এরই মাঝে পর্ব-৩৭+৩৮

0
113

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩৭

রিদওয়ানের ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। জাকিয়া বসে ছিলো ওর জন্য। রিদওয়ান তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে মাকে ঘুমাতে যেতে বললো। কাল দুপুরে ফ্লাইট এগারোটার মধ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। তাই রাতের ঘুমটা জরুরি তার নিজেরও। রিদওয়ান শেষ মুহূর্তে সব চেক করছিল। ঠিকঠাক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়েছে কিনা। সন্তুষ্ট হয়ে লাগেজ বন্ধ করে প্রয়েজনীয় কাগজপত্র চেক করলো। হ্যান্ডব্যাগটা রেখে দিলো জায়গা মতো। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ পড়লো। রিদওয়ান দরজা খুলে দেখলো পল্লবী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে ঠোঁট টেনে হাসলো-“রিদু, তুই কি ব্যস্ত?”
রিদওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো, অবাক হয়ে মাথা নাড়লো-“একটু ব্যস্ত ভাবি কিন্তু সমস্যা নেই। তুমি কিছু বলবে?”
“ঘরে আসি?”
পল্লবী মৃদুস্বরে বলতেই রিদওয়ান থতমত খেয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো-“আরে এটা আবার বলতে হয়? তোমার প্রয়োজন মনে হলে অবশ্যই আসবে।”
পল্লবী দেখলো রিদওয়ানের লাগেজটা র্যাপিং করে একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা। তার মনে দ্বিধা। ব্যাপারটা রিদওয়ানকে বলবে কিনা। ছেলেটা এতেদূর যাচ্ছে, এই মুহূর্তে ওকে টেনশন দিতে মন চাইছে না। আবার শায়লার আচরণকে বাদও দিতে পারছে না। শেষে না এই ক্ষুদ্র ব্যাপারে মন কষাকষি হয়ে দু’জন আলাদা হয়ে যায়। পল্লবীর মনে ভয় জেঁকে বসলো। রিদওয়ান ভাবিকে জরিপ করছে মন দিয়ে। হতবাক হচ্ছে মনে মনে। পল্লবীকে এতোরা আনমনা কখনো দেখেনি আগে। সে জানতে চাইলো-“ভাবি, কি কথা বলবে?”
“আজকে শায়লা এসেছিল বাসায়।”
রিদওয়ানের হাতে একটা চাবি ছিলো সেটা হাত থেকে পড়ে গেলে। বিস্ময়ের চুড়ায় থেকে রিদওয়ান পল্লবীর দিকে তাকিয়ে বললো-“কে এসেছিল বললে? শায়লা!”
পল্লবী বিরক্ত হলো-“হ্যা। তোর মতো আমিও অবাক হয়েছিলাম ওকে দেখে। পড়ে ভাবলাম তুই দূরে চলে যাবি এইজন্য হয়তো দেখা করতে এসেছে।”
রিদওয়ানের কেন যেন মন ভালো হয়ে গেলো। চেহারায় উজ্জ্বলতা এলো, ঠোঁটের কোনে হাসির আভা। ম্যাডামের মান ভাঙলো অবশেষে। পরক্ষণেই হাসি নিভে গেলো। গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলো-“কি বললো এসে? থাকলোনা কেন?”
পল্লবী মাথা নাড়ে-“থাকতে এসেছিল হয়তো কিন্তু কি যে হলো হুট করে। মানে ও কি করে জানলো তাই বুঝতে পারছি না।”
রিদওয়ানের কপালে ভাজ পড়লো এবার। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“কি জেনেছে? কি হয়েছে খুলে বলো ভাবি।”
“শায়লা আমার কাছে সেঁজুতির বিষয়ে জানতে চাইলো। তুই ইউকে যাচ্ছিস কারন সেঁজুতি নাকি ওখানে আছে।”
রিদওয়ান থমকে গেলো। চেহারা জুড়ে অবিশ্বাস দোল খাচ্ছে। সে প্রায় চেচিয়ে উঠলো-“কি বলছো এসব! বানিয়ে বানিয়ে এসব কথা ও বললো কি করে? সেঁজুতির সাথে আমার যোগাযোগ নেই তাও ছয় সাত বছর। ও কোথায় আছে জানি না আমি। আর সেঁজুতির কথা শায়লা জানলো কি করে?”
পল্লবী মাথা ঝাঁকায়-“সেটা তো আমিও ভাবছি। ওর কানে কে দিলো এসব কথা? সেঁজুতির ব্যাপারে আমাদের পরিবারের মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না। তুই কি একবার কথা বলবি শায়লার সাথে? মেয়েটা মনেহয় রাগ করে চলে গেছে।”
রিদওয়ান কিছুক্ষণ ভেবে বললো-“ও কি মায়ের সাথে বসে ছিলো?”
“হ্যা। বাবাও ছিলো। আমি ওকে রুমে ডেকে আনলাম। হুট করে সেঁজুতির কথা জানতে চাইলো। আমি বললাম, তুই আজ থেকে যা। রিদওয়ানের সাথে কথা বলে সব মিটিয়ে নে। বললো যে তার গোপনীয়তা আমার সাথে শেয়ার করেনি তার সাথে কিসের মিটমাট।”
রিদওয়ান মাথার চুল খামচে ধরলো-“সবসময় বেশি বোঝে এই মেয়ে। ওকে যত ছাড় দিচ্ছি ততই পেয়ে বসছে আমাকে। নিজের জায়গা থেকে এক চুল নড়বে না।”
পল্লবী অনুনয় করলো-“তুই বরং ওর সাথে একবার কথা বল রিদু। দূরে চলে যাচ্ছিস, সম্পর্কের সুতো আলগা হয়ে যাবে তো।”
“সম্পর্কের সুতো শুরু থেকেই আলগা ভাবি। নতুন করে আর কি হবে। আর তোমার কি ধারণা ওর সাথে কথা বলতে চাইলে ও বলবে? কোনদিন বলবে না। ওকে আমি ভালেমতো চিনি। ও ভাবছে এভাবে কথা না বলে সম্পর্ক না রেখে ও নিজেকে আত্মসন্মানী মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। ওকে তাই ভাবতে দাও।”
“কিন্তু এভাবে… তুই ফিরে এলে কি হবে?”
রিদওয়ান হতাশ হয়ে খাটের কিনারায় বসলো। দূর্বল গলায় বললো-“শোন ভাবি, শায়লা নিজেকে এ বাড়ির যোগ্য মনে করে না কখনোই। ওর মধ্যে নিজের পরিবার নিয়ে হীনমন্যতা আছে। তার উপর মা ঠারেঠুরে ওকে কথা শুনিয়েছে বলে ওর সেই হীনমন্যতা দিনকে দিন বেড়েছে। এখন আমি ওর জন্য যাই করি সবই ওর কাছে দয়া মনেহচ্ছে। ওর সাথে সংসার করতে গেলে জোর করা হবে, ওর মনে আমার জন্য তিক্ততার জন্ম হবে। তাই নিজেকে ওর থেকে সরিয়ে নিয়েছি৷ ও নিজের পায়ে দাঁড়াক, আত্মবিশ্বাস আসুক নিজের মধ্যে। ও নিজ থেকে আমার কাছে আসুক। বুঝুক ওকে আমি দয়া নয় ভালোবেসেছি। ততদিনে আমিও নিজেকে গুছিয়ে নেই। অপেক্ষা করি ওর আক্কেল হওয়া অবধি।”
পল্লবী হা করে রিদওয়ানের কথা গিলছিল। সে হতবিহ্বল গলায় বললো-“তুই ওর জন্য এতো ভাবিস! আর বোকা মেয়ে এখনো সেঁজুতিকে নিয়ে পড়ে আছে। অবশ্য শায়লাকে খুব একটা দোষও দেওয়া যায় না রিদু। বাবা মায়ের প্রথম সন্তান ছিলো। আদরের ছিলো হয়তো। হুট করে ওর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছিল হয়তো। বাবার কারণে অনেক কিছু দেখে ফেলেছে এইটুকু জীবনে। যার ফলে সহজে কোন কিছুতে বিশ্বাস আসে না ওর। ভাগ্যিস তোর মতো বুঝদার কাউকে পেয়েছে শায়লা। কিন্তু রিদু তুই কবে থেকে এতোটা বুঝদার হলি বলতো? শায়লাকে ভালোবেসেই কি এতো বুঝ এসেছে তোর?”
