এরই মাঝে পর্ব-০৬

0
107

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৬

সেদিনের পর থেকে আসাদ কথা বলছে না তার সাথে। মাহিলাও বলেনি। এখন আর এসব ভালো লাগে না ওর। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এতো তেলাতেলি কারই বা ভালো লাগে। তবে সমস্যা হলো মালিহার মনটাকে নিয়ে। আসাদের সাথে তার এরেন্জ ম্যারেজ হলেও ধীরে ধীরে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে আসাদকে। একটু একটু করে আসাদকে জেনেছে আর ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। বিয়ের পর দুই তিন বছর আসাদও বেশ অনুরক্ত ছিলো ওর প্রতি। নিয়ম করে ঘুরতে যাওয়া, মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ দেওয়া সবই করেছে। তারপর ধীরে ধীরে সব বদলে গেলো। কবে কখন কিভাবে টের পায়নি মালিহা। একদিন দেখলো আসাদ পাল্টে গেছে। আগের মতো ওর সাথে কথা বলছে না, কাছে টানছে না। নিজ থেকে কাছে গেলে বিরক্ত হচ্ছে। ভারী অপমানবোধ হয় মালিহার। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সে, প্রায় লাখের কাছাকাছি বেতন তার৷ তবুও আজকাল আসাদের চোখে নিজেকে খুঁজে না পেয়ে ভীষণ অসহায় বোধ করছে। বিয়ের সাত বছর পার হচ্ছে। চারপাশে গুঞ্জন ভারি হচ্ছে। কবে মা হবে? বাচ্চা কি হচ্ছে না নাকি নিচ্ছনা? আর কতদিন এরকম ঝাড়া হাত হয়ে ঘুরবে? আজকাল মাথায় যে প্রশ্নটা বারবার আসে সেটা হলো, আসাদের দূরে যাওয়ার কারণ ওর মা না হতে পারা নয়তো? চোখ দুটো জলে ভারী হচ্ছে বুঝতে পেরে মালিহা নিজের ডেস্কে মাথা এলিয়ে দিলো।

ভেবেছিল আসাদ হয়তো সিনক্রিয়েট করবে ডাইনিং এর ঘটনা নিয়ে। রুমে ঢুকেই তাই মালিহা নিজেকে নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা করে বলেছিল-“আমি কিন্তু মাকে কিছু বলিনি আসাদ। সত্যি বলছি।”
আসাদ নিশ্চল তাকিয়ে থেকে জবাব দিয়েছিল-“তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মালিহা। লিভ মি এলোন।”
অহমে আঘাত লেগেছে মালিহার। সে আর একটা কথাও বলেনি। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ পর আসাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া টের পেয়েছিল সে। সেই থেকে দু’জন যেন দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। কেউ কারো খবর রাখছে না, ক কথা বলছে না। ঠিকঠাক একজন আরেকজনের চেহারা দেখে বহুদিন হয়। কাল শুনলো আসাদ অফিসিয়াল ট্যুরে একমাসের জন্য সিঙ্গাপুর গেছে। ভীষণ রকম অবাক হয়েছে মালিহা। আসাদ সিঙ্গাপুর গেছে অথচ তাকে বলে যায়নি? এতোটা দূরত্ব কবে এলো তাদের মাঝে? আর এখানে তার দোষটা কি?

ফোনের রিংটোনে চোখ মুছে সোজা হয়ে বসলো মালিহা। পল্লবীর নাম্বার দেখে ঘড়ি দেখলো। অফিস ছুটি হয়েছে অনেক সময়। অনেক ডেস্ক ফাঁকা। মালিহা তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরলো-“ভাবি, সরি আমি আজ লেট। কাজে ছিলাম তাই সময় টের পাইনি।”
ফোনের ওপাশে পল্লবীর গলা শোনা গেলো-“আরে আমি তো টেনশনে পড়ে ফোন দিলাম। এতো দেরি তবুও তোমার ফোন নেই তাই আমিই ফোন দিলাম। তুমি ঠিক আছো?”
“ঠিক আছি ভাবি। এখনই বেরুব।”
“আচ্ছা দেখেশুনে এসো।”
পল্লবী ফোন কেটে দিলো। মালিহা দ্রুত হাতে নিজের জিনিস গুছিয়ে নিলো। বেরুবে এমন সময় অয়ন এলো-“বেরুচ্ছেন?”
“হুম।” তড়িঘড়ি করে জবাব দিলো মালিহা।
“খুব তাড়া আছে নাকি? এরকম হুটোপুটি করছেন কেন?”
“এমনি। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে টের পাইনি।”
দরজার দিকে পা বাড়ায় মালিহা। নিচে এসে উবার কল করতে গিয়ে দেখলো প্রচুর রাশ। পরপর তিনটে কার নিজ থেকে ক্যানসেল করলো জ্যামের অজুহাতে। মালিহার বিরক্তি এবার চাপা অষন্তোসে পরিনত হলো। এমন সময় অয়ন তার বাইক নিয়ে সামনে দাঁড়ায়-“খুব তাড়া থাকলে আমি নামিয়ে দিতে পারি।”
অয়নকে চড় দিতে মন চাইলো মালিহার। ছেলেটা বেহায়ার মতো ওর পেছনে পড়ে থাকে পাত্তা দেয় না মালিহা। আজ সুযোগ পেয়ে একটু বেশি সাহস দেখাচ্ছে। মালিহা মুখে হাসি এনে বললো-“নো থ্যাংকস। উবার আসছে।”
অয়ন হাসলো-“আসবে না। আজ রাস্তায় জ্যাম প্রচুর। এখনো সময় আছে চলে আসুন আমার সাথে। আমি পৌঁছে দিচ্ছি। আচ্ছা, উবারের টাকাটা আমায় দিয়ে দেবেন না হয়।”
এবার মালিহা কিছুটা নরম হলো-“ঠিক তো? টাকা নেবে?”
“অবশ্যই নেব। এই মন্দার বাজারে কে টাকা না নিতে চাইবে। আসুন তাড়াতাড়ি।”
মালিহা তবুও দ্বিধা নিয়ে এগুলো। অয়ন ওকে একটা হেলমেট এগিয়ে দিলো। মালিহা ওদের দু’জনে মাঝে নিজের ব্যাগটা দিলো যাতে অয়নের সাথে শরীর স্পর্শ না করে। খুব সাবধানে পেছনের সিট ধরে বসলো। অয়ন বললো-“আমার কাঁধে হাত রাখতে পারেন আমি কিছু মনে করবো না। নয়তো পড়ে গেলে আমায় দোষ দেবেন না।”
“আস্তে চালাবে তাহলে পড়বো না।”
মালিহার জবাব শুনে অয়ন খানিকটা হাসলো।

*****

শায়লা টিউশনে যাচ্ছে দু’সপ্তাহ হয়ে গেলো। এরমধ্যে তার শাস্তির মেয়াদও বেড়েছে। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে শায়লা কিন্তু কিভাবে সমঝোতা করবে কিছু ভেবে পাচ্ছেনা। আজ সকালে উঠে মনে হলো এই ঘটনা শেষ হওয়া দরকার। এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। ভাবনার মাঝেই ফোন এসেছে বলে শায়লা আনমনে ফোনটা রিসিভ করে ফেললো। ওপাশ থেকে তৈয়ব মাওলানার গলা পেতেই সে ফোন কেটে দিলো। অভিমান মাথা চাঁড়া দিলো। দাদুর সাথে সে আসার পর থেকে কথা বলেনি বলবেও না। তার উপর ভরসা করতে পারেনি তো? এখন সে প্রমান করে দেবে ঢাকায় একা একা বেশ ভালো ভাবে থাকা যায়। এরজন্য কাউকে বিয়ে করার দরকার হয় না। হুট করে শায়লা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, আজ সিনিয়র ক্লাসে যাবে না। দেখ যাক ওরা কি করে।

বিকেলের একটু আগে আজিজ সুপার মার্কেটে এসেছে শায়লা। উদ্দেশ্য কিছু বই কেনা। ঘুরে ঘুরে বই দেখছিল এমন সময় একজনের সাথে ঠোকাঠুকি হলো। শায়লার হাতের কফি ছলকে পড়ে পোশাক নষ্ট হলো। ভীষণ বিরক্ত শায়লা ‘ধ্যাৎ’ বলে পোশাক থেকে কফি ঝাড়ে হাত দিয়ে।
হুট করে শুনতে পেলো কে যেন বলছে-“সালাম দেওয়ার শাস্তি এখনো চলছে নাকি?”
চমকে ঘুরে তাকাতেই দেখলো সেদিনের ছেলেটাকে। হাতে একটা কোল্ডকফির মগ। নরমাল জিন্সের প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট। সেই শার্ট কফিতে মাখামাখি তবুও ছেলেটার বিকার নেই। চোখে চশমা আর এলোমেলো চুল নিয়ে শায়লাকে দেখছে। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো-“আপনি সেদিন ইচ্ছে করেই ডেকেছিলেন ওনাকে?”
রিদওয়ান কিছু বললো না। শায়লাকে দেখে নিলো একফাঁকে। হাতের ইশারায় আরেকদিক নির্দেশ করে বললো-“ওখানে ওয়াশরুম আছে। চাইলে কাপড় ক্লিন করে নিতে পারেন।”
“লাগবে না। হোস্টেলে গিয়ে কাপড় ধুয়ে দেব। কিন্তু আপনার সাদা শার্টের তো বারোটা বেজে গেলো।”
নিজের শার্টটা একপলক দেখে হাসলল-“ফেলে দিতে হবে আরকি। সাদা কাপড় থেকে কফির রং যায় না।”
“সরি।”
শায়লা মন খারাপ করে বলতেই রিদওয়ান বিরক্তিসুচক আওয়াজ করলো-“সরি! কেন?”
“আপনার শার্ট নষ্ট হলে বলে।”
“তাতে আপনার দোষ কোথায়? হয় দু’জনার দোষ নয়তো কারোই দোষ না। বাদ দিন।”
শায়লা ইতস্তত বোধ করে বলেই ফেলে-“আমি চাইছিলাম আপনার সাথে আমার আবার দেখা হোক।”
“কেন?”
অবাক চাহুনি দিয়ে জানতে চাইলো রিদওয়ান। শায়লা কিছুটা লজ্জা পেলো-“খুব বড় লজ্জা পাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন গতদিন। মেনি মেনি থ্যাংকস।”
রিদওয়ান ঠোঁট ওল্টায়-“থ্যাংকস বলার কিছু নেই মিস…”
“শায়লা। আমার নাম শায়লা। আপনি তো রিদওয়ান, তাই না?”
“আরে বাহ, আমার নাম জানেন দেখছি?”
“সেদিন হাসিব ভাইয়া আপনার নাম বলেছিল একবার।”
“শার্প ব্রেন হ্যাহ। তো শায়লা, যা বলছিলাম। থ্যাংকস বলার কিছু নেই আসলে। এই র্যাগিং বিষয়টা আমি ঘৃনা করি। ওরা কেন এমন করে আমার জানা নেই। তবে আই হেইট ইট। হাসিবটা এমন করে জেনে বড় কষ্ট পেয়েছি। এখনো করছে তাই না?”
শায়লা জবাব দিলো না। রিদওয়ান ঠোঁট চেপে ভাবলো কিছু তারপর বললো-“হাসিবকে একটা কথা বলতে পারবেন? পারলে আপনার প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে।”
“কি কথা?” কৌতুহলী শায়লা জানতে চাইলো।
“ওকে বলবেন, ইকরার বিষয়টা আপনি জানেন। হাসিব আপনার সাথে এমন করছে এটা ইকরাকে বলে দেবেন আপনি।”
“কিন্তু ইকরা কে? তাকে তো চিনি না।”
শায়লার কথায় রিদওয়ান খানিকটা দুষ্ট হাসলো-“চিনতে হবে না তো। ওকে বললেই কাজ হবে।”
“কিন্তু যদি বলে বসে আমি ইকরাকে কি করে চিনি?”
শায়লা অস্থির হয়ে বললো। রিদওয়ান এবার রেগে গেলো-“আরে বলে দেবেন কিছু একটা। এতো ভয় পেলে প্রতিদিন কান ধরে উঠবস করুনগে যান।”
“সরি।”
রিদওয়ানের হুট করে মনে হলো সে এই অপরিচিত মেয়েটার সাথে অকারণে গায়ে পড়া হচ্ছে যার কোন প্রয়োজন নেই। নিজের উপর বিরক্ত রিদওয়ান ভারী কন্ঠে বললো-“বারবার সরি বলবেন না তো শুনতে অড লাগে। আচ্ছা আজ গেলাম, প্রচুর পড়া বাকী আছে। পড়তে হবে।”
বলেই কোনরকম ভদ্রতা বা দেখিয়ে গটগট করে হেটে চলে গেল। শায়লা তার এমন ব্যবহারে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। যা বাবা! এ আবার কেমন মানুষ?

চলবে—-
©Farhana_Yesmin