তোমাকে চাই পর্ব-০২

0
104

#তোমাকে_চাই ।০২।
#সাইরা_শেখ

প্রিয়তার বলা প্রতিটি বাক্য যেন তীরের মত বিঁধল মীর্জাদের বক্ষে।পঞ্চায়েত প্রিয়তার কথায় সম্মতি দিতে বাধ্য হবে,কারণ যে অযুহাতে তারা মেহেকের বিয়ে ঠিক করছিল সে অযুহাত, কারণটা পাঁকাপোক্ত নয় প্রমাণ হয়ে গেছে। মীর্জা সাহেবকে দ্রুত নতুন ফন্দি আটতে হবে। তালুকদারদের শিক্ষা দেওয়ার এমন মোক্ষম সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে পারবেন না। আজ এতগুলো বছর ধরে তিনি এমন সুযোগ খুজেছেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করা অসম্ভব। পঞ্চায়েতের রায় বদল হলো। তারা প্রিয়তার কথাকে উপযুক্ত বলে ঘোষণা করল। তালুকদারদের ঠোঁটে ফুটলো স্বস্তির রেখা। চিন্তিত চেহারাগুলো একে একে মলিনতা দূর করতে সক্ষম হলো। এমন সময় মীর্জা সাহেব বললেন,

– আর আমার ছেলেকে ওরা মা’রল তার বিচার?

পঞ্চায়েতের সর্বাপেক্ষা বয়স্ক মানুষটি বললেন,
– আপনি কি চান বলুন? যদি রাজি থাকেন তাহলে তালুকদারের নাতিকেও সেভাবে মা’রা হোক?

সাইদ বলল,
– আমি রাজি। যদি তারা চায় আমাকেও মা’রতে পারে। আমি কিংবা আমার পরিবার দিরুক্তি প্রকাশ করব না। ভুল যখন আমাদের তখন যে শাস্তি দেওয়া হবে তা মেনে নেবো।

মীর্জা সাহেব হেসে বললেন,
– ভুল আমাদেরও ছিল। যে জেদ মনে পুষে রেখেছিলাম তা আজ তোমাদের এমন ব্যবহারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমি চাই দুই পরিবারের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্বের সমাপ্তি হোক। তালুকদার সাহেব আমার ছেলে নাওফিলকে নিয়ে নতুন করে নিশ্চই কিছু বলতে হবে না। সে আমার ছেলে হলেও, আমার মত নয়। আজ সে আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে আমি ভুল আর সে সঠিক। তার চরিত্র, স্বভাব, আচার-আচরণ আমার পরিবারের বাকি ছেলেদের থেকে ভিন্ন। সে নরম স্বভাবের মানুষ, এসব কলহ তার পছন্দ নয়। আমি আমার নিজের সেই ছেলের জন্য আপনার এই নাতনিকে চাই। প্রিয়তার ব্যবহার, সহবত, সাহস, চরিত্র ও নম্রতা সম্পর্কে যেটা শুনেছি তা কমই শুনেছি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে প্রিয়তাকে আমি আমার নাওফিলের বউ করে আনতে চাই। সেই সাথে দু-পরিবারের সকল দ্বন্দ্বও দূর করতে চাই।

“নাওফিল” শব্দটি কানে আসতেই প্রিয়তা সচকিতে তাঁকাল। পরিচিত একটি মানুষের চেহারা ভেসে উঠলো চোখে। কিন্তু তার স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে এই নাওফিলের কোনো মিল নেই। নামটা যে কমন তাও নয় তবে বেশি চিন্তা করে প্রিয়তা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়না। দু-পরিবারের বিচ্ছেদ যতটা ধ্বংসাত্মক, মিলন ততটাই শক্তিশালী হবে। পূর্বে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল তা নিয়ে অনেক গল্প শুনেছে সে। তাই বরাবরই সে চেয়েছে পারিবারিক কলহ যেন ঘুচে যায়। আবারও দুটি পরিবার এক হোক। প্রিয়তা দুর্বল নয়, সে ভয় পায়না, তাই যদি মীর্জাদের উদ্দেশ্য খারাপও হয়ে থাকে তবুও সে হার মানবে না। এখন শুধু দাদুর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। বাড়ির কারোর বিয়েতে অমত থাকার কথা নয়। সবার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে নাওফিলের ব্যাপারে সবারই ইতিবাচক মনোভাব আছে। আজকের রটনা ও ঘটনার প্রেক্ষিতেই নাওফিলকে মা’রতে বাধ্য হয়েছিল সাইদ, তাই সহজেই হার মেনে ক্ষমা চেয়েছে। মানুষটি যদি ভালো হয় তাহলে প্রিয়তার আপত্তি নেই। দাদু প্রিয়তার পানে তাকিয়ে অসহায় গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

– কি চাও?

– যেটা তুমি এতগুলো বছর চেয়ে এসেছ।আমিও সেটা চাই দাদু। বিয়ে যদি পারিবারিক দ্বন্দ্ব ঘোচায় তবে আমি রাজি। কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে।

– বলো।

– মেজচাচা আমার বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন। তাকে সুরক্ষিত রাখার শর্ত। আমি বিশ্বাস করছি, তালুকদার গোষ্ঠী বিশ্বাস করে যাদের ঘরে মেয়ে পাঠাবে তারা নিশ্চই আমার চাচাকে শত্রু মনে করবেন না। হ’ত্যাকারি মনে করবেন না। আমর সুখের দিনে তাকে সশরীরে থাকার অপরাধে পুনরায় কোনো হ’ত্যার সূত্রপাত হবে না এবং নতুন কলহের সৃষ্টি হবে না। যদি এমন হয় তবে আমি রাজি।

– আমার নাতনির চাওয়া পূরণ করতে পারবে তোমরা? যদি পারো তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমি কখনই তোমাদের শত্রু মনে করিনি, আমার ছেলে যে ভুল করেছিল তার জন্য তাকেও ছাড় দেইনি কিন্তু শুধু এটুকু চেয়েছিলাম সে বেঁচে থাকুক। কোনো বাবা চাইবে না ছেলের মৃ’ত্যু দেখতে। তাই ওকে বাঁচাতে যতটুকু করার, করেছি। আমি আজ মন থেকে সবার সামনে বলছি, তোমার বোনের সঙ্গে যে অন্যায় করা হয়েছে তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। যদি তোমরা আমার প্রিয়তাকে পুত্রবধুরূপে চাও, তার সুখের দায়িত্ব নিতে পারো তবে আমি কথা দিচ্ছি আমার ছেলে এবং নাতিরা কখনও তোমাদের সামনে অ’স্ত্র ধরবে না। এই রে’ষারে’ষির সমাপ্তি এখানেই আজ এই মুহূর্তে হবে।

পরিবেশ গরম হয়ে উঠলো। বিভিন্ন মানুষ বিদ্বেষমূলক কথা বলতে আরম্ভ করেছে। ইউনুস সাহেবের সিদ্ধান্তের মতবিরোধ করছে।বলছে,ছেলের পাপের বোঝা কমাতে নাতনিতে নরকে ঠেলে দিচ্ছে তালুকদার।এবার তালুকদার বাড়ির সবার মনেও সন্দেহ ঢুকে গেল। তারা নাওফিলকে কতটা ভরসা করতে পারে? বাবার কথায় ওঠবস করা ছেলে তাদের মেয়েকে আদৌ সুখী করতে পারবে? যতই সে ভালো হোক না কেন। তার নিজেকেই চলতে হয় সাফাওয়াত মীর্জার আঙ্গুলের ইশারায়। তার বউয়ের প্রতি কোনো অবিচার হলে সে কি রুখে দাঁড়াতে পারবে?

নতুন কোন্দলের আভাস পেলেন ইউনুস সাহেব। তাকে স্বার্থপরতা তকমা দেওয়া হচ্ছে এতে তার বিন্দু মাত্র সমস্যা নেই। কিন্তু এখন বিশ্বাসের ফল প্রতারণা পাবে কিনা তা নিয়ে নিজেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। পরে তার প্রিয় নাতনিকে কষ্ট পেতে হবে না তো? প্রিয়তা তার পরিবারের দুশ্চিন্তা কমাতে এবং নিন্দুকের জবাব দিতে রুক্ষস্বরে বলল,

– বিয়েটা নিতান্তই পারিবারিক বিষয়। আমাকে এখানে কথা বলতে দেখে অনেকে আমায় নির্লজ্জ বা বেয়াদব ভাবতে পারেন। কিন্তু আমি স্পষ্টবাদিতা পছন্দ করি। যে বা যারা বলছেন আমার দাদু আমাকে ভালোবাসে না। সে নিজের ফায়দার জন্য আমার বিয়ে শত্রুর ঘরে ঠিক করছে এবং আমার জন্য, আমাকে নিয়ে যারা চিন্তিত, তাদের বলছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। যদি তাদের বিশ্বাস করতে না পারি তাহলে তাদের বাড়ির বউ হওয়া সম্ভব নয়। তারা স্বেচ্ছায় চাচ্ছেন সকল দ্বন্দ্ব ভুলতে, আমাদের সুযোগ দিচ্ছেন এবং তারা সুযোগ চাচ্ছেন। আমাদের উচিত এই সুসময়ে নেতিবাচক চিন্তা না করে, আমাদের সবার জন্য ভালো চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া।

সাইদ বলল,
– তুই একটু থাম প্রিয়। আমরা আছি তো।

– আছ বলেই তো কথা বলতে হচ্ছে ভাইয়া। তোমাদের মনে যে বিষ ঢোকানো হচ্ছে তা তোমরা বুঝতে পারছো না। সহজ বিষয় জটিল করছ। একটা বিয়ে যদি এই দীর্ঘ বছরগুলোর দ্বন্দ্ব মেটায়, সেই বিয়েটা করে আমি ম’রতেও দ্বিধা করবো না।

এরপর সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
– আমি এবং আমার দাদু বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি। আমার এমন আদবহীন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করবেন।

মীর্জা সাহেব উঠে এসে পকেট থেকে একটা গহনার বাক্স বের করলেন। তিনি প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন বুঝল প্রিয়তা। গহনার বাক্সে খানদানি একজোড়া বালা আছে। এটা তার মায়ের। তিনি সেটা প্রিয়তার হাতে দিয়ে বললেন,
– এই খানদানি বালা আমি প্রিয়তার হাতে দিয়ে তাকে আমার পুত্রবধুর স্বীকৃতি দিলাম। আজকের পর থেকে তালুকদার ও মীর্জা এক হলো। আমাদের মধ্যে আর কোনো কলহ নেই, জানিয়ে দিয়ো সবাইকে।

এরপর প্রিয়তার মাথায় হাত রেখে বললেন,
– তোমার মত পুত্রবধু পাওয়া আমার সৌভাগ্য প্রিয়তা। সুখী হও।

দূর হতে নাওফিল সবটা দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– ভুল করলে মেয়ে। আমাকে না দেখে রিয়েতে রাজি হওয়া তোমার জীবনে দুর্বিষহ সময় ডেকে আনতে পারে এটা বোঝা উচিত ছিল তোমার। এখন প্রস্তুত হও সেই সময়টার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
.
.
তালুকদার বাড়িতে একদিকে সুখের অন্যদিকে শোকের ছাঁয়া নেমে এসেছে। সুখের দিকটা মেহেকের জন্য। ওর জন্য ভালো পরিবার ও পাত্র পাওয়া গেছে কিন্তু প্রিয়তার জন্য যে পরিবার নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের প্রতি কতটুকু বিশ্বাস আনতে পারবে সবাই? প্রিয়তার কোলে শুয়ে একাধারে কেঁদে চলেছে মেহেক। নিজেকে দোষারোপ করছে, দুহাতে চুল টানছে, যন্ত্রণায় ছটফট করছিল মেয়েটা। প্রিয়তা তাকে অনেক কষ্টে ঠান্ডা করেছে।

রাত বাজে আটটা। বিছানার ওপর অযত্নে পড়ে থাকা ফোনটায় আননোন নাম্বার থেকে দুবার কল এসেছে। সাইলেন্ট করা ছিল বলে তখন রিসিভ করতে পারেনি প্রিয়তা। পরশু পরীক্ষা আছে, হলে কিছু না জানিয়েই চলে এসেছে সে। রুমমেট কল দিতে পারে, সে গতকাল নতুন সিম কিনেছে। হয়তো এটা তার-ই নতুন নাম্বার। তাকে ফোন করে নিজের জন্য নোটস রেখে দিতে বলতে হবে ভেবে কলব্যাক করে প্রিয়তা। প্রথমবার রিং বেজে বেজে কেটে গেল। দ্বিতীয়বারও তাই।

মেহেক ঘুমাচ্ছে। দুপুর ধরে মেয়েটা কিছু খায়নি, কিছু খাওয়া উচিত, প্রিয়তার বানানো কেক মেহেক ফিরিয়ে দেবে না। তাই প্রিয়তা নিচে রান্নাঘরে চলে যায়। কেক বানিয়ে ফিরে এসে দেখল, তিনটে মিসডকল। একই নাম্বার। সে কলব্যাক করতে যাবে এমন সময় পুনরায় কল আসলো। প্রিয়তা রিসিভ করে সালাম দেয়।ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে সালামের উত্তর এলো। তবে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে এত আওয়াজ আসছে, যে প্রিয়তা সে সালামের উত্তর শোনেনি। নাম্বার অচেনা তাই প্রিয়তা সরাসরি প্রশ্ন করে,
– কে? কে বলছেন?

এবার উত্তর এলো না। ওপাশ থেকে আসা কন্ঠগুলোর আওয়াজ নিভে আসে।প্রিয়তা বিরক্ত হয় এবার। ওর নাম্বার খুবই কনফিডেনশল, যে কারোর পক্ষে নাম্বার জোগাড় করা সম্ভব না, কিছুদিন যাবৎ কয়েকটা ছেলে নজরে আসছিল, এটা কি ওদের মধ্যে কেউ? প্রিয়তা কপোট রাগ দেখানোর চেষ্টা করে ধমক দিয়ে বলে উঠল,

– আশ্চর্য! চুপ করে আছেন কেন? কাকে চান? দেখুন নিজের পরিচয় দিন, নয়ত…

অপর পাশ থেকে গম্ভীর, গভীর কণ্ঠস্বর,
– নাওফিল মীর্জা বলছি। আপাততো আমি আমার হবু বউ অর্থাৎ তোমাকে চাই।

চলবে…