তোমাকে চাই পর্ব-০৬

0
97

#তোমাকে_চাই ।০৬।
#সাইরা_শেখ

– প্রাক্তনকে ডেডিকেট করে গাইলে নাকি? এত দুঃখ কেন গলায়?
গাড়ির স্পিড কমে এসেছে দেখে প্রিয়তা দুশ্চিন্তামুক্ত হলো। নাওফিলের কথাটা তার কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি। সে নিশ্চিন্তে সিটে মাথা লাগিয়ে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে। নাওফিল উত্তর না পেয়ে মেয়েটার দিকে তাঁকাল। তাকে শান্তিতে বসে থাকতে দেখে যেন সহ্য হলো না। কাটখোট্টা গলায় প্রশ্ন করল,
– তাহলে মনে মনে এসব চাও?

প্রিয়তার বেখেয়ালি পাল্টা প্রশ্ন,
– হুহ…কোনসব?
– তোমারো পরানো যাহা চায়, আমি তাই।
প্রিয়তা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তার বাক্যের বিরোধিতা করে বলল,
– একদম না। ইটস যাস্ট অ্যা সং নাথিং মোর মিস্টার নাওফিল।
– ওকে, ওকে বুঝেছি। এত হাইপার হওয়ার কি আছে। নাকি গিল্টি ফিল করছ সত্য ধরে ফেলেছি বলে।
– আপনাকে চাওয়ার থেকে আমি সারাজীবন অবিবাহিত থাকা প্রেফার করবো।
নাওফিল দুষ্টু হেসে বলল,
– যাহ্! মিথ্যে বলছ, আমি অতটাও খারাপ না।

প্রিয়তা কটমটে ভাব নিয়ে তাঁকায়। লোকটা রসিকতা করছে নাকি গতবারের মত চেঁচানোর সুযোগ খুজছে? এভাবে প্রথমদিকে নরম স্বরে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা শুরু করে, শেষ করে অপমানজনক বাক্য ও ধমকে। স্বভাব তার এতটাই খারাপ। পরিচিত একটা রেস্তোরাঁর সামনে এসে থামল গাড়িটি। এখানকার গরুর মাংসের সুনাম গোটা শহরে ছড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকবার বন্ধুদের সঙ্গে এখানে এসেছে প্রিয়তা, কিন্তু আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।

নাওফিল গাড়ি থেকে প্রিয়তাকে নামিয়ে ভেতরে যেতে বলল। সে গাড়ি পার্ক করে আসছে। তার কথামত প্রিয়তা ভেতরে ঢুকলেও ঠিক কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। দোতলার রেস্তোরাঁয় নাকি তিনতলার রেস্তোরাঁয়? নাওফিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চলে এলো। প্রিয়তার নরম হাতটা নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
– তোমার সব কাজ থেমে থেমে করার হ্যাবিট আছে নাকি? দ্রুত এসো।

প্রিয়তা হাত ঝারা দিতেই নাওফিল আরও শক্ত করে ধরে বসল হাতটি। আশেপাশের মানুষ দেখছে। কোনো ধরণের সিনক্রিয়েট করা উচিত হবে না। তাই এবার আর বাঁধ সাধল না প্রিয়তা, চুপচাপ নাওফিলের সঙ্গে হাটতে থাকল। তিনতলার পরিচিত রেস্তোরাঁয় সকলে পরিচিত হওয়ায় কিছুটা হেনস্থাও হতে হলো। সবাই এসে শুভকামনা জানাচ্ছে। এক কাস্টমার সম্ভবত নাওফিলের পরিচিত, সে এসে বলেই বসল,

– ভাবি জিতছেন। একটা গোপন কথা বলি, এতগুলো বছর ধরে ভাইকে চিনি, আপনার আগে আর কাউকে ভাই এখানে আনেনি, ক্যাম্পাসেও কোনো মেয়েঘটিত ঘটনা ঘটেনি, চারবছর ভাইয়ের সাথে কাটিয়েছি, সব মেয়েকে ভাই মাছি তাড়ানোর মত তাড়িয়েছে। আর..

তখন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল প্রিয়তার, নাওফিল গলা খাঁকড়ি দেওয়ায় ছেলেটা চলে যায়।

মুখোমুখি বসেছে দুজন। খাবার অর্ডার করে নাওফিল। ভাত, মাংস, বোরহানি, বিরিয়ানি। প্রিয়তা চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে। খাবার এলে নাওফিল একাই খেতে শুরু করে। মাঝে মধ্যে অবশ্য প্রিয়তার দিকে তাঁকাচ্ছে কিন্তু তাকে খেতে বলছে না। প্রিয়তা শেষে রাগ করে নিজেই খেতে শুরু করল। সে স্বেচ্ছায় আসেনি, তাকে জোর করে আনা হয়েছে। নয়ত সে এখন নিজের রুমে বসে ঠিকই পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারতো। কারোর বলার জন্য অপেক্ষা করতে হত না। নাওফিল সবটা দেখেও নির্বিকার। প্রিয়তাকে কিছু বলার জন্য ডেকে এনেছে সে।

ক্যান্টিনে প্রিয়তাকে দেখে আজ প্রথমবারের মত ঘাবড়ে গিয়েছিল নাওফিল। যেটা সে কখনও চায়নি। মেয়েটা ওর জীবনের সাথে জুড়ে, নানা পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। ইদানিং মেয়েটার জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছে, রাত-দিন মেয়েটার পাহারায় সিয়ামদের রাখলেও নিজের চোখে না দেখলে মনের ভেতর কেমন তোলপাড় শুরু হচ্ছে। তবে কথা বলার বিষয় এটা নয়। বিষয়টা তার ফুফু ও প্রিয়তার মেজচাচাকে নিয়ে। এটার দীর্ঘ তদন্ত করেছে নাওফিল, প্রিয়তা কতটুকু জানে সেটাও জানতে হবে। ওবাড়িতে কে কতটুকু জানে সেটা বুঝতে হবে। দুবাড়িতে কে বা কারা বি’ষ ঢালছে তা সনাক্ত করতে হবে। ক্ষুদ্র একটা বিষয় নিয়ে এমন র’ক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হওয়াটা কাকতালীয় ব্যাপার না। এই রে’ষারে’ষি ততদিন নির্মূল হবে না যতদিন না এরা নির্মূল হয়। গ্রামে তেমন না থাকার কারণে নাওফিল সকল তথ্য থেকে বেখেয়াল ছিল। কিন্তু প্রিয়তা গ্রামেই, বাড়িতে থাকত। তার কাছে কোনো না কোনো তথ্য নিশ্চই থাকবে।

খাওয়া শেষে টেবিল পরিষ্কার করে দুগ্লাস পানীয় দিয়ে গেল ছেলেটা। পানীয় অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়ায় প্রিয়তা এক চুঁমুক পান করে রেখে দিল। নাওফিল পুনরায় ছেলেটিকে ডেকে নরমাল পানীয় আনতে বলে।এবার প্রিয়তা পানীয় পান করে নাওফিলের দিকে তাঁকায়। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকের ওপর দু-হাত গুজে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অপেক্ষা করছে প্রিয়তার খাওয়া শেষ হওয়ার। মুখভঙ্গি তার বেশ গম্ভীর। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে নিশ্চই, নাওফিল টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,
– নতুন গোফটা মুছে ফেলো।

প্রিয়তা ভ্রুঁকুটি করে তাঁকায়। নাওফিল হেসে বলল,
– সবসময় কুঁচকানো চোখমুখের এক্সপ্রেশন কেন দাও? এত সুন্দর চেহারা, কোথায় ভালো ভালো এক্সপ্রেশন দেবে, তা না।
– আপনার সামনে ভালো এক্সপ্রেশন আসে না।
নাওফিল ক্রুদ্ধচোখে তাঁকায়। প্রিয়তা তৎক্ষণাৎ বলে,
– আপনারও তো একটাই এক্সপ্রেশন, কিছু হলেই রাগে চেহারা লাল হয়ে যায়।দেখে মনে হয় অনায়াসে সামনের মানুষটিকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে পারবেন।
– তোমাকে চিবিয়ে খেতে হলে খাওয়ার উপযোগী করে তবে খাবো। চিন্তা করো না উপযুক্ত হওয়ার পর্যাপ্ত সময় পাবে।

প্রিয়তা মুখ বাঁকাল।নাওফিল সরাসরি মূল প্রসঙ্গে চলে আসে।
– আমার ফুপি তোমার চাচার জন্য আত্মহ’ত্যা করেনি প্রিয়।
– জানি। চাচ্চু বলেছে আমাকে। আপনার ফুপি অন্য একজনকে পছন্দ করতেন। বাড়ি থেকে তাদের দুজনকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দিয়ে দাদুরা দু-পরিবারের সম্পর্ক গভীর করতে চেয়েছিলেন। তাই চাচ্চু আর আপনার ফুপি প্লান করে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে। প্রথম দুটি প্লান ব্যর্থ হয়। শেষের প্লান ছিল, চাচ্চু মেজচাচিকে বিয়ে করবে আর পাত্রের অভাবে যখন হইহই পড়ে যাবে তখন আপনার ফুপির প্রেমিক সিনেম্যাটিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিবেন। আগেকার মানুষ দারুন স্মার্ট ছিল। আমি এমন টাইপের একটা সিনেমাও দেখেছি মনে হয়। প্লান মোতাবেক চাচ্চু বিয়ে করে এসে আপনার ফুপির আত্মহ’ত্যার কথা জানতে পারে।সবাই সরাসরি চাচ্চুকে দোষারোপ করে, ঘটনার সত্যতা জানার পরিবর্তে। ব্যাস কাহিনি এখান থেকেই শুরু, দিনের পর দিন মানুষের সলাপরামর্শ তাদের ক্রোধ ও প্রতিশোধের আগুণে ঘি’য়ের ন্যায় পড়েছে আর দাউদাউ করে জ্বলেছে। আমি বুঝিনা এই দুই পরিবারের ভালোয় এত দ্রুত নজর লেগে গেল কেন? যতটা গল্প শুনেছি তার কিছুই দেখতে পেলাম না। তবে কথা হচ্ছে আমি গ্রামে থাকতে আপনাকে দেখিনি কারণ আপনি শহরে থাকতেন, কিন্তু আপনি নিশ্চই আমাকে দেখেছেন তবুও আপনার জন্য ভার্সিটিতে এসেই র‍্যাগ খেতে হলো কেন? আপনি না দুধে ধোয়া তুলসিপাতা? জানেন সেই র‍্যাগের জের এখনও আমাকে বয়ে বেড়াতে হয়? আমার ক্লাসমেটরা হচ্ছে আপনার চামচা,সুযোগ পেলেই আমাকে আস্ত গিলে খেতে আসে। একে তো এসব ঝামেলা তারওপর নতুন করে আপনি জ্বালাতন শুরু করেছেন। ট্রাস্ট মি পরিবারের খাতিরে বিয়েটা করতে চাচ্ছি। প্রয়োজন পড়লে আমরা ডিভোর্স নিয়ে নেব যখন সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ভার্সিটিতে এসে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করবেন না। প্লিজ!

নাওফিল অবাক হয়ে বলল,
– তোমাকে কখন র‍্যাগ দিলাম?
– আমাকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন মনে নেই? তাও দু বার।
– কতজনকে ধরেই তো গান শুনেছে তুহিনরা। তুমিও ছিলে খেয়াল করিনি। তাছাড়া গ্রামে থাকাকালে তোমায় আমি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বাড়ি থেকে বের হওনা বোধ হয়। নয়তো মেহেকদের সাথে তোমায় ঠিক দেখতে পেতাম। এক মিনিট মনে পড়েছে, মাথায় ঘোমটা টানা মুরব্বিটা তুমি ছিলে?
– হ্যাঁ, যাকে লম্বা সালাম দিয়েছিলেন আপনি। আমি প্রত্যুত্তরে সালামের জবাব দিয়ে বলেছিলাম ‘দীর্ঘজীবী হও বাঁছা’।
নাওফিল হেসে বলল,
– অলমোস্ট আঠারোবছর গ্রামে থাকার পর পরিচিত হলাম বিয়ের ঘটনায়, অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তারপর বলো, কেমন লাগছে এমন হ্যান্ডসাম বর পেয়ে? ডিটেইলে অনুভূতি জানাও।
– জঘন্য।
– সেইম টু ইউ। দেখো মানুষ হিসেবে আমার যেটা করা উচিত ছিল, মানবিকতার খাতিরে সেটুকু করেছি। বার বার সাবধান করার পরও বিয়েটা যখন করবে তখন কি আর করার? ফুপিদের ঝামেলাটা সমঝোতার সঙ্গে সমাধান করতে দুজনেরই একে অপরের সহযোগিতা প্রয়োজন। আজকের পর থেকে কোনোরূপ বিবাদ না করে, নতুন করে সবটা শুরু করতে চাচ্ছি। তোমার কি মতামত?
– আপনি ভালো হলে, আমাকেও ভালো পাবেন।
– আর খারাপ হলে? কি করবে তুমি?
প্রিয়তা তেঁতে উঠে বলল,
– দেখেছেন? দেখেছেন কেমন স্বভাব আপনার? আপনার সাথে সমঝোতা আসলেই সম্ভব?
– তোমার কথার ধরণ দেখেছ? পাক্কা ঝগড়ুটে মেয়ে। আমি সমঝোতা করার কথা বলেছি, তুমি কি বলেছ? আমি ভালো হলে তোমাকে ভালো পাবো, এসব কেমন কথা?
– ওকে, আমি সরি। ঠিক আছে?
নাওফিল কোল্ডড্রিংকসে গলা ভিজিয়ে ঠোঁট টিপে স্বল্প স্বরে বলল,
– গুড গার্ল।

প্রিয়তাকে হলে পৌঁছে দেয় নাওফিল। প্রিয়তা গাড়ি থেকে নামার আগে নাওফিল কোমলস্বরে বলল,
– যেহেতু আমাদের মাঝে সমঝোতা এসেছে সুতরাং ভীতু হওয়ার যে অভিনয়টা করছ, সব জেনেও না জানার ভান করছ, এড়িয়ে চলছ, অনর্থক আলাপে আমায় ব্যস্ত রাখছ, এসব বন্ধ করা উচিত।
প্রিয়তা শব্দ করে গাড়ির দরজা লাগিয়ে বলল,
– মেলোড্রামা আমি আপনার থেকেই শিখেছি। তবে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে একমত আমি,পরিবারের জন্য আপনার সঙ্গী হতেও রাজি। তাই আমি যেমন এবার তেমনই দেখবেন, আশা করছি খুব একটা হতাশ হবেন না। আসছি..

নাওফিল হেসে উঠল। প্রিয়তা চোখের আড়াল হতেই নাওফিল চেহারা গম্ভীর করে স্টিয়ারিং’য়ে হাত ঘুরিয়ে বলল,
– পুরোটা কেন বললে না প্রিয়?আমাকে সাহায্য করতে চাইছ না, নাকি বিশ্বাস করতে পারছ না? অথচ আমি তোমার বলা প্রতিটা অর্ধসত্যও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। এটা অনুচিত প্রিয়.. তবে সঙ্গ পেতে সব সহ্য করে নেব।

চলবে…