#এরই_মাঝে
#পর্ব-৫১
বিকেলে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হয়নি শায়লার। খেতে খেতে বিকেল হলো। তারপর সব গুছিয়ে উঠতে উঠতে সন্ধার মুখে বাড়িওয়ালা আন্টি আর আঙ্কেল এসে হাজির। রিদওয়ানের বাবা মা আসার খবর শুনে আলাপ করতে এসেছে ওরা। ওয়াহেদ আর জাকিয়া অতিথির সাথে গল্প করতে বসলে শায়লা গেলো চা বানাতে। ওদের চা নাস্তা দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখলো রিদওয়ান শুয়ে আছে। ওকে দেখে অভিমানি কন্ঠে সুধায়-“সারাদিন ঘরেই ঢুকলে না?”
শায়লা ল্যাপটপ টেবিলে রেখে ঘুরে রিদওয়ানকে দেখলো-“পলি আন্টি আর আঙ্কেল এসেছেন আপনার বাবা মায়ের সাথে পরিচিত হতে। ওনাদের চা নাস্তা দিয়ে এলাম।”
রিদওয়ান শায়লার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো-“খুব দেখি সংসারী হয়ে যাচ্ছ শায়লা।”
শায়লা বিছানায় এসে বসলো-“না হয়ে উপায় আছে?”
রিদওয়ান মোবাইল রেখে শায়লার দিকে ফিরে বললো-“দেখতো জ্বর আছে কিনা?”
শায়লা রিদওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। জ্বর দেখানোটা বাহানা কিনা যাচাই করতে চাইছে। রিদওয়ান যেন ওর মনের হাল বুঝতে পারলো। মলিন হেসে বললো-“বাহানাটা আমার না করে তোমার করা উচিত ছিলো। আমার জ্বর এই বাহানায় তুমি বারবার আমার কপাল আর বুক ছুঁয়ে দেবে। তা না করে আমায় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছো।”
শায়লা হেসে দিলো-“অসুস্থতার সুযোগে দুষ্ট হয়েছেন নাকি আগে থেকেই দুষ্ট আপনি?”
রিদওয়ান খর চোখে চেয়ে থেকে বললো-“তোমার কি মনেহয়?”
“অসুস্থতার সুযোগ নিচ্ছেন।”
শায়লার কথা শুনে রিদওয়ান আফসোসের সুরে বললো-“দুষ্টামি দেখানোর সুযোগ পেলাম কোথায় বলো? সারাক্ষণ তোমার রাগী ফেস দেখতে দেখতে আমিও অমন হয়ে গেছি।”
শায়লা জবাব না দিয়ে আলতো হাতে রিদওয়ানের কপাল ছুঁয়ে দিলো। অনেকটা সময় হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বললো-“আবার জ্বর আসছে নাকি? সারাদিন তো ভালোই ছিলেন।”
রিদওয়ান ক্লান্ত গলায় উত্তর দিলো-“আমার জ্বরের ধারা এমনই। রাতে জ্বর বাড়বে। জ্বর খুব কম হয় আমার হলে খুব ভোগায়।”
“কি করবেন? ওষুধ দেব?”
“উহু, চুমু দাও। আমার শরীরের কিছু উষ্ণতা তোমার শরীরে ট্রান্সফার করি।”
শায়লার গাল লাল হলো। কান দিয়ে উত্তাপ বেরুচ্ছে। সে লাজুক স্বরে জবাব দিলো-“খুব অসভ্যতা হচ্ছে কিন্তু?”
