#বড়ো আপা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৩৪/শেষ পর্ব
চারপাশটা খুঁজতে লাগলাম দুজনেই। এর মধ্যেই মোবাইলটা বেজে উঠল। লাবনী জোহা কল করেছে। আমি কলটা ধরে হ্যালো বলতেই উনি কান্না গলায় বলে উঠলেন
“ফিয়না আমার মেয়ের যেন কিছু না হয়৷ আমার মেয়ে ছাড়া এ দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। আমি আনহারিকে ছাড়া বাঁচব না। দয়াকরে ওকে খুঁজে বের করো। তুমি যা চাও আমি তাই দিব। আমার জীবন দিতে হলেও দিয়ে দিব। তারপরও আমার মেয়েকে চাই।”
আমি কী উত্তর দিব বুঝতে পারছি না। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। গলাটা ভার হয়ে আসছে। জিহ্বার জড়তা বেড়ে যাচ্ছে। ঠোঁটও নড়াতে পারছি না। এ মানুষটা জানেই না আনহারি তার আপন সন্তান না। তবুও এ মানুষটার মায়ার কাছে আপন মা ও হেরে যাবে। আমার মায়ের কাছে অনন্যা ছিল বিষের ন্যায় আর আনহারি লাবনী জোহার কাছে চন্দ্রের ন্যায়। দুজনেই মা অথচ তাদের মধ্যে কত তফাৎ।
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। সরাসরি ফোনটা কেটেই দিলাম। কিছু বলার সাহস আমার হলো না। ফোনটা কেটে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ মহিমা আমার বাহুটা ধরে তার এক হাতের বেষ্টনী দিয়ে আবদ্ধ করে বলল
“ফিয়না নিজেকে সামলাও। আমাদের এখন ভেঙে পড়লে চলবে না। সামনের অনেকটা পথ এগুতে হবে। প্রথমেই আমাদের দীপকের বাড়িটায় সার্চ দিতে হবে। সেখানেই আগে আনহারিকে খুঁজতে হবে। আনজুমানকে আমার একদম বিশ্বাস নেই। আর দীপকের কথা অফিসার মাহিদ বিশ্বাস করলেও আমি করছি না। তাই শত্রুর ঘর থেকেই খোঁজা শুরু করতে হবে। ”
আমিও মহিমার সাথে একমত হলাম। সে সময় আনজুমানের ভাবভঙ্গিও আমার ভালো লাগে নি৷ কেমন যেন সব এলোমেলো লাগছিল। তার কথাবার্তার বিপরীত্য আমাকে বেশ চিন্তিত করেছে। হুট করে এত সহজে একটা মানুষের পরিবর্তন কী করে হয়! তাই দুজন মিলে প্রথমে দীপকের বাড়িতেই গেলাম। সেখান গিয়ে দরজা খুলতেই দুজনেই চমকে উঠলাম।
কারণ আনজুমান গলায় দঁড়ি দিয়ে আত্ম’হত্যার চেষ্টা করছে। আমরা দ্রূত গিয়ে তাকে ধরলাম। তার এমন কর্মকান্ডে কিছুটা বিস্মিত হলাম। কোনো রকম তাকে বসালাম। কারণ সে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ছিল। তাকে শান্ত করতে বেশ সময় লেগেছে। কিন্তু তার অস্বাভাবিক আর বেসামাল কথা বার্তায় মনে হলো সে আর স্বাভাবিক নেই। মানে পাগলের মতো হয়ে গেছে। এত প্রেসার তাকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে ফেলেছে। তাই মহিমা তাকে শান্ত করে আপাতত ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখল। আমরা পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও কিছু পেলাম না।
এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম বাহির দিকটা খুঁজব। সেখানে খুঁজতে যাওয়ার জন্য বাড়ির দরজাটা পার হতেই অফিসার মাহিদ কল দিল। আমি তার কল রিসিভ করার সাথে সাথে সে বলে উঠল
“কোথায় আছো তোমরা?”
“দীপকের বাড়িতে।”
“সাবধানে থাকো। দীপক পালিয়েছে। আর সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। থানা থেকে গুলি নিয়ে পালিয়েছে। সে তার বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। সুতরাং সাবধান থাকো।”
অফিসার মাহিদের কথা শুনে আমার উত্তেজনা বেড়ে গেল। মহিমাকে বলার পর সেও চিন্তিত হয়ে পড়ল।।এ মুহুর্তে আমাদের প্রাণ সংশয়ে আছে। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিছুটা ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বাড়ির পেছন দিয়ে বের হব। মানে জাম গাছটা আগে যেখানে ছিল। সে রাস্তা ধরেই বের হব৷ দীপক আসলে নিশ্চয় সামনের গেইটটা দিয়েই আসবে।
এটা ভেবেই আমরা দুজন বাড়ির পেছন দিকে চলে গেলাম। জাম গাছটার কাছে আসতেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কারণ দীপক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে হায়েনার মতো হাসতে লাগল আর বলতে লাগল
“অনেক দিন রক্ত দেখি না। যে, আমার রক্ত না দেখলে শান্তি লাগে না সে আমি অনেক দিন রক্ত দেখি না। তোদের খুন করে আমি এখন রক্ত দেখব। আমার যে ভীষণ অশান্তি করছে। একেক করে সবাইকে খুন করব। আমার সাথে পাঙ্গা নিলে জান দিতে হয় এটাই বুঝিয়ে দিব। যে আমার পেছনে লেগেছে তাকেই জান দিতে হয়েছে। তোদেরকেও দিতে হবে।”
এই বলে বন্দুকটা তাক করল আমাদের দিকে। দীপকের সাইকো রূপটা সামনে চলে আসলো। আমি ভীষণ ভয় পেতে লাগলাম। এমনভাবে তীরে এসে তরী ডুবে যাবে কে জানত। এই বুঝি আমাদের জীবন শেষ।
এদিকে দীপক গুলি করতে নিবে। এমন সময় আনহারি পেছন থেকে এসে গুলিটা কেড়ে নিল। আর দীপকের বুক বরার একটা লাথি দিল।।দীপক মাটিতে নেতিয়ে পড়ল। আনহারি কড়া গলায় বলে উঠল,
” চিনতে পারছিস আমাকে? আমি সেই অনন্যা যাকে তুই অন্যায়ভাবে অত্যাচার করেছিস। যাকে তুই অন্যায়ভাবে ঠকিয়েছিস। যাকে তুই অন্যায় ভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিস। আমি জানতাম তুই থানা থেকে পালিয়ে এ জায়গায় আসবি। তাই তোকে তিলে তিলে মারতে এখানে চলে এসেছি।”
এই বলেই ভয়ংকর রূপ নিল আনহারি। হিংস্র হয়ে গেল সে। আনহারির এ হিংস্র রূপ দীপক দেখে ভয় পেয়ে গেল। আনহারির দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল
“আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর এমন করব না। যা করেছি ভুল করেছি। কিন্তু প্রাণে মেরো না প্লিজ। আমাকে ক্ষমা করে দাও। ”
“জালিমের ক্ষমা কখনও হয় না।”
কথাটা বলেই পরপর কয়েকটা গুলি চালানোর শব্দ কানে ধেয়ে আসল। সে সাথে বিকট একটা চিৎকারের আওয়াজ। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম সাথে মহিমাও চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।
হয়তো কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ ছিল। চোখটা খোলার সাথে সাথে চমকে উঠলাম। দীপকের হাতে গুলি। আর দীপক নিজেই তার মাথায় গুলি করেছে। তাহলে একটু আগে যে আনহারিকে দেখলাম সে কোথায় গেল? আমার ভাবনাতে এটা আসতেই মহিমাও বলে উঠল
“আনহারি কোথায় গেল?”
মহিমা প্রশ্ন করার সাথে সাথে অফিসার মাহিদ আর আনহারি আসলো। আমি অবাক হয়ে আনহারিকে জিজ্ঞেস করলাম
“তুমি কখন এখান থেকে অফিসার মাহিদের কাছে গেলে? এত অল্প সময়ে কীভাবে সম্ভব?”
আনহারি আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। সামনে দীপকের মরা লাশটাও তাকে এত বিস্মিত করছে না যতটা আমার কথায় হয়েছে। সে বিস্মিত গলায় বলল
“আমি তো অনেকক্ষণ যাবত অফিসার মাহিদের সাথেই। দীপক যখন পালালো এর পর পরই আমি অফিসার মাহিদের কাছে যাই। আমাকে কে যেন চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম দীপক।
একটু আগেই আমার চোখ খুলে দিল কেউ। সামনে কাউকে দেখলাম না। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে প্রথমে থানায় গেলাম অফিসার মাহিদের সাথে কথা বলার জন্য। কারণ দীপককে থানায় ধরে আনতে হবে এজন্য। আর এটাও অভিযোগ করতে চেয়েছিলাম যে সে আমাকে গুম করেছে। কিন্তু থানায় গিয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে জানতে পারলাম আমি নিখোঁজ হওয়ার পর পরই অফিসার মাহিদ দীপক আর পিয়ালিকে ধরে। আর দীপক মিনেট পাঁচেক আগে থানা থেকে পালিয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যে রুমে রাখা হয়েছিল সে রুমে ছিটকিনি কৌশলে খুলে পালিয়েছে।
আমি একথা শুনার পর পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যাই। কারণ আমি ছিলাম থানা থেকে ভালোই দূরে। সেখান থেকে আসতে আমার পনেরো মিনিট সময় লেগেছে। তাহলে বুঝায় যায় আমাকে যে নিয়ে গেছে সে দীপক না। আর আমাকে ধরে নেওয়ার সময় আমার খেয়ালে জানান দেয় কোনো মেয়ের স্পর্শ ছিল। আমি ভেবেছিলাম পিয়ালি। কিন্তু আমার চোখ খুলার সময় আমার কণ্ঠের মতোই কারও কণ্ঠের গুণ গুণ গানের শব্দ শুনি। চোখ খুলার পর আমি কারও অস্তিত্ব পাই না।
আনহারির কথা শুনে আমি আর মহিমা দুজনেই চমকে যাই। তাহলে একটু আগে এখানে কে ছিল? এর কোনো ব্যখ্যায় আমরা পাচ্ছিলাম না। সামনেই দীপকের লা/শটা পড়ে আছে। যেখানে বড়ো আপার লা/শ ঝুলেছিল ঠিক সেখানেই৷ জাম গাছ কেটে ফেলায় গাছটা শুধু নেই সেখানে। অফিসার মাহিদ দীপকের লা/শের কাছে গিয়ে সাধারণ পর্যবেক্ষণ করে বলল
” দীপক নিজেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছে।”
আমি আর মহিমা কিছুই বললাম না। দীপকের লা/শটা নিয়ে যাওয়া হলো।
সাধারণ ময়না তদন্তের পর একই রিপোর্ট আসলো। সে নিজেই নিজেকে গুলি করেছে। আনজুমান পাগল হয়ে গেছে। আনহারি নিজে তাকে পাগলা গারদে দিয়ে এসেছে। আর তার মেয়ের এবং ফাতেমার ছেলের দায়িত্ব সে নিয়েছে। দীপকের মা কোমায় আছে। সে কখনও সুস্থ হবে না। বড়ো আপাকে নিয়ে কুৎসা রটানো আমিন চাচাও নিজের ভুল বুঝতে পরেছে। জটলার ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। সে পুলিশ হেফাজতেই আছে৷ রতন এখনও হাসপাতালে ভর্তি। তারও সুস্থ হওয়ার চান্স একদম কম।
