হৃদয়স্পর্শী মায়াবিনী পর্ব-৪৫+৪৬

0
110

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৪৫

শুনশান নিরিবিলি পথঘাট। নেই কোনো শব্দ। ব্যস্ত এই শহরে এমন সুনসান রাস্তা পাওয়া দুঃসাধ্য সেখানে আজ এই সন্ধ্যাবেলা পুরো রাস্তা ফাকা যেনো একটা কাক পাখির ও দেখা নেই। সেই নির্জন নিরিবিলি রাস্তার দুই প্রান্তে ছিটকে পড়ে আছে তাজ ফারিসতা। তাজের উপরে যেয়ে পড়লো বাইক। তাড়াহুড়োতে হেলমেট পড়তেও খেয়াল ছিলো না যার জন্য গুরুতরভাবে মাথায় আঘাত পেয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যখম হয়ে ঝরঝরিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সেদিকে তাজের খেয়াল নেই। তাজ চকিত দৃষ্টিতে ফারিসতার দিকে তাকাতে বুকের ভিতর কামড় মেরে উঠলো। তাজ সব ভুলে এক ছিটকে বাইক নিজের উপর থেকে সরিয়ে হাওয়ার বেগে ফারিসতার কাছে গিয়ে বিচলিত হয়ে ফারিসতার হাত-পা দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে বলতে লাগলো, ফারিসতা ঠিক আছো? বেশি কষ্ট হচ্ছে? আম সরি জান আমার জন্য সবটা হয়েছে। আমার উচিৎ হয়নি এভাবে বাইক নিয়ে একা বেরোনো। দেখি এ বলে ফারিসতার ছিলে যাওয়া হাত চেপে ধরলো রক্ত আটকানোর জন্য।

হঠাৎ এভাবে বাইক থেকে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়তে শরীরে বিভিন্ন জায়গা ছিলে যাওয়ায় ব্যথায় কুকরাতে থাকা ফারিসতা তাজের অস্থিরতা দেখে ঠোঁট কামড়ে ধরে ব্যথা সয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে তাজের দিকে তাকাতে বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠলো। ভুলে গেলো সব ব্যথা। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা হাতে তাজের গালে হাত দিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো, আ..আপনার মাথার পাশ থেকে ব্রিডিং হচ্ছে। আমি ঠিক আছি আপনি হসপিটালে চলুন প্লিজ এ বলে শব্দ করে কেঁদে উঠলো ফারিসতা।

ফারিসতাকে কান্না করতে দেখে তাজ ফারিসতাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধালো, কান্না করে না শান্ত হও আমি ঠিক আছি। এখানে কোনো সমস্যা আছে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। দেখি ওঠো এ বলে তাজ ফারিসতাকে ধরে উঠিয়ে ফারিসতার হাত শক্ত করে ধরে বাইকের কাছে যেয়ে দ্রুততার সাথে নিচে পড়ে থাকা বাই উঠাতে যাবে তখন চারপাশ থেকে হুট করে কতগুলো গাড়ি এসে ওঁদের ঘেরাও করে ফেললো৷

হঠাৎ এতগুলো গাড়ি এসে ওঁদের ঘেরাও করায় কেঁপে উঠলো ফারিসতার বুক। ফারিসতা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে তাজের হাত খামচে ধরলো। তাজ ওঁদের চারপাশে ঘুরতে থাকা গাড়িগুলোর দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো ফারিসতা হাত যেই হাত ধরার মাঝে অভয় দিয়ে দিলো ভয় পেও না আমি আছি তো।

চারপাশে ঘুরতে থাকা গাড়িগুলো একে একে থেমে গেলো। গাড়িগুলো থামতে সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো মুখোশধারী বিশালাকৃতির মানুষগুলো। সেই মানুষগুলোর মধ্যে থেকে একজন একটা গাড়ির সামনে যেয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিতে গাড়ি থেকে নেমে আসলো এক ব্যক্তি যার মুখে লেগে আছে এক পৌছাসিক হাসি। সেই ব্যক্তির ফেইস স্পষ্ট হতে ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল ফারিসতা সর্বাঙ্গ। চক্কর দিয়ে উঠলো মাথা। ফারিসতা অবিশ্বাস্য চোখে সামনে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, বাবা…..