রিদওয়ান সরু নয়নে শায়লাকে দেখতে দেখতে বললো-“ভদ্রলোক হয়ে থেকে দেখলাম অনেক। তুমি কিছুতেই পটছো না। এবার অসভ্য লোক হয়ে দেখি কাজ হয় কিনা। এসো একটা চুমু দাও।”
রিদওয়ান নিজের মুখটা এগিয়ে দিলো। শায়লা শরমে ছটফটিয়ে উঠলো। ছেলেটা শুরু করেছে কি? তার রাগ ওঠার কথা অথচ হচ্ছে উল্টোটা। মজা লাগছে রিদওয়ানের কাজ। নিজেরও খানিকটা দুষ্টামি করতে মন চাইছে। কিন্তু অনভ্যস্তায় কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। রিদওয়ান তাড়া দিলো-“কি হলো? দাওনা চুমু।”
শায়লা লাজুক দৃষ্টি মেলে রিদওয়ানের বাড়িয়ে দেওয়া ওষ্ঠের দিকে নজর দিলো। জ্বরের প্রকোপে অধরদ্বয় শুকনো হয়ে আছে। শায়লা ঢোক গিললো। কাল ঝোঁকের বসে রিদওয়ানকে চুমু দিয়ে ভুল করে ফেলেছে। এখন সেই ভুলের দ্বন্দনি দিতে হবে ভেবেই মাথার চুল ছিড়তে মন চাইছে। শায়লা ভাবলো হালকা ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সরে আসবে। সেই ভেবেই এগিয়ে এসে হালকা করে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। কিন্তু সরে আসার আগেই রিদওয়ান দু’হাতে ওর কোমড় চেপে ধরে অধরে অধর মিলিয়ে দিয়ে গাঢ় চুম্বনে লিপ্ত হলো। হতবিহ্বল শায়লা রিদওয়ানের জ্বরে তপ্ত মুখের স্পর্শে কেঁপে উঠলো। না চাইতেও রিদওয়ানের মাথার চুল টেনে ধরলো নিজের অজান্তেই। অনুভুতির চোরা স্রোত ওকে ভাসিয়ে নিচ্ছে অন্য জগতে। কিছুক্ষণ পরেই ওর ঠোঁটে সুই ফোঁটার মতো ব্যাথা বোধ হলো। রিদওয়ান আচমকা ওকে ছেড়ে দিয়ে দুষ্ট হেসে বললো-“চুমু এভাবে দিতে হয় বোকা মেয়ে।”
শায়লা বোকার মতো হা করে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দু’টো জ্বলছে রীতিমতো। দরজার ওপাশে জাকিয়ার ছায়া দেখে নড়ে উঠলো শায়লা। রিদওয়ান তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে শুতে শুতে ফিসফিস করলো-“মুখ বন্ধ করো মেয়ে নইলে মা বুঝে ফেলবে তুমি পঁচা কাজ করছিলে।”
শায়লা অতি দ্রুত ঠোঁট কামড়ে ধরলো। জাকিয়া রুমে ঢুকে অদ্ভুত নয়নে দু’জনকে জড়িপ করে শায়লাকে কড়া গলায় ডাকলো-“তোমাকে ডাকছে ওরা।”
সুযোগ পেয়ে শায়লা ছুটে পালালো। জাকিয়া ছেলের কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলো-“রিদু, ঘুমিয়েছিস?”
রিদওয়ান আড়মোড়া ভাঙার ভাব করলো। চোখ বুজেই জবাব দিলো-“না মা। জ্বর ফিরে আসছে আবার। চোখ জ্বালা করছে তাই চোখ বুজে শুয়ে আছি।”
“হুট করে জ্বর বাঁধালি কেন?”
“আমি বাঁধাইনি মা। কয়েকদিন হাসপাতালে খুব চাপ যাচ্ছিল সেই জন্য হয়তো।”
জাকিয়া ছেলের মাথার কাছে বসলো-“গত একমাসে একবারও ঢাকায় যাসনি রিদু। মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না তোর?”
রিদওয়ান জবাব দিলো না। জাকিয়া হতাশ গলায় বললো-“একটা মেয়ের জন্য নিজের মাকে পর করে দিচ্ছিস?”