রিদওয়ান লাজুক হাসলো। মাথা চুলকে বললো-“তা জানি না ভাবি। সত্যি বলতে শায়লাকে শুরুতে সহ্য হতো না আমারও। কিন্তু ধীরে ধীরে কিভাবে যে ওর মায়ায় পড়ে গেলাম। নয়তো সেঁজুতির কান্ডের পর কোন মেয়েকে আমার বিশ্বাস হতো না। এতে অবশ্য দাদুর অনেক ভুমিকা আছে। তুমি তো জানোই দাদু আমার জন্য কি।”
পল্লবী মুগ্ধ হয়ে রিদওয়ানকে দেখলো। ওর মাথার চুলগুলোতে স্নেহস্পর্শ দিয়ে বললো-“এভাবেই সারাজীবন শায়লাকে আগলে রাখিস রিদু। অনেক গর্ব হচ্ছে যে তুই আমার দেবর। গেলাম আমি। তুই ঘুমিয়ে পড়।”
রিদওয়ান মাথা নাড়ে। পল্লবী চলে যাওয়ার পরে ও ফোনটা হাতে নিলো। খুব ইচ্ছে করছে শায়লার গলা শুনতে। যেহেতু সামনে যাওয়ার মুখ নেই তাই এতোদিন লুকিয়ে চুরিয়ে দূর থেকে দেখে আশ মিটিয়েছে। কালকের পর থেকে সেই সু্যোগও রইলো না। মনটা খুব উচাটন হচ্ছে। ডায়াল লিষ্টে শায়লার নাম্বার ডায়াল করে আবার কেটে দিলো। তার বদলে মহুয়ার নাম্বারে কল দিলো। একবার রিং হওয়া মাত্রই মহুয়া ফোন তুললো-“হ্যা ভাইয়া, কেমন আছো?”
“তোর বোন আজ বাসা ঘুরে গেছে অথচ আমার সাথে দেখা করেনি।”
মহুয়া বিস্মিত কন্ঠে সুধাল-“সত্যি! হুট করে কেন গেলো? সকালে আমাকে ফোন দিয়েছিল। তোমার খবর জানতে চাইলো।”
“তা আমি কি করে বলবো? তোর বোনের মতিগতি কি সেই ভালো জানে।”
মহুয়া ফোঁড়ন কাটলো-“তুমিও জানো। বউ তো তোমার।”
“এই মেয়ে বিরহে রাখতে রাখতে আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান আঁটছে। কি দিয়ে যে তৈরী আল্লাহ জানে। এতদিনে একফোঁটা মন নরম হয়নি।”
রিদওয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মহুয়া হাসলো-“ইদানীং মনেহয় একটু নরম হচ্ছিল। কিন্তু তুমি তো পালিয়ে যাচ্ছ।”
“লোভ দেখাস না মহু। তোর নির্দয় বোন মোটেও নরমটরম হয়নি। হলে আজ দেখা না করে ফিরে যেত না। যাকগে, ওর দিকে একটু খেয়াল রাখিস না হলে কখন আবার কি করে বসে ঠিক নেই। এখন তো আমি থাকবো না।”
“এতো ভালোবাসো ওকে জানাচ্ছ না কেন? শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ দু’জন।”
“জানিয়ে লাভ হলে জানাতাম রে। তুই তো জানিস ও কেমন।”
মহুয়া নিরব রইলো। রিদওয়ানের জন্য কষ্ট হলো ওর। শায়লার অকারণ জেদে কষ্ট পাচ্ছে রিদওয়ান। কিন্তু কিছুই করার উপায় নেই। রিদওয়ান নিজেই চায় না কেউ ওর হয়ে শায়লার সাথে কথা বলুক। মহুয়া প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো-“কাল কখন যাবে?”
“এগারোটার দিকে বের হবো। সাড়ে তিনটায় ফ্লাইট আমার। তোরা ভালো থাকিস মহু। এখন ঘুমাতে হবে, রাখছি আমি।”
“আচ্ছা। তুমিও ভালো থেকো।”
ফোন কেটে গেলো। রিদওয়ান অনেকটা সময় অন্ধকারে বসে রইলো চুপচাপ। ওর মন চাইছে ছুটে শায়লার কাছে চলে যেতে। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভালোভাবে দেশ ছাড়তে। কিন্তু সম্ভব না। নিজেই এ পথ রুদ্ধ করেছে। একটা অন্যায় করে শায়লার কাছে নিজেকে ছোট করেছে। শায়লাকে কথা দিয়েছে, নিজ থেকে আর কোনদিন শায়লার কাছে যাবে না। অথচ প্রতিনিয়ত ওর কাছে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে। এ যেন শায়লার সাথে তার করা অন্যায়ের সাজা পাচ্ছে সে। এ বড় কঠিন সাজা তার জন্য।
রিদওয়ান ঠোঁট কামড়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। বিরবির করলো-“দেশে ফিরে আসার পরও যদি তোমার অভিমান না ভাঙে আমার কাছে ফিরে না আসো তাহলে চিরদিনের মতো তোমাকে মুক্ত করে দেব শায়লা। আর পারছি না তোমার এই বিরহ মেনে নিতে।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৩৮

মাতালের মতো টলতে টলতে হলে ফিরেছে শায়লা। কোন রকমে কাপড় বদলে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। হুহু কান্নায় তার মাথার বালিশ ভিজে যায়। দু’হাতে চোখ মুছতেই আবারও অবাধ্য জল আছড়ে পড়ে তার গালে। কেন যেন শায়লার কান্না বাঁধ মানছে না। রিদওয়ানদের বাসা থেকে আসার পর থেকেই ও কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে তবুও ওর কান্না থামছে না। বারবার মনেহচ্ছে, কেন মায়ের মতো ভাগ্য হলো তার? সে মনে প্রানে চাইতো রিদওয়ান যেন তার জন্মদাতার মতো না হয়। তার মা যেমন তার জন্মদাতার কথা ভেবে রাতের আঁধারে লুকিয়ে চুরিয়ে কেঁদে বালিশ ভেজাত তেমন ভাগ্য যেন তার না হয়। তার সব ধারণা মিথ্যে প্রমান হোক তবুও রিদওয়ান যেন সত্য হয়। রিদওয়ান হোক তার বিশ্বাস আর ভরসার জায়গা। কিন্তু শেষমেষ তার ভাবনাই সত্যি হলো। রিদওয়ানও তার জন্মদাতার মতো তাকে ধোঁকা দিলো। এতে একফোঁটাও খুশি না শায়লা। রিদওয়ানকে ভুল প্রমান হতে দেখে কষ্টে তার বুক ভেঙে আসছে। দূরেই যদি ঠেলে দেবে তাহলে অধিকার দেখিয়ে কাছে টেনেছিল কেন? কেন ধৈর্য্য ধরার নাটক করেছে? শায়লা যেন কোন বুঝ দিয়েই নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা। কাঁদতে কাঁদতেই না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল সে।

হুট করে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো শায়লার। তার বুক জুড়ে শুন্যতা। কিসের আসায় মাতালের মতো অন্ধকারে এদিক সেদিক হাতড়ে মোবাইল খুঁজলো। মনে পড়লো ব্যাগ থেকে ফোন বের করা হয়নি। কোনরকমে উঠে যেয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আবার বিছানায় এলো। ফোন ওপেন করে দেখলো কারো কল এসেছে কিনা। নাহ, কেউ ফোন করেনি। না রিদওয়ান না অন্য কেউ। আচ্ছা, রিদওয়ান কি তার বাসায় যাওয়ার খবর পায়নি? তবুও একবারও ফোন দিয়ে জানতে চাইলো না কেন শায়লা তার সাথে দেখা না করে চলে এলো? কেন ফোন দিলো না? দুই বছর শায়লা তার খোঁজ নেয়নি সেজন্য? নাকি নিজ থেকে আর ওর খবর নেবে না বলেছিল সেজন্য? কিন্তু শায়লা তো গেছিল রিদওয়ান এর সাথে দেখা করতে। তাহলে রিদওয়ান কেন একবারও তাকে ফোন দিলো না? পরক্ষণেই নিজেকে শান্তনা দিলো শায়লা। কেন দেবে ফোন? এখন কি শায়লাকে প্রয়োজন আছে তার? নিজের পুরনো প্রেমিকাটিকে ফিরে পেয়েছে আর কি শায়লার প্রয়োজন আছে রিদওয়ান এর? শায়লার মনের পুঞ্জিভূত অভিমান আরও যেন গাঢ় হলো। তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো সে। তার মা রিদওয়ানকে ছেলে বানিয়েছে। অগাধ বিশ্বাস রিদওয়ানের উপর। সে কি জানে রিদওয়ানের প্রেমিকার খবর? রিদওয়ান যে আরেকটা মুকুল সেটা জানলে কি করবে তার মা? খুব তে বলতো, রিদওয়ান ওমন ছেলে নয়। এখন কি বলবে মা? নিজের মেয়ের চাইতে বেশি যাকে বিশ্বাস করেছে তার বিশ্বাসঘাতকতায় কি জবাব দেবে? রাগের অনুভূতি মাথা চারা দিয়ে উঠলো শায়লার মাঝে। সময় জ্ঞান ভুলে সে এই রাত বিরাতে ফোন দিলো রুবিনাকে। রিং হয়ে ফোন কেটে গেলো রুবিনা ফোন ধরে না। শায়লা অধৈর্য্য হয়ে বারবার ফোন দিতে থাকে রুবিনাকে। একসময় রুবিনার ঘুম জড়ানো কন্ঠ শোনা গেলো-“শায়লা, কি হইছে? এতো রাতে ফোন দিছিস কেন মা?”
শায়লা হিসহিসিয়ে বললো-“তোমাকে একটা খবর দিতে ফোন দিছি মা। তোমার আদরের ছেলে রিদওয়ান লন্ডন যাইতেছে।”
“জানি তো। রিদওয়ান বলছে আমাকে।”
রুবিনার কথায় শায়লা অপ্রকৃতস্তের ন্যয় হাসলো-“সে যে নিজের প্রেমিকার কাছে যাইতেছে এইটা কি তোমাকে বলছে মা? জানো মা, রিদওয়ান নাকি খুব ভালোবাসতো সেঁজুতিকে। এখন সে লন্ডনে সেঁজুতির কাছে ফিরে যাইতেছে। কি মজা তাই না মা?”
রুবিনা হতবিহ্বল গলায় বললো-“কি বলিস এসব আবোলতাবোল? রিদওয়ান এমন ছেলেই না। ও বলছে আমাকে, তোকে আরেকটু সময় দিতেই ও দূরে যাইতেছে।”
শায়লা হা হা করে হাসলো। গভীর রাতে তার হাসি ফোনের অপর প্রান্তে অশরীরির ন্যায় ঠেকলো। রুবিনার কেমন যেন ভয় লাগলো মেয়েকে। শায়লা কি পাগল হয়ে গেছে? শায়লা হাসতে হাসতেই বললো-“কতো বিশ্বাস করো তুমি রিদওয়ানকে যে নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করো না। আহা! তোমার এই বিশ্বাস যদি সত্য হইতো মা আমার চাইতে খুশি কেউ হইতো না।”
রুবিনা ভীত গলায় বললো-“তুই কেন এইসব বলস শায়লা? বারবার ছেলেটাকে অবিশ্বাস করিস।”
শায়লা দাঁতে দাঁত চেপে চেচিয়ে উঠলো-“আমি সবসময় অবিশ্বাস্য করতাম। আজ সেই অবিশ্বাস সত্য কেন হইলো মা? তোমার বিশ্বাস হয় নাতো? জিজ্ঞেস করো তোমার রিদওয়ানকে। বলুক সেঁজুতি নামে কেউ নাই।”
রিবিনা হতাশ গলায় বললো-“একি পাগলামি শায়লা? রিদওয়ান সেই কবে থেকে তোর সাথে সংসার করতে চায়। তুই চাস না বলে ছেলেটা তাও মেনে নিলো। তোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সময় দিলো যাতে ওদের সামনে হীনমন্যতায় না ভুগিস। তবুও আজ খুঁজে খুঁজে ওর দোষ বের করছিস?”
শায়লা কেঁদে দিলো, ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো-“নিজের স্বামীর সাথে অন্য মেয়ের সম্পর্কের কথা শোনা কি দোষ ধরা মা? তুমি বুঝতে পারছোনা আমার কেমন লাগতেছে? ওই লোক যখন তোমাকে ফেলে আরেকটা বউ নিয়ে আসছিল তোমার কেমন লাগছিলো মা? তুমি কি ভুলে গেছো সেইসব দিনের কথা?”
এতোক্ষণে যেন রুবিনার ঘুম ভাঙলো। বিছানায় উঠে বসলো। সে বুঝতে পারছে না শায়লা এসব কথা শোনে কোত্থেকে? ফোনের অপর প্রান্তে শায়লার কান্না শুনে তার অস্থির লাগছে। তার জীবনের ঝড়ের রেশ পুরোটা শায়লার উপর দিয়েই গেছে। স্বামীর প্রতারনার দুঃখে নিজেকে সামলাতে বড্ড বেগ পেতে হয়েছে। তখন শায়লাকে সময় দিতে পারেননি। উল্টো মাঝে মাঝেই রাগ দেখিয়ে ফেলতেন মেয়ের উপর। রুবিনার কেন যেন মনটা খচখচ করে উঠলো। সে
মেয়েকে শান্ত করতে জানতে চাইলো-“তোকে কে বলেছে সেঁজুতির কথা? আচ্ছা যেই বলুক। ধর সেঁজুতির সাথে সম্পর্ক ছিলো কিন্তু এখন তো ওর জীবনে তুই আছিস। তুই ছাড়া আর কেউ নাই।আর রিদওয়ানকে যতটুকু বুঝেছি সে এমন করার মানুষ না।”
“তাহলে ও আমাকে ফোন দিলো না কেন? আমি আজ ওর বাড়িতে গেছিলাম ওর সাথে দেখা করতে। ওকে না পেয়ে ফিরে এসেছি। এ কথা জানার পরও ও আমাকে ফোন দেয়নি। অথচ কাল ও ইউকে যাইতেছে মা। আমার সাথে দেখা না করেই চলে যাবে মা। ও বলে আমার জন্য এতো পাগল তাহলে দেখা না করে কেন যাবে?”
শায়লার যুক্তি ফেলনা নয় বুঝে রুবিনা খানিকক্ষণ চুপ রইলো। তারপর বললো-“তুই চলে আসছিলি কেন? রিদওয়ানকে বিদায় দিয়ে ফিরতি। ওর কাছে জানতে চাইতি সেঁজুতির কথা।”
“আর রিদওয়ান আমাকে সব বলতো তাই না? কোনদিন দেখছো ছলনাময় পুরুষ নিজের দোষ বলে? ওর মন যদি পরিস্কার হইতো তাইলে ও নিজ থেকে বুলতো সেঁজুতির কথা। কিন্তু তোমাকে এইসব বলে কি হবে? তুমি তো বুঝবা না আমাকে। তুমি দাদাজান মহুয়া তোমরা কেউ আমাকে বোঝে না। সবাই খালি রিদওয়ানকে বোঝে। তুমি যে কষ্টে জীবন কাটাইলা সেই একই কষ্টের মধ্যে আমাকে ফেললা। মা হয়ে কেমনে পারলা মা? রিদওয়ানও আমার সাথে ছলনা করলো। তোমরা সবাই মিলে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলা। আমি তোমাদের কোনদিন মাফ করবো না মা, কোনদিন না। আজ থেকে আমাকে ভুলে যাইয়। মনে কইরো শায়লা নামে তোমাদের কোন মেয়ে ছিলো না।”
রুবিনা পাগলের মতো ‘শায়লা শায়লা’ করছে কিন্তু শায়লা শুনলো না। সে ফোন কেটে দিয়েছে। তার হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস হৃদয় ভাঙার শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। না হলে আজ এই হোস্টেলরুমে প্রলয় হতো। শায়লা হাহাকার করে কাঁদে। বৃহস্পতিবার রাত বলে তার রুমের বাকীরাও নেই যে শায়লাকে সামলে নেবে সান্তনা দেবে। শায়লা হুহু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদে মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতে রাগ ওঠে ওর। কেন কাঁদছে ও? কার জন্য? ওই প্রতারকের জন্য? কেন পাচ্ছে ও রিদওয়ানের জন্য? কেন? আজ থেকে আর কষ্ট পাবে না। একদম না। সব কষ্ট থেকে চিরমুক্তি নেবে সে। লাইট জ্বালিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে আতিপাতি করে কিছু খুঁজে চলেছে শায়লা।

ওদিকে শায়লা ফোন রাখার পর থেকেই রুবিনার মনটা ছটফট করছে। শায়লাকে আজ একদনই স্বাভাবিক লাগলো না। ভীষণ দূর্বল মনের এক মেয়ে মনে হয়েছে। সে জানে শায়লা মনের দিক দিয়ে অনেক শক্ত দেখালেও তার মনটা কাঁদামাটির মতোই নরম। স্বভাবে অনেক চাপা সহজে কাউকে মনের কথা বলতে পারে না। সেই মেয়ে আজ কতো কথা বলে গেলো। ভীষণ চিন্তায় রুবিনার শরীর ঘামছে। মেয়েটা আবার কোন পাগলামি না করে। থাকতে না পেরে মহুয়াকে ফোন দিলো। রাত জেগে পড়ালেখা করে মহুয়া হয়তো এখনো জেগেই আছে। মায়ের ফোন দেখে অবাক হলো মহুয়া। তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করলো-“হ্যালো মা, কি হয়েছে? এতো রাতে ফোন দিলে? দাদুর শরীর ঠিক আছে? তুমি ঠিক আছো?”
“আমরা ঠিক আছি মহুয়া কিন্তু শায়লার জন্য চিন্তা হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে আমাকে ফোন দিয়ে কিসব উল্টো পাল্টা বললো তারপর ফোন কেটে দিলো। এখন ওর ফোনে ফোনও ঢুকছে না। তুই একটু দেখবি?”
মহুয়া বিরক্ত হলো। এই বড়পাটা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। সে জানতে চাইলো-“এতো রাতে?”
“হুম। সেজন্যই তো চিন্তা হচ্ছে।”
“আচ্ছা, কি বলেছে ও? ভাইয়াও আজ আমাকে ফোন দিলো। বললো, ও নাকি দেখা করতে গেছিল অথচ দেখা না করে ফিরে এসেছে। ভাইয়া তো ভয়ে ওর কাছেও যায় না কি না কি মনে করবে এই ভয়ে।”
রুবিনার এবার সত্যিই মন ছটফট করছে। সে চঞ্চল গলায় বললো-“সেটাই তো। আমার মনেহচ্ছে কি রিদওয়ান দেশের বাইরে যাচ্ছে দেখে ওর মাথা নষ্ট হয়েছে। যতই মুখে বলুক ও হয়তো রিদওয়ানকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।”
“সে তো ওর বহু আগে থেকেই করা উচিত ছিলো মা। ও একটা গাধী বলেই ভাইয়াকে পাত্তা দেয় না।”
রুবিনা ভ্রু কুঁচকে আছে। মহুয়ার কথা শুনেও শুনলো না। তার কানে শায়লার কথা বাজছে। আজ শায়লার কথা অন্যরকম লেগেছে। চিন্তিত হয়ে রুবিনা বললো-“শোন, আমার কেন যেন ভালো লাগছে না। শায়লার কথাগুলো এলোমেলো ঠেকেছে। ও বলেছে রিদওয়ানের নাকি কোন সেঁজুতিকে ভালোবাসতো।”
“কি বলছো এসব মা?”
মহুয়া চেচিয়ে উঠতেই রুবিনা বললো-“আমিও তোর মতো চেচিয়েছি। ও রাগ করে ফোন কেটে দিয়েছে। এখন আমার মনটা কেমন যেন করছে। তুই একটু দেখ না মা।”
মহুয়ার কপালে ভাজ পড়লো। কোমল কন্ঠে বললো-“আমি ফোন দিচ্ছি। না পেলে সকালে যাব ওর হোস্টেলে। এখন গেলে তো ঢুকতে দেবে না তাই এখন যাব না। এমনিতেও আর তিন চার ঘন্টাই আছে সকাল হতে। তুমি শান্ত হও মা। আপুর ওখানে যেয়ে ফোন দেব তোমাকে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।”
রুবিনা ঘুমালো না। ওজু করে তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়ালো মেয়ের জন্য দোয়া করতে।

মহুয়া বারকয়েক ফোন দিলো কিন্তু শায়লার ফোন আনরিচেবল দেখাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ফোন রাখলো। সকালে বোনের কাছে যাবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো তখনি। তিনঘণ্টা ঘুমিয়ে সাতটার দিকেই শায়লার হলে চলে এলো সে। মহুয়াকে চিনলেও এতো সকালে ঢুকতে দিতে চাইলো না সিকিউরিটি। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর রাজি হলো। বোনের রুমের সামনে অনেকক্ষণ ডাকাডাকির ওরেও দরজা না খোলায় ভয় পেয়ে গেলো মহুয়া৷ এমনটা কখনো হয় না। ও দরজায় আঘাত করে চেচিয়ে ডাকতে শুরু করলো বোনকে। আওয়াজে বিরক্ত হয়ে আশেপাশের কক্ষের ছাত্রীরা উঁকি দিলো। জানতে চাইলো এতো সকালে এমন আওয়াজের কারণ কি। মহুয়া ওদের সবকিছু বলে সাহায্য চাইলো। কয়েকজন মিলে ডাকাডাকির পরও দরজা না খোলায় দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো ওরা। একসময় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলো। রক্তে রন্জিত শায়লাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিলো মহুয়া। এ কি করেছে শায়লা? এখন তার মাকে কি বলবে সে? ডুকরে কেঁদে উঠলো মহুয়া। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েগুলোও বোকা সেজে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে একজন ছুটলো হোস্টেল সুপারকে ডাকতে। মহুয়ার শরীর কাঁপছে থরথর। এরইমধ্যে ওর মনে হলো আর কাউকে না হোক একটা ফোন করতেই হবে। এই অবস্থায় তার কোথাও যাওয়া চলবে না।
কাঁপা কাঁপা হাতে রিদওয়ানের নাম্বারে ডায়াল করলো মহুয়া। রিং বাজতেই বুকটা ধরাস ধরাস শুরু করলো। কিভাবে বলবে কথাগুলো?

চলবে—
©Farhana_Yesmin