বড়ো আপার সাথে জড়িত সকলের শাস্তিই হলো। সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক হলে মহিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফাতেমার ছেলে এবং আনজুমানের মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের পর আমরা গ্রাম ছাড়লাম। গ্রাম ছাড়ার আগে অফিসারের মাহিদের সাথে শেষ দেখা করলাম। তাকে আমার মনের অব্যক্ত কথাটা বলে দিলাম। তবে ভাগ্য সহায় ছিল না। জানতে পারলাম সে বিবাহিত তার একটা মেয়েও আছে। ঝড়ের মতো আমার জীবনে প্রেম এসেছিল আবার ঝড়ের মতোই তা থুবরে পড়েছে।
লাবনী জোহা আজও জানে না তার মেয়ে আনহারি না। গাড়িটা ঢাকার পথে রওনা দিল। অশান্ত দেশটাও স্বৈরাচারের পতনে শান্ত হলো। গাড়িটা চলছে আপন গতিতে। চলতে চলতে অনন্যা নামের সে হোটেলের সামনে আসলাম। আনহারি গাড়িকে থামতে বলল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“চলো কিছু খেয়ে নিই।”
আমিও আর না করলাম না। খেতে গেলাম সেখানে। সেখানে গিয়ে বসতেই হোটেল মালিক বলে উঠল
“গতকাল অনন্যা এসে খেয়ে গেল। বেশ প্রশংসা করল আপনাদের। সত্যিই আপনাদের দেখে বুঝা যায় না আপনারা আলাদা। সব কিছুই হুবুহু।”
উনার মুখে এ কথা শুনে আমি আর আনহারি একে অপরের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। আনহারি বিস্ময়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে বলল
“এটা কী করে সম্ভব? আমি তো কাল এখানে আসিনি। আর আমি অনন্যাকে জাস্টিস পাওয়ানোর জন্যই অনন্যার সবকিছু কপি করেছি। অনন্যার শরীরে কোথায় কী দাগ আছে, কোথায় কী নেই সব লক্ষ করে নিজের মধ্যে সাদৃশ্য এনেছি। তাই আমাকে অনন্যা মনে করা অস্বাভাবিক না। কিন্তু আমি তো এখানে আসিই নি গতকাল, তাহলে কাকে দেখল উনি? আর অনন্যায় আসবে কোথায় থেকে?”
আনহারির কথা শুনে আমি এবার সেদিনের কথাটা বললাম। এ কয়দিন বলিনি,, কারণ মনে হয়েছিল এটা আমার আর মহিমার মনের ভুল। তবে এখন মনে হচ্ছে সকল রহস্যের সমাপ্তি ঘটিয়ে একটা রহস্য রয়েই গেছে।
আনহারি আমার কথা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠল
“তাহলে কী অনন্যা বেঁচে আছে? তাহলে সে কেন সবার সামনে আসছে না। আর অনন্যা যদি বেঁচে না থাকে তাহলে কী তার আত্মা আমাদের আশেপাশে ঘুরছে?”
কথাটা বলেই আনহারি চুপ হয়ে গেল। আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললাম।
“হয়তো অনন্যা বেঁচে আছে আর আমাদের মাঝে লোকোচুরি খেলছে।”
কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেলাম।
আচ্ছা আদৌ কী অনন্যা বেঁচে আছে নাকি এটা আমাদের মনের মতিভ্রম। কিন্তু এতজন মানুষের একসাথে মতিভ্রম হওয়া কী সম্ভব?
[১ম খন্ডের সমাপ্তি হলো। দ্বিতীয় খন্ড খুব দ্রূত আসবে। আমি নিজেকে একটু গুছিয়ে দ্বিতীয় খন্ড দিব। যাতে করে প্রতিদিন পর্ব দিতে পারি।]
সমাপ্তি।