রিদওয়ান চোখ খুলে মাকে দেখলো। ওর চোখ দুটো লাল হতে শুরু করেছে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও উঠে বসে মায়ের হাত মুঠোয় নিলো-“ওই মেয়েটা আমার বউ মা। বিয়েটা দাদাজান জোর করে দিলেও পরে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি মা। মেয়েটা একটু অবুঝ আর বোকা এছাড়া আর কোন দোষ নেই ওর। দাদাজান ভরসা করে আমার উপর শায়লার দায়িত্ব দিয়েছেন ওনাকে নিরাশ করবো না কখনোই। তুমিও শায়লাকে মেনে নাও মা। তোমার ছেলের সুখ জড়িয়ে আছে ওর সাথে। শায়লা ভালো থাকলে আমি ভালো থাকবো। যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝবে তত তাড়াতাড়ি তোমার আমার দুরত্ব কমবে। আমি যেমন তোমার ছেলে তেমন শায়লার স্বামী। তোমরা দু’জনই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শায়লা কম বয়সী বুঝ কম ওর কিন্তু তুমি তো বুঝদার। সেইরকম আচরণ করো তুমি।”
জাকিয়ার চেহারায় কঠোরতার আভাস দেখে রিদওয়ান মোলায়েম স্বরে বললো-“সংসার তো যুদ্ধের ময়দান না মা আর শায়লাও তোমার প্রতিদ্বন্দি না তাহলে কেন এমন আচরণ করছো? শুধুমাত্র দাদাজান ওকে পছন্দ করেছে সেই কারণে? একজন বৃদ্ধ মানুষ সম্পর্কে তোমার শশুর তাও আবার মৃত তার প্রতি সামান্য শ্রদ্ধা দেখালে তুমি ছোট হবে না মা। আমাদের ছোট জীবনে এতো জেদ রেষারেষি এগুলো কি খুব জরুরি মা?”
জাকিয়া চুপ করে রইলো। মনটা তেতো হলেও রিদওয়ান অসুস্থ বলে কথা বাড়াতে মন চাইলো না। কিছুক্ষণ পর শুষ্কো গলায় বললো-“তুই শুয়ে থাক। জ্বর তো ধেয়ে আসছে। তোর বাবাকে বলছি একটু কমলা কিনে আনতে। কমলা খেলে শরীর ভালো লাগবে তোর।”
রিদওয়ানের সত্যিই খারাপ লাগছিল বলে মায়ের কথা মেনে শুয়ে পড়লো। বাইরে এসে ওয়াহেদকে পাওয়া গেলো না। সে নাকি বাড়িওয়ালার সাথে গেছে। জাকিয়া ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে কমলা কিনে আনার আদেশ দিলো। শায়লাকে বললো ড্রাইভার কমলা নিয়ে এলে রিদওয়ানকে যেন জুস করে দেয়। ঘরে ফিরে এসে পল্লবীকে ফোন দিলো।
ওদিকে শায়লার মনের ভেতর উথাল পাথাল হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে রিদওয়ান আর জাকিয়ার কথোপকথন শুনে ফেলেছে সে। তারপর থেকেই তার বুকে ঝড় বইছে। রিদওয়ানকে কি ও বরাবরই ভুল ভেবেছে? বরাবর রিদওয়ানকে আন্ডার এস্টিমেট করেছে, একতরফা জাজ করেছে। অথচ এতোকিছুর পরেও রিদওয়ান এখনো চোখ বুজে ওর কথা ভাবছে। ওর জন্য নিজের মায়ের সাথেও ঝগড়া করছে। শায়লার কান্না পেয়ে গেলো। এতোদিন সে রিদওয়ানের প্রতি অন্যায় করে গেলো। নিজের বাবার কর্মের সাজা রিদওয়ানকে দিলো। অপরাধবোধে মনটা ছটফট করে উঠলো।
কমলার জুস বানিয়ে রুমে গেলো শায়লা। রিদওয়ান শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। জ্বর বেড়েছে বলে স্বস্তি পাচ্ছে না। শায়লা সামনে গিয়ে ডাকলো-“শুনছেন, একটু জুস এনেছি খাবেন?”
রিদওয়ান উঠে বসলো-“ভাবছি গোসল করে ফেলবো। জ্বরে গা পুড়ছে। তুমি কি বলো?”
জবাব পাওয়ার আশায় শায়লার দিকে তাকিয়ে আছে রিদওয়ান। শায়লাও তাকিয়ে আছে। নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখছে তাকে। রিদওয়ান চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো-“কি হলো? কি দেখছো?”
শায়লা আচমকা ঝাপিয়ে পড়ে রিদওয়ানকে জড়িয়ে ধরলো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দিলো।
চলবে—
#এরই_মাঝে
#পর্ব-৫২
রোগা শরীরের রিদওয়ান হতচকিত হলো। শায়লার কান্নার কারণ বুঝলো না। বিরক্ত হলো কিছুটা তবুও ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল গলায় জানতে চাইলো-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? মা বকেছে?”
