তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-২১+২২

0
184

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২১
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

দীপ্তির ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা প্রাপ্তির ঘরের দিকে হাঁটা দেয় সজীব। দড়জার সামনে এসে আলতো হাতে দড়জা ঠকঠক শব্দ করে। সুপ্তি বিছানা ঠিক করছিলো ঘুমানোর জন্য। এমন সময় দড়জায় কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে দড়জা খুলে দেয়। দরজার সামনে সটান হয়ে দাড়িয়ে আছে সজীব। সুপ্তিকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা প্রাপ্তির কাছে চলে আসে। প্রাপ্তি সোফায় চুপচাপ বসে ছিলো। সজীব ধীরে সুস্থে প্রাপ্তির কাছে গিয়ে পাশ ঘেঁষে বসে। মাথায় হাত রেখে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

—“এখন কেমন লাগছে? ব্যথা এখনো আছে?”

—“ওই, একটু।”

প্রাপ্তির জবাব শুনে ছোট্ট করে একটা দম ছাড়ে সজীব। ওষুধের বাক্সটা হাতে নিয়ে প্রাপ্তির রাতে খাবার ওষুধগুলো বের করে। পরপর পকেট থেকে একটা ওষুধের পাতা বের করে বক্সে রাখে। এক এক করে সবগুলো ওষুধ হাতের তালুতে নেয়। সামনে তাকিয়ে দেখে সুপ্তি চুপচাপ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। সুপ্তিকে উদ্দেশ্য করে সজীব বলে,

—“চুপচাপ দাড়িয়ে না থেকে তোর কাজ শেষ কর। রাত অনেক হলো তো।”

সুপ্তি জিভে কামর দিয়ে বিছানা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সজীব আঁড়চোখে সুপ্তিকে দেখে নেয় একবার। তারপর হাতের ওষুধগুলো প্রাপ্তির সামনে ধরে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে খেয়ে নিতে বলে।

ওষুধগুলো নিজের হাতের তালুতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে যায় প্রাপ্তির। সন্দিহান কন্ঠে বলে,

—“তুমি আমাকে ওষুধ খাওয়াতে আসলেই এতো ওষুধ দাও কেনো? এতো ওষুধ তো একেবারে খাইনা কখনো।”

—“তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস?”

সজীবের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে যায় প্রাপ্তি। তড়িঘড়ি করে বলে,

—“এই, না না দাদাভাই! একদম না। কি যা তা বলছো। তোমাকে আমি নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি। আমার এতো ওষুধ খেতে ভালো লাগে না তাই বলছিলাম।”

—“সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? ঠিক মতো ওষুধ গুলো খেলে তো আজ এই অবস্থা হতো না।”

প্রাপ্তিও আর কোনো কথা বলে না। মুখ ফসকে একটা কথা বলে এখন মনে মনে গিলটি ফিল হচ্ছে। সজীব কি ওকে ভূল বুঝলো? প্রাপ্তির কথায় নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। সজীব কি এবার মুখ ফিরিয়ে নেবে প্রাপ্তির থেকে?

—————————-

সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই। সন্ধ্যা বেগম সবার সামনে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছেন। আজ সুভাষ সাহেবও যুক্ত হয়েছেন সবার সাথে। কাজের ব্যস্ততা শেষ করে দুদিন হলো একটু ফাঁকা হয়েছেন।

পরোটার একপাশ ছিড়ে ডিম ভাজি দিয়ে সেটা মুখে পুরে নেন সুভাষ সাহেব। এমন সময় পাশ থেকে অর্পন জোরেশোরে কেশে ওঠে। খাওয়া থামিয়ে দেয় সবাই। ভ্রু কুচকে তাকায় অর্পনের দিকে। সে একবার কাশি দিয়েই খাওয়া শুরু করেছে। বিষয়টা তেমন পাত্তা না দিয়ে সবাই আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। মিনিট এখানে পর অর্পন আবার খুকখুক করে কেশে ওঠে। এবার সকলের কুচকানো ভ্রু আরো দ্বিগুণ কুঁচকে যায়। পাশ থেকে পানির গ্লাসটা অর্পনের দিকে ঠেলে দেয় অঙ্কন। তার ভাইয়ের এমন হঠাৎ হঠাৎ কাশির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। এমন করে কেশে ওঠার কি আছে?

পানি খেয়ে অর্পন আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। একটু পর অর্পন আবার জোরেশোরে কেশে ওঠে। যেনো গলায় বড়সড় কিছু আটকে গেছে। সুভাষ সাহেব এবার বেজায় বিরক্ত হন। কন্ঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেন,

—“কিছু বলবে কি? কিছু বলতে চাইলে বলে ফেলো। তবুও এমন যক্ষা রোগীদের মতো ব্যবহার করো না।”

বাবার কথা শুনে নড়েচড়ে বসে অর্পন। নজর খাবারের প্লেটের দিকে রেখেই বলে,

—“একটা জরুরি কথা বলার ছিলো তোমাদের সাথে।”

এটুকু বলেই একনজর সবার দিকে তাকায়। সবাই কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে আছে। সবার থেকে নজর সরিয়ে খেতে খেতে অর্পন বলে,

—“আসলে, অঙ্কন কয়েকদিন ধরেই বায়না করছে তার নাকি ভাবি চাই। একপ্রকার মাথা খেয়ে ফেলছে আমার। কাল তো কান্নাকাটিও শুরু করে দিয়েছিলো ভাবি এনে দেয়ার জন্য।”

অর্পনের এটুকু কথা শুনেই বেশ বড়সড় বিষম খায় অঙ্কন। অনবরত কাশতে থাকে। কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। অর্পন তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পিঠে হালকা চাপর দিতে দিতে বলে,

—“আহ্ আস্তে, বলেছি তো ভাবি এনে দেবো। এখন সবার সামনে কান্নাকাটি করবি নাকি?”

অঙ্কন কাশি থামিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে অর্পনের দিকে। তার ভাইয়ের এই হঠাৎ পরিবর্তন ঠিক হজম করতে পারছে না। মস্তিষ্কে জোর দিয়ে ভাবতে থাকে সে কখন ভাইয়ের কাছে এমন আবদার করেছে? তখন মস্তিষ্ক উত্তর দেয়, “একদম না, তুই মোটেও এমন আবদার করিসনি। তোর ভাই মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে।” মস্তিষ্ক বিষয়টা ক্লিয়ার করে দিলেও প্রতিবাদ করার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না অঙ্কন। আশ্চর্য হয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে তার ভাইয়ের দিকে। অঙ্কন কাশি থামাতেই অর্পন ফের বলতে শুরু করে

—“ছোট ভাইটা আমার এতো করে যখন বায়না করছে তাই বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম। অনেক কিছুই ভাবলাম। তাছাড়া মাও তো সব সময় মেয়ে নেই বলে আফসোস করে। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি মাকে একটা মেয়ে আর অঙ্কনকে একটা ভাবি এনে দেবো।”

রান্নাঘরে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে অর্পনের কথা শুনছিলো জমিলা খালা। তিনি সন্ধ্যা বেগমকে রান্নার কাজে সাহায্য করেন। অর্পনের কথা শেষ হতেই তিনি এগিয়ে এসে বলেন,

—“এর লেইগা দুইডা মাইয়া আনোনের কি দরকার বাবা? তুমি একখান বিয়া করলেই তো পারো। তাইলেই তো হইয়া যায়।”

—“আরে বাহ্ খালা। তোমার বুদ্ধির দরজা খুললো কবে থেকে? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি সারাজীবন বোকাই থেকে যাবে। আমাদের সাথে থাকতে থাকতে বেশ বুদ্ধিমতি হয়ে গেছো।”

অর্পনের খোঁচা মারা প্রশংসা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে যায় জমিলা খালা। লাজুক হেসে নিজের কাজে চলে যায়। অর্পন নজর ঘুরিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। তিনি শান্ত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাবার নজর দেখে অর্পন এটুকু বুঝতে পেরেছে যে তার বাবা সবই বুঝে গেছে। ড্রয়িং রুমে আপাতত পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিরবতা ভেঙে সুভাষ সাহেব বলেন,

—“এতো ভনিতা না করে সরাসরি বললেই পারতে। এখানে নিজের ছোট ভাইকে গুনেগার বানানোর কোনো দরকার ছিলো না। মেয়ের নাম ঠিকানা দাও, আজই পাকা কথা সেরে আসছি।”

এদিকে বাবা ছেলের কথোপকথন শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে যান সন্ধ্যা বেগম। আমোদিত কন্ঠে বলেন,

—“কি সৌভাগ্য আমার। আমার ছেলে নিজে থেকে বিয়ে করতে চাইছে। তোকে তো বিয়ের জন্য রাজিই করাতে পারতাম না। বিয়ের কথা বললেই ছ্যাত করে উঠতি। এই খুত খুঁতে ছেলে আমার কোনো মেয়েকে পছন্দ করেছে মানে সেই মেয়ে সেরার সেরা হবে। আমার তো আর সয্যই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসি। পরে যদি তোর মত বদলে যায়।”

মায়ের কথায় হালকা হাসে অর্পন। জীবনে সব ক্ষেত্রেই সে বাবা মায়ের সাপোর্ট পেয়েছে। কখনো কোনো বিষয়ে তারা না করেনি। তবে আজ অর্পনের কিছুটা ভয় হচ্ছে। বাবা মায়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকার পরেও মনের কোথাও একটা সংশয় কাজ করছে। প্রাপ্তির কথা শুনে তারা কি সবটা মেনে নিবে? একটা অন্ধ মেয়েকে বাড়ির বৌ বানাতে রাজি হবে? যদি তারা রাজি না হয়? তখন কি করবে অর্পন? ভয়ে বুকটা ধুকধুক করছে। এই প্রথম অর্পন ভয় পাচ্ছে। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়, প্রাপ্তিকে হারানোর ভয়। খুবই বাজে অনুভূতি এটা। অর্পন একটা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে। কন্ঠ যথা সম্ভব গম্ভীর করে বলে,

—“এবার আসি সেই জরুরি কথায়। জীবনে চলার পথে তোমাদের সাপোর্ট সবসময় পেয়েছি। আশা করি এবারও আমার সিদ্ধান্তকে তোমরা সাপোর্ট করবে।”

সুভাষ সাহেব অভয় দিয়ে বলেন,

—“নিঃসংকোচে বল। আমরা আছি তোর সাথে।”

অর্পন প্রাপ্তির একটা ছবি বের করে টেবিলের ওপর রাখে। ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে সন্ধ্যা বেগমের। ছবিটা হাতে নিয়ে বলেন,

—“মাশা-আল্লাহ! মেয়েটাতো ভারি মিষ্টি। আমি তো রাজি।”

—“ও চোখে দেখতে পায় না মা। এই একটাই সমস্যা।”

অর্পনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান সুভাষ সাহেব আর সন্ধ্যা বেগম। দু’জন চমকে তাকান অর্পনের দিকে। অর্পন নির্বিকার। চেহারা তার একদম স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিক চেহারা দেখে আরো আশ্চর্য হয়ে যান সুভাষ সাহেব। কিছুটা চেচিয়ে বলেন,

—“পাগল হয়ে গেছো তুমি? কি বলছো এসব? একটা অন্ধ মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে চাও? ভবিষ্যতের চিন্তা আছে তোমার?”

—“সবদিক চিন্তা করেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবা। আমার প্রাপ্তিকেই চাই।”

—“বাচ্চাদের মতো জেদ করোনা অর্পন। তুমি নিজের হাতে নিজের জীবন নষ্ট করছো। বাবা হয়ে আমি তোমার অন্যায় আবদার মানতে পারবো না। তুমি ভুল পথে এগোচ্ছো।”

—“আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। এখন তোমরাও মেনে নাও। বিয়ে তো আমি প্রাপ্তিকেই করবো। তৈরি থেকো সবাই।”

কথাগুলো বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায় অর্পন। মেজাজটাই বিগড়ে গেছে। যেই ভয়টা পাচ্ছিলো ঠিক সেটাই হলো। এবার বাবাকে মানাতে বেশ পরিশ্রম করতে হবে।

—————————-

থমথমে চেহারা নিয়ে থানায় উপস্থিত হয় অর্পন। চোখ মুখ সর্বোচ্চ কঠিন হয়ে আছে। ভেতরে ঢুকতেই সবাই দাড়িয়ে সালাম জানায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে ভেতরে চলে যায় অর্পন। পেছন পেছন ছুটে যায় কনস্টেবল রহিম। পাশ থেকে দুজন কনস্টেবল নিজেদের মধ্যে কথা বলছে,

—“বড় স্যার সবসময় এমন রেগে থাকে কেনো বলতো? তাকে আমি কখনো হাসতে দেখিনি। উনি কি হাসতে জানেন না?”

অপরজন জবাব দেয়,

—“কি জানি। সবসময় চেহারায় রাগ নিয়ে থাকে। আমার তো কথা বলতেই ভয় লাগে।”

দুজনের কথা শুনতে শুনতে সামনে এগিয়ে যায় রহিম। অর্পনের সাথে থাকতে থাকতে সে অনেকটাই চিনে ফেলেছে অর্পনকে। এজন্য আগে ভয় পেলেও এখন খুব বেশি ভয় পায় না। কারণ সে এতোদিনে এটুকু চিনেছে যে অর্পন কাজের জায়গাতেই এতোটা কঠোর হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে সে খুবই নরম মনের প্রানোচ্ছল মানুষ। তার ওই নরম সত্তা সে কাজের জায়গায় প্রকাশ করে না। হয়তো তাদের কাজের ক্ষেত্রটাই এমন তাই। পুলিশদের যে সর্বোচ্চ কঠোর হতে হয়। এজন্য অর্পনের এতো কঠোরতার।

ভাবতে ভাবতেই নিজের গন্তব্যে চলে এসেছে রহিম। অর্পন নিজের চেয়ারে কাঠকাঠ ভঙ্গিতে বসে আছে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রহিমের দিকে। ওই বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ নজর দেখে নড়েচড়ে ওঠে রহিম। কি সাঙ্ঘাতিক দৃষ্টি। এ যেনো চোখ দিয়েই জখম করে দিতে পারে। অর্পন গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,

—“খবর পাওয়া গেছে?”

—“জ্বি স্যার! কষ্ট হয়েছে ঠিকই কিন্তু লোকেশন পেয়ে গেছি। মতিঝিলেই ওদের আস্তানা। রনি স্যার এজন্যই হয়তো কেসটার নাম “অপারেশন মতিঝিল” দিয়ে উল্লেখ করেছে। এটা আপনার জন্য একটা ক্লু ছিলো স্যার।”

দুই হাত একসাথে মুঠো করে সামনে এগিয়ে আসে অর্পন। চেহারা আরো গম্ভীর করে বলে,

—“বিষয়টা আমার মাথায় আগেই এসেছিলো। রনি আমার জন্য ক্লু রেখে গেছে। আমিই বুঝতে দেরি করে ফেলেছি। তবে কোনো ব্যপার না। ওদের আস্তানার খবর যখন পেয়ে গেছি, সেটা ধ্বংস করতে আমার বেশি সময় লাগবে না।

—“ওরা খুব ভয়ঙ্কর স্যার। ওদের হাতে ধরা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত।”

—“বিপদ নিয়ে খেলতে অর্পন খুব ভালোবাসে রহিম সাহেব। এবার চলুন।”

বলেই অর্পন উঠে দাঁড়ায়। এদিকে অর্পনকে হুট করে উঠে দাঁড়াতে দেখে একটু ভয় পেয়ে যায় রহিম। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

—“কোথায় যাবেন স্যার?”

—“আত্মীয়র বাড়ি দর্শন করে আসি। এদের সাথে মুলাকাত তো সেখানেই হবে। আগে থেকেই একবার চোখকে শান্ত করি।”

অর্পনের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রহিম। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে অর্পনের দিকে। অর্পনের বলা সব কথা রহিমের মাথার ওপর দিয়ে গেছে সেটা রহিমের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ অর্পনের সাথে বেরিয়ে যায়।

গাড়ি ড্রাইভ করছে অর্পন নিজেই। একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামায়। বাড়িটা বহু পুরাতন। অনেক বছর ধরে মেরামত না করায় কিছু জায়গায় ভেঙে গেছে। রং চটে গিয়ে বাড়ির বেহাল দশা। বিশাল বড় জায়গা জুড়ে এই আলিশান বাড়ি। চারিদিক উঁচু বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা। বাহির থেকে কেউ ভেতরের অবস্থা জানতে পারবে না। পুরনো বাড়িটা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। আর না আছে এই জায়গার মালিকের কোনো খোঁজ। বাড়ির পেছনে ঠিক কি আছে সেটা সবার অজানা। রাস্তায় দাড়িয়েই পুরো বাড়ির সীমানায় চোখ বুলিয়ে নেয় অর্পন।

পাশেই রহিম বসে ক্রমাগত শুকনো ঢোক গিলছে। ভয়ে শরীরে মৃদু কম্পন ধরেছে রহিমের। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মোছে। অর্পন কিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বাঁকা হেঁসে সানগ্লাস চোখে পড়ে নেয়। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এক টানে সেখান থেকে চলে যায়।

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২২
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

বন্ধ ঘরের ভেতরে বাবা ছেলের মধ্যে তুমুল তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। দড়জার বাইরে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে সবাই। ভেতরের অবস্থা কেউই ঠিক মতো আন্দাজ করতে পারছে না। সাগর কয়েক মিনিট পায়চারি করে এসে সন্ধ্যা বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই সে এসেছে তার মাকে নিয়ে। তার মামা আর অর্পনের মধ্যে প্রাপ্তিকে নিয়ে দন্দ লেগেছে। কথাটা শোনা মাত্রই ছুটে চলে এসেছে সাগর। কিন্তু বাবা ছেলে দড়জা ভেতর থেকে আটকে সলাপরামর্শ করতে বসেছে। দড়জা আটকানো আছে বিধায় কেউ ভেতরে যেতে পারছে না। তাই পরিস্থিতি ঠিক কতটা বিগড়ে গেছে সেটাও কেউ বুঝতে পারছে না।

কয়েক মিনিট পরেই খট করে দড়জা খুলে যায়। প্যন্টের পকেটে দুই হাত গুঁজে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসে অর্পন। তার পেছন পেছন ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন সুভাষ সাহেব। চেহারা তার নিশ্চুপ, স্বাভাবিক। সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় দুই বাবা ছেলের দিকে। সকলের নজর উপেক্ষা করে অর্পন সোফায় বসে গা এলিয়ে দেয়। আয়েশ করে বসে সামনে তাকায়। তার বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে ফোনে কিছু দেখতে থাকে অর্পন। কয়েক সেকেন্ড নিরবতা পালন করে সুভাষ সাহেব বলেন,

—“সবাই তৈরি হয়ে নাও। বিকালে আমরা যাচ্ছি সেখানে। বিয়ের কথা আজকেই পাকা করে আসবো।”

কথাগুলো বলেই হনহন করে নিজের ঘরে চলে যান সুভাষ সাহেব। এই মুহুর্তে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সুভাষ সাহেবের দিকে। একটু আগেই তো কাঠকাঠ কন্ঠে বললেন প্রাপ্তিকে তিনি ছেলের বৌ হিসেবে মেনে নিবেন না। আবার এখনই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো! আশ্চর্য। সন্ধ্যা বেগম দ্রুত পায়ে স্বামীর পেছন পেছন ছুটে যান।

সুভাষ সাহেব চলে যেতেই অর্পনের কাছে এগিয়ে আসে সাগর। অর্পনের মুখোমুখি হয়ে বসে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

—“সিদ্ধান্ত কি ভেবে চিন্তে নিয়েছিস?”

—“ভেবে চিন্তে, স্বজ্ঞানেই নিয়েছি।”

—“আর ইউ শিওর?”

—“হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।”

অর্পনের তৎক্ষনাৎ জবাব শুনে ফোঁস করে দম ছাড়ে সাগর। অর্পনের মনে যে প্রাপ্তির প্রতি দুর্বলতা আছে সেটা সাগর আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলো। তাই বিয়ে করতে চাওয়ার বিষয়টা খুব একটা অস্বাভাবিক লাগেনি সাগরের কাছে।

—————————

সময়টা এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দুপুরের উত্তপ্ত বাতাস ধীরে ধীরে হিম শীতল রুপে পরিবর্তন হচ্ছে। পশ্চিম দিকে হেলে পড়া তেজহীন সূর্য প্রায় ডুবতে বসার পথে। নিজের সর্ব শক্তি হারিয়ে নিজ গৃহে ফিরে যাচ্ছে সে। কাল পূর্ণ শক্তি অর্জন করে আবার ফিরে আসবে তার রাগে সকলকে ঝলসে দিতে।

বিকেলের স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ উপভোগ করছে দুই বোন। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়তেই দুজন ছুটে ছাঁদে চলে এসেছে। এখন কিছু সময় প্রকৃতিকে উপভোগ করবে তারা।

ছাদের কোণার দিকে চেয়ার পেতে বসে নিচের দিকে নজর রাখে সুপ্তি। রাস্তায় চলাফেরা করতে থাকা মানুষ গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। সেদিকে চোখ রেখেই প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“তুমি আর আগের মতো গান গাওনা কেনো ছোট আপি? তোমার খালি গলার গান অনেক মিস করি। একটা গান শোনাও না প্লিজ।”

—“পরিবেশ পরিস্থিতি কি আর আগের মতো আছে সুপ্তি? গান গাইতে মানসিক শান্তি লাগে। যেটা এই মুহূর্তে আমাদের মধ্যে নেই। বড় আপির চিন্তায় আর কিছুই ভালো লাগছে না।”

—“তাই বলে এভাবে মনমরা হয়ে থাকবে? মন ভালো করতেও তো গান গাইতে পারো। গাও না আপি, প্লিজ।”

নিশ্চুপ হয়ে যায় প্রাপ্তি। কোনো কথা বলে না। একটা সময় ছিলো যখন প্রাপ্তি প্রচুর গান গাইতো। গান গাইতে ভালো বাসতো আর কি। ঘরে অসংখ্য মেডেল সহ পুরস্কার গুলো সাজানো আছে। স্কুল কলেজের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে জিতেছে এগুলো। কিন্তু চোখের দৃষ্টি হারানোর সাথে সাথে প্রাপ্তির জীবনটাই অন্ধকারে ঢেকে গেছে। হারিয়ে গেছে জীবনের সকল রঙ। মাটি চাপা দিয়েছে মনের সকল সখ আহ্লাদ। প্রাপ্তির ভাবনার মাঝেই সুপ্তি আবার ডেকে ওঠে প্রাপ্তিকে। হাত ধরে ঝাকিয়ে বলে,

—“একটা গান শোনাও না আপি, প্লিজ!”

বোনের কথায় এবার মৃদু হাসে প্রাপ্তি। কোনো বাক্য ব্যায় না করে উঠে দাঁড়ায়। কয়েক কদম এগিয়ে যায় ছাদের রেলিঙের দিকে। প্রাপ্তিকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ফোনের ক্যমেরা অন করে সুপ্তি। কারণ সে বুঝে গেছে তার বোন গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডই কর্নকুহরে ভেসে আসে প্রাপ্তির মিষ্টি গলার সুর। দুই হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে গানের সুর তোলে কন্ঠে,

এই তো আমি চাই….
মাখবো গায়ে সোনা….
হাত বাড়ালেই ছাই…
আবার কখন ঘিরছে আমায় চাদর সকাল..
ভাঙছে আওয়াজ ঘুম…
ওওওও…..
বুনতে বুনতে ফুরোয় সময়….
গুনতে গুনতে দিন…
ওওওও….
এই তো আমি চাই…..

গান গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে যায় প্রাপ্তি। কানে আসে কোনো একটা গাড়ির আওয়াজ। মনে হচ্ছে তাদের বাড়ির সামনে কেউ সজোরে গাড়ি ব্রেক কষলো। শব্দটা স্পষ্ট প্রাপ্তির কানে এসেছে। সেই সাথে মনে জাগছে অদ্ভুত অনুভূতি। কেনো এমন লাগছে সেটা প্রাপ্তি জানে না। শুধু অদ্ভুত কিছু অনুভব করতে পারছে ব্যাস।

বোনকে এভাবে থেমে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সুপ্তি। ফোনের ক্যমেরা অন করে প্রাপ্তির গান ভিডিও রেকর্ড করছিলো সুপ্তি। মাঝপথে প্রাপ্তি থেমে যাওয়ায় চোখ তুলে প্রাপ্তির দিকে তাকায়। ক্যমেরা অফ করে এগিয়ে আসে বোনের দিকে। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,

—“কি হলো আপি? চুপ হয়ে গেলে যে!”

—“আমাদের বাসায় কি কেউ আসছে সুপ্তি? গেটের কাছে কেউ কি আছে?”

বোনের কথা শুনে নিচের দিকে ঝুকে তাকায় সুপ্তি। কিন্তু নিচে কেউ নেই। বাহিরে একটা গাড়ি দাড়িয়ে আছে শুধু। তাও রাস্তায়। সেখানে তো অসংখ্য গাড়ি চলাচল করে। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। নিচ থেকে চোখ সরিয়ে বোনের দিকে তাকায় সুপ্তি। ধীর কন্ঠে বলে,

—“কেউ তো নেই আপি। কেনো বলোতো?”

কোনো জবাব দেয় না প্রাপ্তি। তবে মনের মধ্যে কিছু একটা অনুভব করতে পারছে। কিন্তু কি সেটা প্রাপ্তি বুঝতে পারছে না। চিন্তা ভাবনা করতে করতেই চেয়ারে গিয়ে বসে।

মিনিট দশকে পরে ছাঁদে উপস্থিত হন দিলারা বেগম। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছেন। তড়িঘড়ি করে মেয়েদের সামনে এসে বলেন,

—“আমার সাথে নিচে চল তো প্রাপ্তি। তাড়াতাড়ি।”

মায়ের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রাপ্তি। প্রশ্নবোধক কন্ঠে বলে,

—“কেনো মা? কোনো দরকার?”

—“হ্যা, মেহমান এসেছে বাড়িতে। তারা তোকে দেখতে চাইছে।”

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে প্রাপ্তির। মস্তিষ্ক হয়ে যায় এলোমেলো। কেনো যেনো শ্বাস রোধ হয়ে আসছে। মায়ের কথার মানে বেশ বুঝতে পারছে প্রাপ্তি। বুকের ধুকপুকানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। হঠাৎ করেই মন মস্তিষ্কে অর্পনের বিচরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু অর্পনের খেয়াল আসছে কেনো? প্রাপ্তি তো তাকে দেখেনি। তাহলে এই অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসলো কেনো? হঠাৎ করেই চারিদিক বিষাক্ত লাগছে প্রাপ্তির। নিচে যেতে বিন্দু মাত্র ইচ্ছা করছে না। সোজা হয়ে দাড়িয়ে কাঠকাঠ গলায় প্রাপ্তি বলে,

—“আমি কোথাও যাবো না মা। যে বা যারা এসেছে তাদের ফেরত যেতে বলো। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই। আর বাবা আবার আমার বিয়ে দেয়ার জন্য পাগলামি শুরু করেছে। আগের বারের কথা ভুলে গেছে নাকি?”

—“কিচ্ছু ভুলিনি আমরা। সব মনে আছে। আগের ঘটনাটা একটা ভুলবোঝাবুঝির জন্য হয়েছিলো। তবে আজ যারা এসেছে তারা সরাসরি তোর জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ছেলেটা বেশ ভালো। ভালো চাকরি করে। সবচেয়ে বড় কথা তারা নিজে থেকে তোকে তাদের বাড়ির বৌ করে নিয়ে যেতে চাইছে।”

স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে প্রাপ্তি। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। কোনো কারণে সে বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছে না। এর কারণটা কি অর্পন? অর্পনের অপেক্ষায় কি প্রাপ্তি পথ চেয়ে আছে? এজন্য অন্য কারো সামনে যেতে মন চাইছে না? হ্যা তাই হবে। এর উত্তর তো সেটাই হয়। কিন্তু এই চাওয়াটাই তো অন্যায়। মন মস্তিষ্কের দন্দে ক্লান্ত লাগছে প্রাপ্তির। টলমল পায়ে এগিয়ে গিয়ে ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,

—“আমি বিয়ে করবো না মা। এটাই আমার শেষ কথা। তুমি বাবাকে মানা করে দিতে বলো।”

দিলারা বেগম আর কিছু বলবেন তার আগেই কামরুল রহমান সেখানে উপস্থিত হন। লাঠি ভর দিয়ে ধীর পায়ে হেটে আসছেন বৃদ্ধ। ছাঁদের শেষ প্রান্তে এসে প্রাপ্তির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ান। দিলারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলেন,

—“তুমি মেহমান দের সাথে গিয়ে কথা বলতে থাকো বৌ মা। প্রাপ্তি দিদি ভাইকে আমি নিয়ে আসছি।”

দিলারা বেগম মাথা নিচু করে সামনের দিকে পা বাড়ান। শ্বশুরের মুখের ওপর কথা বলার স্পর্ধা তার নেই। দিলারা বেগম চলে যেতেই কামরুল সাহেব প্রাপ্তির কাছ ঘেঁষে বসেন। প্রাপ্তি মাথা নিচু করে বসে আছে। মাথাটা এতোটাই নিচে ঝুকিয়ে রেখেছে যে ওর মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। কামরুল সাহেব শান্ত চোখে তাকান প্রাপ্তির দিকে। ঝুলে পড়া চামড়া যুক্ত বৃদ্ধ হাতটা প্রাপ্তির মাথায় রাখেন। আদুরে কন্ঠে বলেন,

—“আগে তো কখনো তুমি এমন করোনি দিদিভাই। তাহলে আজ এমন করছো কেনো? আমাকে সবটা বলো। কিচ্ছু লুকাবে না।”

দাদুর আদুরে কন্ঠ শুনে মাথা তুলে তাকায় প্রাপ্তি। এতোক্ষণে সকলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার কান্নারত মুখ। মাথা নিচু করে রাখায় কেউ বুঝতে পারেনি। বোনের চোখে পানি দেখে বিচলিত হয়ে যায় সুপ্তি। এগিয়ে এসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কামরুল সাহেব হাতের ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দেয়। প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

—“কি হয়েছে দিদিভাই?”

—“আমি বিয়ে করতে চাই না দাদু।”

—“কিন্তু কেনো? এর তো কোনো কারণ থাকবে।”

এই কথার প্রেক্ষিতে কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না প্রাপ্তি। তার মনের এই অদ্ভুত চাওয়ার পেছনে উপযুক্ত কারণ তো সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কন্ঠ কাঁপছে তার। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় ঠেলেঠুলে অবাধ্য কান্নারা বেরিয়ে আসবে। কান্না জোর করে আটকে রাখায় গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেছে। কয়েকবার ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রাপ্তি বলে,

—“একজন মানুষ আমার মন মস্তিষ্কে খুব গভীর ভাবে বসে গেছে দাদু। তাকে কিছুতেই মন আর মস্তিষ্ক থেকে সরাতে পারছি না। কেনো এমন হচ্ছে আমি জানি না। শুধু জানি, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে। বুক কাঁপছে। শরীর অসার হয়ে আসছে এমন ভাবতেই। তাহলে বিয়ে কিভাবে করবো আমি?”

প্রাপ্তির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান কামরুল সাহেব। প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকান সুপ্তির দিকে। সুপ্তি নিজেও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দাদুর সাথে চোখে চোখ মিলতেই নড়েচড়ে দাঁড়ায় সুপ্তি। মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে এটা বোঝায় যে, সে এই বিষয়ে কিছুই জানে না। ছোট নাতনির ইশারা বুঝে ফের প্রাপ্তির দিকে তাকান কামরুল সাহেব। ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করেন,

—“তুমি কি তাকে ভালোবাসো দিদিভাই?”

“ভালোবাসো” শব্দটা প্রাপ্তির মস্তিষ্কে গিয়ে ঝঙ্কার তোলে যেনো। ভাবনার সাগরে ডুব দেয় প্রাপ্তি। সে কি সত্যি অর্পনকে ভালোবাসে? এজন্য অন্য কাউকে বিয়ে করতে বলায় সে মানতে পারছে না? সে কি কোনো ভাবে অর্পনের জন্য অপেক্ষা করছে? কিন্তু কই, আগে তো এই কথা মাথায় আসেনি। ভালোবাসার কথা তো কখনো ভেবে দেখেনি প্রাপ্তি। ভাবনার ছেদ ঘটে কামরুল সাহেবের আওয়াজে। তিনি ফের বলেন,

—“উত্তর দাও দিদিভাই। তুমি যদি ছেলেটাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমি সেখানেই তোমার বিয়ে দেবো। তোমার বাবাকে আমি সামলে নেবো। যে ভুল সে দীপ্তি দিদি ভাইয়ের বেলায় করেছে, সেই একই ভুল আমি তোমার বেলায় করতে দেবো না।”

—“কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবাসি না দাদু।”

ভ্রু কুচকে তাকান কামরুল সাহেব। ছোট্ট করে বলেন,

—“মানে?”

—“মানে তার সাথে তো আমার প্রেমের সম্পর্ক নেই।”

—“তাহলে?”

—“জানি না দাদু। শুধু এটুকু জানি, সে আমার জীবনের বেশ খানিকটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে। আমার মাথায় শুধু তার চিন্তাই ঘুরতে থাকে।”

এই পর্যায়ে নড়েচড়ে বসেন কামরুল সাহেব। কিছুটা এগিয়ে এসে বলেন,

—“এটা তো ভালোবাসাই লক্ষন দিদিভাই।”

—“ভালোবাসি কি না জানি না। কিন্তু আমি তাকে অনুভব করতে পারি। সে আমার আশেপাশে থাকলে আমি সেটা বুঝে যাই। আমার চারিপাশ আমাকে তার উপস্থিতির জানান দেয়। তার সঙ্গ আমার বড্ড ভালো লাগে।”

কথাগুলো বলেই চুপ হয়ে যায় প্রাপ্তি। কামরুল সাহেবও চুপ। কয়েক মিনিট নিরবতা পালন করেন। নিরবতা ভেঙে প্রাপ্তি বলে ওঠে,

—“আচ্ছা ভালোবাসার জন্য কি তাকে চোখে দেখা অনিবার্য? না দেখে কি ভালোবাসা যায় না? যে চোখ দিয়ে মানুষ পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখে, সেই চোখের বিরুদ্ধে গিয়ে যদি তাকে মনের চোখ দিয়ে দেখি তাহলে কি ভালোবাসা হবে না?”

—“অবশ্যই হবে। কেনো হবে না? মানুষ চোখ দিয়ে যেটা দেখে সেটা হলো ভালো লাগা বা মোহ। আর মন থেকে যেটা অনুভব করে সেটাই হলো ভালোবাসা। ভালোবাসার জন্য দেখার প্রয়োজন নেই। চোখ বন্ধ করেও ভালোবাসা যায়।”

প্রাপ্তি নিশ্চুপ। এতোদিন ধরে চলতে থাকা মনের দন্দ মিটলো আজ। মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়ানো সকল প্রশ্নের উত্তর পেলো আজ। পূর্বের মতোই আজও দাদু তার মনের সকল সংশয় দূর করে দিলো। প্রাপ্তির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেন কামরুল সাহেব। অভয় দিয়ে বলেন,

—“তোমার সিদ্ধান্তের বিপরীতে কেউ জোর করবে না তোমায়। নিচে বসে থাকা মেহমানদেরও কৌশলে ফিরিয়ে দেবো আমি। তবে আপাতত তোমাকে যে আমার সাথে যেতে হবে দিদিভাই। না হলে যে মেহমানদের অপমান করা হবে।”

দাদুর কথা বুঝতে পেরে আলতো করে মাথা নাড়ে প্রাপ্তি। তা দেখে মৃদু হাসেন কামরুল সাহেব। নাতনির হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। নিজের সাথে করে নিচে নিয়ে যান প্রাপ্তিকে।

———————–

আধো-অন্ধকারে পরিপূর্ণ একটি কক্ষ। মাথার ওপর একটা লাল লাইট জ্বলছে শুধু। মাঝারি মাপের ঘরটায় এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে এগারোজন যুবতী মেয়ে। তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউই হুঁশে নেই। নেশাক্ত মাতালদের মতো টলমল করছে তারা। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর মারাত্মক নেশা জাতীয় কিছু প্রয়োগ করা হয়েছে। এজন্য হুঁশে থেকেও বেহুশ দের মতো পড়ে আছে।

মেয়েগুলো দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বস। তার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো যে রুহুল মেয়েগুলোকে এখান থেকে বের করতে পারেনি। কথা দিয়ে বোকা বানাচ্ছিলো সবাইকে। কারণ এই জায়গা থেকে একজন মানুষকে বের করাই প্রায় অসম্ভব। সেখানে এগারোজন মেয়েকে বের করে নিয়ে যাওয়া তাও আবার সবগুলোই পুরোপুরি মাতাল। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা নেই মেয়ে গুলোর। তাহলে তাদের বের করবে কিভাবে? সন্দেহ হলেও নিশ্চিত ছিলো না বস। তবে আজ মেয়েগুলোকে পেয়েই গেলো। রুহুলের সব পরিশ্রম বিফলে গেছে। ভাবতেই পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। হাসতে হাসতে বস বলে,

—“এভাবেই তোর সব পরিশ্রম বিফলে যাবে রুহুল। তুই শুধু দেখবি আর ছটফট করবি। তবেই না পাবো আসল মজা।”

বলেই উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে বস। তার উচ্চ ধ্বনির হাসির শব্দ রুমের চার দেয়ালে বারি খেয়ে প্রতিফলন হচ্ছে। একটা ভয়ানক পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারিপাশে। বসের ঠিক পাশেই দাড়িয়ে আছে সোহেল। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে ছেলেটা। দুরুদুরু বুক কাঁপছে। এতো কষ্ট করেও তারা উদ্দেশ্যে সফল হতে পারলো না। ভেতরে যেনো কালবৈশাখী ঝড় বইছে সোহেলের। তবে বাইরে থেকে কাউকে সেটা বুঝতে দিচ্ছে না। বস বুঝে গেলেই বিপদ। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে রনির কাছে যেতে হবে। রনিকে সবটা জানানো বিশেষ জরুরি।

চলবে?