#এরই_মাঝে
#পর্ব-১০
শশুরের নাম্বার মোবাইল স্ক্রীনে ভেসে উঠতে দেখে প্রায় লাফিয়ে উঠে বসলো শায়লা। মোবাইল কানে ঠেকিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে ওয়াহেদের নরম কোমল কন্ঠ শোনা গেলো-“শায়লা মামনী, তুমি কি ব্যস্ত?”
শায়লা কি বলবে ভেবে পেলো না। বয়স্ক মানুষটাকে মিছে বলতে মন সায় দিলো না। ও ভীষণ নার্ভাস হয়ে জবাব দিলো-“না আঙ্কেল। রুমে আছি।”
“তোমার আন্টি মনেহয় ফোন করেছিল তোমাকে। আজ সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার কথা বলেছিল। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। তুমি কি তৈরি হয়ে নিচে নামবে মামনী? আমি অপেক্ষা করছি নিচে।”
“কিন্তু আঙ্কেল আমি আসলে…”
শায়লা কথা শেষ করতে পারে না। ওয়াহেদ বললো-“তুমি প্লিজ তৈরি হয়ে এসো। আমরা পথে যেতে যেতে কথা বলবো মামনী।”
“জ্বি আচ্ছা।”
শায়লা কথা না বাড়িয়ে মেনে নিলো। যদিও ভীষণ বিরক্ত সে। অনিচ্ছায় একটা সালোয়ার কামিজ বের করে পড়লো। লম্বা চুলগুলো বেনী করে চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা করে লিপবাম দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে এলো। ওকে দেখে ওয়াহেদ হাসলো। গাড়ির দরজা খুলে দিলো। শায়লাকে বসিয়ে দিয়ে নিজের শায়লার পাশে বসলো। ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করতেই ওয়াহেদ শায়লার দিকে তাকিয়ে বললো-“তোমার বুঝি বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না?”
শায়লা ইতস্তত বোধ করে। ওয়াহেল মৃদু হাসি দেয়-“মানলাম তোমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক বিয়ে নয় তবুও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করতে দোষ কি?”
শায়লা চুপ করে রইলো। ওয়াহেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো-“আজ আমাদের রোদেলা দাদুভাই এর জন্মদিন। বাসায় সবাই আসবে বলে তোমাকে ডাকা। তাছারা তোমাদের বিয়েতে আমাদের মেয়ে মুনিয়া যেতে পারেনি দেশের বাইরে থাকার কারণে। ও তোমাকে দেখতে চায়। আমি জানি তুমি কমফোর্ট ফিল করবে না তবুও সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সবার সাথে পরিচয় হওয়া জরুরি।”
শায়লা অস্ফুটে উচ্চারন করলো-“কিন্তু আমি তো রোদেলার জন্য কোন গিফট কিনিনি।”
ওয়াহেদ হাসলো-“তুমি যাচ্ছ এটাই বড় গিফট।”
তবুও শায়লার মন খচখচ করছে। সে নতুন বড়, খালি হাতে যাওয়াটা মোটেও ভালো দেখায় না। ওয়াহেদ হয়তো ওর দোলাচল বুঝলো। ওকে অভয় দিতে বললো-“তুমি চাইলে পথে কোন শপে দাঁড়াতে পারি আমরা।”
শায়লা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে পিতাসম মানুষটার দিকে চাইলো। ওয়াহেদ অভয় দেওয়া হাসি দিয়ে আস্বস্ত করলো।
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে ওয়াহেদ থামলো। শায়লার দিয়ে দ্বিধা নিয়ে তাকালো।
“কিছু বলবেন আঙ্কেল?”
“একটা অনুরোধ থাকবে।”
“জ্বি বলুন।”
“আমার মেয়েটা একটু মেজাজি। তারউপর ছোট ভাইয়ের বিয়েতে একমাত্র বোন হিসেবে থাকতে পারেনি বলে মনঃক্ষুণ্ন। তাই ও যদি তোমাকে মনখারাপ হবে এমন কিছু বলে তুমি প্লিজ মন খারাপ করো না। এমনিতে ওর মন খুবই পরিস্কার। ভাইদের খুব ভালো বাসে। দেখবে তোমাকও ভালো বাসবে ভীষণ।”
শায়লা হাসলো-“আমি কিছু মনে করবোনা আঙ্কেল।”
ওয়াহেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তার মনে পাথর চাপা ভাবটা আর নেই। সে নির্ভার হয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো।
*****
ওয়াহেদের সাথে শায়লাকে দেখে জাকিয়া অবাকের চুড়ান্ত হলো। ওয়াহেদ অবশ্য জাকিয়াকে পাত্তা দিলো না। পল্লবীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“রিদু এসেছে?”
“না বাবা।”
“ওকে ঘরে নিয়ে যাও। মুনিয়া আসার আগেই ওকে শাড়ী পরিয়ে তৈরি করো।”
“জ্বি বাবা।”
পল্লবী শায়লাকে ইশারায় ডাকলো ওর সাথে যাওয়ার জন্য। এই পুরো দৃশ্য বোবা বনে দেখলো জাকিয়া। ওয়াহেদের পিছু পিছু নিজেদের ঘরে এসে দরজা আঁটকে জানতে চাইলো-“এসব কি হচ্ছে? তুমি ওই মেয়েকে আনতে গেছিলে?”
ওয়াহেদ হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে মাথা দুলিয়ে বললো-“গেছিলাম। এটাই তো করা উচিত তাই না?”
জাকিয়া গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে ওয়াহেদকে দেখলো। ওয়াহেদ শার্টটা খুলে জাকিয়ার সামনে দাঁড়ায়-“দেখো জাকিয়া, বাবা শখ করে নিজের বন্ধুর সাথে আত্মীয়তা করেছে। বাবার সিদ্ধান্তকে সন্মান দেখানোর জন্য হলেও আমাদের এই বিয়েটা মেনে নেওয়া উচিত।”
জাকিয়া কন্ঠে তাচ্ছিল্য ঢেলে বললো-“আজ খুব বাবার চিন্তা হচ্ছে যে?”
ওয়াহেদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জাকিয়ার তাচ্ছিল্যটুকু বুঝলেও রাগ করলো না বরং কন্ঠ শান্ত করে বললো-“হ্যা হচ্ছে। একজন বুড়ো মানুষ একা একা থাকে। তিন সন্তানের কেউ তার সাথে থাকে না্। কেউ তার কথা ভাবেনি। সে শখ করে একমাত্র ছেলের বিয়ে ঠিক করেছিল কিন্তু ছেলে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলে। সে মেনে নিয়েছে। এখন শেষ বয়সে এসে মানুষটা এতটুকু প্রশান্তি চাইছে সেটাও পেতে দেব না বলছো?”
জাকিয়া রেগে গেলো-“তা বাবার পছন্দে বিয়ে করনি বলে আফসোস হচ্ছে? ওই গাইয়া মেয়েটাকে বিয়ে করলেই সুখে থাকতে মনেহচ্ছে?”
ওয়াহেদের চোখে হতাশা ফুটে উঠলো-“তুমি সবকিছু সহজ করে দেখতে পারো না কেন বলতো? তুমি কি কখনো আমাকে বুঝবে না? সবসময় আমারই তোমাকে বুঝতে হবে? বাবার সাথে সমস্যা কি তোমার?”
জাকিয়ার চেহারা দ্রুত পরিবর্তন হলো। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। ওয়াহেদকে ধ্বংস করে দেওয়া দৃষ্টি হেনে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল। ওয়াহেদ পিছু ডাকলো-“আগেই সাবধান করছি মেয়েটার সাথে কোনরকম উল্টো পাল্টা আচরণ করবে না। বাবার কাছে যেন আমার মাথা হেট না হয়।”
জাকিয়া দুপদাপ পা ফেলে চলে গেলো।
*****
শায়লাকে রিদওয়ান এর ঘরে নিয়ে এলো পল্লবী। ওর জন্য কিনে রাখা শাড়ীটা পরিয়ে দিয়ে বললো-“তুমি বসো আমি একটু দেখে আসি ঘরের ডেকোরেশনের কাজ কতদূর হলো।”
“আমি কিছু করবো ভাবি? কোন কাজ থাকলে বলুন করে ফেলি।”
শায়লার কথায় পল্লবী হাসলো-“সামান্য কাজ আমি পারবো। খাবার তো বাইরে থেকে আসবে কাজেই কাজের ঝামেলা নেই অতো।”
“তবুও। রোদেলাকে আমার কাছে দিন ওকে তৈরি করে দেই না হয়।”
শায়লাকে মানা করতে পারে না পল্লবী-“চলো তাহলে।”
রোদেলা ঘরে বসে খেলছিল। অনেকদিন পরে দেখা হলেও শায়লাকে ভোলেনি সে। শায়লাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো-“শালু, তুমি এসেছ? তুমি খুব পঁচা মেয়ে শালু, রোদেলাকে তুমি ভালোবাসো না। সেই যে গেলে আর এলে না কেন?”
শায়লা হেসে দেয়-“রোদুও তো শালুকে মনে করে না।”
রোদেলা মাথা নাড়ে-“আমি পঁচা না। তুমিই তো আমাকে দেখতে আসো না।”
“এই যে এলাম। তোমার জন্য কি এনেছি জানো?”
“কি এনেছ?”
“এই যে দেখো একটা রেড টেডি আর রুপকথার গল্পের বই। দেখো দেখো কি সুন্দর টেডিটা।”
খুশিতে চোখ চিকমিক করে রোদেলার। পুতুলটা হাতে নিয়ে চাচীকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দেয়-“তুমি খুব ভালো শালু।”
শায়লা হেসে দিলো। পল্লবী ওদের দেখে মিটিমিটি হাসে। শায়লা মেয়েটাকে শুরুতে বেশ গম্ভীর ভেবেছে। কিন্তু এখন দেখলো ও বেশ মিশুক। সে রোদেলার কাপড়গুলো শায়লার হাতে দিলো-“তুমি ওকে তৈরি করে বাইরে এসো। আমি দেখি ডেকোরেশনের কতদূর।”
শায়লা মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ে।
মুনিয়ার বর মেহেদী বেশ রসিক মানুষ হিসেবে পরিচিত। সে সরকারী ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। তবে এবারই প্রথম এমন হলো যে কোন খুশির সংবাদ পেয়ে তার চেহারা থমথমে হলো। ছোট শ্যালকের বিয়ের খবর পেয়ে প্রথমে অবাক তারপর অপমানিত বোধ করলো। রিদওয়ান ভালো ছেলে, তার সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো রিদওয়ানের সাথে তার বোন তৃষার বিয়ে দেবে। শাশুড়ীর কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে ইচ্ছে প্রকাশ করলে তার কাছ থেকে সায়ও মিলেছিল। আজ হঠাৎ শশুর যখন রিদওয়ানের বিয়ের খবর বললো সে হতবাক হয়ে মুনিয়াকে দেখলো। মুনিয়া মুখ কাচুমাচু করলো। এ বাড়ির একমাত্র জামাই সে, শ্যালকের বিয়ের খবর কেন জানবে না? মেজাজটা তেতো হয়ে গেলো তার। শায়লাকে দেখে তাই বলেই ফেললো-“শ্যালকের এতো বিয়ে তাড়া ছিলো জানতাম না। সে আমাদের জন্য অপেক্ষা না করেই একা একা বিয়ে করে ফেললো?”
ওয়াহেদ গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো-“রিদু কিছু জানতো না মেহেদী। বাবা হুট করে ডেকে নিয়ে এমন কাজ করলো। বাবাকে কে জানোই, কোন কথা বলা যায় না।”
“কিন্তু তারপরেও বাবা, আমাদের না জানিয়ে এমন কাজ করা কি ঠিক হয়েছে? একটা মাত্র মেয়ে আপনাদের।”
“ঠিক হয়নি মেহেদী। কিন্তু নিরুপায় না হলে আমরাও রাজি হতাম না এটা তো মানবে? তুমি প্লিজ কিছু মনে রেখো না। আপাতত ওরা দু’জনেই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত বলে ঘটা করে কোন অনুষ্ঠান করছি না। রিদু থিতু হোক, চাকরি করুক, ওদের নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হোক তখন না হয় অনুষ্ঠান করা যাবে।”
শায়লা স্থানুর মতো বসে আছে। পুরো আলোচনা তার জন্য ভীষণ অসস্তিকর। আপনাতেই শায়লার শরীর শক্ত হয়ে গেলো। বুঝলো বিয়েটা শুধু তার না এ বাড়ির অনেকের জন্যও গলার কাঁটা। কিন্তু যে মানুষটার সাথে বিয়ে হলো তার কি মত? সেও কি বিয়েতে রাজি ছিলোনা? এমন হলে ভালোই হবে। অন্তত বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না তাকে। এরমাঝে হুট করে রোদেলার চিৎকার-“চাচ্চু এসেছে চাচ্চু এসেছে।”
বলেই শায়লার কোল থেকে ছুটলো। মুনিয়ার ছেলে দুটোও মামু মামু করে ঝাপিয়ে পড়লো দরজার কাছে বসে থাকা মানুষটার কোলে।
পল্লবী হেসে বললো-“ওই যে রিদওয়ান চলে এসেছে। এখন সব আলোচনা বন্ধ করে চলো কেকটা কেটে ফেলি।”
নামটা কানে বাঁধলো শায়লার। সে ঝট করে মুখ তুলে তাকালো। চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো সে। রিদওয়ানকে ধরে বাচ্চা তিনটে ঝুলছে রীতিমতো। টানতে টানতে শায়লার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়-“দেখো মামু মামী এসেছে। তুমি বিয়ে করেছ একথা আমাদের বলোনি কিন্তু আমরা জেনে গেছি।”
রিদওয়ান সামনে তাকিয়ে চারশো চল্লিশ ভোল্টের ঝাটকা খেলো। দু’জনই দু’জনকে দেখে চমকে উঠলো। শায়লা ফিসফিস করলো-“আপনি!”
রিদওয়ান প্রায় চেচিয়ে উঠলো-“আপনি! এখানে!”
চলবে—-
©Farhana_Yesmin