শায়লা রিদওয়ানের কাঁধে মুখ লুকিয়ে মাথা নাড়ে।
“তাহলে?”
শায়লা তবুও কথা না বলে কেঁদে যাচ্ছে। রিদওয়ানের কাঁধের জায়গাটা শায়লার চোখের জলে ভিজে একাকার। জ্বরের শরীরে সে ছটফটিয়ে উঠলো-“তাহলে বলবে তো কি হয়েছে? না বললে জানবো কি করে কি হয়েছে?”
শায়লা নাক টেনে কাঁধ থেকে মুখ তুললো। রিদওয়ানের চোখে চোখ রাখে। চোখ দুটোতে রাজ্যের অস্থিরতা। শায়লা অবিচল গলায় মৃদুস্বরে বললো-“আপনি এতো ভালো কেন বলবেন? এতো ধৈর্য্য ধরে আছেন কেন আমার সাথে? আমি তো কখনোই আপনাকে বুঝিনি। এমনকি বোঝার চেষ্টাও করিনি। তবুও কি করে আমাকে এখনো এতোটা ভালোবাসতে পারেন?”
এতোক্ষণে যেন সব বুঝতে পারলো রিদওয়ান। মনে খানিকটা আনন্দ দোলা দিয়ে গেলো। অবশেষে শায়লা কি তাকে বুঝলো? তার এতোদিনের ধৈর্য্যের ফল কি পেতে চলেছে সে? কিন্তু এতো সহজে কি মেনে নেওয়া যায়? শায়লা সত্যিই তাকে বুঝেছে কিনা তা যাচাই করতে হবে তো? রিদওয়ান মৃদু হাসলো-“ভালোবাসি বলেই তো ধৈর্য্য ধরে পাশে থাকতে পেরেছি। কিন্তু কেন এতো ভালোবাসি তা জানি না। ওসব বাদ দাও, তুমি আমাকে বলো আজ হঠাৎ এসব কথা উঠলো কেন? আমার ভালোবাসা না বাসায় তোমার কি আসে যায়?”
শায়লা মাথা নিচু করে রইলো কিছু সময়। যখন চোখ তুলে তাকালো ওর দুই চোখ জলে টইটম্বুর-“আমি আপনার যোগ্য না রিদওয়ান। কতোটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না বুঝে প্রতিনিয়ত। তবুও আমাকে কিছুই বলেননি।”
শায়লার চোখের পানিতে রিদওয়ানের হৃদয় টালমাটাল হলেও গলে গেলোনা, গম্ভীর মুখ করে বললো-“এখন কি বুঝেছ নিজের ভুলগুলো? শুধরে নিতে চাইছো?”
শায়লা মাথা দুলিয়ে তীব্র আকুতি নিয়ে বললো-“চাইছি, সত্যিই চাইছি। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো বলুন তো? আমি তো সব ম্যাছাকার করে রেখেছি। কি করে নিজেকে আপনার সাথে আমার সম্পর্ককে গুছিয়ে নেব? আমি আসলে বুঝতে পারছি না প্রথম স্টেপটা কিভাবে নেব?”
রিদওয়ানের পা ঝিমঝিম করছে। সে বিছানায় বসলো। শায়লাকেও ইশারায় বসতে বললো। শায়লা সাথে সাথে বসলো। আকুল নয়নে রিদওয়ানের পানে তাকিয়ে আছে সে। রিদওয়ান বললো-“বিবাহিত সম্পর্ক রক্ষা করা খুব সহজ শায়লা। এখানে একটা জিনিসই দরকার হয় তা হলো আন্তরিকতা। তুমি আন্তরিক হলে বাকীসব এমনিতেই হয়ে যাবে। আমি জানি তোমার মধ্যে স্বামী সম্পর্কে ভীতি আছে। কিন্তু এই ভয়কে জয় করাই তো আসল কাজ বলো?”
শায়লা মন লাগিয়ে রিদওয়ানের কথা শুনছে। কি সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলে ছেলেটা। শায়লা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বললো-“আমি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আন্তরিক এটা কিভাবে বোঝাব?”
