরি খেতে এসেছেন? আচ্ছা আজব মেয়ে তো আপনি।”

আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। উনার পায়ে ধরে কান্না করে বললাম

“আমি একটু দেখা করতে চাই। আমি আমার বড়ো আপার কষ্টের জবাব দিতে চাই। কিন্তু সেজন্য আমাকে এ রহস্য ভেদ করতে হবে। আমাকে একটু সাহায্য করুন। উনার সাথে দেখা করার সুযোগ আমাকে করে দিন প্লিজ।”

উনি এবার আমার কথায় একটু নরম হলেন। আমাকে তার পা থেকে ছুটিয়ে বললেন

“এখানেই দাঁড়ান আমি ম্যাডামের সাথে কথা বলে আসতেছি।”

এ কথা বলে উনি ভেতরে ঢুকলেন। আমি অস্থিরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। সময় যেন কাটছেই না। সারা শরীর আমার ঝিম ধরে আছে। জানি না দেখা করতে পারব কি’না। তবে এ রহস্য উন্মোচনের জন্য আনহারি ভবনে আমাকে ঢুকতেই হবে।

অস্থিরতাময় অপেক্ষার এক পর্যায়ে তিনি আসলেন। আমাকে ঠান্ডা গলায় বললেন

“আপনি ভেতরে যান। ম্যাডাম যেতে বলেছেন।”

আমার বুকটা কাঁপছে। যতই প্রবেশ দরজা ভেদ করে ভেতরে ঢুকছি ততই আমার বুকের ধরফর বাড়ছে। গেইটটা পার হয়ে একটা বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা। এ ফাঁকা জায়গায় কোনো বাগান নেই। একটা ফুলের গাছ নেই। সাধারণত এসব বাড়ির এ জায়গা গুলো ফুল ফল গাছে ভরপুর থাকলেও এ বাড়ির এ জায়গাটা ছিল একদম ফাঁকা। প্রবেশ দরজা থেকে ভবন পর্যন্ত যেতে দুই মিনিট পথ হাঁটতে হয়। আমি দুই মিনিট পথ হেঁটে গিয়ে একটা বড়ো দরজা লক্ষ্য করলাম। সেখানেও একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আর আমাকে বাঁধা দিলেন না। হয়তো এ বাড়ির প্রথম চৌকাঠ পার হওয়ার পর আর কোনো কড়া নিষেধ নেই ভবনের ভেতরের ঢুকার। আমি দরজার সামনে যেতেই তিনি দরজা খুলে দিলেন।

আমি ভবনের ভেতরে প্রকাশ করলাম। বুকটা আমার আরও কেঁপে উঠল। কারণ বড়ো আপার ছবি দিয়ে পুরো দেয়াল সাজানো। আরও বেশি কৌতুহল বাড়ল যখন পার্সেলে পাঠানো বড়ো আপার সেই তৈলচিত্রটা এখানের দেয়ালে ঝুলছে। একই ছবি দুইজনের কাছে আছে। তাহলে এ মেয়েটা কে ছিল?

আমি চারদিকের ছবির দিকেই কেবল চোখ বুলাচ্ছিলাম। এমন সময় মধ্য বয়স্ক এক ভদ্র মহিলা আমার কাছে আসলেন। মহলিার বয়স ৫৫ বছরের মতো হবে। তবে বেশ পরিপাটি হয়ে থাকায় বয়স ৪০ এর কোঠায় লাগছে। দেখতে ভীষণ সুন্দরী এবং মায়াবতী। লম্বায় একটু খাটো তবে চেহারার টান বাকি সব দিক বিবেচনা করে এটাতে তেমন ফোকাস হচ্ছে না। তিনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন

“তুমিই কী আমার সাথে দেখা করার জন্য দারোয়ানের পা ধরেছিলে? কীজন্য দেখা করতে চাও? কোনো ডোনেশন লাগবে কারও জন্য।”

আমি মাথা নীচু করে মাথা নেড়ে না বললাম। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন

“তাহলে কী চাও?”

আমি হালকা গলায় বললাম

“দেয়ালে টানানো ছবির মেয়েটা হুবুহু আমার বড়ো আপার মতো দেখতে। আমার বড়ো আপা মারা গেছে বারো বছর হলো। গতকাল এই মেয়ে আমাকে আনহারি ভবনের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তখন থেকেই বড়ো আাপার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আমি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে এখানে চলে আসি। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করার পর বলল উনার নাম আনহারি। এ বাড়ির নামকরণ উনার নামেই করা হয়েছে। তবে দুই বছর আগে তিনি নাকি রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। কিন্তু উনি যদি মারা যান তাহলে গতকাল আমি কাকে দেখেছি? তিনি কী শুধু আমার ভ্রম ছিল? আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় বড়ো আপার মতো এত হুবুহু দেখতে একটা মানুষ কী করে হয়? আপনার কী কোনো জমজ মেয়ে ছিল সে কী হারানো গেছে কোনোভাবে?”

এবার তিনি আমার দিকে বিষন্ন চোখে তাকালেন। তারপর আবারও জিজ্ঞেস করলেন

“তুমি কী নিশ্চিত তোমার বড়ো আপা দেখতে আনহারির মতো?”

উনার কথা শুনে আমি আমার মোবাইল থেকে বের করে আপার সে তৈল চিত্রের ছবিটা দেখালাম। আপার অঙ্গিত সেই ছবিটা দেখালাম। সবকিছু দেখার পর উনি বললেন

“এটা সত্য তোমার বড়ো আপা আনহারির মতো দেখতে। তবে আনহারির কোনো জমজ বোন নেই। আমার মেয়ে দেশের বাইরে জন্ম নিয়েছে। এবং একটা মেয়েই আমার হয়েছে। শুনেছি পৃথিবীতে সাতজন মানুষ এক রকম দেখতে হয়। হয়তো সেরকম কিছুই। আর কী যেন বললে আনহারি মারা গেছে?”

আমি উতলা কণ্ঠে বললাম

“আপনাদের দারোয়ান তো তাই বলল। কিন্তু আমি তো নিজ চোখে গতকাল উনাকে দেখলাম।”

তিনি একটু বিরক্ত গলায় বললেন

“দারোয়ান তোমাকে এমন ইনফরমেশন কেন দিয়েছে জানি না। আনহারি বেঁচে আছে। সে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিল। পড়ালেখা করেছে। এরপর গতকাল দেশে আসলো। ঘরেই আছে সে। তবে এখন তুমি কী চাও বলো?”

আমি উনার কথা শুনে একদম চুপসে গেলাম। তাহলে দারোয়ান আমাকে এ কথা কেন বলল। কী হচ্ছে এসব আমার সাথে। কান্নায় আমার চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। কান্না গলায় বললাম

“আমি একটু আনহারী আপাকে ধরতে চাই। আমার বড়ো আপার মতো দেখতে মানুষটাকে একটা বার জড়িয়ে ধরতে চাই। আমি আর কিছু চাই না। না কোনো টাকা, পয়সা… না কোনো ডোনেশন।”

এ কথা বলার পর আন্টি আমাকে বসতে বললেন। এতক্ষণ কথাবার্তা দাঁড়িয়েই হচ্ছিল। আমি বসলাম। তিনি আনু বলে কাউকে ডাক দিলেন৷ ডাকার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আনহারি সামনে আসলো। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। দৌঁড়ে গিয়ে উনার হাতটা ধরলাম। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলাম

“আপনি দেখতে হুবুহু আমার বড়ো আাপার মতো। আপনারা জমজ নন তবুও আপনাদের মধ্যে কত মিল। আপনাকে ধরার পর মনে হচ্ছে আমি আমার বড়ো আপাকেই ধরেছি৷ কেন জানি না কোনো পার্থক্য আমি তৈরী করতে পারছি না। কিন্তু জলজ্যান্ত একটা মানুষকে আপনার বাসার দারোয়ান কেন বলল দুই বছর আগে মারা গেছেন। সেটাই বুঝছি না।

আমার কথা শুনে আনহারি চমকে উঠে বলল

” রতন বলেছে আমি মারা গেছি? আমার সাথে চলো তো তাকে জিজ্ঞেস করি। সে এ বাড়িতে কাজ করে তিন বছর হয়েছে। তার সাথে আমার দেখা হয়েছে কেবল একবার। আর সে আমাকে মৃত বানিয়ে দিল। আর শুনো জানিনা তোমার বড়ো আপা সত্যই আমার মতো দেখতে কিনা৷ তবে বড়ো আপা বলে ডেকেছো যেহেতু সকল কাহিনি আমি শুনব তোমার। তবে এর আগে রতনকে জিজ্ঞেস করি কেন এমনটা বলেছ। আমার সাথে চলো।”

তারপর উনি আন্টির দিকে তাকিয়ে বললেন

“মা তুমি এখানেই থাকো। আমি দেখছি বিষয়টা।”

কথাটা বলেই তিনি আমার হাতটা চেপে ধরে বাইরে আনলেন। দারোয়ানের সামনে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি। দারোয়ানকে তিনি রুষ্ঠ গলায় বললেন

“কী ব্যাপার এ মেয়েকে কেন বলেছো আমি দুই বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছি। জলজ্যান্ত আমাকে মেরে দিলে?”

দারোয়ান উনার দিকে তাকালেন। আবার আমার দিকে তাকালেন। আমার দিকে তাকাতেই বললাম

“এমনটা কেন বলেছেন?”

দারোয়ান ভূত ভূত বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আমি ভীষণ অবাক হলাম। এটার মানে বুঝতে পারলাম না। কী হচ্ছে এসব। কেনই বা দারোয়ান এমন করল। দারোয়ানকে এভাবে চিল্লাতে দেখে ভেতেরের দারেয়ান বাইরে চলে আসলো। আনহারি অস্থির গলায় বলল

“মফিজ সাহেব উনাকে ধরে গাড়িতে তুলুন। আমি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”

মফিজ সাহেব রতনকে ধরে গাড়িতে তুলল। আনহারি আপা আমাকে নিয়েই গাড়িতে উঠল। কল দিয়ে উনার মাকে বলল হাসপাতালে আসতে। দ্রূত রতনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে নেওয়ার পর জানা গেল সে ব্রেন স্ট্রোক করেছে। আনহারির মা এবং বাবা ছুটে আসলেন হাসপাতালে। আনহারি বাবা আমজাদ চৌধুরি ব্যববসার কাজে কুমিল্লায় ছিলেন গত ছয় দিন। আজকেই ঢাকায় পৌঁছে এ খবর শুনলেন। আর সাথে সাথে আসলেন। তিনি হাসপাতালে আসতেই আনহারি উনাকে বললেন

“বাবা এই রতন আমাকে দেখে কেন ভয় পেল?”

আমজাদ সাহেব থমকে গেলেন আনহারিকে দেখে। তিনি মনের অজান্তেই বলে উঠলেন

“দুই বছর আগে চলে যাওয়া মেয়ে কী করে আসলো আমার সামনে?”

উনার মুখে এমন কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। তাহলে সত্যিই কী আনহারি মারা গেছে? আনহারি যদি মারা যায়, বড়ো আপা যদি মারা যায় তাহলে এই মেয়ে কে? এই প্রশ্নটায় এখন মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর সে রহস্যের জট খুলতে গিয়ে একের পর এক সাসপেন্স যেন গল্পটার নতুন মোড় দিল।

কপি করা নিষেধ।

শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার