রূপসাগরে মনের মানুষ পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
110

#রূপসাগরে_মনের_মানুষ
#কলমেঃইশা আহমেদ
#শেষ_পর্ব

একটা নতুন দিন। ঘন কালো মেঘের আড়াল থেকে সূর্য মামা বেরিয়ে এসেছে। তড়িঘড়ি করে তৈরি হচ্ছে মাহাদ। কিছুক্ষণ পর কি হবে কে জানে! তবে মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে মাহাদ যা হবে ভালো হবে এই ভেবে। ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই। মাহাদ দ্রুত শরীরে শার্ট জড়িয়ে বাইকের চাবি নিয়ে তাড়াহুড়োয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। নাহিদা সুলতানা ছেলেকে পেছন থেকে ডাকলেও মাহাদ উত্তরে শুধু এটুকুই বলেছে অবনীকে আনতে যাচ্ছি। এতেই নাহিদা সুলতানা বুঝে গেলেন সব কিছু। চিন্তা হচ্ছে তার। তবুও কিছু করার নেই। মাহাদ বাইক টান দিয়ে সোজা অবনীদের বাড়ির সামনে এসে থামে। নার্ভাস লাগছে তার। যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলে অবনীর আব্বুর সামনে এই ভেবে তার চিন্তার শেষ নেই।

অনেকটা সময় ভাবার পর সে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরজায় কড়াঘাত করলো। কিছুক্ষণের মাঝেই ওয়াহিদা বেগম এসে দরজা খুললেন। মাহাদকে তিনি প্রথম দেখাতেই চিনলেন। মাহাদ খুবই সুদর্শন একজন যুবক। যে কেউই এক দেখাতে তাকে পছন্দ করে ফেলবে। ওয়াহিদা সুলতানা ও তার ব্যাতিক্রম নন। তবুও তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,,

“ভেতরে আসো”

মাহাদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করলো। ওয়াহিদা বেগম মাহাদকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। মাহাদ অস্বস্তি চিন্তায় কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষণ বাদেই শওকত হোসেন উপস্থিত হলেন বসার রুমে। মাহাদ তাকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। সালাম দিতেই শওকত হোসেন ও উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলে। ওয়াহিদা বেগমকে পাঠান অবনীকে ডেকে আনতে। তিনি কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বলে উঠলেন,,,

“মাহাদ তোমাকে অবনী অবশ্যই বলেছে আমি কেনো ডেকে পাঠিয়েছি?”

“জি আঙ্কেল।”

“অবনী আমার একমাত্র মেয়ে। কখনো দুঃখ ছুঁতে দেইনি ওকে। ও যা বলেছে সাধ্য মতো চেষ্টা করেছি এনে দেওয়ার। ওর বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বুঝতেই পারছো কতো ভালো একজন পাত্র। অবনী সুখে থাকবে।”

“আঙ্কেল…”

মাহাদ কিছু বলবে তার আগেই শওকত হোসেন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,,,
“থামো। আমি জানি কি বলবে তুমি। টাকা পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না এটা আমি জানি। আমার মেয়ে তোমায় বেছে নিয়েছে এর অবশ্যই কোনো কারণ আছে। তুমি অতন্ত্য সুদর্শন একজন যুবক। পরিবার ও ভালো। তবে চাকরি নেই, পড়া শোনা ও শেষ হয়নি এখানেই সমস্যা। তোমার বাবার সম্পত্তি আছে বুঝলাম তবে আমার মেয়েকে তো আমি এমন ঘরে পাঠাতে পারি না তাই না যেখানে ছেলে নিজেই তার বাপের টাকায় চলে।”

“আঙ্কেল আপনি ভুল জানেন। আমি গত এক বছর ধরে নিজের টাকাতেই চলি। আমি একজন ফ্রিল্যান্সার। মোটামুটি পর্যায়ের। আমার প্রতি মাসে যেই টাকা টা আসে আমি অবনীকে খুব সুখেই রাখতে পারবো। আঙ্কেল আমি অবনীকে ভীষণ ভালোবাসি ভীষণ। ওকে আমি পাঁচ বছর যাবত পাগলের মতো ভালোবাসি। দয়া করে ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দিবেন না। মরে যাবো আমি। আঙ্কেল আমি আপনার পায়ে ধরি তবুও ওকে দিয়ে দিন আমায়। আমি আমার রানী ওকে রাখবো ওকে। একটু কষ্ট ও পেতে দিবো না। আঙ্কেল দয়া করে ওকে আমার কাছ থেকে সরাবেন না।”

শওকত হোসেন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন মাহাদের দিকে। মাহাদ সত্যি তার পা জড়িয়ে ধরেছে। আঁখি জোড়ায় চিক চিক করছে অশ্রুকণা। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না তার পরে যদি তার মেয়েকে কেউ ভালোবাসে তাহলে সে একমাত্র মাহাদ। মাহাদের আর্তনাদে অবনী বেরিয়ে এসেছে রুম থেকে। মেয়েটা কাঁদছে। শওকত হোসেন দিক বেদিক হারিয়ে ফেললেন। তিনি কখনোই পারবেন না দুটো ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করতে। তিনি যে বোঝেন ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো পাশে দেখার যন্ত্রণা। কতগুলো বছর আগে তিনি নিজেও এ যন্ত্রণা পেয়ে এসেছেন। তিনি নিজেকে শক্ত রেখে বললেন,,,

“পা ছেড়ে উঠে দাঁড়াও মাহাদ”

মাহাদ ছাড়তে চাইছিলো না। শওকত হোসেন ধমক দিতেই মাহাদ উঠে দাঁড়ালো। শওকত হোসেন অবনীকে জিজ্ঞেস করলেন,,,
“তুমি কি মাহাদের সাথে এই মুহুর্তে এক কাপড়ে বেরিয়ে যেতে পারবে?”

“আব্বু আমি তোমাকেও ভালোবাসি মাহাদকেও ভীষণ ভালোবাসি। দুজনই আমার ভীষণ প্রিয়। আমি এই মুহুর্তে মাহাদকে বেঁচে নিবো আব্বু। আমি জানি তুমি কিছুদিন পর এমনিতেই মেনে নিবে কিন্তু মাহাদকে এই মুহুর্তে হারালেও আমি কোনো দিনও ওকে পাবো না আব্বু। আমি মাহাদের সাথেই যাচ্ছি আব্বু তুমি ক্ষমা করো আমায়। ভালো মেয়ে আমি হতে পারলাম না এর জন্য খুবই দুঃখিত। আমায় ক্ষমা করো”

শওকত হোসেন মেয়ের দিকে না তাকিয়ে বললেন,,,“বেরিয়ে যাও এই মুহুর্তে”

অবনী মাহাদের সাথে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। ওয়াহিদা বেগম এতো সময় নিরব থাকলেও এখন স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন,,,
“কি করলে তুমি এটা মেয়েকে যেতে দিলে। সুখের জীবন ছেড়ে ওকে ওই খানে যেতে দিলে তুমি? ইন্জিনিয়ার ছেলে ছিলো হায় হায় কি করলা এইটা।”

শওকত হোসেন স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বললেন,,,
“চুপ! অবনী যেখানে গিয়েছে সেখানে ও অনেক বেশি সুখী থাকবে। টাকা থাকলেই সুখী হওয়া যায় না। আমি জোর করে বিয়ে দিলে মেয়েটা সংসার করলেও মন পরে থাকতো মাহাদের কাছে। এর থেকে ও মাহাদের কাছেই থাকুক। আর আমার বিশ্বাস মাহাদ সুখেই রাখবে অবনীকে।”

শওকত হোসেন এক মুহুর্ত ও সেখানে দাঁড়ালেন না। তিনি নিজের রুমে চলে গেলেন। ওয়াহিদা বেগম পেছন থেকে হা হুতাশ করতে লাগলেন। শওকত হোসেন রুমে এসে ধীর পায়ে বসলেন বিছানায়। চশমা খুলে বা হাতে চোখ মুছলেন। মেয়েকে সে কষ্টে থাকতে দেখতে পেতো না তাই তো চলে যেতে দিয়েছে। সে যতটুকু মাহাদ সম্পর্কে জানে মাহাদ খুবই ভালো ছেলে। তার মেয়েকে সুখী রাখবে। এই ভেবেই তিনি খুশি মেয়ে তার সুখে থাকবে।

দ্রুত গতিতে বাইক ছুটছে। অবনী মাহাদের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। মাহাদ থামতে বলছে না। কারণ এখন অবনীর কান্নার প্রয়োজন। অবনী কাঁদতে কাঁদতে মাহাদের শার্টের এক পাশ ভিজিয়ে ফেলেছে। মাহাদ নিরিবিলি একটা জায়গায় এনে বাইক থামায়। অবনীকে নামিয়ে ধরে পাশে থাকা বেঞ্চে বসায়। মাহাদ আলতো হাতে অবনীর চোখ মুছে দিয়ে বলল,,

“পাখি অনেক কেঁদেছো থামো এবার। না হয় চোখ মুখ ফুলে উঠবে। এমনিও ফুলে গিয়েছে। আরেকটু কাঁদলে আরো ফুলবে। তুমি আর কেঁদো না”

“মাহাদ আমি আব্বুকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। জানো আব্বু না আমায় অনেক ভালোবাসে। সেই আব্বুকে আমি কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কিন্তু আমি তোমায় ও ভীষণ ভালোবাসি মাহাদ। তোমাকেও ছাড়তে পারবো না। এর থেকে ক্ষণিকের বিচ্ছেদ ভালো। পরিবার মেনে নিবে তবে তোমায় হারালে আমি আশি বছরেও আর ফিরে পাবো না।”

“পাখি আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তুমি চিন্তা করো না আঙ্কেল আন্টি সবাই মেনে নিবে। এখন আগে বিয়ে করতে হবে তো না কি। চলো মার্কেটে শাড়ি আর পাঞ্জাবি কিনবো। এরপর বিয়ে, সোজা তোমার শ্বশুর বাড়িতে”

শেষের কথা শুনে অবনী হেসে ফেললো। মাহাদ ফোন করে ইমাদকে সব ব্যবস্থা করতে বলে দু’জন মার্কেটে গিয়ে লাল শাড়ি পাঞ্জাবি কিনলো। দু’জন তৈরি হয়ে সোজা কাজি অফিসে চলে গেলো। সবাই দু’জনকে এক সঙ্গে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছে। সব কটা মিলে ফাজলামি করতে করতে বিয়ে সম্পন্ন হলো।
দু’জন নবদম্পতি বাইকে করে ঘুরছে রাতের শহর। রাত বাজে হয়তো দশটা। সময়ের খেয়াল কি তাদের আছে। তারা পূর্ণতার সাগরে ভাসছে। মাহাদ বাইক এনে নদীর পাড়ে থামায়। অবনী মাহাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,,,

“মাহাদ আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে বিশ্বাস করে সব কিছু ফেলে চলে এসেছি আমায় ছেড়ো না মরে যবো”

“শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তোমায় আগলে রাখবো পাখি। তুমি আমার রূপ সাগরের মনের মানুষ। তোমার ছাড়া অচল আমি। তুমি হীনা আমার জগৎ শূন্য পাখি। ভালোবাসি”

দু’জন বসে পরলো নদীর পারে। শীতল হাওয়া বইছে। মাহাদ বিড়বিড় করে আওড়ালো,,
“আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না
বলে বলুক লোকে মন্দ
বিরহে তার প্রাণ বাঁচে না
দেখেছি-
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”

#সমাপ্ত