বড়ো আপা পর্ব-৩৩

0
74

#বড়ো আপা
#পর্ব- ৩৩
#শারমিন আঁচল নিপা

গা টা শিউরে উঠছে। মাথাটা ব্যথায় টনটন করছে। মহিমা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। শিরদাঁড়ায় যেন বৈদ্যুতিক শক লাগছে। একদম মন টিকছে না। শরীরও একদম ভালো লাগছে না। আনহারির কাপড়চোপড় দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। কিন্তু কী? সে কী বেঁচে আছে? নাকি বড়ো আপার মতো সেও চলে গেছে। এক আপাকে হারিয়ে বারোটা বছর দহনে পুড়েছি। এখন আরেকজনকে হারিয়ে ক্ষতটা যেন ভয়ংকর রুপে তাজা হয়ে উঠছে। এ ধাক্কা কী আমি সামলাতে পারব? এর মধ্যেই অফিসার মাহিদ বেশ চিন্তিত আর দ্বিধান্বিত গলায় বলে উঠলেন

“আপনারা এসেছেন? দয়াকরে বসুন।”

তার কথায় দুজনেই বসলাম। বসার পর পরই তিনি বলে উঠলেন

“থানায় ঢুকার সাথে সাথে হয়তো এক সেট জামা দেখেছেন। সেটা আমরা ব্রিজের পাশে পেয়েছি। ধারণা করছি এবং কিছুটা নিশ্চিত হয়েছি এটা আনহারির জামা। কিন্তু জামা পাওয়া গেলেও আনহারির সন্ধান পাওয়া যায় নি। পুরো নদীতে খোঁজা হয়েছে কোনো লাশের সন্ধানও মিলে নি। আমরা লাবনী জোহার সাথে কথা বলেছি। সে এ মুহুর্তে আসতে পারছে না। সরকার পতনের জন্য কাল লং টু মার্চ হবে ঢাকায়। সেখানে অনেকেই যেতে চাচ্ছে। সেজন্য রাস্তাঘাটসহ সকল পরিবহন চলাচল বন্ধ। থানায় বেশ প্রেসার আসছে সেগুলো হ্যান্ডেল করার জন্য। সরকার কর্তৃক প্রেসার তো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না।

এতদিন এ থানায় তেমন কোনো আন্দোলন বা হতাহতের চিন্হ নেই। দূর্ঘম গ্রাম হওয়ায় এগুলোতে বেগ পুহাতে হয়নি। তারপরও বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে কেউ আন্দোলন করলে যেন বুকে গুলি চালাই। তবে বিবেকের তাড়নায় তা সম্ভব হবে না জানিয়ে দিয়েছি। এজন্য চাকুরি নিয়েও বেশ সমস্যা চলছে। চাকুরি থাকে কি’না সেটাও জানি না। আজকের দিনটায় হয়তো আমার কাছে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। এরপর সরকার কী করে? আমরা কোনদিকে যাই বলতে পারব না। এ কেইস আমার হাতে থাকে কি’না সেটা নিয়েও চিন্তিত আছি। আজকের দিনটাতেই হয়তো আমার সবটা করতে হবে। আমাদের একদল ফোর্সকে ইমারজেন্সি ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের হ্যান্ডেল করতে। তাই থানায় পুলিশও নেই তেমন। সেজন্য আপনাদের সাহায্য প্রয়োজন। আপনারা দুজন আনহারির খোঁজ করুন। এ গ্রামের প্রতিটা জায়গায় নিজ উদ্যোগে খোঁজ করুন।”

আমি হালকা গলায় বললাম

“দীপক আর পিয়ালিকে কী পেয়েছেন? তারা একসাথেই বের হয়েছিল। তাদের খোঁজ পাওয়া গেলেও তো আনহারির খোঁজ মিলবে। নাকি তারাও নিখোঁজ?”

অফিসার মাহিদ হালকা গলায় বলল

“দীপক পুলিশ হেফাজতেই আছে। তবে তার থেকে আনহারির খোঁজ মেলে নি৷ তারা একসাথে থানার দিকেই আসতেছিল সেন্সর তেলাপোকা বিষয় নিয়ে বিহিত করার জন্য। রাস্তার মাঝখানে তাদেরকে কে জানি হঠাৎ করে চোখ বেঁধে, হাত, পা বেঁধে ফেলে রেখে যায়। আর আনহারিকে নিয়ে যায়। আমরা তাদেরকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় রাস্তার মাঝে পাই। তাদেরকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরও একই কথা বলে। দুজনের বিবরণ একই ছিল। তাই ধারণা করছি তারা মিথ্যা বলেনি।”

আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললাম

“ওরা পুরোটায় জানে। ওদের ধরে কয়েকটা দিন, দেখবেন মুখ দিয়ে সব বের হয়ে আসছে। আপনি কীভাবে ওদের কথা সত্যি ধরে নিচ্ছেন। ওরা জাস্ট একটা নাটক সাজাচ্ছে। আর আপনিও সে নাটকে ফেঁসে যাচ্ছেন।”

অফিসার মাহিদ আমাকে ইশারা দিয়ে শান্ত হতে বলল। তারপর হালকা গলায় বলল

“দীপক সত্যিই বলছে। একটা মানুষ এতগুলো সত্যি বলার পর কখনও কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না। সাইকোরা কখনও ভয়ংকর হয়, কখনও অনুতপ্ত হয়। ওরা যখন সত্যি বলে পুরোটাই সত্যি বলে। তাদের কথায় তখন মিথ্যা থাকে না।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

“দীপক সাইকো মানে?”

অফিসার মাহিদের স্বাভাবিক উত্তর

“হ্যাঁ সে সাইকো। ছোটো বেলা থেকে তার মায়ের পরকিয়া দেখেছে সে। সে দেখেছে তার মা বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলত, অনৈতিক কাজ করত। তার বাবার ব্যবসায়িক পার্টনারের সাথে অবৈধ কাজ করত। এগুলো অবশ্য তার বাবা আজও জানতে পারে নি। না জেনেই মারা গেছে। আর তার বাবাকে মারার পেছনে তার মায়ের হাত ছিল। কারণ সে একা এ সমস্ত সম্পত্তি ভোগ করতে চেয়েছিল। আর সেটা সক্ষমও হয়েছে। দীপকের মায়ের পরকিয়া সবার আড়ালে থাকলেও দীপকের আড়াল হতে পারে নি। মায়ের প্রতি চরম ঘৃনা, একই সাথে মায়ের প্রতি দুর্বলতা। যত খারাপেই হোক মাকে কিছু করতে পারত না, বলতে পারত না । সব মুখ বুজে সয়ে নিত। হাজারটা ঘৃনা থাকা সত্ত্বেও মায়ের প্রতি অদৃশ্য এক ভালোবাসা যেন তাকে গ্রাস করে নিত। আর মায়ের প্রতি থাকা জেদ গুলো এভাবেই জমা হতে লাগে তার মনে। যা পরবর্তীতে তার স্ত্রীদের উপর প্রভাব পড়েছে।

মায়ের প্রতি থাকা সকল ঘৃনা সে স্ত্রী দের উপর প্রয়োগ করেছে। নানানভাবে কষ্ট দিয়ে সে আনন্দ পেত। ঠিক একইভাবে অদিতি আর জুঁইয়ের বেলাতেও করেছে আবার তোমার বোনের বেলাতেও হয়েছে। এভাবে স্ত্রীদের একের পর এক কষ্ট দিলে সে মানসিক শান্তি পেত। যখন সে বুঝত তার স্ত্রীরা তার প্রতি দুর্বল তখন তার তাকে ভালো লাগত না। সে সময় তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দূরে সরে যেত। আবার একই ভাবে কেউ নিজে থেকে দূরে যেতে চাইলেও সে সেটা মানতে পারত না। তার ভাষ্যমতে সে সবাইকে ছাড়তে পারলেও তাকে কেউ ছাড়তে পারবে না।
শুধু ছেড়ে দিয়েও ক্ষ্যান্ত হত না সে। সে চাইত তাদের খুন করতে। প্রথম বউকে সে খুন করতে পারেনি এটা তার সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা। দ্বিতীয় বউ জুঁই তাকে ছেড়ে দেওয়ার পর, তার বাড়িতে গিয়েই কৌশলে এমনভাবে খুন করেছে সবাই এটাকে আত্মহত্যাই মনে করেছে।
তবে তার আফসোস সে তার প্রথম বউকে খুন করতে পারে নি। এ পর্যন্ত সে অদিতিকে খুন করার চেষ্টা করে এসেছে অনেকবার। আর অদিতিকে খুন করার সূত্র ধরেই তার সাইকেট্রিক্স হেলেনের সাথে পরিচয়। দীপকের এ মানসিক সমস্যার বিষয়টি অদিতি বুঝতে পেরেছিল। সে এটা বুঝেছিল এর থেকে নিস্তার পাওয়া কষ্টসাধ্য। তাই তার সাথে একটা মাইন্ড গেইম খেলার জন্য হেলেনকে নিযুক্ত করে। হেলেন যেহেতু সাইকেট্রিক্স ছিল তাই সে দীপকের মনের গতিবিধি লক্ষ্য করে এগুতে থাকে। জুঁইকে খুন করার পরপরই সে অদিতিকে খুন করতে উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এরপর সে অনন্যাকে বিয়ে করে। তার মন তখন অনন্যাকে কষ্ট দেওয়ায় ব্যস্ত। তখন সে অনন্যাকে খুন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। যখন বুঝতে পেরেছে অনন্যা খুন হয়েছে। তখন তো তার পরবর্তী গুটি তৃনা ছিল। তৃনাকেও সে একের পর এক কষ্ট দিতে লাগল। এক পর্যায়ে তৃনাও কষ্ট সইতে না পরে নিজের বাড়ি ফিরে গেল।
আর এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। দীপক কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারছিল না তাকে কেউ ছেড়ে যেতে পারে। তাই জুঁই এর মতো তৃনাকেও সে খুন করে৷

