এরই মাঝে পর্ব-০৩

0
127

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩

“মা, সেজুতির ঘটনা জানার পরও তুমি দাদুর সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করেছো? তুমি জানতে দাদুর কথা ফেলতে পারবোনা আমি।”
জাকিয়া মুখে বাদাম দিতে গিয়ে থামলো-“শোন রিদওয়ান, আমাকে ভুল বুঝছিস আবারও। আমিও তোর মতোই বাধ্য হয়ে অনুমতি দিয়েছি। কিছু করার নেই আমার।”
রিদওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করলো-“এখনো সময় আছে মা বিয়েটা বন্ধ করো। একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সাহস দেখাচ্ছ। এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। পরে কিছু হলে আমাকে দোষ দিয় না যেন।”
জাকিয়া জবাব দিলো না। সে নিজেই আছে গ্যারাকলে। শশুর সাহেব যে সারাজীবনের শোধ এভাবে তুলবে তা কি সে ধারণা করেছিল। তারও কিছু করার নেই আসলে। সে ফিরে তাকালো উঠোনের দিকে। সেখানে আব্দুল রব, তৈয়ব মাওলানা সহ সকলে বসে আছে। হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। জাকিয়া উঁকি দিয়ে শশুর সাহেবকে দেখলো। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে মানুষটাকে। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই মানুষটা এতোটা অসুস্থ ছিলো। জাকিয়া ছেলেকে ডাকলো-“রিদওয়ান, চল যাই। ওখানে সকলে বসে আছে। এভাবে আলাদা থাকলে খারাপ দেখায়।”
“তুমি যাও। আমি পুকুর পাড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকবো।”
জাকিয়া ঝট করে ছেলের মুখের দিকে তাকালো। রিদওয়ানের চেহারা লাল। প্রচন্ড রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে। এখন রিদওয়ানকে কিছু বলা আর উলো বনে মুক্ত ছড়ানো একই কথা। জাকিয়া ওকে রেখে এগিয়ে গেলো। মাকে যেতে দেখে রিদওয়ান হাত ছুঁড়ে দিলো আকাশের দিকে। নিজের চুল খাঁমচে ধরে কিছুক্ষণ উবু হয়ে বসে রইলো। হঠাৎ পাশে থাকা ইটের টুকরো হাতে তুলে নিয়ে পুকুরে ঢিল ছুড়লো প্রচন্ড আক্রোশে।

★★★

শায়লা ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে। কারো সাথেই ঠিকঠাক কথা বলছে না। বিকেলে রুবিনা একটা শাড়ী নিয়ে শায়লাকে দিলো-“তোর দাদীজান পাঠিয়েছে। পরে তৈরি হয়ে থাক। ওরা চলে এসেছে।”
শায়লা একবার নজর ফিরিয়ে শাড়ীটা দেখলো তারপর আবার বইয়ের দিকে তাকালো। রুবিনা আরও কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু মেয়ের মুখ দেখে সাহস হলো না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলো। মা চলে যাওয়ার পরই শায়লা বই বন্ধ করলো। উঠে এসে শাড়ীটা হাতে নিলো। তার ইচ্ছে করছে শাড়ীটা কুঁচি কুঁচি করে কেটে ফেলতে কিন্তু পারলোনা। অন্যের আশ্রয়ে থাকলে এসব দুঃসাহসিক কাজ করা যায় না। হুট করে শায়লার কান্না পেয়ে গেলো। সচরাচর যা করে না তাই করে ফেললো। হুহু করে কেঁদে দিলো শায়লা। মুখে ওড়না গুঁজে শব্দহীন কান্নায় ভেসে গেলো শায়লার গালদুটো।
“বুবু, তোমার কাপড় পরা হইছে? মা দেখতে পাঠাইলো।”
শায়লা দ্রুত হাতে চোখ মুছলো। ঘুরে বোনকে দেখলো। বিনার চেহারা আনন্দে ঝলমল করছে। সে চোখ নাচিয়ে বললো-“বুবু, দুলাভাই অনেক সুন্দর। ইয়া লম্বা, ফর্সা আবার চোখে চশমাও পরে। তুমি দেখবা?”
শায়লার ভ্রু কুঁচকে বিনাকে দেখলো। তার চেহারায় বিরক্তি স্পষ্ট অথচ বিনার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে জানালার কাছে গিয়ে বললো-“দুলাভাই পুকুরপাড়ে বসে আছে। এখান থেকে দেখতে পাবা তুমি।”
শায়লা হীম শীতল গলায় বললো-“তুই যা বিনা, আমি শাড়ী পরবো।”
শায়লার বলার ঢংয়ে বিনা থেমে গেলো। ভীত নজরে বোনকে দেখলো। কথা না বাড়িয়ে সে দ্রুত পালিয়ে এলো শায়লার সামনে থেকে। বিনা চলে যাওয়ার পরে দরজা আঁটকে শায়লা একবার জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। দ্বিধা নিয়ে পর্দায় হাত রাখে। পড়ে কি মনে করে সরে এলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্লাউজ আর পেটিকোট হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো।

