#এরই_মাঝে
#পর্ব-৫৩
কথায় আছে ‘যদি হয় সুজন তেতুল পাতায় নয় জন’। কথাটার সত্যতা এই দুই দিনে ভালোমতো টের পেলো শায়লা। শায়লা ভয় পাচ্ছিলো এতো ছোট বাসায় কি করে এতোগুলো মানুষ থাকবে। ওরা খোলামেলা থেকে অভ্যস্ত চাপাচাপি করে থাকতে পারবে তো? অথচ ওর ভয়কে ধুলোয় মিশিয়ে ওরা হাসি আনন্দে দু’টো দিন কিভাবে কাটালো টেরই পেলো না। গত কাল রাত বারোটায় ঘটা করে রিদওয়ানের জন্মদিন পালন করা হলো। জন্মদিন উপলক্ষে কেকও কাটলো। সে এক আনন্দময় মুহুর্ত। বাবা মায়ের মাঝে দাঁড়িয়ে কেক কেটে ছেলেটা বাচ্চাদের মতো খুশি জাহির করেছে। সবাই এটা সেটা গিফট দিলো তখনও রিদওয়ান হাসি মুখে গিফট নিলো। শায়লা দেখেছে আর অবাক হয়েছে। এ কোন রিদওয়ানকে দেখছে সে? দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ ছেলেটাও এরকম বাচ্চাদের মতো করতে পারে?
আজ বিকেলে সবাই ঢাকায় ফিরে যাবে। ঠিক হয়েছে দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই সেজেগুজে ছাদে যেয়ে সবাই মিলে ছবি তোলা হবে। রাতে দেরিতে ঘুমানোর কারণে সবার ঘুম ভেঙেছে বেলা করে। তাই সকালের ব্রেকফাস্ট স্কিপ করে ব্রান্চ করতে বসেছে সবাই। মেন্যু হলো খিচুড়ি গরুর মাংস আর ইলিশ মাছ ভাজা। রিদওয়ান ক’দিন একদমই খেতে পারেনি। আজ খিচুড়ি দেখে নিজ থেকে খেতে বসেছে। জাকিয়া ভাত মাখিয়ে ছেলেকে খাইয়ে দিতে কল্লোল আর আসাদ গাল ফুলিয়ে বললো-“আমরা কি দোষ করেছি মা? আদর কি খালি রিদু পাবে?”
জাকিয়া হেসে বাকি দু’জনের মুখেও খাবার দেয়। বিয়ের পর এই প্রথম জাকিয়ার মা সুলভ আচরণ শায়লার নজরে এলো। দেখে মজাও পেলো। ওয়াহেদ এই মজার দৃশ্যে ঘি ঢেলে বলে উঠলো-“জাকিয়া, তোমার হাত থেকে খাওয়ার অধিকার আমারও আছে। বরং বলা যায় এই অধিকার আগে আমারই তারপর ওদের। কিন্তু তুমি চক্ষুশুলের মতো আচরণ করে আমাকে একবারও সাধলে না। ভেরি ব্যাড জাকিয়া।”
বাবার কথা শুনে ছেলেরা হইহই করে উঠলো। রিদওয়ান বললো-“মা, বাবাকেও খাইয়ে দাও তো। না হলে আমাদের আবার পেট খারাপ হবে।”
কল্লোল আর আসাদ রিদওয়ানের কথায় সায় জানাল। জাকিয়া রীতিমতো লজ্জা পেয়ে চোখ দিয়ে শাসন করতে চাইলো ওয়াহেদকে। ওয়াহেদ তার চোখ রাঙানি পাত্তা না দিয়ে বললো-“তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও জাকিয়া। এই সুযোগে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন হোক। সেই চল্লিশ বছর আগে বিয়ের পর পর তুমি খাইয়ে দিতে। কি দিন ছিলো বলো তো?”
জাকিয়া না পারতে মুখ ঝামটা দিলো-“কি শুরু করলে ওয়াহেদ? বাচ্চাদের সামনে এসব বলতে হবে?”
ওয়াহেদ নিপাট ভালো মানুষের মতো মুখ করলো-“কি শুরু করলাম? ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে। দাদা দাদী হয়ে গেছি এখন আবার কিসের লজ্জা? দাও মুখে খাবার দাও দেখি?”
বাধ্য হয়ে জাকিয়া ওয়াহেদের মুখে খাবার দিলো। ওয়াহেদ চোখ বুজে সেই খাবার চাবিয়ে যাচ্ছে। চোখ খুলে বললো-“সেই পুরনো স্বাদ পেলাম জাকিয়া। তোমার হাতের খাবার মানেই অমৃত।”
জাকিয়া লজ্জা পেয়ে কিশোরীর মতো নতজানু হয়। ছেলেরা আর বউরা মুখ টিপে হাসি সামলে নিতে চাইছে। ওদের সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে ওয়াহেদের কান্ডে। ওয়াহেদ চোখ তুলে ধমক দিলো-“তোমাদের কি সমস্যা? যারা যার বউদের কাছ থেকে খাও। আমার বউকে বিরক্ত করো না। এটা আমার ভাগের খাবার আমিই খাবো।”
রিদওয়ান হো হো করে হেসে দিলো সাথে বাকি সকলে। জাকিয়া রেগে মেগে খাবার রেখে উঠে গেলো। ওয়াহেদ প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে জাকিয়ার রাগ ভাঙাতে তার পিছু নিলো। রিদওয়ান শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বললো-“দেখেছ প্রেম ভালোবাসা কেমন হয়? শেখো কিছু শাশুড়ীর কাছ থেকে।”
শায়লা মুখ ভেংচি দিলো-“আপনিও কিছু শিখুন বাবার কাছ থেকে।”
****
খাওয়া পর্ব শেষে মেয়েরা তৈরি হতে বসলো। পল্লবী শায়লাকে একটা লাল সিল্ক শাড়ী ধরিয়ে দিলো-“তুই এটা পর শায়লা। সেম শাড়ী পরবো আমরা তিনজন তবে কালার আলাদা হবে।”
শায়লা ইতস্তত করে। বিয়ের পর একবারই শাড়ী পরেছিল সেটা হলো কুয়াকাটা যেয়ে। সেই স্মৃতি মনে করেও শায়লা লজ্জা পেলো। কতরকম বাচ্চামো করে রিদওয়ানকে জ্বালিয়েছে সে? নিজের উপর বিরক্তি আসে এসব মনে এলে। শায়লা আনমনা হয়ে ভাবতে বসেছিল কিন্তু পল্লবী তাড়া দিলো। শাড়ী পরা হতেই পল্লবী আর মালিহা মিলে তাকে সাজিয়ে দিলো। সবশেষে সন্তুষ্ট চিত্তে ওকে দেখলো দু’জন। মালিহা মুখ টিপে হাসলো-“আজকে রিদুর খবর আছে। কি বলো ভাবি?”
“তা আর বলতে? ওর জ্বর কেটে গেছে, আজ দূর্বলতাও কেটে যাবে দেখবি।”
বলেই দু’জন মুখ টিপে হাসলো। হুট করে মালিহা সিরিয়াস মুখ করে বললো-“এই শায়লা, তুই রিদুকে কি গিফট দিলি বলতো?”
শায়লা আড়ষ্ট হয়ে গেলো। কোন গিফট কেনার কথা মনে ছিলো না তার। অনলাইনে একটা অর্ডার করেছে তাও সেটা আজ পাবে কিনা কে জানে। কিছু না দেওয়ার লজ্জায় শায়লার মুখ থেকে কথা বেরুল না। মালিহা শায়লাকে বুঝে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো-“সবচেয়ে বেস্ট গিফট কি হবে জানো?”
পল্লবী এসে শায়লার কানে ফিসফিস করলো-“তুই নিজেকে নববধুর মতো সাজিয়ে রিদুর সামনে দাঁড়ালে সেটাই হবে রিদুর জীবনের বেস্ট গিফট। তুই রিদুকে বেস্ট গিফট দিতো চাস কিনা সেটা তোর ইচ্ছে শায়লা।”
শায়লা মাথা দুলায়। কথাগুলো কান গরম করার মতো হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। বউ সাজবে কি সাজবে না তা জানে না শায়লা। তবে কাল থেকে রিদওয়ানকে নির্জনে পেতে খুব মন চাইছে। ওকে ভালোমতো জন্মদিনের উইশটাও করা হয়নি। সে কথা মনে করে শায়লার মন অশান্ত হলো পুনরায়।
ছাদে যাওয়ার তাড়া এলো। সবাই উঠে গেছে ওরা তিনজন বাকী। রিদওয়ান ওদের ডাকতে এলো। শায়লা রুম থেকে বেরুতেই রিদওয়ানের সাথে ধাক্কা খেলো।
“উফফ, চোখ কোথায় থাকে তোমার? কতো জোর ব্যাথা…পে…”
রিদওয়ান কথা শেষ করতে পারে না। তার বিস্মিত নজর ঘুরছে শায়লার আপাদমস্তক। সে বিরবির করলো-“শায়লা! তুমি?”
শায়লা সংকোচ নিয়ে মাথা দুলায়-“হুমম, আমি।”
রিদওয়ান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে ঘোর লাগা কন্ঠে সুধায়-“ইউ লুক স্টানিং ইন শাড়ী।”
রিদওয়ানের প্রশংসা শুনে মিইয়ে গেলো শায়লা। যদিও রিদুওয়ানের প্রশংসা তার ভীষণ ভালো লাগছে কিন্তু সেই সাথে লজ্জাও লাগছে। সে মৃদুস্বরে উত্তর দিলো-“থ্যাংকস।”
রিদওয়ান দুই ঠোঁট চেপে তার চারপাশে ঘুরলো তারপর কৌতুক করে বললো-“সেদিনের মতো আজও অজ্ঞান হয়ে যাবে নাকি শায়লা?”
মেয়েটা চমকে রিদওয়ানকে দেখলো। ওর গাল দুটো রং বদলাতে দেখে রিদওয়ানের মন চাইলো ছুঁয়ে দিতে। খানিকটা ঝুকেও এলো কিন্তু তার সুপ্ত ইচ্ছা পূরণ করার আগেই পল্লবী আর মালিহা আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো-“এর আগেও বুঝি শায়লাকে অজ্ঞান করেছিলি রিদু?”
রিদওয়ান দুই ভাবিকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পিছু হটলো-“তো তো তোমরা এতোক্ষণ কোথায় ছিলে ভাবি?”
পল্লবী রিদওয়ানের কান ধরলো-“তোর চোখের সামনেই ছিলাম রিদু কিন্তু বউয়ের থেকে নজর সরালে না আমাদের দেখবি।”
রিদওয়ান মাথা চুলকায়-“ছাড়ো ভাবি কানে লাগছে।”
“ছাড়বো, তার আগে বল শায়লাকে অজ্ঞান করেছিলি কবে? এই শায়লা কবে হয়েছিল এসব? তোরা দুটিতে দেখি ছুপা রুস্তম।”
শায়লা মিনমিন করলো-“তেমন কিছু না ভাবি। তোমরা ভুল বুঝছো।”
“আমরা ভুল বুঝছি?”
পল্লবী চোখ কপালে তুলে জানতে চাইলো। শায়লা কিছু না বলে দৌড়ো পালালো। ওরা উচ্চস্বরে হেসে দিতে রিদওয়ানও কেটে পড়লো।
ছাদে নানারকম পোজে ছবি তোলা হলো। সবাই মিলে ছবি তোলার পর জাকিয়ারা গেলো বাড়িওয়ালার থেকে বিদায় নিতে। এই সুযোগ রিদওয়ান আর শায়লার কিছু ফটোসেশান হলো।ওরা বিদায় নিলো শেষ বিকেলে। রিদওয়ান ওদের এগিয়ে দিতে নিচে নেমে গেলো। বাবা মা চলে যাওয়ার পর পথে এক কলিগের সাথে দেখা হলো। তার সাথে গল্প করে ফিরতে সন্ধ্যা নামলো। নিজের ফ্লাট অন্ধকার দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। দরজা আঁটকে শায়লাকে ডাকলো কয়েকবার কিন্তু সাড়া পাওয়া গেলোনা। রিদওয়ান বাতি জ্বালিয়ে শায়লাকে খুঁজে না পেয়ে বেডরুমের দরজা খুলতেই ওর পা থমকে গেলো। এই ভর সন্ধ্যায় ড্রিম লাইটের আলোয় নিজের বিছানা ফুলে ফুলে সাজানো দেখে বুকটা ধরাস ধরাস করতে শুরু করেছে। রিদওয়ান অবিশ্বাস্য নয়নে এক পা দুই পা করে এগিয়ে আসছে। বিছানায় একহাত ঘোমটা টেনে বসে থাকা মেয়েটা শায়লা এতে কোন সন্দেহ না থাকলেও বিশ্বাস হতে মন চায় না। নিজের গায়ে জোরেসোরে চিমটি কাটে রিদওয়ান। ব্যাথায় চেচিয়ে উঠতেই ঘোমটা টানা শায়লা কেঁপে উঠলো। রিদওয়ান ঘরে এসেছে বুঝতে পেরে তার হার্টবিট ফাস্ট হচ্ছে। সে আরেকটু জড়সড় হয়ে বসলো। রিদওয়ান হতবিহ্বল হয়ে এগিয়ে এসে বিছানার কাছে দাঁড়ায়-“শায়লা!”
শায়লা চঞ্চল দৃষ্টি মেলে চারপাশে দেখলো। কি করবে এখন? রিদওয়ান নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। একটা টকটকে লাল কাতান শাড়ী শায়লার পরনে। মাথায় ভারী কাজের ওড়না। শাড়ী কখন পাল্টালো মেয়েটা? হতবুদ্ধি হয়ে রিদওয়ান বিছানায় বসলো। এই আচানক সারপ্রাইজ সে কিভাবে হ্যান্ডেল করবে? নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে তার। অদম্য তৃষ্ণা শায়লার ঘোমটা তুলে মুখ দেখার। কিন্তু রিদওয়ানের হাত পা কাঁপছে তুমুল বেগে। এই মেয়েটাকে কবে থেকে এরকম বউ সাজে দেখার কল্পনা করেছে। নিজে থেকে মেয়েটার ধরা দেওয়ার অপেক্ষায় কেটেছে কতগুলো দিন মাস বছর। আজ যখন সেই দিন এলো তখন এমন নার্ভাস লাগাটা কি স্বাভাবিক? রিদওয়ানের খুশিতে কাঁদতে মন চাইলো। অতি আনন্দে সে কাঁপা হাতে শায়লার ঘোমটা তুলে ফেলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করলো-“শায়লা! ইটস ইউ? আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি প্লিজ আমাকে চিমটি কাটো।”
চলবে—
©Farhana_Yesmin