নতুন করে অদিতির পেছনে লাগে তৃনাকে খুনের পর। তৃনাকে খুন করার পর প্রায় চার বছর সে একা ছিল। সে সময়টায় জীবনে নতুনকে আনার আগে সে চাচ্ছিল অদিতিকে খুন করতে। আর সে সময়টায় হেলেন তাকে নিয়ে গবেষণা শুরু করে। একমাত্র হেলেনেই তার রোগটা ধরতে পরেছিল আর তার ব্যক্তিগত সকল তথ্য জোগাড় করতে পরেছিল। সে এটার প্রতিকার ও খুঁজে বের করেছিল। তবে সেটা দীপকের উপর প্রয়োগের পূর্বেই অদিতিকে বাঁচাতে গিয়ে হেলেন খুন হয়। আর হেলেনকে এমনভাবে খুন করেছিল, ডাক্তাররা তাকে দেখে বলেছিল তার হার্ট এটাক হয়েছে।
সে সময়টায় অদিতির বাবা, মায়ের একই সাথে রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়। একা লড়াই করতে সে ভয় পাচ্ছিল। তাই বিষয়টি সে চেপে গিয়ে পালিয়ে যায়। আর এরপর দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হয়।

আনহারি যখন অনন্যাকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তখন অদিতির সাথেও দেখা করে। এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। আনহারি দীপকের গতিবিধি সব জানত। কখন কী হতে পারে সবকিছুই তার জানার মধ্যে ছিল। তাই দীপকের সাথে সে খুব সহজেই লড়ে যাচ্ছিল।

হেলেনের মৃত্যুর পর দীপক অদিতিকে অনেকবার খু/ন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এদিকে একের পর এক খু/ন তার নেশা হয়ে যায়। খুন করতে না পারলে তার হাত নিশপিশ করে।
আর মনে আছে জটলা বলেছিল সে ফাতেমাকে খুনের প্ল্যান করেছিল তবে তাকে খুন করার আগে কে যেন খুন করে গিয়েছিল। সে আর কেউ না দীপকেই ছিল। ফাতেমাকে সে খুন করেছিল তার বোনের সংসার বাঁচাতে। কারণ মায়ের মতো সে বোনকেও ভালোবাসত। তাই যখন ফাতেমার কথা সে জানতে পারে তখন তার বোনের পথের কাটা ফাতেমাকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু জটলাকে সেটা বুঝতেও দেয় নি। কারণ জটলাকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে তার বোনের জন্য।

আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো দীপক বলেছে তাকে যখন চোখ বাঁধা হয়েছিল তখন সে হেলেনের কণ্ঠস্বর শুনেছিল। আর সে এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল হেলেনও অন্যনার মতো ফিরে এসেছে কি’না। আর সব মিলিয়ে এসব থ্রিল আর নিতে পারছিল না সে। এতদিন সে সবার সাথে থ্রিল থ্রিল খেলছিল এখন কেউ তার সাথে খেলছে৷ এটা সে মানতে পারছিল না। তাই আত্মকষ্টে আজকে সবটা স্বীকারোক্তি দিয়েছে সে। আর ফিয়না আমি এতটুকু কনফিডেন্ট নিয়ে বলতে পারব দীপক যা বলেছে সত্যি৷

তবে ভাববার বিষয় হেলেন যদি মারা যায় তাহলে হেলেন কী করে ফিরে আসে? আর হেলেনের শত্রুতা দীপকের সাথে সে কেন দীপক আর পিয়ালিকে রাস্তার মাঝে চোখ, হাত বেঁধে আনহারিকে নিয়ে যাব? তার তো আনহারির সাথে কোনো শত্রুতা নেই। এখানে কোনো তৃতীয় পক্ষের আগমণ ঘটেছে। আর পিয়ালি আনহারির জামা কাপড় দেখে নিশ্চিত করেছে আনহারি তাদের সাথে এ জামা পরেই বের হয়েছিল। এখন একটায় প্রশ্ন আনহারি কোথায়? তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে? তৃতীয় ব্যক্তিটা কে?

মহিমা বলে উঠল

“তৃতীয় ব্যক্তি তো অদিতিও হতে পারে।”

অফিসার মাহিদ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল

“অদিতি ছিল না। অদিতি এখনও দেশের বাইরে। ভয়ে দেশে আসছে না। আমরা তার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। আর অদিতির কোনো স্বার্থ নেই আনহারিকে নিয়ে যাওয়াতে। বরং এখানে এমন কেউ জড়িত যার এতে স্বার্থ রয়েছে। আর সে হয়তো হেলেনের মতো কন্ঠকে নকল করেছে। যাতে করে দীপক বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। আর কিছু বলতে না পারে। এখন সেই তৃতীয় ব্যক্তির সন্ধান পেলে আনহারির সন্ধান মিলবে। অথবা আনহারির সন্ধান মিললে সে ব্যক্তির সন্ধান মিলবে। আপনারা দয়াকরে সময় নষ্ট না করে খোঁজা শুরু করুন। আমি এদিকের কাজগুলো সেড়ে নেই।”

অফিসার মাহিদের কথা শুনে আমি আর মহিমা আপু বের হলাম অনিশ্চিত এক রহস্য ভেদ করতে।

কপি করা নিষেধ।