#এরই_মাঝে
#পর্ব-১৫
ভোরেই ঘুম ভেঙে গেছে রিদওয়ান এর। শায়লা কামরায় নেই। হাই তুলতে তুলতে নিচে নেমে এলো রিদওয়ান। দাদাজানকে বারান্দায় বসা পেলো। শায়লাও আছে তার সামনে। দু’জনে মিলে চা খাচ্ছে। শায়লাকে দেখে রিদওয়ান থমকে গেলো। মেয়েটাকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। শায়লাও তাকে একঝলক দেখে নজর ফিরিয়ে নিলো। আব্দুর রব নাতিকে দেখে হাসলো-“ঘুম ভাঙলো?”
রিদওয়ান মাথা দুলিয়ে বললো-“আমার আজ ফিরে যেতে হবে দাদাজান। ক্লাস আর ডিউটি দু’টোই মিস যাচ্ছে।”
“কিন্তু আজ যে যাওয়া হবে না। বিয়ের পর প্রথম বাড়ি এলে শশুর বাড়ির লোকেদের সাথে দেখা না করে যাওয়া যায়? নাস্তা করে ও বাড়ি যাই চলো। শায়লার দাদা দাদী আছে, তোমার শাশুড়ী আছে, শালীরা আছে। সবার সাথে দেখা করবে খাবে তারপর যাওয়ার কথা।”
রিদওয়ান দাদার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে বললো-“কিন্তু দাদু, আমার পক্ষে কোনভাবেই আজ থাকা সম্ভব হবে না।”
আব্দুর রব মাথা নাড়লো-“ওদের সাথে দেখা না করে গেলে ওরা কষ্ট পাবে। তৈয়ব তোমার আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিয়েছে। সবাই আশা করে আছে এমন অবস্থায় তুমি না গেলে তাদের অপমান করা হবে।”
রিদওয়ান শায়লাকে দেখলো একপলক। শায়লা মাথা নিচু করে থেকে মৃদুস্বরে বললো-“দাদু উনি যেতে না চাইলে জোর করার দরকার নেই। দাদাজানকে আমি বুঝিয়ে বলবো।”
“নাহ, তৈয়বকে কষ্ট দিতে পারবোনা। আমি কথা দিয়েছি আমরা দুপুরে যাব। তুমি বরং রাতের গাড়িতে রওনা দাও। তাহলে চলবে তো?”
রিদওয়ান জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। দাদাকে হ্যা বা না বলা অর্থহীন। সে যা করার তাই করবে।
“আমেরকে তাহলে রাতের বাসের দুটো টিকেট কাটতে বলে দিচ্ছি।”
দাদুর কথায় রিদওয়ান বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো-“দুটো? আর কে যাবে? তুমি?”
আব্দুর রব হেসে দিলো-“নিজের বউ বাদ দিয়ে আমাকে টানছো কেন দাদু? বউটাকে কি নজরে পড়ছে না?”
রিদওয়ান বিব্রত হয়ে বললো-“উনি যাবে আমার সাথে?”
আব্দুর রব হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো নাতির দিকে-“উনি! বউকে উনি বলছো? ও তোমার পাঁচ বছরের ছোট। ওকে আপনি করে বলছো কেন? আর তুমি গেলে ও এখানে থেকে কি করবে?”
রিদওয়ান ফট করে উত্তর দিলো-“তোমাকে সঙ্গ দেবে।”
“না বাবা, স্বামীর কাছ দূরে সরিয়ে আমার কারো সঙ্গ চাই না। আমার জন্য সঙ্গী দিতে চাইলে তাড়াতাড়ি ভাইয়া বা আপু এনে দাও তাহলেই হবে।”
রিদওয়ান না বুঝে বললো-“তোমার জন্য ভাইয়া বা আপু কোথায় পাবো? তারা তো শুনেছি গত হয়েছে।”
আব্দুর রব নাতির নাদানিতে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। সে শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বললো-“শায়লা দাদু, তোমার নাদান স্বামীকে একটু আমার ভাইয়া বা আপু পাওয়ার উপায়টা বুঝিয়ে দিয় তো। নাতি আমার বড়ই সরল সোজা কিছু বোঝে না।”
শায়লার গাল আরক্ত হলো, অকারণে হিঁচকি শুরু হলো তার। “আমি আসছি” বলে সে কেটে পড়লো। তা দেখো আব্দুর রব হা হা করে হাসলো-“তোমার বউ লজ্জা পেয়েছে দাদাভাই।”
ততক্ষণে রিদওয়ানের মাথায়ও ব্যাপারটা ঢুকেছে। তার দাদুর সিক্স জি গতির ইন্টারনেট স্পিডের মতো ভাবনার গতি দেখে সে আসলে মুগ্ধ। যেখানে তারা এখনো স্বাভাবিক বাক্যলাপ শুরু করেনি সেখানে বুড়ো তাদের বাচ্চার প্ল্যান করে ফেলেছে। সে বলেই ফেললো-“বাহ দাদু, তোমার ভাবনার গাড়ির গতি তো অসামান্য। এই গতির নেট পেলে আমরা কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যেতাম।”
আব্দুর রব রিদওয়ানকে চমকে দিয়ে বলল-“নেটের গতির কথা না ভেবে নিজের গতি বাড়ালেই হবে দাদু। তাহলে বছর খানেকের মধ্যেই আমি আপু বা ভাইয়াকে পেয়ে যাব। বুঝলে?”
রিদওয়ান মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো-“বুঝিনি আর বুঝতে চাইও না। তুমি আমার ডাক্তার হওয়া পন্ড করতে চাইছো এটা পরিস্কার বুঝতে পারছি। যাকগে আজকের পর আমাকে হাজার ডাকলেও পাবে না দেখে নিয়। তোমার এইসব পাগলামিতে সায় নিলে আমার ডাক্তার হওয়া হবে না বুঝতে পারছি বেশ।”
আব্দুর রব নাতির কথায় মজা পেলো-“আমিও দেখবো তুমি না এসে কিভাবে থাকো।”
“সময় হলেই দেখতে পাবে।”
নাস্তা সেরে শায়লা আর দাদাজানের সাথে পায়ে পায়ে এগিয়ে শায়লাদের বাড়িতে উপস্থিত হলো রিদওয়ান। বাসায় এসেই শায়লা ভেতরের ঘরে চলে গেল। রিদওয়ান শায়লার দাদা দাদীকে সালাম করলো। নাজনীন রিদওয়ানকে সাথে করে ভেতরের এক কামরার সামনে নিয়ে এলো-“এইটা শায়লার রুম। আসো তুমি। এই শায়লা জামাইকে ঘর দেখা।”
রুমে ঢুকতেই শায়লাকে দেখা গেলো রুবিনার কোলে শুয়ে আছে। রিদওয়ানকে দু’জনই বিব্রত হলো। শায়লা প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রুবিনা সংকুচিত হলো। নাজনীন বুঝলো অসময়ে ঘরে ঢুকেছে। তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রিদওয়ানকে বললো-“ও রুবিনা, তোমার শাশুড়ি। সেদিন তোমাদের ঠিক ঠাক পরিচয় হয়নি মনেহয়।”
রিদওয়ান ভালোমতো তাকিয়ে দেখলো শাশুড়ী সম্পর্কের মানুষটাকে। একদমই সাধারন চেহারা আর বেশভূষার মানুষটা খুব সহজসরল বোঝা যাচ্ছে। রিদওয়ান সালাম দিলো-“আসসালামু আলাইকুম মা। আপনি ভালো আছেন?”
রুবিনাকে কেমন যেন বিহ্বল দেখায়। তার চোখ দুটো জলে ভারী হলো। সে আত্যাশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলো-“ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। তুমি কি আমাকে মা ডাকলা?”
রিদওয়ান আন্তরিক হাসি দিলো-“আপনাকে দেখে মা ডাকতে মন চাইলো। ভুল করেছি কি? আপনি মন খারাপ করেছেন তাহলে আর ডাকবো না।”
রুবিনা ছলছল নয়নে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো-“না না বাবা মন খারাপ করি নাই। বরং এতো খুশি হইছি যে তোমাকে ঠিক বোঝাইতে পারবো আজকে কতটা খুশি হইছি আমি। ছেলের মুখে মা ডাক শুনতে কেমন লাগে আজ তুমি আমাকে বুঝায় দিলা। মনটা ভরে গেলো বাবা। আজ থেকে তোমাকে আমি আমার শায়লার জামাই কম আমার ছেলে বেশি ভাববো। এই মায়ের অত্যাচার সহ্য হবে তো?”
রিদওয়ান মৃদুহাসি দিলো-“খুব হবে মা। ছেলে বলেছেন যেহেতু আমি মান রাখার চেষ্টা করবো সাধ্যমতো।”
নাজনীন রুবিনাকে তাড়া দিলো-“বউমা, চলো খাওয়ার আয়োজন দেখি। ওরা কি না কি করতেছে।”
“হ্যা আম্মা, চলেন যাই। রিদওয়ান বাবা, তুমি বসো শায়লার সাথে গল্প করো। আমি তোমাদের জন্য চা বানিয়ে পাঠাচ্ছি।”
রিদওয়ান মাথা দুলিয়ে হাসলো। ওরা চলে যেহেই রিদওয়ান শায়লাকে দেখলো আড়চোখে। মেয়েটা সেই তখন থেকে মাথা নিচু করে বসে বসে নখ খুঁটিয়ে যাচ্ছে। রিদওয়ান হেটে এসে জানালার সামনে দাঁড়াল। সামনের বিশাল বড় পুকুরটার দিকে নজর পড়লেই মনটা ভীষণ শান্ত হয়ে যাচ্ছে। রিদওয়ান আনমনা হয়ে বললো-“তোমার রুমের এই জানালার ওপাশটা ভীষণ রকম সুন্দর। দেখলেই মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। এই জানালার নাম হওয়া উচিত ‘মন উদাসী বাতায়ন’।”
শায়লা বিস্মিত হয়ে তাকালেও জবাব দিলো না। অবাক ব্যাপার হলো ওর নিজেরও এমন কিছু মনেহয় এই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে। দু’জনের ভাবনা এতো মিললো দেখে আশ্চর্য হলো।
“পুকুরটা তোমাদের?”
“হুমমম। দাদাজানের।”
রিদওয়ানের প্রশ্নের ছোট্ট করে উত্তর দেয় শায়লা। উত্তর শুনে চকিতে শায়লার দিকে একনজর তাকায়। শায়লার দৃষ্টি জানালায় ছিলো। রিদওয়ান নজর ফিরিয়ে আবার আগের মতো জানালায় দৃষ্টিপাত করলো।
“যা দাদুর তা কি তোমাদের না?”
শায়লা সে কথার জবাব না দিয়ে বললো-“আমার মাকে সন্মান দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
রিদওয়ান জানালা থেকে সরে এসে চেয়ারে বসলো-“ধন্যবাদ দেওয়ার কি আছে? মাতৃস্থানীয় কাউকে সন্মান দেওয়াটাই তো স্বাভাবিক।”
“আমার শশুর সাহেবকে দেখছি না। উনি কোথায়?”
প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে শায়লার মুখচোখ বিবর্ন হয়ে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে রিদওয়ানকে দেখলো, চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। শায়লার আচমকা বদলে যাওয়া নজর এড়ায় না রিদওয়ানের। তখনই তার মনে পড়ে দাদুর কথাগুলো। বিয়ের দিন দুপুরে শায়লার বাবাকে নিয়ে কিসব যেন বলছিল। রিদওয়ান জিভে কামড় দেয়। ভীষণ বাজে প্রশ্ন করে ফেলেছে শায়লাকে। মেয়েটা নিশ্চয়ই অফেন্ডেড হয়েছে। কিভাবে বললে মেয়েটার রাগ কমবে ভাবছে সে। এর মাঝেই পর্দার ওপাশে দু’টো উৎসাহি মুখ উঁকি দিতে দেখলো।
“কে ওখানে? ভেতরে এসো।”
“আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই, আমি মহুয়া আর ও বিনা। আমরা দুইজনই আপনার শালি।”
মহুয়া আর বিনা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো। মহুয়া ট্রেটা রিদওয়ান এর সামনে নামিয়ে রাখলো। তাতে কয়েক পদের পিঠা আর দুই কাপ চা। মহুয়ার সপ্রতিভ উত্তরে রিদওয়ান হেসে দিলো-“আরে বাহ! আমার আবার শালিও আছে? তাও আবার দু’দুটো? দারুন ব্যাপার। তা শালিরা আপনারা কোথায় পড়ছেন বলে ফেলেন তাড়াতাড়ি।”
“আমি এইবার ইন্টার পরীক্ষা দিব আর…”
“আমি ক্লাস এইটে পড়ি।”
বিনা তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিলো। রিদওয়ান হেসে দু’জনকে কাছে ডাকলো। এরইমধ্যে শায়লাকেও দেখে নিয়েছে। মেয়েটার মুখের পেশীগুলো ঢিলে হওয়ায় বুঝলো এখনকার মতো আগুনের উত্তাপ কিছুটা কমেছে। হয়তো বোনদের সামনে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাইছে না। মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে রিদওয়ান। মানুষের দূর্বলতা নিয়ে আঘাত করা ভীষণ অপছন্দের কাজ ওর কাছে। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই কাজটা করে ফেলেছে। এখন শায়লাকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখে ওর অপরাধবোধ কিছুটা কমলো।
চলবে—-
©Farhana_Yesmin