ফারিসতার মুখে বাবা ডাক শুনে চমকে উঠে তাজ ফারিসতার দিকে একবার তাকিয়ে আরেকবার সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে শুধালো,

আফজাল আকন্দ…..

আফজাল আকন্দ বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে ফারিসতার দিকে তাকিয়ে বলল,

যাক এতবছর পর ও তাহলে চিনতে পেরেছো কষ্ট করে নিজের পরিচয় দেওয়া লাগলো…

সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগে তাজ আফজাল আকন্দের কলার টেনে ধরে হুঙ্কার ছেড়ে বলে উঠলো,

এতদিনে গর্ত থেকে বের হয়েছিস তোকে তো আমি খু*ন করে ফেলবো। মায়ের এক্সিডেন্ট তুই করিয়েছিস তাইনা? জা* তোর মতো নরপশুকে জিন্দা কবর দিবো আমি৷

এমনিতেই ফারিসতার পুরো দুনিয়াটা যেনো অন্ধকার হয়ে আসছিলো তার উপরে তাজের কথা কানে যেতে আত্নাটা যেনো শরীর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। মায়ের এক্সিডেন্ট মানে? এই জন্য তাজ ওঁকে বুঝিয়ে তখন হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছিলো। কি হয়েছে ওর মায়ের ভাবতে ফারিসতার নিঃশ্বাস আঁটকে আসতে লাগলো। ওর মা ভালো নেই আর ওর মায়ের এই অবস্থা আর কেউ না ওর বাবা করেছে ঠিক মানতে পারলো না ফারিসতা৷ আজ এত বছর পর কেনো এই লোক ওর মাকে, ওদের মারতে এসেছে? কিসের শত্রুতা ওনার সাথে ওদের? মাথার ভিতর ঘুতরে লাগলো হাজারো প্রশ্ন সেই সাথে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে বুকের ভিতর। অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো চোখের সামনে সব। ফারিসতা বন্ধ হয়ে আসা নেত্রে তাজের দিকে তাকাতে দুনিয়াটা থমকে গেলো। কিছু বুঝে ওঠার আগে আচমকা পিছ থেকে ঝড়ের বেগে কেউ এসে রড দিয়ে সজোরে তাজের মাথায় বাড়ি মারতে ফারিসতা তাজ বলে গগনবিদারী চিৎকার এক ছুটে তাজের তাজের কাছে যেতে নিলে কেউ হাত ধরে ফেলল।

তাজ ঢুকলুম পায়ে মাথায় হাত দিয়ে পিছু ঘুরতে অস্পষ্ট ভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফারিসতার মুখশ্রী যে ওর কাছে আসার জন্য ছটফট করছে কিন্তু কেউ হাত ধরে রাখার আসতে পারছে না৷ তাজের চোখের সামনে ধীরে ধীরে সব কিছু আরো অস্পষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। এতো করে চোখ খোলা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত চোখ খুলে রাখতে সক্ষম হলো না। ধীরে ধীরে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গিয়ে শরীর সব শক্তি ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়ল পিচঢালা রাস্তার মাঝে।

তাজকে পড়ে যেতে দেখে ফারিসতা চিৎকার করে ওঁকে ধরে রাখা ব্যক্তিকে ছাড়তে বলল কিন্তু নরপিশাচগুলো কেউ ফারিসতার চিৎকার কানে নিলো না যেনো শুনতেই পায়নি কি বলছে মেয়েটা।

ফারিসতার ছটফটানির মাঝে আফজাল আকন্দ ফারিসতার সামনে এসে দাঁড়াতে ফারিসতা ছটফটানি থামিয়ে কান্না জড়িত ভেঙে যাওয়া গলায় চ্যাচিয়ে বলল লাগলো,

কেনো এমন করছেন? কিসের শত্রুতা আপনার সাথে আমাদের? আমার মায়ের সাথে কি করেছেন আপনি? ছাড়ুন আমায় আমাকে যেতে দিন। আমি আপনার পায়ে পড়ি দয়া করে ওনাকে নিয়ে আমায় যেতে দিন কথা গুলো বলে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়লো ফারিসতা।

মেয়ের কান্নায় পাষাণ আফজাল আকন্দের মন এইটুকুও গললো না উল্টো শায়িতা হাসি দিয়ে বলতে লাগলো, ভয় পেও না তোমার কিছু করবো না শত হলেও আমার মেয়ে তুমি। যারা আমার পিছে লাগতে এসেছে জাস্ট তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিবো একে একে। প্রথমে তোমার মা এবার তোমার স্বামী, নেক্সট টার্গেট চৌধুরীর বাড়ির প্রতিটি সদস্য এ বলে রাস্তা কাপিয়ে হেসে উঠলে তিনি।

আফজাল আকন্দের কথাগুলো কর্ণগোচর হতে ফারিসতার পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসলো। হুট করে ফারিসতা দিকবেদিক ভুলে ওকে ধরে রাখা ব্যক্তির হাতে কামড় মারতে সেই ব্যাক্তির হাত আলগা হয়ে আসতে ফারিসতা এক ঝামটা মেরে হাত ছুটিয়ে দৌড়ে তাজের কাছে যেতে নিবে তার আগে ক্ষপ করে ফের হাত ধরে ফেললো আফজাল আকন্দ।

***
হসপিটালের সামনে গাড়ি থামতে বিচলিত হয়ে ছুটে ভিতরে প্রবেশ করলো চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা। সবাই ছুটে একটা কেবিনের সামনে যেতে কেবিনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলো তিফাজ চৌধুরী। তিফাজ চৌধুরী বের হতে তাহমিনা বেগম অস্থির হয়ে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,

কি অবস্থা এখন ফারজানার?

তিফাজ চৌধুরী অভয় দিয়ে বলল, এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। জ্ঞান এখনো ফেরেনি। জ্ঞান ফিরলে বাকিটা বলা যাবে।

তিফাজ চৌধুরীর কথায় যেনো জীবন ফিরে পেলো তাহমিনা বেগম। তিনি বিচলিত হয়ে বলল, ভিতরে যেতে পারবো?

তিফাজ চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতে তাহমিনা বেগম ভিতে যেতে উদ্যত হতে প্রশ্ন ছুড়লো, ফারিসতা কোথায়? ওকে দেখছি না কেনো?

তিফাজ চৌধুরীর প্রশ্নে সবাই চমকে উঠলো। সৌরভ চৌধুরী চমকে বলে উঠলো, ফারিসতা কোথায় মানে? তাজ ফারিসতাকে নিয়ে আমাদের আগে বের হয়েছে। হসপিটালে আসেনি ওরা?

সৌরভ চৌধুরীর কথায় তিফাজ চৌধুরীর কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো৷ তিনি চিন্তিত হয়ে শুধালো, হসপিটালে আসলে নিশ্চিয়ই এখানে দেখতে পেতে।

তাজরা হসপিটালে পৌঁছায়নি শুনে বিপদের আশঙ্কায় তাহমিনা বেগম আহাজারি করে উঠতে সৌরভ চৌধুরী অভয় দিয়ে বলল, ভাবি শান্ত হও আমি দেখছি এ বলে পকেট থেকে ফোন বের করে আরফিকে কল করতে আরফি জানালো তাজ ওদের ক্লাবে আসতে বলে জানিয়েছিলো ও বিশ মিনিটের ভিতরে আসছে কিন্তু সেখানে ঘন্টাখানেক হয়ে গিয়েছে তাজ পৌঁছায়নি।

আরফির কথায় সৌরভ চৌধুরীর আরো চিন্তিত হয়ে আরফিকে জানান দিলো ওদের ক্লাবে থাকতে সে আসছে এ বলে ফোন কেটে দিয়ে সৌরভ চৌধুরী তিফাজ চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলল, তুমি এ দিকটা খেয়াল রেখো আর সিকিউরিটি বাড়িয়ে দেও। আমি বের হচ্ছি কেউ টেনশন করো না এ বলে কাউকে ফোন করতে করতে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো।

চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৪৬

বাহিরে প্রচন্ড শব্দের আওয়াজ কানে যেতে পিটপিট করে চোখ খুললো ফারিসতা। চোখ খোলায় সাথে সাথে মস্তিষ্কে একে একে জানান দিতে লাগলো ওদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো৷ ও যখন ছুটে তাজের কাছে যাচ্ছিলো তখন আফজাল আকন্দ ওর হাত ধরে ফেলে মুখের উপরে কিছু একটা স্প্রে করতে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এসেছিলো এরপর কি হয়েছে কিছুই মনে নেই। সব কথা স্মরণ হতে ফারিসতা চাতক পাখির মতো তাজকে খুঁজতে লাগলো কিন্তু তাজের অস্তিত্ব টের পেলো না। টের পেলো বদ্ধ একটা রুমের ভিতরে চেয়ারের সাথে বাঁধা ও। টিনের চালের ফাঁক দিয়ে আলোর রশ্মি রুমে প্রবেশ করতে ফারিসতার বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠলো। ওদের যখন আফজাল আকন্দ ধরেছিলো তখনতো রাত ছিলো এখন দিন তাহলে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ও কোথা আছে?ওর মা কেমন আছে? তাজ কোথায় আছে ভাবতে ফারিসতার চোখ দিয়ে অঝোর ধারা পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অস্থিরতায় বুকের ভিতর যন্ত্রণায় কাতরে উঠলো। জীবন ওঁকে এ কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলো ভাবতে হুহু করে কেঁদে উঠলো ফারিসতা।

ফারিসতার কান্নার মাঝে বিকট শব্দের দরজা খুলে গিয়ে আফজাল আকন্দ ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ফারিসতার গলায় ছু*রি ধরতে থেমে গেলো ফারিসতার কান্না। ক্ষত বিক্ষত হলো হৃদয়। এমন বাবাও কি পৃথিবীতে থাকতে পারে যে নিজের মেয়ের গলায় ছু*রি ধরতে পারে? নিজের মেয়ের ভালোবাসার মানুষগুলোকে এভাবে নিঃশেষ করে দিতে পারে? ঘৃণায় যন্ত্রণায় কতরে উঠে ফারিসতা মন থেকে চাইলো ছু*রি*টা যেনো ওর গলায় চালানো হয়। এমন বাবা এই পৃথিবীর আর কারো না হোক এ বলে ফারিসতার দুর্বল চোখ জোড়া বন্ধ করে নিতে নিবে তখন চোখ যেয়ে ঠেকলো দরজায়। দরজার দিকে চোখ যেতে যেনো মৃত প্রায় ফারিসতা পুনরায় জীবন ফিরে পেলো। তৃষ্ণাত্বক কাকে মতো চেয়ে রইলো তাজের দিকে। ওর তাজের কিছু হয়নি এটা জানতে পেরেছে এখন যেনো মরেও শান্তি পাবে।

দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করলো তাজ, আরফি, পাপন, মাহিম, সাব্বির সহ আরো কিছু গার্ড। কাল সারা রাত হন্য হয়ে তাজদের খুঁজেছে আরফিরা কিন্তু কোনো ভাবেই তাজদের খোঁজ মিলাতে পারেনি। শেষ রাতের দিকে ফারজানা বেগমের জ্ঞান ফিরতে তার কাছ থেকে আফজাল আকন্দের কথা শুনে কেউ এক সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে সোর্স লাগিয়ে আফজাল আকন্দ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে একে একে আফজাল আকন্দের সব চ্যালা প্যালাদের শেষ করে তাজকে ছাড়িয়ে আরফজাল আকন্দকে ধরতে নিবে তখন আফজাল আকন্দ চালাকি করে ফারিসতার গলায় ছু*রি ধরে চ্যাচিয়ে বলে উঠলো,

খবরদার আর এক পা এগোলে একদম ছু*রি চালিয়ে দিবো।

আফজাল আকন্দ ফারিসতার গলায় ছুরি ধরতে তাজ সহ সবার পা জোড়া থেমে গেলো। তাজ থেমে গিয়েই হুঙ্কার ছুড়লো,

ওর শরীরের এক ফোটা রক্ত ও যদি তোর জন্য ঝড়ে তাহলে তোর কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি কু*

আফজাল আকন্দ কিছু বলতে যাবে তার আগে ঝড়ের বেগে একটা বুলেট ছুটে এসে তার মাথার এপার থেকে ওপারে চলে গেলো সাথে সাথে হাত থেকে খসে পড়লো ফারিসতার গলায় ধরে রাখা ছু*রি। হাত থেকে ছু*রি পাড়ার সাথে ছটফট করতে করতে নিজেও গড়িয়ে পড়লো ফ্লোরে। এখানেই বিন্যাশ হলো পাপিষ্ঠর পাপ লীলা।

সৌরভ চৌধুরী জানালার বাহির থেকে চ্যাচিয়ে বলে উঠলো, ঠিক আছিস তোরা?

তাজ চোখের ইশারায় হ্যা বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ফারিসতার দিকে। তাজ ফারিসতার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে ফারিসতার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে শক্ত করে ফারিসতাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলো যেনো পারলে বুকের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলে। তাজ কিছুক্ষণ ফারিসতাকে বুকের মাঝে শক্ত করে আগলে রেখে ফারিসতার কেনো রেসস্পন্স না পেয়ে ফারিসতাকে ছেড়ে দুই গালে হাত রেখে বিচলিত হয়ে শুধালো, ফারিসতা ঠিক আছো তুমি?

এবারো কোনো রেসপন্স এলো না ফারিসতার থেকে। সেই একে ভাবে শুধু চেয়ে আছে তাজের পানে সেই চেয়ে থাকার মাঝে ধীরে ধীরে ফারিসতার চোখজোড়া বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো তা দেখে তাজ আরো বিচলিত হয়ে ফারিসতার গালে মৃদু চাপড় দিয়ে ওকে ডাকতে লাগলো কিন্তু ফারিসতার কান অব্দি সেই ডাক পৌঁছালো না একটা সময় শরীরের পুরো ভার ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি বুঁজে গেলো আখিজুগল।

ফারিসতার চোখ বন্ধ করে নেওয়ায় তাজের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। তাজ দ্রুত ফারিসতাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠতে বসতে একে একে সবাই এসে গাড়িতে উঠে সবাই ছুটলো হসপিটালে।

***
গভীর জঙ্গলের মাঝে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলেছে তাজ ফারিসতা। মূলত জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যাওয়ায় এখান থেকে বের হওয়ার জন্য সঠিক পথ খুঁজে চলেছে। জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছপালা তার ভিতরে একটু পর পর জীবজন্তুর ডাকের আওয়াজ কানে ভেসে আসতে শিউরে উঠছে ফারিসতা। ফারিসতাকে ভয় পেতে দেখে তাজ ফারিসতার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে অভয় দিয়ে বলল, ভয় পেও না আমি আছি তো।

আমি আছিতো ধ্বনিটা কানে যেতে ভয়ে গুটিয়ে থাকা ফারিসতার আবার সক্রিয় হয়ে উঠলো। ওর পাশে থাকা মানুষটা ওকে যেভাবে আগলে রেখেছে এর পর ও কি ভয় পাওয়া সম্ভব? ফারিসতা যখন তাজকে নিয়ে ভাবনায় মত্ত তখন আচমকা তাজ ওকে ধাক্কা মারতে ফারিসতা নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে না পেরে মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে গিয়ে কাঁটাযুক্ত লতাপাতায় হাত-পা ছিলে গিয়ে টাটকা রক্ত বের হতে লাগলো। তাজ ওকে এভাবে ফেলে দিলো ভাবতে ফারিসতা আহত মন নিয়ে উঠে বসে চোখ তুলে তাকাতে মনে হলো কলিজাটা কোনো জন্তু জানোয়ার টেনে ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা তীর ছুটে এসে তাজের বুকের এপার থেকে ওপার ভেদ করে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো তাজের দেহ তা দেখে ফারিসতা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে তাজকে ধরার আগে তাজ লুটিয়ে পড়লো নিচে। ফারিসতা দিকবেদিক ভুলে চিৎকার দিয়ে তাজের কাছে বসতে নিবে তখন কোথা থেকে একটা হিংস্র পশু তাজের উপরে ঝাপটে পড়তে ফারিতা পুরো জঙ্গল কাঁপিয়ে তাজ বলে চিৎকার করে উঠতে সাথে সাথে ফারিসতার ঘুম ভেঙে গেলো।

হঠাৎ ফারিসতার এমন চিৎকারে তাজের কলিজা কেঁপে উঠল। ফারিসতার পাশেই বসে থাকা তাজ ফারিসতা বাহুডোরে আগলে নিয়ে অস্থির হয়ে বলতে লাগলো, ফারিসতা কি হয়েছে? চিৎকার করলে কেনো? দুঃস্বপ্ন দেখেছো? শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে আমায় বলো। শুনতে পারছো আমার কথা?

অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে থাকা ফারিসতার কানে তাজের কণ্ঠ যেতে জেনো জীবন ফিরে পেলো মেয়েটা। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা হাতে তাজকে ঝাপটে ধরে কান্না করে দিয়ে বলতে লাগলো, আ..আপনি ঠিক আছেন? দেখি এ বলে তাজকে ছেড়ে দিয়ে পাগলের মতো তাজের শার্টের বেতাম টেনে ছুটিয়ে বুকে হাত দিয়ে দেখতে লাগলো ক্ষত আছে নাকি। বুকে কোনো ক্ষত না পেয়ে ফারিসতা প্রাণ ফিরে পেয়ে খুশিতে কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়ে ফের তাজকে জাপটে ধরলো।

তাজ ফারিসতাকে শান্ত করতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, জান আমি ঠিক আছি। দেখো আমি একদম ঠিক আছি তোমার পাশে বসে আছি৷ আমার কিছু হয়নি শান্ত হও প্লিজ। এভাবে হাইপার হয়ে গেলে তোমার সমস্যা হবে। তোমার তাজ তোমার কাছে আছে একদম তোমার কাছে দেখো তুমি এ বলে তাজ ফারিসতার মুখ বুকের মাঝ থেকে তুলে দুই গালে হাত রেখে আস্তে ধীরে ফারিসতাকে শান্ত করলো। ফারিসতা শান্ত হয়ে আসতে তাজ ফারিসতার চোখের পানি মুছে দিয়ে পুরো মুখ চুমুতে ভোরে দিয়ে শক্ত করে আবার বুকের ভিতর আগলে নিলো। ফারিসতা শান্ত হয়ে নীরবে তাজের বুকের সাথে লেপ্টে রইলো। এভাবে কতটা সময় পেরিয়ে গেলো জানা নেই কিন্তু অনেকটা সময় পর ফারিসতার কিছু একটা মনে পড়তে চট করে তাজকে ছেড়ে ফের অস্থির হয়ে বলে উঠলো, আম্মু, আম্মু কোথায়?

ফারিসতাকে ফের অস্থির হতে দেখে তাজ ফারিসতাকে শান্ত করতে করতে বলল, মা ঠিক আছে। শান্ত হও পাশের কেবিনে মা। অস্থির হয়ো না আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে মায়ের কাছে এ বলে তাজ সিট থেকে নেমে ফারিসতাকে ধরে নামিয়ে ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পাশের কেবিনে নিতে দেখা মিললো পরিচিত সব মুখগুলো। ফারিসতা ধীর পায়ে বেডে কাছে এগিয়ে গিয়ে মায়ের শরীরের বিভিন্ন জায়গা ব্যান্ডেজ দেখে তার পাশে বসে ঠোঁট ভেঙে কান্না করে দিলো।

মেয়ের কান্নার ফারজানা বেগম এক হাত দিয়ে ফারিসতার হাত মুঠোয় বিয়ে অভয় দিয়ে বলল, কান্না করছো কেনো মামনী? মা একদম ঠিক আছি শুধু একটু লেগেছে। একটুও কান্না করবে না তাহলে কিন্তু মা কষ্ট পাবো।

ফারিসতা হেকচি তুলে বলল, এত আঘাতের পরও সামান্য লেগেছে বলছো?

তোমার মা খুব স্ট্রং তাতো জানোই। এত অল্পতে দুর্বল হলে হবে? আঘাত তো তুমিও পেয়েছে। দেখো কিভাবে নিজের আঘাত ভুলে মায়ের কাছে ছুটে চলে এসেছো। তেমনি তোমাকে দেখে মায়ের সব আঘাতের ক্ষত সেরে গিয়েছে। তোমাদের উপরে অনেক ধকল গিয়েছে মামনী। তাজের শরীর ও অনেকটা খারাপ। তোমরা বাসায় যেয়ে একটু রেস্ট নেও।

ফারিসতা নাকচ করে দিয়ে জানালো ও এখানেই থাকবে। শেষে সবাই অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাজ ফারিসতাকে বাসায় পাঠালো। ওদের সাথে রাশফিয়া, আদরিবার, আরফি, সাফওয়ানকেও পঠিয়ে দিলো। সবাই কাল থেকে হসপিটালের ছিলো তাই ওদের রেস্ট নেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে ফারজানা বেগমের সাথে থেকে গেলো, তাহমিনা, রেহেনা, জেরিনা তিন জা।

***
বাসার সামনে এসে গাড়ি থামতে একে একে গাড়ি থেকে নামলো তাজ ফারিসতা, আরফি রাশফিয়া আর সাফওয়ান আদরিবা। সবাই গাড়ি থেকে নেমে এক সাথে বাসায় প্রবেশ করতে রাশফিয়া ফারিসতা আর তাজের উদ্দেশ্যে বলল, ভাইয়া আপনার উপরে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট করুন আমি দেখি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করি। খাবার হলে আপনাদের ডেকে নিবো।

রাশফিয়ার কথা শুনে তাজ বলল, সবাই খুব ক্লান্ত এখন খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে না তোমরাও রেস্ট নেও আমি খাবার বাহির থেকে অর্ডার করে দিচ্ছি।

না না ভাইয়া আমি ঠিক আছি পারবো করতে। এখন এই শরীরে বাহিরের খাবার খাওয়া ঠিক হবে না। আপনি চিন্তা করবেন না আমি করতে পারবো। আপনার যেয়ে একটু রেস্ট করুন।

তাজ আর অমত করলো না। এমনি বাহিরের খাবার খাওয়া খুব একটা পছন্দ না তার উপরে এখন এই দুর্বল শরীরে বাহিরের খাবার খাওয়াটা ঠিক হবে না। তাজ আর কথা না বড়িয়ে ফারিসতার দিকে চেয়ে বলল, চলো..

তাজের ডাকে ফারিসতা আমতা আমতা করে বলল, আমি রাশফিয়াকে সবকিছু রেডি করে দিয়ে আসি? খুঁজে পাবে না কোথায় কি আছে।

ফারিসতার কথা শেষ হতে না হতে রাশফিয়া ধমকে উঠলো, বেশি বুঝলে একদম মার খাবি। আমি একবার ও বলেছি আমি কিছু খুঁজে পাবো না? এখন চুপচাপ উপরে গিয়ে রেস্ট নিবি। আমি কিছু খুঁজে পাবো নাকি পাবো না তা আমি দেখে নিবো।

ফারিসতা কিছু বলতে উদ্যত হতে আদরিবার থামিয়ে দিয়ে বলল, দোস্ত আমরা সবাই জানি তোর ঘাড়ের রগ ত্যাড়া। তুই অসুস্থ এখন অন্তত ত্যাড়ামো করিস না। সুস্থ হলে যত খুশি ঘাড় ত্যাড়ামো করিস তখন কিছু বলবো না। আর এই বাসায় কেথায় কি আছে সব আমার জানা আছে তাই প্রবলেম হবে না আমরা দুজন সামলে নিবো। আর একটা কথাও বলবি না চুপচাপ উপরে যা এ বলে রাশফিয়া আর আদরিবা ফারিসতাকে ঠেলেঠুলে তাজের সাথে উপরে পাঠালো।

ফারিসতারা যেতে রাশফিয়া আরফির উদ্দেশ্যে বলল, তুমিও যেয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নেও।

আপাতত একটু ফ্রেশ হলেই এনাফ। আজ নাহয় সবাই মিলে রান্না করবো। একটু ওয়েট করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

আরফি যেতে আদরিবা কোমড়ে হাত দিয়ে সাফওয়ানের উদ্দেশ্যে বলল, এখন কি তোমাকেও ইনভাইট করে বলতে হবে ফ্রেশ হতে? যাচ্ছো না কেনো তুমি?

সাফওয়ান আদরিবার মাথায় গাট্টা মেরে বলল, আমি একদম ফিট আছি ফ্রেশ হতে হবে না। চল তোদের কাজে হেল্প করি।

সাফওয়ানের কথায় আদরিবার চোখ গোল গোল করে বলল, জীবনে কোনো দিন কিচেনে পা দিতেও দেখিনি। কিচেন থেকে অলওয়েজ দশহাত দূরে থাকো আর বলছো আমাদের কাজে হেল্প করবে?

কিচেনে যাইনি তো কি হয়েছে? এখন যাবো আর তোদের কাজে সাহায্য করে কাজ কমিয়ে দিবো।

হয়েছে জনাব আপনি কাজ কমানোর বদলে উল্টো অকাজ করে যে কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিবেন তা খুব ভালো করেই জানি। এখন এমনি সবাই ক্লান্ত তাই আপনার অকাজ করে আর কাজ বাড়ানো লাগবে না। আপনি এখন আসতে পারেন।

অপমান করছিস? এর শোধ কিন্তু সুদে আসলে আমি তুলবো।

যাবে তুমি এখান থেকে? দাঁত কটমট করে বলে উঠলো রাশফিয়া।

সাফওয়ান ফের আদরিবার মাথায় গাট্টা মেরে যেতে যেতে বলল, যাচ্ছি বাপ।

আদরিবার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে বলল, শালা আনরোমান্টিক হবু বউকে জান না ডেকে ডাকে বাপ।

তুই হবু জামাইকে শালা ডাকতে পারলে ভাইয়া বাপ কেনো ডাকতে পারবে না? সিরিয়াসলি তোরা দুইটাই হাপ মেন্টাল। এই হাপ মেন্টাল দুইটা এক সাথে হলে ফুল মেন্টাল হয়ে যাবি আমি শিওর এ বলে রাশফিয়া উচ্চশব্দে হেঁসে উঠলো।

হইলাম নাহয় পাগল তবুও এক হতে পারবো এটা ভাবলেইতো খুশিতে নাচতে মন চায় আমার।

ওলে আমাল ননদিনী কি ভালোবাসা। ভালোবেসে এত দিওয়ানা না হয়ে এবার চলেন দেখি খাবারের কি ব্যবস্থা করা যায়।

যথা আজ্ঞা ভাবিজি চলেন এ বলে রাশফিয়া আর আদরিবা কিচেনে চলে গেলো।

চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

হ্যাপি রিডিং…🥰 ।