রিদওয়ান হুট করে শায়লার কোলের উপরে শুয়ে পড়লো। শায়লার হাতটা নিজের মাথায় দিয়ে বললো-“আপাতত অসুস্থ স্বামীর সেবা করে দেখাও তুমি কতটা আন্তরিক। অনেকক্ষণ ধরে বকবক করে মাথা ধরে গেছে। এবার চুলগুলো আস্তে আস্তে টেনে দাও তো আমি একটু ঘুমাই। আর চোখ মেলে রাখতে পারছি না।”
শায়লা এবার সত্যি সত্যি লজ্জা পেলো। সে অবুঝ বাচ্চার মতো অসুস্থ মানুষটাকে বিরক্ত করছে দেখে নিজের উপর রাগ লাগলো। অপরাধবোধেই রিদওয়ানের কথাটা মেনে নিলো চুপচাপ। রিদওয়ানের মাথার চুল টানতে লাগলো পরম মমতায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিদওয়ানের গভীর নিশ্বাস পড়ার শব্দে বুঝলো মানুষটা ঘুমিয়ে গেছে। শায়লা ভীষণ মায়া নিয়ে ঘুমন্ত রিদওয়ানকে দেখছে। ছেলেটা যথেষ্ট সুদর্শন সন্দেহ নাই। ফর্সা ছেলেটার গাল জুড়ে কালো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি তাকে আরও সুন্দর করেছে। শায়লা আলতো হাতে রিদওয়ান পুরো মুখে হাত বোলায়। মন দিয়ে দেখতে দেখতেই সে যেন প্রথমবারের মতো নিজের স্বামীর প্রেমে পড়লো।
*****
পরদিন দুপুর একটা নাগাত রিদওয়ানের পুরো পরিবারকে বাসায় দেখে শায়লার চোখ খুলে হাতে আসার উপক্রম হলো। পল্লবী আর মাহিলা মিটিমিটি হাসছে-“কি শায়লা, কেমন চমকে দিলাম বলো তো?”
শায়লা ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেছে। সকালে জাকিয়া তাকে গেস্ট আসার কথা বলে বেশি করে রান্না করতে বলেছিল। কে আসবে জানতে চায়নি শায়লা। এখন হুট করে সবাইকে দেখে সে বিস্মিত হয়ে মাথা নাড়ে-“ভীষণ চমকে গেছি ভাবি। তোমরা সবাই এখানে আসবে কখনো ভাবিনি।”
মালিহা মুচকি হাসে-“ছোট দেবর অসুস্থ আবার দূরে সংসার পেতেছে দেখার তো একটু লোভ হয় বলো?”
পল্লবী সায় জানায়-“তার উপর যদি সেই দেবরের জন্মদিন হয় তাহলে তো কথাই নেই। সুযোগ পেতে দেরি আমাদের আসতে দেরি নেই। তাই নারে মালিহা?”
“তুমি জানো শায়লা মা তার ছোট ছেলের জন্মদিন কখনো মিস দেয়না। জন্মদিনের দিন যত কাজই থাকুক রিদুটাকে মায়ের কাছে থাকতেই হবে। কিন্তু এবার তো রিদু মায়ের কাছে যাবে না কিছুতেই। মা কি করবে তাই ভাবছিলাম। পরে রিদুর জ্বরের খবর শুনে সুযোগ পেয়ে মা বাবাকে নিয়ে চলে এসেছে আগেভাগে।”
মালিহার কথা হা করে গিলছে শায়লা। ওদের আসার রহস্য এতোক্ষণ পরিস্কার হলো তার কাছে। বাবু মশাইয়ের জন্মদিন বলে কথা। দ্বিতীয়বারের মতো রিদওয়ানে মুগ্ধ হলো শায়লা। ছেলেটা ওর জন্য নিজের জন্মদিনে মায়ের আশির্বাদ নেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত ত্যাগ করতে রাজি। কতটা ভালোবাসা থাকলে এমন কিছু করা যায়? শায়লা কিছু ভাবার অবকাশ পায় না পল্লবী ওর হাত টানে-“কি ভাবছিস শায়লা?”
“ওনার জন্মদিন কবে আপু?” বলেই ভীষণ লজ্জা পেলো শায়লা। বিয়ের এতোগুলা দিন পার হলো আর সে কিনা বরের জন্মদিন জানে না। পল্লবী আর মাহিলা দু’জনেরই চোখ ছানাবড়া-“বলিস কিরে? বরের জন্মদিন জানিস না?”
