এরই মাঝে পর্ব-২১

0
102

#এরই_মাঝে
#পর্ব-২১

মুকুল নামটা দেখে থমকাল ওয়াহেদ। বিস্মিত হয়ে লেখার দিকে তাকিয়ে রইলো। পিএ জানতে চাইলো-“ওনাকে কি বিদায় দেব স্যার?”
ওয়াহেদের অবাক ভাব কাটেনি। সে ব্যস্ত হয়ে বললো-“না না বিদায় দেবে কেন? তাড়াতাড়ি আমার কেবিনে পাঠাও। কিছুক্ষণ পরে দুইকাপ চা পাঠাবে সাথে নাস্তা।”
পিএ চলে গেলো। ওয়াহেদ ভাবছে মুকুল হঠাৎ এতোদিন পরে কেন তার সাথে যোগাযোগ করলো? কি চায় সে? শুনেছে কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই ওর। হুট করে এতোদিন পরে তার কাছে কেন এলো? মুকুলকে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালো ওয়াহেদ। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলো। বসতে ইশারা করে বললো-“মুকুল, এতোদিন পরে হুট করে তোমার ফোন পেয়ে খুব অবাক হয়েছি। কেমন আছো?”
মুকুল কিছুটা ইতস্তত বোধ করে জবাব দিলো-“হুট করে ঢাকায় কাজ পড়লো ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করি। সহপাঠী থেকে বেয়াই হয়ে গেলাম, বিশ্বাস হচ্ছিল না তাই নিজ চোখে দেখতে এলাম তোমাকে। যদিও নিজের মেয়ের বিয়ের খবর আমি অনেক পরে জেনেছি।”
ওয়াহেদ কি বলবে ভেবে পেলো না। আড়ষ্ট বোধ করলো জবাব দিতে। মুকুলের কন্ঠে অভিযোগের ছোঁয়া পেয়ে অবাকও কম হলো না। মুকুলই বললো-“কিছু মনে করো না ওয়াহেদ, আসলে শায়লার বিয়ের খবর জেনে মনটা খুব খারাপ হয়েছে। আমি বাবা তো ওদের, একবার জানাতে পারতো।”
ওয়াহেদ বিব্রত হয়ে ল্যাপটপে তাকিয়ে থাকে। মুকুলের চেহারা ভার। সে সগতোক্তি করলো-“মেয়েটাকে দেখিনা বহুদিন। ও দেখতে কেমন হয়েছে? তোমার ছেলের সাথে ভাব হয়েছে তো?”
মুকুলের বাবা হৃদয়ের আর্তি বুঝলো ওয়াহেদ। কোমল কন্ঠে বললো-“তোমার মেয়ে মানুষ হিসেবে খুব ভালো তবে ওকে দেখে যতটা বুঝেছি ওর আত্মসম্মান জ্ঞান অনেক প্রখর। মনোবল অনেক শক্ত, হয়তো তোমার অনুপস্থিতির কারণে এমন হয়েছে।”
“তোমার সাথে কথা বলে?”
ওয়াহেদ মাথা দুলিয়ে সায় দিলো-“বলে। ভদ্রতাবোধ ওর মায়ের মতোই।”
কথাটা হুল ফোটার মতো লাগলো মুকুলের কাছে। ব্যাথীত নয়নে বললো-“কঠিন মনটাও মায়ের মতোই।”
কিছুটা চুপ করে থেকে পুনরায় বললো-“ও আমাকে প্রচন্ড ঘৃনা করে। এতোটাই যে মাঝে মাঝে আমার নিজের মনে প্রশ্ন জাগে পৃথিবীতে কেউ কাউকে এতোটা ঘৃনা করতে পারে কি?”
“টেক ইট ইজি মুকুল। তোমার কাজটা কিন্তু ঘৃনার যোগ্যই। ওর মনের হাল একবার ভাবো। নিজেকে ওর জায়গায় রেখে দেখো তাহলে হয়ত ওর এমন ব্যবহারে আর কষ্ট লাগবে না তোমার।”
মুকুল ব্যস্ত হয়ে উত্তর দেয়-“না না বুঝি আমি। দোষ তো আসলে আমারই। ওর প্রতি কোন অভিযোগ নেই আমার।”
“থাকা উচিতও নয়। ওরা ওদের মতো ভালো থাকতে চাইলে তোমার আপত্তির কোন জায়গা দেখি না।”
ওয়াহেদ কাট কাট কন্ঠে জানিয়ে দিলো। বিনিময়ে মুকুল চুপ করে রইলো। কিছু সময় পরে বললো-“শায়লার বিয়ে উপলক্ষে কিছু উপহার দিতে চাই আমি। জানি আমার কোন উপহার সে নেবে না তাই তোমাকেই দিতে চাচ্ছি। এই যে চেকটা রাখো ওয়াহেদ। পাঁচ লাখ টাকা আছে, ওর যদি কখনো প্রয়োজন হয় তাহলে ওকে দিয়।”
ওয়াহেদ ভ্রু কুঁচকে চেকটা দেখলো-“যৌতুক দিচ্ছ নাকি মুকুল?”
“আরে না না, এসব কি বলছো?”
“যৌতুক তো নেব না মুকুল। আমার কোন ছেলের বিয়েতো যৌতুক নেইনি আমি। তাছাড়া তোমার মেয়েকে বিয়ে করেছে আমার ছেলে, কিছু প্রয়োজন হলে সে পূরণ করবে ওর চাহিদা। না হলে আমি তো আছি। আল্লাহ চাইলে কোন কিছুর কমতি নেই আমার কাছে। সবচেয়ে বড় কথা তোমার মেয়ে শায়লা যদি কখনো জানে এ কথা তাহলে হয়তো সংসারই করবে না। ওকে যতটুকু বুঝেছি নিজের খরচ ও নিজেই চালায় ভবিষ্যতেও চালাবে। তুমি ওর এই চেষ্টাটুকু নষ্ট করতে চেয় না।”
“ভুল বুঝো না ওয়াহেদ। আমি মোটেও এসব বলতে চাইনি। আমি শুধু চাই শায়লা ভালো থাক।”
ওয়াহেদ মাথা নাড়ে-“বুঝেছি। চেকটা নিজের কাছেই রাখো। এসব নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলো না। বাচ্চাদের জন্য দোয়া করো তাহলেই হবে। ওরা অবশ্যই ভালো থাকবে।”

*****

রিদওয়ানের কথা শুনে শায়লা নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করছে। শত ব্যস্ততার মাঝে বন্ধুদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরতে যাচ্ছে, হাহা হিহি করছে। সেদিন মহুয়ার হোস্টেলে গেলো। দিন দুয়েক পরে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। এমন সময় বড় আপুকে দেখে মহুয়া অবাক সেই সাথে ভীষণ খুশিও। দুইবোন গুটগুট করে সারাদিন গল্প করলো, হাসলো, খেলো। ওখান থেকে টিউশন যাওয়ার সময় শায়লা বললো-“মহুয়া, তোর পড়ালেখার অনেক ক্ষতি করে ফেললাম আজ, তাই নারে?”
মহুয়া শায়লাকে জড়িয়ে ধরে-“আপা, পরীক্ষার আগে তোমার সাথে এই গল্প করাটা কিযে ভালো হলো। মনটা একদম রোদেলা আকাশের মতো ঝকঝকে হয়ে গেছে। দেখবে খুব ভালো পরীক্ষা দেব আমি।”
মহুয়ার কথায় শায়লা লাজুক হাসলো। কয়েকদিন পরে হুট করে রিদওয়ানের ফোন-“এই শায়লা আগামীকাল আমার এক্সাম আছে একটা। তোমার সাথে গল্প করতে চাইছি। তুমি কি ব্যস্ত?”
শুক্রবার সকাল, শায়লা তখন জেনেটিক কোড মুখস্থ করছিল। সে বুঝে পেলো না এক্সামের সাথে শায়লার গল্প করার কি সম্পর্ক? সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“আপনার এক্সাম তো পড়তে বসুন। আমার সাথে গল্প করতে হবে কেন?”
“আরে হবে হবে। তুমি বলো ফ্রি আছো কিনা। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি তোমার হলের সামনে।”
রিদওয়ান কথা বলে খট করে ফোন কেটে দেয়। শায়লা নিজেকে আয়নায় দেখলো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, ঠোট ফ্যাকাশে, নাকের উপর এক পাতিল তেলের প্রলেপ, মুখ শুকনো। নিজেকে দেখে নিজেরই বমি এলো। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলে শায়লার এই অবস্থা হয়। নাওয়া খাওয়া ভুলে সে শুধু পড়ে। শায়লা দ্রুত গতিতে বাথরুমে ঢুকলো। দশমিনিটে নিজেকে কোনরকমে প্রস্তুত করে নিচে নামলো। এরমধ্যে রিদওয়ান কম করে হলেও বিশবার কল দিয়েছে। ওকে দেখেই বললো-“কি অবস্থা শায়লা, তুমি তো দেখি ওইসব মেয়েদের মতো সাজগোজে ঘন্টা লাগিয়ে দিচ্ছ। দেখি দেখি কি এমন সাজলে যে এতোক্ষণ লাগলো?”
শায়লা আশেপাশে তাকিয়ে রিদওয়ানকে চোখ রাঙানি দিলো। রিদওয়ান না দেখার ভান করলো-“আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্তত সাজগোজে এতো সময় নেবে না। পড়ুয়া মেয়ে বলে কথা। কিন্তু এখন দেখছি…”
শায়লা ওর মুখের কথা কেড়ে নিলো-“কোথায় যাবেন?”
রিদওয়ান উদাস হলো-“ইচ্ছে তো করছে তোমাদের পুকুর পাড়ে বসে থাকতে। কিন্তু এখানে পুকুর পাবো কোথায়? চলো একটু দূরে কোথাও যাই।”
“দূরে কোথাও?”
শায়লার কপালে ভাজ পড়লো। রিদওয়ান বললো-“পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে চলো আগে নাস্তা করি। পরে দেখবো কোথায় যাওয়া যায়।”
শায়লারও খিদে লেগেছে বলে রিদওয়ানের কথাটা মেনে নিলো। খেতে বসে হঠাৎ বলে বসলো-“আপনার কি কোন কারণে মন খারাপ?”
রিদওয়ানের খাওয়া থেমে যায়। বিষন্ন স্বরে বললো-“কি করে বুঝলে?”
“অকারণে ফানি কথা বলে হাসানোর চেষ্টা করছেন।”
রিদওয়ান হালকা নির্ভার হয়ে বললো-“হুম, ভীষণ মন খারাপ আমার। গতকাল ডিউটি আর এক্সাম ছিলো। এক্সাম খুব খারাপ হয়েছে আর এক্সামের চক্করে ডিউতে গড়বড় করেছি। স্যার ভীষণ বকেছেন কাল আমায়।”
শায়লা চুপচাপ কথাগুলো শুনলো-“এরকম ঘটনা মেডিকেল স্টুডেন্টদের জন্য খুব নরমাল। এতো আপসেট হচ্ছেন কেন?”
“আপসেট হচ্ছি কারণ আমার সাথে এমনটা ঘটেনি আগে।”
শায়লা হেসে দিলো-“ঘটেনি বলে ঘটা যাবে না? এতো ছেলেমানুষী করছেন কেন?”
রিদওয়ান রেগে গেলো-“আমি ছেলে, ছেলেমানুষী করবো নাতো কি মেয়েমানুষী করবো? আজব কথা বলে।”
শায়লা হাসি চাপলো-“আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে জানেন? সাদা বিড়ালের মতো। বিড়াল রেগে গেলে যেমন গড়গড় শব্দ করে আপনিও করছেন।”
রিদওয়ানের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম-“আমি বিড়াল?”
শায়লা মাথা দুলায়-“হুমমম, রয়েল বেঙ্গল টাইগার ধাঁচের বেড়াল। প্রচুর রাগী কিন্তু দেখতে কিউট।”
শায়লা বলার ভঙ্গিতে রিদওয়ান হেসে দিলো। হো হো করে উচ্চস্বরে হাসছে। শায়লা ব্রীরায় মুখ নত করে রইলো। পরক্ষণেই আবার চোখ তুলে তাকায়। রিদওয়ান এর হাসি দেখতে ভালো লাগছে। হুট করে রিদওয়ান হাসি থামিয়ে দিলো-“তুমি দেখি সত্যি সত্যি টিচার আপা থেকে লাফটার আপা হয়ে উঠেছ।”
“মানে? টিচার আপা কে?”
“তুমি। তুমি জানো না মহু আর বিনা তোমাকে টিচার আপা ডাকে?”
শায়লার চেহারা ঈষৎ লাল হলো। তার বোনদুটো এরকম বিচ্ছু কেন? বোন হয়ে বোনের মানসম্মান রাখলো না? রিদওয়ান ওর মুখভঙ্গি দেখে তটস্থ হয়ে বললো-“আরে, রাগ করলে নাকি? ওরা তো ফান করে বলেছে। তাছাড়া এখন তো তোমার নাম বদলে গেছে।”
বলে ফিক করে হাসলো রিদওয়ান। শায়লা হাসবে না হাসবে না করেও হেসে দিলো। রিদওয়ান হুট করে হাসি থামিয়ে দেয়। শায়লার দিকে চুপ করে দু’মিনিট তাকিয়ে থেকে বললো-“আমার সত্যি মন খারাপ ছিলো শায়লা। এখন আপাতত ভালো বোধ করছি। থ্যাংকস টু ইউ।”
শায়লা গম্ভীর হয়। রিদওয়ান বললো-“চলো বের হই। কোন চায়ের দোকানে বসি।”
শায়লা সায় দিলো। দু’জনেই চুপচাপ পাশাপাশি হাটছে। সত্যি বলতে এই একসাথে হাঁটাও ভালো লাগছে শায়লার। অন্যরকম অনুভূতি। শায়লা রিদওয়ানকে দেখলো আড়চোখে। সুদর্শন ছেলেটাকে দেখে ওর বুকে কেমন ধক করে উঠলো। মনে হলো হার্টবিট মিস করলো দু’একটা।

চলবে—
©Farhana_Yesmin