তোমাকে চাই পর্ব-০৩

0
97

#তোমাকে_চাই ।০৩।
#সাইরা_শেখ

– নাওফিল মীর্জা বলছি। আপাততো আমি আমার হবু বউ অর্থাৎ তোমাকে চাই।
প্রিয়তা মিইয়ে গেল। অপ্রস্তুত হলো, সামান্য লজ্জাও পেল। লোকটার কণ্ঠে রসিকতা ভাব না থাকলেও কেন যেন এই কঠিন মেজাজের রসিকতা প্রিয়তা নিতে পারলো না। নিজের নির্লজ্জ কার্যকলাপের কারণেই লজ্জাটা পাচ্ছে সে। ব্যাঙ্গ করছে নাওফিল। সামনে মেহেক আছে বলে প্রিয়তা ফোন নিয়ে ব্যালকোনিতে চলে যায়। এতটা সময় দুপ্রান্তেই নিরবতা ছিল। প্রিয়তা নিরবতা ভেঙে বলল,
– দুঃখিত।
– কেন?
– আপনি বিয়েটা করতে চাননা।আমার অসাবধানতার কারণে অঘটন ঘটে গেল। তাই..
– তোমাকে কে বলল আমি বিয়ে করতে চাই না?
– গলা শুনে মনে হলো।কেন?ভুল ধারণা করেছি নাকি?
– পুরোপুরি ভুল নয়। বিয়ে নিয়ে আমার আপত্তি নেই। আপত্তি তোমাকে নিয়ে। বউ হিসেবে তোমাকে আমার পছন্দ নয়।
– কথাটা নিজের বাবাকে বলুন। প্রস্তাব উনি রেখেছেন। আমারও যে বিয়েতে আহামরি মত আছে এমন নয়। একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হচ্ছে,সবার ভালোর জন্য।
– যে মেয়ে নিজের ভালো বোঝে না সে অন্যের ভালো কি বুঝবে?
– নাওফিল? এটা কি সত্যিই আপনি?
বিস্ময় নিয়ে বলল প্রিয়তা।

প্রিয়তার মুখে নিজের নাম শুনে থমকাল নাওফিল। এই তো মেয়েটা তাকে চিনেছে। এবার নিশ্চই বিয়েটা সে করবে না।
– হ্যাঁ।
– আপনি কি করে ভদ্র সভ্য হন? আশ্চর্য! এখানকার মানুষ আপনাকে চিনতে এতটা ভুল করেছে? আপনার বাবা অবধি। আসলেই মানুষকে ঠকানো একটা আর্ট। আর আপনি দক্ষ আর্টিস্ট বটে।

নাওফিল বিরক্তি নিয়ে বলল,
– কাকে ঠকিয়েছি? সবাই সত্য জানে, হ্যাঁ হয়তো অর্ধ সত্য জানে। সেটা তাদের জানার কমতি।আমার এখানে কিছু করার নেই। যাই হোক, বিয়েটা আমাদের দুজনের মতের বিরুদ্ধে না হওয়াই ভালো।

– কাকে ঠকিয়েছেন মনে পড়ছে না? আচ্ছা আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। বাংলা বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, রোলনাম্বার ২…., নাম অহনা রহমান। মনে পড়েছে?
– অহনা? ওর কথা তুমি কি করে জানলে? আর যেটা জানো সেটা যাচাই না করে সত্য ভেবে নিলে? নির্বোধ নাকি?
– তাহলে সত্য কি? চারমাস প্রেম করে তাকে ইঁদুরের বিষ খেতে বাধ্য করে হসপিটালে পাঠানো,সবটা মিথ্যে? বানোয়াট?
– বোকা মেয়ে। পরে খোজ নিলে জানতে পারতে ওকে এসব করতে আমি বাধ্য করিনি।আমার আইডির অ্যাক্সেস সিয়ামের কাছে ছিল। প্রেমটা ওদের হয়েছিল, নাম আমার। এ আমার কার সাথে বিয়ে ঠিক হলো? চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে কানে হাত না দিয়ে চিলের পেছনে ছুটছে। হা হা হা।

নাওফিলের হাসি শুনে প্রিয়তা রেগে গেল। নাওফিল খুব একটা সুবিধার নয় বলে পরে ব্যাপারটা নিয়ে সে তলিয়ে দেখেনি। এটা বোকামি হলেও নাওফিলের উচিৎ নয় এখন এভাবে মজা নেওয়া। প্রিয়তা তিতকুটে মুখে বলে,
– আপনি আসলেই খারাপ।
– হ্যাঁ, তাই এখন তোমার উচিত বিয়েটা না করা। সাহায্য আমি করবো। তুমি শুধু কথামতো চলো।
– পুনরায় কোনো অশান্তি হোক তা আমি চাইনা। সবটা মিটলে না হয় আলাদা পথের সন্ধান করা যাবে।
– ভালোভাবে বোঝাচ্ছি,বোঝার চেষ্টা করো। জেদ করে বিপদ ডেকে এনো না। আমার সাথে থাকলে তুমি সুখি হবে না।
– আমার সুখের প্রয়োজন নেই।
– বিয়েটা তাহলে করবেই?
– হুম।
– পস্তাতে হবে। আর একবার ভেবে দেখো।
– কিছু করার নেই। রাখছি। ভালো থাকবেন।

নাওফিল ফোনটা বিছানার ওপর ছুড়ে মা’রে। ক্রোধে ফেটে পড়ল সে। মেয়েটার সঙ্গে এত নরম গলায় কথা বলা উচিত হয়নি। ভেবেছিল শান্তভাবে বোঝালে বুঝবে। কিন্তু না, নাওফিলের ভদ্র স্বভাবটা কেউ নিতেই পারে না। যদি দু-একটা ধমক দিত তবে হয়তো কাজ কিছুটা এগোতো। মেয়েটাকে কিভাবে বোঝাবে মীর্জা বাড়ির সকলের মনে যে বি’দ্বে’ষী ভাব আছে তা এত সহজে নির্মূল হবে না। এবাড়ির বউ হলে কোমলতা ত্যাগ করতে হবে। এই নির্বোধ মেয়ে কি তা পারবে?
.
.
পরীক্ষার পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো। প্রিয়তা পরদিন চলে এলো শহরে। টানা কুড়িদিন ধরে চলবে পরীক্ষা। নাওফিলের সঙ্গে আর কথা হয়নি। প্রিয়তা এখন তাকে নিয়ে ভেবে পরীক্ষার অবনতি করতে চায় না। এমনিতেও নাওফিল তার অপছন্দের বিষয়। তাকে নিয়ে হয়তো একটা ধারণা ভুল হয়েছে,কিন্তু বাকিগুলো? যা চোখের সামনে দেখেছে তা অস্বীকার করবে কি করে?
নাওফিল মানুষটা প্রচণ্ড রাগি, বদমেজাজি, হাত চলে অত্যধিক। প্রিয়তার সামনেই তো কয়েকটাকে মে’রে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। রাগের সময় মুখের ভাষাও চমৎকার বের হয়। তবে সে মেয়েদের সম্মান করে। তাতে কি? এক গুণে শতদোষ মাফ হতে পারে না। সে বাড়িতে ভদ্র,সভ্য থাকার নাটক করে শহরে এসে দাদাগিরি করে। তার একটা ফোনকল মানুষের জীবন দিতে যেমন পারে তেমন নিতেও পারে। মূলকথা তার রাজনীতি, প্রিয়তার রাজনীতি বিষয়টা পছন্দ নয়। তাই সে এ যাবৎকাল রাজনীতি শব্দটা থেকে কয়েশগজ দূরে থেকেছে। তার পরিবারের সবাই’ও রাজনীতির বিপক্ষে। সেখানে প্রিয়তা এক নেতাকে বিয়ে করবে এটা ভাবলেই মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। এরপর থেকে ভার্সিটিতে মানুষ মেহেরীন তালুকদার প্রিয়তা নামে কাউকে চিনবে না, চিনবে নাওফিলের বউ ওরফে ভাবি নামে। আসতে-যেতে সালাম আর ভাবি ডাক, সামনে পেছনে চ্যালাপ্যালা, ভাবলেই মেজাজ খারাপ লাগছে। চোখ বুজে দৃশ্যটি কল্পনা করেই আঁতকে ওঠে প্রিয়তা। কি বিভৎস সে অনুভূতি।

পরীক্ষা শুরুর একঘন্টা আগে, বাড়ির সবাই শুভকামনা জানাল, দোয়া করল। নওফিল যে এসব করার জন্য ফোন করবে তা কল্পনাতীত ছিল। প্রিয়তা ফোন ধরবে না ধরবে না করেও ধরতে হলো,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।পরীক্ষা দিতে যাচ্ছো বললে না তো? আমার দোয়া লাগবে না?
– দিলে দেন, না দিলে নাই।
– ভালোভাবে পরীক্ষা দিয়ো। পরে যেন শুনতে না হয় নাওফিলের হবু বউ অনার্স ফেল।
– হবে না।
– পরীক্ষা দিয়ে গেইটে দাঁড়াবে। আমি থাকবো।
প্রিয়তা চমকে বলল,
– না,আপনি কেন থাকবেন?থাকতে হবে না। আপাততো আপনাকে দেখতে চাচ্ছি না আমি।
– আরে দেখোই না। লাস্ট কবে দেখেছ? আই গেস মাস দুয়েক আগে, রাইট? আমি আগের তুলনায় বেশ হ্যান্ডসাম হয়েছি। আমার চেহারা দেখলে এনার্জি পাবে। আর এভাবে না পেলে, অন্যভাবে এনার্জি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।
– কি মতলবে ফোন করেছেন বলুন তো?
– দেখা হলে জানাবো। এখন এসব নিয়ে চিন্তা না করে পরীক্ষা দিতে যাও।
– মাথায় চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে বলছেন যেন চিন্তা না করি, ওকে। এবার এমন কাজ করবো যাতে আপনাকে চিন্তা করতে হয়।

নাওফিল ফোনটা পকেটে ভরে সিয়ামকে বলল,
– নজর রাখিস। প্রিয়তার আশেপাশে সন্দেহজনক কাউকে দেখামাত্র জানাবি।
সিয়াম বলল,
– তুহিন বলছিল, অপোনেন্টরা ক্ষেপেছে। তবে খোজ পেয়েছে ওরা আজ অ্যাকশন নাও নিতে পারে।
– না নিলেই ভালোই। মেয়েটাকে হারানো যাবে না। এত বছরের যু’দ্ধ কেবলমাত্র ওর জন্য শান্তিতে পরিণত হতে পারে। পঞ্চায়েতের সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলা মেয়েটা এত বোকা হতে পারে না। বুঝতে পেরেছিস?
– জ্বি ভাই বুঝতে পেরেছি।
.
.
সিয়াম চলে যেতেই নাওফিল বাড়ির হিডেন ক্যামেরা গুলো চেক করে। সবাই জানে নাওফিল তার বাবার বি’দ্বে’ষভাব পছন্দ করেনা, সহজে সে বিয়েটা মানবে না। তাই নাওফিল চেষ্টা করবে মেয়েটাকে ফোন করে বিয়ে ভাঙার। সেভাবেই নজর রাখা হচ্ছিল।
নাওফিল অপছন্দ করে তার বাবার মনে জমে থাকা রাগ-বি’দ্বে’ষকে, তালুকদারকের ক্ষতি করার একমাত্র লক্ষ্যকে। তাদের ক্ষ’তি করার উদ্দেশ্যে করা সকল খারাপ কাজকে।এসব বদলানোর কেবলমাত্র একটাই উপায়, তাকে দিয়েই সবার সামনে শত্রুতার নিশ্চিহ্নতা প্রমাণ করা। যেটা ইতোমধ্যে হয়েছে বাকিটা বাড়ির বউ এসে ঠিক করতে পারবে জানে নাওফিল।

প্রিয়তা মেয়েটাকে সে অপছন্দ করেনা।তার কোমলতার আড়ালে থাকা কাঠিন্যময়তা নাওফিলের নজর এড়ায়নি। প্রিয়তা চাচ্ছে না তার আসল রূপ নাওফিল জানুক, নাওফিলও এজন্য তাকে জানাতে চায়না যে সে প্রিয়তাকে বুঝতে পেরেছে। প্রিয়তাকে অপছন্দের কথা বলার অর্থ বাড়িতে ঢোকার পর সে নাওফিলের সহযোগিতা পাবে না, এটা বোঝানো। যেটা প্রিয়তা বুঝেছে,কিন্তু নাওফিল কি চায় সেটাও বোধ হয় বুঝেছে মেয়েটা। তাই আজ রাগ চেপে রাখতে না পেরে সামনতালে থ্রেট করেছে। নাওফিলকে সচেতন হতে হবে। মেয়েটা ধারণার চেয়েও অতিরিক্ত বুদ্ধি রাখে। একবার যদি বোঝে নাওফিল এই পরিবার বন্ধনে ওকে সহযোগিতা করছে তাহলে পদে পদে হেনস্থা করবে। কারন সে নাওফিলের শখের রাজনীতি একদম পছন্দ করেনা। নাওফিল হতাশ গলায় বলল,

– ব্যাপারটা দুঃখজনক। এত ভালো মেয়ে অথচ ভালো জিনিস চেনে না, কদর করতে জানে না।
.
.
পরীক্ষা শেষে নাওফিলকে ঠিক গেইটের কাছেই দেখা গেল। প্রিয়তা পেছন ঘুরে অন্য মোড় নিলে সিয়াম এসে হাঁজির। সে বেশ চওড়া হাসির সাথে দাঁত বের করে সালাম দিল,
– ভাবি, আসসালামু আলাইকুম।

চলবে..