শায়লা মাথা নিচু করে রইলো। পল্লবী হা করে করে তাকিয়ে ছিলো। মালিনা বললো-“ভাবি, এইজন্যই রিদওয়ান ওর জন্য এতো পাগল বুঝলে। আমরা আমাদের স্বামীদের পাত্তা দেই বলেই আমাদের ওরা পাত্তা দেয় না।”
পল্লবী সায় জানালো-“ঠিকই বলেছিস মালিহা। শায়লা তুই ঠিক আছিস। কি দরকার স্বামীর জন্মদিন জানার। এভাবেই তো রিদওয়ান তোর জন্য দিওয়ানা।”
শায়লা কাতর নয়নে তাকালো, পল্লবীর হাত ধরে মিনতি করলো-“প্লিজ ভাবি বলো না কবে ওনার জন্মদিন? আজ নাকি কাল?”
“জেনে আর কি হবে? সারপ্রাইজ দেওয়ার সময় শেষ।”
মাহিলা চোক টিপে দিলো পল্লবীকে। শায়লা অসহায় হয়ে দুই জনকে দেখছে-“তোমরা এতো খারাপ? আমাকে অসহায় পেয়ে মজা নিচ্ছ?”
পল্লবী গম্ভীর হলো-“তুইও আমার দেবর বেচারাকে দৌড়ের ওপরে রেখে মজা নিয়েছিস এতদিন। শোন, অতো কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। রিদওয়ানের জন্মদিন কবে সেটা তোকে বলবে তবে শর্ত আছে।”
“কি শর্ত ভাবি?”
“আমার দেবরের এবারের জন্মদিনটা স্পেশাল করে দিবি এই শর্তে বলবো।”
শায়লার না বুঝে মরিয়া হলো-“স্পেশাল করবো কি করে?”
পল্লবী আর মালিহা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হাসলো। পল্লবী আফসোসের সুরে বললো-“দেখো মেয়ের কথা। বিয়ের এতোদিন পরে এসে এই কথা? ভালো মতো সংসার হলে এতোদিনে তোর কোলে বাচ্চা থাকতো শায়লা।”
শায়লা এবার লজ্জা পেয়ে মুখ লুকালো। পল্লবী কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটাও কিছুটা গোচরে আসলো। সে ছুটে রান্নাঘরের দিকে পালাতে চাইলে মাহিলা ওর হাত ধরলো-“উহু, আজ পালাতে দেব না তোকে। এই ভাবি, এককাজ করবো, আমরাই এবার ওদের অফিসিয়াল বাসর সাজিয়ে দেব আর এই নাবালিকাকে বউ। কি বলো তুমি?”
পল্লবীর মুখ উজ্জ্বল হলো, উচ্ছাস নিয়ে বললো-“ভালো বুদ্ধি মালিহা। রিদুর এবারের জন্মদিনে এটাই সারপ্রাইজ হবে ওর জন্য।”
দু’জনার গল্প শুনে শায়লা পারলে মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যায়। পারছে না বলে হাত মোচড়াচ্ছে ছাড়ানোর জন্য। তার মুখ চোখ লালচে রং ধারন করেছে। সে লাজুক স্বরে বললো-“ভাবি ছাড়ো আমাকে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে খাবারের আয়োজন করি।”
পল্লবী মুচকি হেসে বললো-“চল আমরাও যাচ্ছি। তোকে দুইদিন একা ছাড়বো না কিছুতেই। এই দুইদিনে তোকে শিখিয়ে পড়িয়ে আমার দেবরের রোমান্টিক বউ বানিয়ে দিয়ে যাব। কি বলিস মালিহা?”
“একদম ভাবি। ওকে এমন ভাবে স্বামীকে ভালোবাসতে শেখাব যে আমাদের রিদু যেন বলে, ভাবিরা তার বউকে মানুষ করতে পেরেছে।”
দু’জনের দুষ্ট মিষ্টি অত্যাচার সইতে না পেরে শায়লা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো- “ভাবি, ভালো হচ্ছে না কিন্তু?”
পল্লবী আর মালিহা উচ্চস্বরে হেসে দিলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin