#এরই_মাঝে
#পর্ব-১৩
বহুদিন পরে দাদাজানের ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হলো রিদওয়ান। গত কয়েকমাসে দাদাজান তার সাথে কথা বলেনি রাগ করে। বিয়ে করে হুট করে চলে এসেছিল বলে দাদাজান রাগ। রিদওয়ান পাত্তা দেয়নি। আজ হঠাৎ কি মনে করে ফোন দিলো বুড়ো? শরীর টরীর খারাপ করেনি তো? তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করলো রিদওয়ান-“হ্যালো দাদাজান, শরীর ঠিক আছে আপনার?”
ওপাশ থেকে আব্দুর রবের গম্ভীর গলা শোনা গেলো-“শরীর ঠিক থাকলেও মন ঠিক নাই আমার। অবশ্য আমার মন ঠিক থাকলে কি না থাকলে কি? কেউ কি আমার খবর রাখে?”
রিদওয়ান হেসে দিলো-“কত নাটক করতে পারেন দাদাজান? আপনার খবর তো নিতেই চাই আপনি কথা বলেন না আমার সাথে।”
“তাতে কি তোমার কিছু আসে যায়? কই এতোদিনে দাদাজানকে তো একবারও দেখতে আসলা না?”
অভিমান ঝরে পড়ে আব্দুর রবের গলা থেকে। রিদওয়ান ক্লান্ত গলায় বললো-“আমি ব্যস্ত থাকি দাদাজান। ওখান থেকে আসার পর ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল দিলাম। এখন হাসপাতালে ডিউটি করতে হয়। কিভাবে আসবো বলেন?”
“কথায় আছে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তোমার আমাকে দেখার ইচ্ছা নাই তাই উপায় হয় নাই। বুড়ি মরে আমাকে অসহায় করে দিয়ে গেলো। এখন একা একা দিন কাটাই।”
রিদওয়ান এবার খানিকটা বিরক্ত হলো,-“আহ দাদাজান, কি শুরু করলেন? এতো ইমোশনাল ব্লাকমেল করছেন কেন? কি চান বলুন। হাসপাতালে ডিউটিতে আছি এতো কথা বলতে পারছি না।”
আব্দুর রব যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। কন্ঠে মলিনতা ঢেলে বললো-“বেশি কিছু চাওয়ার সুযোগ কোথায়? এই বুড়োর অত শখ আহলাদও নেই। যদি চাও বুড়ো খুশি হোক তাহলে আজই একবার এসে বুড়োকে দেখে যাও।”
রিদওয়ান প্রায় চেচিয়ে উঠলো-“আজ! আজ কি করে সম্ভব দাদাজান? বললাম না আমি ডিউটিতে আছি এখন।”
“তার আমি কি জানি। তুমি জানতে চাইলা আমি বললাম। এখন ইচ্ছা পূরণ করা তোমার ইচ্ছা। ভালো থেকো। রাখলাম।”
নিরীহ গলায় প্রতিউত্তর দিলো আব্দুল রব। কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলো টুক করে। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো-“দেখবা বিকালেই হাজির তোমার নাতজামাই।”
তৈয়ব মাওলানার কন্ঠে দ্বিধা-“সত্যি আসবে তো?”
“পাক্কা। রিদওয়ানকে যতদূর জানি সে আমার কথা ফেলে না। এখন তোমার নাতীনকে বলো তার দাদাশ্বশুরকে দেখে যাইতে। বাড়ি আসছে আর দাদাশ্বশুরকে সালাম করে যায় নাই এটা কিন্তু মানবো না।”
তৈয়ব মাওলানা গম্ভীর হয়ে বললো-“কালকে শায়লা অনেক ভারী ভারী কথা বলে ফেলছে। রিদওয়ান এর নাকি অন্য পছন্দ আছে তাই বিয়েতে রাজি ছিলো না। বিয়ের পর চলে যাওয়ার এটাই কারণ ছিলো হয়তো।”
আব্দুল রব হাসলো-“আর তাই তুমি চিন্তিত হয়ে গেছ? আমার নাতিকে ভালোমতো চিনি আমি। আমার অসম্মান হবে এমন কিছু সে করবে না। তবুও শায়লা দাদু যখন এই কথা বলছে আমি জিজ্ঞেস করবো রিদওয়ানকে। তার আগে ওদের দুইজনের একটু একলা সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা লাগবে। নিজেরা নিজেরা কথা বললে অনেক ভুল বোঝাবুঝি কেটে যাবে, ভবিষ্যতের জন্যও ভালো হবে। তুমি চিন্তা কইরো না তৈয়ব। ওদের বিয়া দিয়া কোন ভুল করি নাই আমরা। দেইখো শায়লা সুখে থাকবো।”
তৈয়ব মাওলানাকে খানিকটা প্রসন্ন দেখায়-“তাই যেন হয় রব। মেয়েটা সুখী হইলে আমি অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবো।”
“তাই হবে দেইখো। আল্লাহর উপর ভরসা রাইখো। এখন নাতীনকে এই বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আজ যেন আমার রিদওয়ান শায়লার থেকে নজর না ফিরাইতে পারে।”
আব্দুর রবের চেহারায় দুষ্ট হাসি খেলে যায়। তৈয়ব মাওলানা বন্ধুর চেহারা দেখে হাসলো-“কি যে চলে তোমার মনে বুঝা দায়। আমি গেলাম বাড়ি। সন্ধ্যায় শায়লাকে নিয়ে আসবোনে।”
“আচ্ছা।” প্রসন্নচিত্তে উত্তর দিলো আব্দুর রব।
*****
“এতো সাজগোছ করতে হবে কেন দাদী? দাদাশ্বশুরকে দেখতে যাচ্ছি তাও দুইকদম দূরে বাড়ি। তাছাড়া সে কি অচেনা কেউ? ছোট বেলা থেকেই তো দেখছি তাকে। মানুষ কি বলবে এমন সাজ দেখে?”
শায়লা তর্ক জুড়ে দিলো নাজনীন এর সাথে। নাজনীন মুখ টিপে হাসলো। শাড়ীর আঁচল কাঁধে তুলে দিতে দিতে বললো-“নতুন বউ শশুরবাড়ি যাবে না সেজে সেইটা আরও খারাপ দেখায়। তাছাড়া তুই কি এমন সাজগোছ করতেছিস যে এইসব বলিস। একটা ভালো শাড়ীই তো পড়তেছিস।”
শায়লার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“ভালো শাড়ী! তুমি আমাকে পাট ভাঙা কাতান পরাই দিয়ে বলতেছ একটু ভালো শাড়ী?”
নাজনীন হাসলো-“রব ভাইকে চিনিস। খুব সৌখিন মানুষ সে। ভাবি যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন দেখছি পাটভাঙা শাড়ী, গহনা পরে ঘুরতে। বউ মানুষ সাজগোছ না করলে নাকি হয়না, এটা রন ভাইয়ের কথা। মানুষটা এখন একা একা অতোবড় বাড়িতে থাকে ভাবলেই খারাপ লাগে। তাই তার ছোট খাটো ইচ্ছা পূরণ করে তাকে আনন্দ দেই আর কি।”
শায়লা বিরক্ত হলেও জবাব দিলো না। এরমধ্যে রুবিনা কাজ গুছিয়ে মেয়ের ঘরে এলো। শায়লাকে শাড়ী পরা দেখে তার মন জুড়িয়ে গেল-“আম্মা, শায়লাকে দেখি পরির মতো লাগতেছে।”
“হুমমম। রুবি, ওকে দেখে তোর বিয়ের দিন মনে পড়লো। তোকে এমনই সুন্দরী লাগতেছিল। মেয়ে তোরই রুপ পাইছে।”
রুবিনার চেহারা করুন হলো। ফিসফিস করে মৃদুস্বরে বললো-“আমার মতো কপাল না হোক আম্মা।”
শায়লা চমকে উঠলো মায়ের কথায়। নাজনীন শুনেও না শোনার ভান করলো-“রুবি, সব খাওয়ার তৈরী হইছে?”
“হুমম। আমি সব গুছায় দিয়ে আসলাম। আব্বা শায়লার জন্য বসে আছে। ওকে ওই বাড়ি নিয়ে যাবে। রব কাকা বারবার ফোন দিতেছে।”
নাজনীন তাড়াহুড়ো করে বললো-“আমি যাই তুই ওকে নিয়ে আয়।”
রুবিনা জবাব দিলো না। সে মুগ্ধ হয়ে শায়লাকে দেখছে।
ওরা যখন আব্দুর রবের বাসায় এলো তখন বিকেলের আলো পড়তির দিকে। দাওয়াত বসে হাওয়া খাওয়া আব্দুল রব ওদের দেখে ভীষণ খুশি। শায়লা তাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতেই হৈ হৈ করে উঠলো আব্দুর রব-“আরে করো কি দাদু? আমি এমনেই তোমার জন্য অনেক দোয়া করি।”
শায়লা মাথা নিচু করে বসলো। ওকে বলা হয়েছে আব্দুল রবের শরীর খারাপ কিন্তু তাকে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। তৈয়ব মাওলানা বললো-“নাজনীন খাবার পাঠাইছে তোমার জন্য।”
“কি দরকার ছিলো বন্ধু? আমি তো আমেরের বউকে আরও রান্না করতে বললাম।”
“মানা করো। মেলা খাবার সেগুলো না হয় নষ্ট হবে।”
“আচ্ছা।”
বলেই আমেরকে গলা উঁচু করে ডাকে। রান্না করতে মানা করে শায়লাকে দেখলো মন দিয়ে। কিছুটা রুষ্ট গলায় বললো-“নাতবউ এর গলা খালি হাত খালি কেন? গয়না গায়ে না থাকলে কি বউ বউ লাগে? শায়লা দাদু আসো তো আমার সাথে।”
শায়লা ফট করে উত্তর দিলো-“আমার গয়না ভালো লাগে না দাদু।”
আব্দুল রব গম্ভীর হলো, কিছুটা ধমকের স্বরে বললো-“আমি কি তোমার কাছে জানতে চাইছি কিছু? আসো আমার সাথে।”
শায়লা কিছু না বলে তার পিছু নিলো। নিচতলায় দখিনের ঘরটায় ঢুকে সিন্দুক খুলে কিছুক্ষণ ঘুটমুট করলো সে। কিছু সময় পরে দুটো বক্স বের করে সামনে এলো-“এইগুলা সব রিদওয়ান এর দাদীর আছিল, আইজ থেকে তোমার। গয়নাগুলো পইরা আসো বাইরে।”
শায়লা ইতস্তত বোধ করে-“কিন্তু দাদু এগুলো…”
“যা বলছি তা করো।”
বলে আর দাঁড়ায় না আব্দুল রব। শায়লা পড়ে বিপাকে। এ কেমন আবদার? শায়লা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট দিতেও মন সায় দিচ্ছে না। কেমন যেন অধিকার নিয়ে কথা বলে। শায়লা ধীর পায়ে পুরনো ধাঁচের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একে একে গহনাগুলো পরে নেয়। গলায় জড়োয়া হাড়, কানে ঝুমকা আর হাতে মোটা বালা জড়িয়ে নেওয়ার পর নিজেকে কেমন অচেনা লাগে শায়লার। অকারণ ব্রীড়া তাকে জাপ্টে ধরলো। বাইরে থেকে হাক ভেসে এলো-“কইগো নাতবউ, হইলো তোমার?”
শায়লা চমকে উঠলো। ধীর পায়ে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়ায়। সোফায় বসে থাকা দুই জোড়া আঁখি ওকে দেখা মাত্রই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তা বুঝতে পেরে শায়লার পা থমকায়, লজ্জায় গুটিয়ে যেতে চায়। আব্দুর রব তাকে ডাকে-“নাতবউ, এইদিকে আইসা বসো। তোমাকে মন ভরে দেখি। ও তৈয়ব, আমার রিদওয়ান এর বউ কেমন বলো দেখি?”
লাজুক শায়লার মাথা নেমে আসে দাদুর কথা শুনে। তৈয়ব মাওলানা প্রসন্নচিত্তে নাতীনকে দেখেন-“মাশাল্লাহ, তোমার রিদওয়ানের বউ লাখে একটা।”
“আরে কও কি? ও কোটিতে একজন। আমার রিদওয়ান এর যোগ্য সঙ্গী।”
একের পর এক প্রশংসা বানে জর্জরিত শায়লা। এই প্রথম স্বাভাবিক নারীর মতো তার গালদুটো লাল হলো। তার ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে কিন্তু পা দু’টো যেন জমে গেছে।
“দাদাজান, কোথায় আপনি? বারবার ইমোশনাল ব্লাকমেল করে আমাকে নাচিয়ে কি মজা পান বলুন তো? কত কাজ ফেলে আসতে হলো জানেন? আমি ঠিকঠাক মতো ডাক্তার হই সেটা মনেহয় আপনি চান না, তাই না?”
বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো রিদওয়ান। তার মেজাজ অত্যাধিক খারাপ। আজ আচমকা ছুটি চাওয়ায় ভীষণ বকা খেয়েছে সে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তার জবান বন্ধ হয়ে গেলো। আচমকা এমন দৃশ্য সামনে দেখে সে বিস্ময়ে বধির আর বোবা বনে গেলো। সামনা সামনি সোফায় যে মেয়েটা বসে আছে তার দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিতে পারলোনা কিছুতেই। বউ সাজে বসে থাকা অনিন্দ্য সুন্দরি মেয়েটাই কি তারই বউ? সে ফিসফিস করলো-“শায়লা! এখানে?”
©Farhana_Yesmin