অনপেখিত পর্ব-১২

0
65

#অনপেখিত
পর্ব ১২
লিখা Sidratul Muntaz

“আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি।” একটা লাইন বার-বার লিখে যাচ্ছে মেহেক তার ডায়েরীতে। তবুও মন ভরছে না। আরও লিখতে মন চাইছে। ফারদিন বাথরুম থেকে বের হতেই তাড়াহুড়ো করে ডায়েরীটা লুকিয়ে ফেলে মেহেক।

ফারদিনের গলায় তোয়ালে, খালি গা, ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে গোসলে যাওয়ার আগে মেহেককে ঘুমন্ত দেখেছিল। এখন উঠতে দেখে কাছে এগিয়ে এলো। কপালে হাত রাখতেই সামান্য কেঁপে উঠল মেহেক। কি ঠান্ডা হাত!

ফারদিন ভ্রু কুঁচকে বলল,” জ্বর এখনও কমেনি দেখছি। ঠিকাছে রেস্ট করো। আমি বাইরে যাচ্ছি।”

” বাইরে কোথায়?”

” তোমার জন্য ঔষধ নিয়ে আসি।”

” আমার ঔষধ লাগবে না। আপনি আমার পাশে বসে থাকুন।”মেহেক আবদারের স্বরে বলল।

ফারদিন হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল,” বসে থেকে কি করব?”

মেহেক ঘাড় কাত করে বলল,” কেন? আমাকে আদর করবেন।”

ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ফারদিন হতভম্ব হয়ে বলল,” মাত্র একরাতেই লজ্জা শেষ? ”

মেহেক লজ্জা পেয়ে হেসে দিল। দ্রুত মুখ আড়াল করতে ফারদিনের বুকে মাথা ঠেঁকাল। কি মিষ্টি একটা গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ।

” তোমার শরীর ভালো নেই মেহেক। অন্তত একটা পেইন কিলার খেতেই হবে।”

” লাগবে না। আপনি কোথাও যাবেন না আমাকে ছেড়ে।”

” সকাল থেকে ঘরে বসে আছি। সবাই কি ভাববে?”

মেহেক পেটের উপর হাত রেখে বলল,” আমার পেট ব্যথা করছে।”

” এজন্যই তো বললাম, পেইন কিলার…”

” আপনিই তো আমার পেইন কিলার। আমার কাছে থাকুন, ব্যথা সেরে যাবে। ”

বলেই হেসে উঠল মেহেক। ফারদিনকে টেনে নিজের কাছে বসালো। দুহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” আপনি আমাকে কখনও ছেড়ে যাবেন না তো?”

ফারদিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জ্বরের ঘোরে মেয়েটা পাগলামি করছে খুব। ফারদিনের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সে কি মেয়েটার সাথে অনেক বেশিই অন্যায় করে ফেলেছে এই কয়দিনে? নিশ্চয়ই করেছে৷ তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে মেহেককে বিয়ে করা। তারপর বিভিন্ন ঘটনায় মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়া।

হঠাৎ শব্দে ফারদিন চ’মকে তাকাল। মেয়েটা কাঁদছে। তার ফোলা ফোলা মায়াবী চোখ দু’টো অশ্রুতে পরিপূর্ণ।

” কি হয়েছে মেহেক? তুমি কাঁদছো কেন?”

” জানি না। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো কখনও? ”

ফারদিন হালকা গলায় বলল,” না, যাব না।”

” সত্যি?” মেয়েটার সারামুখ হাসিতে ভরে উঠল। ফারদিন মাথা নেড়ে বলল” হ্যাঁ সত্যি!”

মেহেক শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল ফারদিনকে। তারপর গালে, কপালে, সারামুখে চু’মু দিতে লাগল। ফারদিন বলল,” কি করছো?”

” আপনি আমার কি হোন? স্বামী তাই না? তাহলে আমি আমার স্বামীকে নিজের ইচ্ছেমতো আদর করতে পারব না?”

” হুম পারবে।”

মেহেক মুচকি হাসল। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তার ছোট্ট শরীরটা দুইহাতে আগলে নিল ফারদিন। তারও ইচ্ছে করল মেহেককে রাতের মতো আদর করতে। কিন্তু মেয়েটার শরীর ভালো নেই। তাই নিজেকে সা’মলালো ফারদিন। মেহেকের পাগলামিকে প্রশ্রয় দিলেও নিজের পাগলামিকে প্রশ্রয় দিল না। মেহেক খুব দ্রুতই আবার ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু সে শক্ত হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে আছে ফারদিনের হাত।

ফারদিন খুব সাবধানে মেহেকের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে উঠে বসল। তখনি শুনতে পেল মেহেক বিড়বিড় করছে,” যাবেন না, যাবেন না। ”

কথাগুলো বলার সময় সে কেমন কান্নার মতো একটা ভঙ্গি করছে। বার-বার তার ঠোঁট উল্টে যাচ্ছে।

এতো বেলা করে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য যতটা অস্বস্তির মুখে পড়তে হবে বলে ফারদিন ভেবেছিল, ততটা হলো না৷ সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। সুজানা আর আনজীর ঘুরতে বের হয়েছে। পূর্বিতা গোসলে গেছে। ওয়াসীম ব্যালকনিতে বসে ফোনে রিলস দেখছে। ফারদিনকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,” দোস্ত, কি অবস্থা? আজকের প্ল্যান কি? বের হবি কোথাও?”

ফারদিন স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করল। সবকিছু স্বাভাবিক। সে তো ভেবেছিল রুম থেকে বের হলেই বন্ধুদের তোপের মুখে পড়তে হবে। কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারেনি ভেবেই হালকা লাগছে।

মেহেকের ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোনের শব্দে। সে ঘুমো ঘুমো চোখে ফোন হাতে নিল। ওইপাশ থেকে ভেসে এলো মেয়েলী কণ্ঠ,” হ্যালো, গুড মর্ণিং ফারু।”

মেহেক অস্ফুট স্বরে বলল,” কে বলছেন?”

” আমি ফয়জুন্নিসা। ফারু আছে? তুমি কে?”

” তার আগে বলুন আপনি কে? ফারু কে? এখানে ফারু নামের কেউ থাকে না।”

” ফারু মানে ফারদিন। ওকে ফোনটা দাও।”

মেহেক কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,” ফারদিনের সাথে আপনার কি সম্পর্ক যে আপনি তাকে ফারু বলে ডাকছেন?”

” কি সম্পর্ক সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করো।”

মেহেক আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিল। মাথাটা কেমন ভনভন করে ঘুরছে তার। সুজি ছাড়াও কি ফারদিনের জীবনে অন্যকেউ আছে? কে এই মেয়ে? এতো অধিকারবোধ নিয়ে সে ফারদিনকে ফারু বলে কেন ডাকছে?

মেহেক রুম থেকে বের হয়ে ব্যালকনি পর্যন্ত এলো। ফারদিনের মোবাইলটা তার হাতেই। কাঠের চেয়ারে বসে গল্প করছিল ওয়াসীম আর ফারদিন। তাদের কথার বিষয়-বস্তু শুনে মেহেক আ’চমকাই থ’মকে দাঁড়াল।

” তুই কি এখনও মেহেককে ডিভোর্স দিতে চাস?” ওয়াসীম প্রশ্ন করল।

ফারদিন মাথা নিচু করে বলল,” জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে আমি মস্তবড় ভুল করেছি। মেহেকের সাথে ইন্টিমেট হওয়া ঠিক হয়নি আমার। এতে ওর আমার প্রতি এক্সপেক্টেশন অনেক বেড়ে গেছে। অথচ আমি কালরাতে যেটা করেছিলাম সেটা শুধুই সুজির উপর রাগ থেকে। ”

মেহেকের মাথা ঘুরে উঠল। দুনিয়া দুলে উঠল। কেমন যেন হঠাৎ অন্ধকারবোধ হলো সবকিছু। বিশাল উঁচু স্থান থেকে যেন আছড়ে ফেলে দেওয়া হলো তাকে! অপমানে চেহারা থমথমে, চোখ অশ্রুসিক্ত।

ওয়াসীম আফসোসের স্বরে বলল,” কাজটা একদম ঠিক হয়নি ফারদিন। মেয়েটার এখন কি হবে? তোর কি ওর প্রতি একটুও ফিলিংস নেই?”

” না। ওর প্রতি কোনো ফিলিংস নেই আমার। যেটা আছে সেটা শুধুই এট্রাকশন। ফিজিক্যাল নীড!”

মেহেক আর কিছু শুনতে পারবে না। মুখে হাত চেপে ছুটে ঘরে চলে এলো। তার কান্না পাচ্ছে না, কষ্টও লাগছে না, কেমন দূর্বোধ্য একটা অনুভূতিতে তিক্ত লাগছে সবকিছু। পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষ কি তবে এক?

রাতে সুজানা আর আনজির ফিরল অনেক শপিং নিয়ে। তারা ডিনার করে এসেছে। মেহেকের জন্য আড়ং থেকে খুব সুন্দর একটা আনারকলি কূর্তি কিনেছে সুজানা। সেটা দেখিয়ে মেহেককে জিজ্ঞেস করল,” তোমার পছন্দ হয়েছে?”

মেহেক শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। সুজানা মেহেকের গালে হাত রেখে বলল,” কাল ফিরে যাচ্ছি। দিনগুলো খুব মিস করব। তোমার কথা খুব মনে পড়বে। ”

মেহেক সামান্য হাসল৷ সুজানা প্রশ্ন করল,” তোমার মনে পড়বে না আমার কথা?”

” পড়বে আপু।”

সুজানা ফারদিনের দিকে তাকিয়ে বলল,” এইযে ভদ্রলোক, বউকে নিয়ে কিন্তু অবশ্যই আমার বাসায় বেড়াতে আসবেন। মনে থাকে যেন।”

মেহেক পাথরের মতো মুখ করে বসে আছে। একবারও ফারদিনের দিকে তাকাল না। তাই সুজানার কথায় ফারদিনের মুখের অভিব্যক্তিও বুঝতে পারল না।

পেয়ারা গাছের নিচে একাকি বসে মেহেক। আজকে সুজানারা চলে গেছে। মেহেক আর ফারদিন আরও কিছুদিন এখানেই থাকবে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মেহেক চিন্তা করছে, সে মরে গেলে কয়জন কষ্ট পাবে? আম্মা তো নিশ্চয়ই খুব কাঁদবেন। আব্বা কি কাঁদবেন? মেহেক কখনও তার আব্বাকে কাঁদতে দেখেনি। মেহেকের মৃত্যুর পরেও হয়তো তিনি কাঁদবেন না। কে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে মেহেকের মৃত্যুতে? সুজানা আপু কি কষ্ট পাবে? সুজানা চলে যাওয়ার আগে মেহেককে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,” ভালো থেকো মেহেক।”

মেহেকের ওই মুহুর্তে কি যে ভালো লেগেছিল! সুজানা তার থুতনি স্পর্শ করে বলল,” একদম মনখারাপ করবে না ঠিকাছে? ফারদিন দেখবে তোমাকে অনেক ভালোবাসবে৷ কারণ তোমার মতো একটা মেয়েকে ভালো না বেসে থাকাই যায় না। আর ফারদিনকে আমি হারে হারে চিনি। মাথাগরম হলে ও একটু পাগলামি করে। কিন্তু মাথা ঠান্ডা থাকলে ও হয় সবচেয়ে ভালো মানুষ। রাগী হলেও ওর মনটা খুব নরম। তুমি ওর কাছে নিশ্চয়ই ভালো থাকবে। আর ভুলেও এই কথা ভেবো না যে ফারদিন আমাকে ভালোবাসে। কারণ সে যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসতো তাহলে তোমাকে বিয়ে করতেই পারতো না।”

সবশেষে সুজানা আরও একটা কথা বলেছিল,” আমেরিকা থেকে আমি আমার এই ছোট্ট বোনের জন্য একটা সুন্দর উপহার পাঠাবো।”

মেহেক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সুজি আপুর উপহার কাছে পৌঁছাবে না৷ মেহেকের স্বল্প পরিসরের জীবনটা হয়তো ফুরিয়ে এসেছে। বাঁচার আশা তার মধ্যে আর বিন্দুমাত্র নেই। বন্দী খাঁচার পাখি হয়ে সে বাঁচতে চায় না! তার এখন ভীষণভাবে মুক্তি চাই৷ সেই মুক্তির নাম মৃত্যু।

ফারদিনের ঘুমের সুযোগ নিয়ে মেহেক তার পকেট থেকে লাইটার চুরি করে এনেছে। ফারদিন তা টের পায়নি। উর্মিদের ঘর থেকে মেহেক কেরোসিন আর ইঁদুর মারার বিষ এনেছে। ইঁদুর মারার বিষ ব্যাক আপ হিসেবে কাজ করবে। যদি শরীরে আগুন লাগাতে ভয় লাগে তাহলে মেহেক বিষ খেয়ে নিবে। এই যন্ত্রণাময় জীবনের বোঝা তার পক্ষে বয়ে বেড়ানো আর সম্ভব না। সে একটু শান্তি চায়। মৃত্যু কি তাকে দিতে পারবে সেই শান্তি?

ফারদিন ঘুম ভেঙে দেখল পাশে মেহেক নেই। মুহূর্তে বিচলিত হয়ে উঠল। ইদানিং একটা ব্যাপার সে খুব ভালোভাবে আবিষ্কার করেছে। সে আসলে ভালো থাকতে পারছে না। তার কি যেন একটা নেই! কিছু একটা’র বড্ড অভাব। আর অভাবটা ফারদিনের সহ্য হচ্ছে না। পৃথিবীর সবকিছু অর্থহীন লাগছে, অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। শুধু সেই জিনিসটির অভাবে নিজেকেও নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে।

মেহেক কাল থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে। কোনো কথা বলছে না তার সাথে। শুধু তার সাথে কেন? কারো সাথেই খুব একটা কথা বলছে না মেহেক৷ সারাক্ষণ দরজা আটকে একটা ঘরে বসে ছিল। ফারদিন তাকে যে পাখি কিনে দিয়েছিল সেই পাখিগুলোও আজ সকালে বাগানে ছেড়ে এসেছে মেহেক। সে কেমন যেন হয়ে গেছে। তার এই পরিবর্তনটা বড় অদ্ভুত। কিন্তু তার এই পরিবর্তন ফারদিনকেই বা কেন এতো বিচলিত করছে? কেন ফারদিনের দম আটকে আসছে? সে কি আগের মেহেককে মিস করছে? মেহেকের উচ্ছলতা, চাঞ্চল্য, বাচ্চাদের মতো বোকা-বোকা কথাবার্তা,সবকিছু হারিয়ে গেছে৷ ফারদিনের মনে হচ্ছে তার জীবনের ছন্দটাও যেন এগুলোর সাথে হারিয়ে গেছে।

পেয়ারা গাছের নিচে মেহেককে বসে থাকতে দেখেই ছুটে গেল ফারদিন। অবাক হয়ে বলল, ” এইখানে তুমি কি করছো মেহেক? তোমার কি ভয় লাগে না?”

মেহেক মনে মনে হাসলো। আর ভয়! এখন মেহেক শুধু একটা জিনিসকেই ভয় পায়। তা হলো বেঁচে থাকা। এই লানিত, গ্লানিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে দূর্বিষহ ব্যপার আর কি হতে পারে? ফারদিন মেহেকের পাশে বসলো। হঠাৎ বলল,” আমি কি তোমার হাতটা ধরতে পারি মেহেক?”

মেহেক নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাল। আচ্ছা, সে যদি মরে যায় তাহলে এই মানুষটা কি কাঁদবে তার জন্য? ফারদিন অনুমতির আশায় বসে থাকল না।মেহেকের ফরসা, কোমল হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। মেহেক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছুতেই সে তার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। মরার আগে দুনিয়া তাকে মায়ার বাঁধনে জড়াতে চাইছে। কিন্তু মেহেক কিছুতেই এই মিথ্যে মায়ায় ভুলবে না। সে চিরবিদায় গ্রহণ করবে পৃথিবী থেকে। তার বাঁচার অধিকার নেই।

ফারদিন কি মনে করে যেন আচমকা মেহেকের হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিল। মেহেক কেঁপে উঠলো, সংকুচিত হলো, থেমে গেল তার শ্বাস-প্রশ্বাস, শরীরের রক্ত চলাচলেও যেন এক মুহুর্তের জন্য বিঘ্ন ঘটল। ফারদিন তাকিয়ে দেখল মেহেকের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে৷ তার বুকের ভেতরটা সুচালো এক তীক্ষ্ণ ব্যথায় হাহাকার করে উঠলো। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হলো। যেন তার জন্যই মেহেকের এই করুণ দশা। নিজের মনের এই অনুভূতির কারণ ফারদিনের কাছে স্পষ্ট নয়। সে মেহেককে ভালোবাসতে না পারলেও মেহেক তো তাকে ঠিকই ভালোবেসেছিল।

দীর্ঘসময় ফারদিন মেহেকের ছোট্ট হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বসে রইল। আর মেহেক? সে যেন পাথুরে মূর্তি। একটা কথাও বলছে না। যেন নিশ্বাসও নিচ্ছে না। ফারদিন ধৈর্য্য হারিয়ে প্রশ্ন করল,” আমি অনুরোধ করছি মেহেক, প্লিজ বলো কি হয়েছে তোমার? আমার আচরণে কি কোনোভাবে কষ্ট পেয়েছো তুমি? তাহলে আ’ম স্যরি।”

মেহেক দীর্ঘসময় পর শীতল গলায় প্রশ্ন করল,” জীবনে কখনও ধর্ষিতা দেখেছেন আপনি?”

তার এমন প্রশ্নে ফারদিন কিছুটা বিস্মিত হলো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেহেক নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,” না দেখে থাকলে দেখে নিন। ধর্ষিতা আপনার সামনেই বসে আছে।”

ফারদিনের হৃৎপিন্ড যেন এক মুহুর্তের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। মুষ্টিতে নিয়ে রাখা মেহেকের হাতটা আপনা-আপনি ছেড়ে দিল সে। মেহেক চোখ দু’টি স্তব্ধ,অনুভূতিশূন্য! সে কান্নার দমক সামলে বলল,” কি ব্যাপার? এখন কথা বলছেন না কেন? খুব তো জানতে চাইছিলেন। এখন কি সহ্য করতে পারছেন না?”

ফারদিনের মনে হলো বাতাসে অক্সিজেনের বদলে বিষ প্রবেশ করছে নাক দিয়ে। চারদিকে দমবন্ধকর অনুভূতি। শুধু ঠোঁট দু’টি নাড়িয়ে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল একবার,” কি বলছো এসব?”

মেহেকের কণ্ঠে লুটিয়ে পড়ল আর্তনাদের হাহাকার।ফারদিনের এই কথাটুকু সহ্য করতে বেশ বেগ পেতে হলো। হৃদয় কেঁপে উঠলো নিদারুণ যন্ত্রণায়। মেহেক দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুজে গুমরে কাঁদতে শুরু করল।

২০১৮ সাল। মাত্র শীত পড়তে শুরু করেছে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ শীতের পোশাক গাঁয়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাঁড়ে করে খেঁজুরের গুঁড় নিয়ে ছুটছে বিক্রেতারা। সন্ধ্যা হলেই কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে চারপাশ। ঘন অভয়ারণ্যেটিতে তখন মনে হয় গভীর রাত। মেহেকদের জমিদার বাড়ির সবকয়টি আলো প্রজ্জ্বলিত হয় সন্ধ্যা নামলেই। সদ্য কৈশোরে পা রাখা তেরো বছর বয়সী মেহেক তখন ভীষণ চঞ্চল। তার দস্যিপনার যেন অন্ত নেই। একবার রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের বকুনি খেয়ে এসে বইয়ে মুখ গুঁজে। তো পরক্ষণেই আবার ছোট ভাই-বোনদের ডাকে ছুটে যায় কানামাছি খেলতে। চোখে পট্টি বেঁধে অঘটন ঘটায় একের পর এক। কেউ কিছু বললেই খিলখিল করে হেসে পালানো তার স্বভাব। যেন তার জন্মই হয়েছে হাসার জন্য। হেসে,খেলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব যেন তার একার কাঁধেই অর্পিত। মেঝ চাচী বিরক্ত হয়ে বলেন,” এই মেয়েকে এবার বিয়ে দিন বাসন্তী আপা”

মেহেকের মা বাসন্তী হাসেন। জাঁয়ের কথা দুষ্টমি ভেবে উড়িয়ে দেন। কিন্তু মেহেক জানে, মেঝো চাচি আসলে দুষ্টমি করেন না। তিনি প্রায়ই মেহেকের আব্বার কান ভাঙেন বিয়ের কথা বলে বলে। মেহেক আড়ালে দাঁড়িয়ে অনেকবার শুনেছে। কোনো এক বিচিত্র কারণে মেহেক তার মেঝো চাচীর দুই চোখের দুশমন। কারণটা হতে পারে মেহেকের বাবার টাকা-পয়সা। হ্যাঁ, মেহেকের বাবার যে পরিমাণ টাকা আছে তাতে এই গ্রামের মতো আরও দশটা গ্রাম অনায়াসে লালন-পালন করা যাবে। মেহেকের আব্বা খুব ছোটকাল থেকেই পরিশ্রমী ছিলেন। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। কিন্তু তাঁর ভাইগুলো একেকটা অকর্মার ঢেঁকী। তিনবোনের বিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভাইদের সংসার পালার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন মোজাম্মেল শাহ্। একটা ছেলের খুব শখ ছিল মোজাম্মেল সাহেবের। কিন্তু পরপর তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম হলো। দু’জন জন্মের পরপরই মারা গেছে। মেহেকই একমাত্র টিকে ছিল। তাই সে মায়ের বড় আদরের। মেহেক জন্মানোর আগে মোজাম্মেলকে জানানো হয়েছিল এইবার ছেলে আসছে। তিনিও ছেলের আশা নিয়ে মেহেককে হসপিটালে দেখতে গেছিলেন। কিন্তু যখন জানতে পারলেন মেয়ে তখন একবার ছুঁয়েও দেখলেন না। মোজাম্মেলের চোখের মণি ছিল মেহেকের মেঝোচাচার দুই ছেলে শাফায়েত ও শাফিন। এদের দুইজনকে নিয়ে মেতে থাকতেন সারাক্ষণ। আর মেহেকের মেঝোচাচীও চান ভাসুরের সমস্ত সম্পত্তি যেন তার এই দুই ছেলের মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া হয়। মেহেক যেন কানাকড়িটিও না পায়।

মূলত এই হিংসা থেকেই তিনি মেহেককে সহ্য করতে পারতেন না। মেহেক ছোটবেলায় তো এতোকিছু বুঝতো না। বড় হওয়ার পর আস্তে আস্তে বুঝেছে। মেহেকের ছোটচাচী বিয়ের অনেকবছর পরেও কোনো সন্তান জন্ম দিতে পারেননি। তাই তিনি মেহেককে একটু বেশিই স্নেহ করেন। আর মেহেকও বাড়িতে তার ছোটচাচী আর আম্মাকে সবচেয়ে পছন্দ করে। দাদীমার কাছেও মেহেক চোখের মণি। এছাড়া মেহেকের নানু,মামা,খালা, সবাই মেহেককে অনেক ভালোবাসেন। মেহেক বলতে পাগল তারা। মেহেক ছিল অত্যাধিক রূপবতী একটি মেয়ে৷ তার ঘন রেশমি চুল, ফরসা, কোমল, ছিপছিপে দেহ, বড় বড় চোখ, ছোট্ট নাক, পাতলা ঠোঁট সব মিলিয়ে যেন একটা জ্যান্ত পুতুল। সে আচমকা যখন খিলখিল করে হেসে ফেলে তখন তার দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। ঐশ্বরিক সৌন্দর্য্যের এই মেয়েটি ছিল ভীষণ নিষ্পাপ,সহজ সরল আর চঞ্চলাবতী। তার সুন্দর ফুলের মতো জীবনে একদিন অন্ধকার নামাতে কালো হাত নিয়ে আচমকা প্রবেশ করল এক অসুর।

একদিন স্কুল থেকে মেহেক বাড়ি ফিরে দেখল মেহমান এসেছে। আম্মা,চাচীরা ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটোছুটি করছে। ঘরদোর সাজিয়ে হুলুস্থুল অবস্থা৷ খাওয়া-দাওয়ারও হয়েছে ব্যাপক আয়োজন। বোঝা গেল মেহমান কোনো সাধারণ মানুষ নয়। রাজা-বাদশার বংশধর হবে বোধহয়। ছোটভাই শাফায়েতের কাছ থেকে জানা গেল ঢাকা থেকে অনেক বড়নেতা এসেছেন। গাঁয়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, শরীরে আঁতরের সুগন্ধ, দেখতেও নাকি রাজপুত্রের মতো সুন্দর! আঠাশ বছরের সুদর্শন যুবক। মেহেক খুব আগ্রহী হয়ে দেখতে গেল বিশেষ মেহমানটিকে। তিনি বসেছিলেন মেহেকদের বৈঠকঘরের সোফায়। প্রথম দর্শনেই মেহেকের অরুচি এসে গেল মানুষটির প্রতি। মেহেকের আব্বার সামনে পায়ের উপর পা তুলে লোকটা বেয়াদবের মতো উচ্চস্বরে কথা বলছে। মুরব্বিদের সাথে কথা বলার ধরণ বুঝি এমন হয়? কিসের শিক্ষিত এরা? কিসের আবার নেতা? যার নিজেরই আদব-কায়দার অভাব সে আবার কন্ট্রোল করবে জনগণকে? নিতান্তই হাস্যকর ব্যাপার! মোজাম্মেল শাহ মেহেককে দেখেই হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন,” স্কুল থেকে কখন এসেছো মামনি?”

মেহেক পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার কণ্ঠ শুনেই পর্দা ছেড়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। আব্বাকে সে ভয় পায়। মোজাম্মেল সবসময় কঠিন ভঙ্গিতে মেহেকের সাথে কথা বলেন। কিন্তু আজকে খুব নরম সুরে গান গাইছেন। কারণটা হয়তো এই বিশেষ অতিথি। মোজাম্মেল শাহ হাত বাড়িয়ে বললেন,” এদিকে এসো মা। ভেতরে আঙ্কেল আছে একটা সালাম দিয়ে যাও।”

মেহেক মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকল। নতুন অতিথিকে বিনীত স্বরে সালাম দিল। ঠিক সেই সময় শকুনি দৃষ্টিটা নিক্ষিপ্ত হলো মেহেকের উপর। দুধে আলতা ফরসা গাঁয়ে নেভী ব্লু রাউন্ড শেপের ইউনিফর্ম পড়া রেশমি চুলের পুতুলের মতো সুন্দর মেয়েটিকে দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য সম্বিৎ হারালো উপজেলা পরিষদের তরুণ চেয়ারম্যান রাজ আহমেদ খান। তেরো বছর বয়সী কিশোরীর রূপে বোধজ্ঞান হারিয়ে সে এতোটাই মগ্ন হলো যে দ্বিতীয়বার ডেকে তার সম্বিত ফেরাতে হলো। মোজাম্মেল ডাকলেন,” রাজ ভাই, আমার মেয়ে মেহেক। ক্লাস এইটে উঠলো এবার।”

রাজ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত মেহেককে একবার দেখে সালামের জবাব নিল। মেহেকের খুব অস্বস্তি লাগছিল লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। যেন চোখ দিয়েই লোকটি গিলে খাচ্ছিল তাকে। শাফায়েতের বর্ণনায় এই লোকটি নাকি সুন্দর। হ্যাঁ, বলা যায় সুন্দর। কিন্তু মেহেকের এই সৌন্দর্য্য ভালো লাগলো না। লোকটার চেহারাতেই কেমন একটা শয়তানি ভাব। দেখলে মন চায় জোরে একটা ঘুষি মেরে থুতনি ফাটিয়ে দিতে। হঠাৎ অপরিচিত লোকটির প্রতি কেন পিচ্চি মেহেকের এতো ক্ষোভ জন্মালো সেটা মেহেক তৎক্ষণাৎ বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছিল। লোকটার অমার্জিত নজরই ছিল তার প্রতি বিতৃষ্ণার কারণ। এরপরদিনই মেহেক জানতে পারল রাজ আহমেদ তার আব্বাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। মেহেককে সে বিয়ে করতে চায়।

চলবে