শাড়ী পরে চুল বিনুনি করে চুপচাপ আয়নার সামনে বসে ছিলো শায়লা। দরজায় টোকা পড়লো, রুবিনার ফিসফিসিয়ে ডাকা কানে এলো-“শায়লা, তুই তৈরি হয়েছিস? তাহলে বাইরে আয় দাদু ডাকছে।”
শায়লা দেরি না করে দরজা খুলে দিলো। রুবিনা ভেতরে এসে মেয়েকে দেখে থমকে গেলো। কি সুন্দর লাগছে শায়লাকে। একি তারই মেয়ে? এতো সুন্দর কবে হলো? মুগ্ধ নয়নে মেয়েকে দেখে রুবিনা। মেয়ের জন্মের সময়কার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মনে পড়লো মেয়ে হওয়ার পর শায়লার বাবা কতটা খুশি হয়েছিল। বলেছিল, রুবি এই মেয়েকে আমি ডাক্তার বানাবো। এমন মায়াবী চেহারা আমার মেয়ের যে রোগী ডাক্তারের চেহারা দেখে অর্ধেক রোগ সেরে যাবে। অথচ মেয়ে চান্স পেয়েও ডাক্তারি পড়লোনা লোকটা একবারও সেই খোঁজ নিলো না। রুবিনা আর্দ্র চোখের পাতা দ্রুত হাতে মুছে নিয়ে মেয়েকে ডাকলেন-“চল শায়লা, সবাই অপেক্ষা করতেছে।”
শায়লা চুপচাপ মায়ের পিছু নেয়। “একমিনিট” বলেই রুবিনা হুট করে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে কাজল হাতে টেনে শায়লার কানের পাশে লাগিয়ে দিলো-“কারো নজর না লাগুক আমার মেয়ের জীবনে।”

★★★

রাত আটটার দিকে দুই পরিবারের লোকজন, গ্রামের কিছু গন্যমান্য মুরুব্বিদের উপস্থিতিতে শায়লা আর রিদওয়ানের বিয়ে সম্পন্ন হলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য কথা হলো দু’জনার কেউই একে অপরকে তাকিয়ে দেখলো না ভালো মতো। শায়লার আর রিদওয়ান দু’জনার কাছেই বিয়েটা কেবল দাদুদের ইচ্ছেপূরন। বিয়ে হওয়ার পর শায়লা সবাইকে সালাম করে ঘরে ঢুকে গেলো। এমনকি খাওয়ার সময়ও বেরুল না। সবাই কথা বলে ঠিক করলো রিদওয়ান আজ এখানেই থাকবে। পাত্র পাত্রী নিজেদের মধ্যে একটু আলাপ পরিচয় করবে। কাল ভোরে নতুন বউ নিয়ে পুরো পরিবার ঢাকায় রওনা হবে। রিদওয়ান পুরোটা সময় দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। নতুন বউয়ের সাথে রাত কাটানো অসম্ভব। কিছু একটা করতেই হবে তাকে।

শায়লা চুপচাপ নিজের কামরায় বসে ছিলো। বিনা এসে বলে গেছে আজ দুলাভাই থাকবে এ বাড়িতে। সেই থেকে শায়লার হাত পা কাঁপছে। যে বিয়ের জন্য প্রস্তুতই ছিলো না সেই বরের সাথে রাত কাটাতে হবে ভেবেই মেজাজ চড়ছে তার। সে দরজা আঁটকে বসে রইলো। বর থাকলে থাকুক কিন্তু সে দরজা খুলবে না। এই ঘর বাদে অন্য যেখানে ইচ্ছে থাকুক ছেলেটা।

রাত দশটা নাগাত শোনা গেলো, জরুরি কাজ থাকায় বর একা একাই ঢাকায় চলে গেছে। খবর শুনে শায়লা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তার আর কোন অশান্তি করতে হলো না ভেবে মনে মনে বর নামক ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞ হলো।

★★★

রিদওয়ান চলে যাওয়াতে জাকিয়া বেশ খুশি। শশুরকে মুখের উপর কিছু বলতে পারছে না। আজ রিদওয়ানের ওখানে থেকে যাওয়ার আইডিয়া মোটেও পছন্দ হয়নি তার। কিন্তু মুখ ফুটে বলতেও পারছিলেন না। শায়লা মেয়েটাকে ভালো লাগেনি। তার সাথে কিংবা পল্লবী মালিহার সাথেও মেয়েটা কথা বলেনি খুব একটা। কেমন যেন গম্ভীর মুখ করে বসে ছিলো। যতদূর মনেহচ্ছে মেয়েটাও বিয়েতে রাজী না। একদিক দিয়ে ভালোই হলো। দু’জনার কেউ কাউকে পছন্দ না করাই ভালো। এই মেয়েকে তার রিদওয়ানের বউ হিসেবে মানায় না। গ্রামের মেয়ের এতো ভাব? পল্লবী কিংবা মাহিলার কাছে মেয়ে কিছুই না। ওরা দু’জনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্ব মহিমায় উজ্জ্বল। এই মেয়ে নেহাতই বাচ্চা তারউপর ভাব আছে ষোলআনা। তাও তো বাপের হদিশ নেই। বাপ থাকলে না জানি কি করতো। জাকিয়া বেশ বিরক্ত।
“বউমা, কি ভাবতেছ?”
হঠাৎ করে আব্দুর রবকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খায় জাকিয়া-“কিছুনা আব্বা।”
আব্দুল রব সামনে চেয়ার টেনে বসলেন-“শোন, আমি জানি রিদু চলে যাওয়াতে তুমি খুশি। কিন্তু একটা কথা মনে রাইখো রিদওয়ান এর সাথে শায়লার সংসার গড়ে তোলার দায়িত্ব তোমার। দু’জনই তোমার কাছে থাকবে, ওরা কিভাবে একজন আরেকজনকে পছন্দ করবে সেটা তুমি বুঝবা কিন্তু ওদের একে অপরকে পছন্দ করা চাই। বুঝছো? অন্য কোন তাল করার চেষ্টা কইরো না কিন্তু।”
জাকিয়া রেগে গেলো-“আব্বা, আপনি সবসময় আমাকে ভুল বোঝেন। রিদু ওই মেয়েকে পছন্দ না করলে আমার কি করার আছে? আমি কি কিছু করছি? আপনি জোর করে ওর বিয়ে দিলেন। ও মানতে পারতেছে না।”
“এখন মানতে পারতেছে না পরে পারবে। তুমি কিছু করার কথা মাথায় আইনো না। তুমি বরং ওদের ভাব ভালোবাসা করানোর চেষ্টা কইরো। এর বিপরীত কিছু হইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হইবো না এই বলে রাখলাম।”
জাকিয়া রেগে গিয়ে কিছু বলতে চাইলো আব্দুর রব হাত দেখালেন-“তোমার শাশুড়ীর ঘটনা ভুলি নাই এখনো। কাজেই ভেবেচিন্তে কাজ করবা।”
জাকিয়া ভেতরে ভেতরে রেগে বোম হলেও মুখ খুলতে পারলোনা। আব্দুল রব উঠে গেলে সে কেবল হাত কামড়ে রাগ কন্ট্রোল করলো। শশুরের হুমকির জন্যই হয়তো বুকের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। জাকিয়া ঠিক করলো এই বিয়েটা ও ভাঙবে। হয়তো এসব কিছুই করতো না তবে শশুরের তাকে বারবার অপমান করাটা মেনে নিতে পারছে না। বিয়েটা ভাঙলে শশুরের নাক কাটা যাবে নিজের প্রানপ্রিয় বন্ধুর কাছে। এর চেয়ে বড় শিক্ষা কিছু হবে না আর। জাকিয়া হাসলো ঠোঁট টিপে। নিজ থেকে কিছু না করেও কি করে বিয়েটা ভাঙা যায় এটাই এখন তার বড় যুদ্ধ। এবং এটা সে করে দেখাবে। বুড়োটা অনেক জ্বালাচ্ছে তাকে। একে শায়েস্তা করতেই হবে। আর বাল্যবন্ধুর সাথে আত্মীয়তা করার অনেক শখ না, শখটা ভালোমতো মেটাবে জাকিয়া। মনে মনে পৈশাচিক হাসি হাসলো সে।

★প্রিয় পাঠক, শায়লা আর রিদওয়ান এর বর বউ হয়ে ওঠার জার্নিতে স্বাগতম আপনাদের। আমার লেখা ভালোলাগলে আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin