হৃদয়স্পর্শী মায়াবিনী পর্ব-৪৭ এবং শেষ পর্ব

0
137

#হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর (মিমি)
#পর্বঃ৪৭ অন্তিম পর্ব

মুখে পানির ছিটে দিতে ক্ষত স্থানেগুলোতে পানি লাগতে ব্যথায় উহ্ করে উঠলো ফারিসতার।

ফারিসতার মুখ থেকে ব্যথাসূচক শব্দ বের হতে তাজ অস্থির হয়ে বলল, দেখি রুমে চলো আর পানি দিতে হবে না মুখে এ বলে ফারিসতাকে ধরে রুমি নিয়ে গিয়ে তোয়ালে এনে খুব সাবধানে ফারিসতার মুখ মুছে দিতে লাগলো যাতে এইটুকু ব্যথা না লাগে।

তাজের এমন সাবধানী কাজে ফারিসতা সব ব্যথা ভুলে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইলো তাজের দিকে। ফারিসতার মুখ মোছা হলেও একি ভাবে ফারিসতাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাজ ভ্রু গুটিয়ে শুধালো,

কি দেখছো এভাবে?

আমার চেয়েও তো আপনার ক্ষতগুলো বেশি জখম। পানি লাগানোর পর ও এতটা স্বাভাবিক কিভাবে আছেন? জ্বালা করছে না?

তাজ মৃদু হেঁসে ফারিসতার নাক টেনে দিয়ে বলল, এইটুকু আঘাতে তাজ চৌধুরীকে কাবু করতে পারে না বুঝলে। একটু বসো এ বলে তাজ কাভার্ড থেকে একটা মলম এনে ফারিসতার পাশে বসতে ফারিসতা মৃদু চ্যাচিয়ে বলে উঠলো,

এই না এটা আমি কিছুতে দিবো না। পানি লাগাতেই জ্বালা করছে ওটা লাগালে আরো জ্বালা করবে।

বাচ্চামো করে না জান এটা না দিলে ক্ষত সারতে সময় লাগবে। দেখি আমি আস্তে করে দিয়ে দিচ্ছি একটুও ব্যথা করবে না এ বলে ফারিসতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে হাতে মলন নিয়ে কপালের পাশে ক্ষততে লাগাতে কামড় মেরে উঠতে ফারিসতা চ্যাচাতে যেয়েও চ্যাচালো না। চোখমুখ খিচে অধর কামড়ে ধরে সয়ে নিলো সব ব্যথা। তাজ ফারিসতার মুখ অবলোকন করে আস্তে আস্তে হাতে পায়ের সব ক্ষত স্থানে মলম লাগানোর সাথে আস্তে করে ফু দিলো যাতে জ্বালা না করে। সব ক্ষততে মলম দেওয়া হলে ফারিসতার গালে হাত রেখে বলল,
হয়ে গিয়েছে চোখ খোলো।

তাজের কথায় ফারিসতা পিটপিট করে চোখ খুলতে তাজ প্রশ্ন করলো, এখনো জ্বালা করছে?

ফারিসতা চটজলদি দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে না বলে তাজের থেকে মলমটা নিয়ে তাজের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, শুধু বউ এর ক্ষত সারালেই হবে? নিজেরটাও তো সারাতে হবে।

বউয়ের একটু আদর পেলে সব ক্ষত ভ্যানিশ হয়ে যাবে।

তাজের কথায় ফারিসতা লজ্জমাখা হেসে বলল, অসভ্য নিজের মুখ বন্ধ রাখুন এ বলে তাজের শরীর থেকে শার্ট খুলে তাজের পিঠের দিকে তাকাতে ফারিসতার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা হাতে তাজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে কান্না জড়িত গলায় বলল, এই ক্ষত নিয়েও আপনি এতটা স্বাভাবিক হয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে আছেন। খুব ব্যথা করছে না এখানে?

ফারিসতার কান্না জাড়িত কণ্ঠস্বর শুনে তাজ মুচকি হেঁসে বলল, তোমার হাতের স্পর্শে সব ব্যথা ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে জান।

এত ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়েও লোকটা ওর সামনে কতটা স্বাভাবিক হয়ে আছে ভাবতে ফারিসতার আরো করে কান্না পেয়ে গেলো। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা হাতে তাজের পিঠে অতি সপ্তপর্ণে মলম লাগিয়ে দিলো। একে একে সব ক্ষততে খুব সাবধানে মলম লাগিয়ে দিলো যাতে ব্যথা না পায়। মলম লাগানো হলে তাজ বেডে শুয়ে ফারিসতাকে ইশারায় কাছে ডাকলো।

তাজের ডাকে ফারিসতা কোনো বাক্য বিনয় না করে তাজের পাশে শুতে তাজ ফারিসতাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে বলল, এখন চুপচাপ একটু ঘুমাবে। একটু ঘুম হলে দুর্বলতা কেটে যাবে অনেকটা।

ফারিসতা অমত করলো না। তাজের উষ্ণ বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে বিড়াল ছানার ন্যায় লেগে রইলো। একটা সময় দু’জনেই ঘুমের দেশে পারি দিলো।

****
আরফি ফ্রেশ হয়ে কিচেনে আসতে দেখলো রাশফিয়া আর আদরিবা রান্নার সবকিছু গোছগাছ করছে। রাশফিয়া ভাত বসিয়ে বেসিনে মাংস ধুচ্ছে আর রাশফিয়া পেয়াজ কাটছে। ছু*রি দিয়ে এক টুকরো করে পেয়াজ কাটছে আবার চোখ ডলছে। বোনের কাজে আরফি স্মিত হাসলো। মেয়েটা রান্নার কাজে খুবি কাঁচা। আরফি আদরিবার কাছে যেয়ে ওর হাত থেকে ছু*রি নিয়ে বলল, আর কিছু করতে হবে তোর আমি করছি।

ভাইয়ের কথায় আদরিবা ঠোঁট উল্টো বলল, ভাইয়া একটু বলবে এই পেয়াজের সাথে আমার কিসের শত্রুতা। আমি যখনি পেয়াজ কাটাতে আসবো তখনি ও আমাকে কাঁদাবে।

আদরিবার কথায় আরফি আর রাশফিয়া এক সাথে হেঁসে উঠলো তা দেখে আদরিবার আরো ঠোঁট উল্টে বলল, হাসছো কেনো তোমরা?

রাশফিয়া তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে আদরিবার কাছে এসে আদরিবার গাল টেনে দিয়ে বলল,

ননদিনী আপনি রান্না-বান্নার কাজে খুব এক্সপার্ট এই জন্য আপনার সাথে পেয়াজের এত শত্রুতা। অনেক কাজ করেছিস আর কিছু করতে হবে না৷ সবকিছু তো রেডি আছে এখন শুধু বসাবো তুই যেয়ে রেস্ট কর।

আদরিবা যেতে না চাইলেও রাশফিয়া জোর করে পাঠিয়ে দিলো। রান্নার কাজে মেয়েটা একদমি কাঁচা সেই হিসেবে যতটুকু পেরেছে ওকে হেল্প করেছে এখন বাকিটা ও সামলে নিতে পারবে তাই আদরিবাকে পাঠিয়ে দিলো।
আদরিবা যেতে রাশফিয়া আরফির উদ্দেশ্যে বলল,

আমাকে দেও আমি কেটে নিচ্ছি।

আরফি দিলো না। নিজেই পেয়াজ কাটতে কাটতে বলল, কোনো কথা না আজ আমি রান্না করবো তুমি রিলাক্স করো।

আমেনা বেগম যখন বাসায় থাকে না তখন রাশফিয়া একাই সব কাজ সামলে নেয় তখন রান্না করতে গেলে আরফি সবসময় ওকে টুকিটাকি সাহায্য করে কিন্তু তাই বলে আজ রান্না করবে ভাবতে রাশফিয়া চোখ বড় বড় করে বলল, রান্না করবে মানে? তুমি রান্না করতে পাড়ো যে রান্না করবে?

পাড়ি না তো কি হয়েছে? তুমি দেখিয়ে দিবে আমি রান্না করবো।

এই একদম না তুমি পাড়বে না। দেখি সরো আমাকে দেও।

আরফি রাশফিয়ার হাত ধরে একটা চেয়ার টেনে সেটায় বসিয়ে দিয়ে বলল, চুপচাপ এখানে বসে থাকো আর কিভাবে কি করতে হবে আমাকে দেখিয়ে দেও। তোমার হাতের রান্নার মতো এতটা ইয়াম্মি করে রান্না করতে না পারলেও খাওয়ার উপযোগী কিছু তৈরি করতে পারবো এইটুকু কনফিডেন্স আছে বুঝেছো?

আরফি যেটা বলছে সেটা করবেই এখন হাজারো না বলে কাজ হবে না তাই রাশফিয়া হার মেনে নিয়ে আরফিকে দেখিয়ে দিতে লাগলো কিভাবে কি করবে। রাশফিয়ার কথা মতো সব করে রান্না কমপ্লিট করতে করতে ঘন্টাখানেক লেগে গেলো। এক টানা এমন ঘন্টাখানেক রান্না করায় আরফি ঘেমে পুরো শার্ট ভিজে গিয়েছে। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে অনেকটা। কপাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে ঘাম তা দেখে রাশফিয়া ওড়নার এক মাথা হাতের মুঠোয় নিয়ে আরফির মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল, দেখেছো নিজের কি হাল করেছো? এতবার করে বললাম আমার কাছে দিতে কিন্তু কে শোনে কার কথা।

রাশফিয়ার বকা কানে তুলল না আরফি। উল্টো রাশফিয়ার কোমরে হাত রেখে এক টানের রাশফিয়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল, আমার একদিনের কষ্টের কথা চিন্তা করে তুমি অস্থির হয়ে পড়ছো তাহলে আমার কেমন লাগে? এমন কষ্ট তো রেগুলার করো তুমি আর মা। বাসায় কোনো মেইড ও রাখতে দেও না। তোমাদের কষ্ট দেখলে আমার ও এমন লাগে।

কি যে বলো না নিজের সংসার নিজে সামলাবো সেখানে মেইড কেনো রাখবো? তাহলে সংসারটা তো আমার হলো না ওই মেইডটার হলো। রান্না বান্না ছেলেদের কাজ না মেয়েদের কাজ বুঝলে তাই এই কাজ করতে আমাদের কোনো কষ্ট লাগে না৷ নিজের মতো করে নিজের সংসারটা সামলানোর শান্তি কতটা সেটা তুমি বুঝবে না।

সংসার সামলাতে এত শান্তি আপনার বিবিজানের?

খুব খুব শান্তি এ বলে আরফিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো রাশফিয়া।

ঘামে ভিজে আছি এভাবে ধরো না তোমার শরীরে লেগে যাবে।

রাশফিয়া আরফিকে আরো গভীর ভাজে জড়িয়ে নিয়ে শুধালো, লাগুক। দিন শেষে তোমার ঘর্মাক্ত বুকেই আমার ঠাই হোক।

আরফি মুচকি হেসে রাশফিয়ার কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বুকের মাঝে আলিঙ্গন করে নিয়ে বলল, ভালোবাসি রাশুপাখি।

আমিও খুব খুব ভালেবাসি সাহেব। এবার ছাড়ো আর তাজ ভাইয়াকে ডেকে তার থেকে পোষাক নিয়ে শাওয়ার নিয়ে আসো একবারে। আমি খাবার টেবিলে সাজাই।

আরফি সম্মতি দিয়ে তাজদের ডেকে তুলে শাওয়ার নিয়ে নিচে এসে সবাই এক সাথে খেতে বসলো। বলা বাহুল্য প্রথমবার হিসেবে আরফি খুবি ভালো রান্না করেছে তার প্রশংসা করতে কেউ ভুললো না।

***
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কায়েক মাস। তাজ, ফারিসতা, ফারজানা বেগম এখন পুরোপুরি সুস্থ। সবাই সুস্থ হতে সাফওয়ান আর আদরিবার বিয়ে বন্দবস্ত শুরু হয়ে গেলো। বিয়ের জন্য এক সপ্তহের জন্য হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে তাজ আর তিফাজ চৌধুরী গাড়িতে উঠে বসলো। বাবা ছেলের মাঝে আগের মতো দূরত্ব না থাকলেও এখনো একে অপরকে খুঁচিয়ে কথা বলতে কেউ কাউকে ছাড়ে না। তাজ গাড়ি স্টার্ট করতে তিফাজ চৌধুরী খোঁচা মেরে বলে উঠলো,

বিয়ে করেছো অর্ধেক বুড়ো হয়ে এখন বাবা হবে কি পুরো বুড়ো হয়ে? বেঁচে থাকতে কি আর নাতিনাতনির মুখ দেখতে পারবো না?

বাবার খোঁচা মারা কথার পৃষ্ঠে তাজ আজ আর পাল্টা খোঁচা মেরে কথা বলল না। আজ ওর কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিটা ও। এই সুখের দিনটা বাবার সাথে মোটেও খোঁচাখুঁচি করতে চায় না। তাজ ঠোঁটে কোনে হাসি ফুটিয়ে পাশ থেকে একটা রিপোর্ট বাড়িয়ে দিলো তিফাজ চৌধুরীর দিকে।

তাজের কাজে তিফাজ চৌধুরী বিস্মিত হলেন। ছেলেকে আজ একটু বেশি খুশি খুশি লাগছে যেনো ঠোটের কোন থেকে আজ হাসি সড়ছেই না। ছেলের এত খুশির কারণ খুঁজে না পেলেও তিনি ভ্রু কুঁচকে তাজের দিকে তাকিয়ে বলল, কি আছে এতে?

তাজ ড্রাইভ করতে করতে জবাব দিলো নিজেই খুলে দেখো না।

তিফাজ চৌধুরী তাজের থেকে চোখ সরিয়ে রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে সব ভুলে উচ্ছসিত হয়ে বলল, সত্যি আমি দাদা হতে চলেছি?

তাজ উত্তর দিলো না শুধু হাসলো। কিছুদিন যাবত ফারিসতার শরীর খুব খারাপ যেতে কিছু টেস্ট করিয়েছিলো। টেস্ট করিয়ে এমন একটা সারপ্রাইজ পাবে নিজেও কল্পনা করেনি। প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতি টের পেয়ে ছেলেটার মুখ থেকে যেনো আজ হাসি সড়ছেই না।

ছেলের হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে তিফাজ চৌধুরী তার উত্তর পেয়ে গিয়ে দুই হাত তুলে মোনাজাত তুলে বলতে লাতলো, আলহামদুলিল্লাহ, আমার নাতি যেনো আমার মতো হয়।

তিফাজ চৌধুরীর মোনাজাতে তাজের ভ্রু কুঁচকে গেলো। তাজ ভ্রু কুঁচকে তিফাজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সন্তান তোমার মতো হবে কেনো? তোমার মতো গোমড়ামুখো আমার সন্তান হবে প্রশ্নই আসে না। আমার সন্তান আমার মতো হবে।

আমার নাতি তোমার মতো গুন্ডা হবে সেটা আমি বেঁচে থাকতে হতে দিবো না। আমার নাতি আমার মতোই হবে।

বাবা তুমি আমায় এভাবে অপমান করতে পারো না।

তিফাজ চৌধুরী অবাক হওয়ার ভান করে বলল, অপমান কোথায় করলাম? আমিতো ইনসাল্ট করেছি।

বাবার এমন রসিকাতার কথায় তাজ রাগের মাঝে হেঁসে দিলো সেই সাথে তিফাজ চৌধুরী ও হেঁসে দিয়ে তাজের কাঁধে ভরসার হাত দিয়ে বলল, মজা করছিলাম। আমার নাতি আমার তাজের মতোই হোক এটাই প্রর্থনা করি। বাবা হতে চলেছো এখন কিন্তু তোমার দায়িত্ব দ্বিগুণ হতে চলেছে। তবে তুমি যতই বড় হও যতই দায়িত্ব নিতে শেখো তুমি আমার সেই ছোট্ট তাজ হয়েই থাকবে। এই বাবাকে সবসময় বটবৃক্ষ হয়ে পাশে পাবে।

বাবার ভরসাযোগ্য হাতটা কাঁধে পড়তে তাজের সুখের পরিমাপটা যেনো এবার আকাশ ছুই ছুই। তাজ মৃদু হেসে ছোট করে বলল, লাভ ইউ বাবা।

তিফাজ চৌধুরী ছেলের কথায় মৃদু হাসলো। এর ভিতরেই গাড়ি বাসার সামনে থামতে তাজ গাড়ি থেকে নামতে নামতে তিফাজ চৌধুরীকে জানান দিলো নতুন সদস্যর কথা এখনি সবার কাছে না বলতে। সবাইকে এক সাথে সারপ্রাইজ দিবে। ছেলের কথায় তিফাজ চৌধুরী সম্মতি দিয়ে এক সাথে বাসায় প্রবেশ করতে তাহমিনা বেগমের চোখ জুড়িয়ে গেলো। একটা সময় বাবা ছেলের সম্পর্ক ছিলো সাপ আর নেউলের সেখানে এখন বাবা ছেলের সম্পর্কটা কতটা ফ্রেন্ডলি যেটা দেখলেও মনটা একরাশ ভালোলাগায় ছেয়ে যায়।

বাসায় প্রবেশ করে মাকে দেখে তাজ মুচকি হেঁসে বলল, খুব খিদে পেয়ে খাবার রেডি করো ফ্রেশ হয়ে আসছি।

তাহমিনা বেগম সম্মতি দিয়ে বলল, ফারিসতাকেও নিয়ে আসিস। মেয়েটার শরীর এমনি ভালো না। এত করে বললাম তাড়াতাড়ি খেয়ে নে কিন্তু না সে সবার সাথে খাবে।

তাজ ঠিক আছে বলে উপরে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে ফারিসতাকে নিয়ে নিচে নামলো। সবাই এক সাথে খাওয়া শেষ করে ফারিসতা এটো থালাবাসন ধুতে গেলে তাহমিনা এক ধাপার দিলো অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার কাজ করতে আসায়। শাশুড়ী মায়ের বকা খেয়ে ফারিসতা ঠোঁট উল্টে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতে তিফাজ চৌধুরী ফারিসতাকে কাছে ডেকে বলল, কি হয়েছে আমার মামনীর?

বাবার আহ্লাদী কণ্ঠস্বর শুনে ফারিসতা তার পাশে বসে ঠোঁট উল্টে বিচার ঠুকলো, মা বকা দিয়েছে।

কি? কত বড় সাহস আমার মেয়েকে বকা দেয় এ বলে হাক ছেড়ে তাহমিনা বেগমকে ডাকলো তিফাজ চৌধুরী।তাহমিনা বেগম হাতের কাজ ফেলে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতে তিনি বলে উঠলো, কি সমস্যা? আমার মামনীকে কোন সাহসে বকা দিয়েছো?

স্বামীর ডাকে হাতের কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন তাহমিনা বেগম কোনো প্রয়োজনে ডাকছেন কিনা এই জন্য। এদিকে এখানে এসে স্বামীর কথা শুনে কোমরে হাত দিয়ে বলল, কেনো বকা দিয়েছি সেটা জিজ্ঞেস করো না তোমার মেয়েকে।

তিফাজ চৌধুরী এবার ফারিসতার দিকে তাকিয়ে বলল, কেনো বকেছে মা?

তিফাজ চৌধুরীর প্রশ্নে ফারিসতা এবার আমতা আমতা করতে লাগলো৷ বিচার ঠুকতে এসে এবার তো নিজেই ফেঁসে গেলো৷ এখন কি করে বলবে মা কেনো বকা দিয়েছে।

ফারিসতাকে আমতা আমতা করতে দেখে তাহমিনা বেগম এই বলে দিলো, কি হলো আম্মাজান এখন বলছেন না কেনো? শুনেন তাহলে আপনার মেয়ে কি করেছে। এমনি অসুস্থ তার উপরে নাফতানি করে থালাবাসন ধুতে গিয়েছে। বাসার আমরা তিন তিনটা মা থাকতে ও অসুস্থ শরীর নিয়ে কোন সাহসে কাজ করতে গিয়েছে সেটা এবার আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন। বাবার কাছে আমার নালিশ ঠোকা হচ্ছে তাইনা দাঁড়াও আমি ফারাজানার কাছে নালিশ ঠুকছি মেয়ে এখন আর আমাকে ভালোবাসে না।

তাহমিনা বেগমের কথায় ফারিসতা ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তখন তিফাজ চৌধুরী ফারিসতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, অসুস্থ শরীর নিয়ে ঠান্ডা কেনো ছুতে গেলে এতে ঠান্ডা লেগে যাবে তো মামনী। এখন থেকে সাবধানে চলাফেরা করবে, নিজের ভালোটা বুঝতে হবে তো মামনী। সুস্থ হলে তখন মায়ের কাজে হেল্প করলে কেউ কিছু বলবে না তবে অসুস্থ শরীর নিয়ে কিছু করা চলবে না কেমন?

ফারিসতা কোনো কথা না বলে উপর নিচ মাথা দুলালো। এদিকে পাশের সোফায় বসে তাজ বাবা-মা আর বউয়ের কান্ড দেখছে আর ঠোঁট টিপে হাসছে। ওর বাবা-মায়ের সাথে ফারিসতার বন্ডিংটা দেখলে কেউ বলবে না এরা ওর শশুর শাশুড়ী বলবে আপন বাবা-মা। ওর বাবা-মায়ের ভাগ এভাবে ফারিসতা নিয়ে নেওয়ায় একটুও হিংসে হলো না তাজের বরং বাবা-মায়ের উপরে সন্তুষ্ট হলো ওর ভালোবাসার মানুষটাকে তাঁরাও এভাবে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছে।

তাহমিনা বেগম ফারিসতার পাশে বসে একপাশ থেকে ওকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, এত রাগ করতে হবে না আম্মাজান। মা তোর ভালোর জন্যই বকা দিয়েছি। সবসময় মনে রাখবি আমি তোর শাশুড়ী না আমি তো মা। মা কি কখনো পারে অসুস্থ সন্তানকে দিয়ে কাজ করাতে? আমি অসুস্থ হলে তুই আমার কাজ করে দিবি আবার তুই অসুস্থ হলে আমি তোর কাজ করে দিবো এটাইতো মা মেয়ে ভালোবাসা।

তাহমিনা বেগমের কথায় ফারিসতা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকে ঝাপটে ধরে বলল, তোমরা এতো ভালো কেনো আম্মু?

তাহমিনা বেগম কিছু বলতে উদ্যত হতে তাজ রাগ করার ভান ধরে বলে উঠলো, এখানে যে একটা এতিম ছেলে বসে আছে সেটা কি কারে চোখে পড়েছে? মেয়েকে পেয়ে সবাই ছেলেকে যেনো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।

তাজের কথায় তিফাজ চৌধুরী খোঁচা মেরে বলল, তোমাকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। সেখান থেকে এনে চেয়েছিলাম মানুষ করতে কিন্তু হয়েছো গুন্ডা৷ একদম আমার মামনীর সাথে হিংসে করবে না তাহলে সত্যি সত্যি ডাস্টবিনে ফেলে আসবো।

তিফাজ চৌধুরীর কথায় ফারিসতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেও তাজ চোখ পাকিয়ে তিফাজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই অপমানের বদলা আমি নিবো ডক্টর সাহেব।

তাহমিনা বেগম বাপ ছেলে বাজানোর আগে এদের থামিয়ে দিয়ে তাজকে ইশারায় কাছে আসতে বলে তাজ ফারিসতাকে এক সাথে আগলে নিয়ে বলল, তোরা দুজনেই আমার জীবন।

আমিতো কারো কিছুই না এখানে থেকে আর কি হবে চলে যাই আমি এ বলে রাগের ভান করে তিফাজ চৌধুরী উঠে চলে যেতে তিনজন এক সাথে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে তাহমিনা বেগম ফারিসতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, রাত অনেক হয়েছে এবার যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আম্মা আমি হাতের কাজটা সেরে আসি এ বলে তিনিও চলে গেলো।

তাহমিনা বেগম যেতে তাজ ফারিসতার উদ্দেশ্যে বলল, চলো মেডিসিন নিতে হবে।

ফারিসতা সম্মতি দিয়ে তাজের সাথে আস্তে ধীরে উপরে উঠে গেলো। তাজ ফারিসতাকে মেডিসিন খাইয়ে শুতে বললে ফারিসতা বায়না ধরলো বেলকনিতে বসে একটু রাত্রি বিলাশ করবে।

অর্ধাঙ্গিনীর আবদার ফেলতে পারলো না তাজ। তাজ ফারিসতাকে নিয়ে বেলকলিতে আসতে ফারিসতা তাজের বুকের সাথে লেপ্টে রইলো তা দেখে তাজ কোমল স্বরে ডাকলো

ফারিসতা….

হুম…

কি হয়েছে…?

কিছুনা,, শুনছি…

কি?

আপনার হার্টবিট কথাটা বলে মুচকি হাসলো ফারিতা।

ফারিসতার কথায় তাজ মুখে সুপ্ত হসির রেখা ফুটিয়ে ফারিসতার কপালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে শুধালো,

এখনো আপনি সম্মোধন করবে? এবারতো তুমি করে বলো জান।

আপনি সম্মোধনের মাঝে অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করে তাই ছাড়তে পারিনা এই সম্মোধন।

তাজ মুচকি হেঁসে বলল, তোমার যেটা ভালো লাগে ডেকো এ বলে আলতো করে ফারিসতাকে বুকের মাঝে আলিঙ্গন করে নিয়ে বলল,

ভালোবাসি তাজফা’স আম্মু।

ফারিসতা চমকে তাজের বুক থেকে মাথা উচু করে তাজের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল তাজফা কে?

তাজ ফারিসতার কোমল ঠোঁটের ভাজে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে ফারিসতার উষ্ণ পেটে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, এখানে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে।

তাজের কথাটা কর্ণগোচর হতে ফারিসতার পুরো শরীর ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল। ফারিসতা কাঁপা কাঁপা হাতে পেটের উপরে তাজের হাতের উপরে হাত রেখে জ্বলজ্বল চোখে তাজের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে শুধালো, স…সত্যি?

তিন সত্যি। তাজফা ইজ কামইন মাই জান। আমাদের ভালোবাসা একটু একটু করে বেড়ে উঠছে তোমার মাঝে। আম সো হ্যাপি ফারিসতা। আজ আমরা পরিপূর্ণ। আমাকে এই পরিপূর্ণ ভালোবাসাম জীবন উপহার দেয়ার জন্য এতো এতো ভালোবাসি তোমায় বউ। লাভ ইউ, লাভ ইউ, লাভ ইউ সো মাচ বউজান।

ফারিসতা কম্পিত শরীরে তাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। যেই কান্না মাঝে নেই কোনো বিষাদ এর ছোয়া। আছে শুধু অফুরন্ত সুখের ছোয়া। তাজের ভালোবাসায় সমসময় এক অন্যরকম সুখের সাগরে ডুবে ছিলো আজ সেই ভালোবাসা পরিপূর্ণ একটা রূপ নিলো। ওর ভিতরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে ছোট্ট একটা প্রাণ যেটা ওদের দু’জনের ভালোবাসার চিহ্ন। কিছুমাস পর এই ছোট্ট প্রাণটা এই পৃথিবীতে এসে ওদের বাবা-মা বলে ডাকবে। ইস কি সুখময় মুহূর্ত হবে সেটা। এত সুখ কিভাবে সইবো আমি ভাবতে ফারিসতা সব ভুলে তাজের বুকে মাথা রেখে আলতো করে চোখ জোড়া বুঁজে নিলো।

ফারিসতা….

তাজের ডাকে ফারিসত ছোট করে সাড়া দিলো হুম..

আমাদের গল্পের একটা নাম দিয়েছি সেটা কি জানো?

ফারিসতা দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে বলল, কি?

তাজ ফারিসতাকে আরেকটু গভীরভাবে আলিঙ্গন করে নিয়ে শুধালো,

তুমি হৃদয়স্পর্শী
তুমি মায়াবিনী
তাইতো আমাদের গল্পের নাম দিয়েছি #হৃদয়স্পর্শী_মায়াবিনী

তাজের ছন্দে ফারিসতা মুচকি হেঁসে মাথা তুলে তাজের চোখে চোখ রেখে বলল,

ভালোবাসি ডক্টর সাহেব।

তাজ ফারিসতা চোখের পাতায় ছোট করে চুমু খেয়ে শুধালো, তোমার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা মাই কুইন।

#সমাপ্ত