গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-০১

0
111

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#Raiha_Zubair_Ripti
#সূচনা_পর্ব

বাবার পছন্দ করা পাত্র হিসেবে নিজের ভার্সিটির একাউন্ট ডিপার্টমেন্টের রাগী জল্লাদ লেকচারার শাফায়াত ইমতিয়াজ কে দেখে চমকে উঠলো রুয়াত। যাকে কি না যমের মতো ভয় পায় সে তার সাথে তার বাবা বিয়ে ঠিক করেছে! রুয়াতের জানা মতে তো তার হবু বরের নাম নোয়াশ তাহলে ইনি কেনো এখানে?

রুয়াত তড়িঘড়ি করে কেবিন নম্বরটা দেখে নিলো। নাহ্ ঠিক কেবিন টাতেই তো এসেছে সে। তার মা আসার আগে বলে দিছে থার্ড ফ্লোরের সাত নম্বর কেবিন টাতে নোয়াশ অপেক্ষা করছে। রুয়াত যখন আসে তখন কেবিন টা ফাঁকাই ছিলো। অপেক্ষা করছিল তার বাবার পছন্দ করা ছেলের জন্য। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে পাশে কাউকে চেয়ার টেনে বসতেই রুয়াত সেদিক তাকায়। কিন্তু পাশ ফিরে শাফায়াত ইমতিয়াজ কে দেখে রীতিমতো ভড়কে যায় রুয়াত। লোকটার শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার। এখনও তাকায় নি রুয়াতের দিকে। তাকালে নিশ্চয়ই রুয়াতের মতো সেও চমকে উঠতো।
-“ দুঃখিত দেরি….
কথাটা বলতে বলতে মাথা উঁচু করতেই আর কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না শাফায়াত । দৃষ্টি পাত হলো দু’জনের। রুয়াত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অস্বস্তিরা প্রবল ভাবে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে তাকে সাথে ভয় ও। লোকটা ভীষন পাজি রুয়াতের ভাষ্যমতে। কেননা একাউন্ট সাবজেক্টে জাস্ট অঙ্কে এফোঁড়ওফোঁড় হলেই সবার সাথে বেশ রুড হয়ে কথা বলে। রুয়াতের সাথেও বেশ কয়েকবার রুড হয়ে কথা বলেছে। সাথে শাস্তি স্বরূপ সেই টপিক রিলেটেড অধ্যায়ের সব উদাহরণের অংঙ্ক বাসার কাজ দিয়েছে।

শাফায়াত ও বেশ চমকালো নিজের স্টুডেন্ট কে পাত্রী রূপে দেখে তা তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও কিছুটা শিউর হওয়ার জন্য রুয়াতের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল-
-“ আপনি কবির আঙ্কেলের মেয়ে?
রুয়াত মাথা নত করেই জাবাব দিলো-
-“ জ্বি স্যার।
শাফায়াতের কপালে দু ভাজ পড়লো। বিরক্তির নাকি চিন্তার সেটা ঠাওর করা গেলো না।
-“ আপনি কি আগে থেকেই জানতেন আঙ্কেল আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে?
রুয়াত তড়িৎ গতিতে তাকালো শাফায়াতের দিকে। ঝড়ের বেগে মাথা নাড়িয়ে বলল-
-“ না না স্যার আমি সত্যি আগে জানতাম না আপনার সাথে বাবা বিয়ে ঠিক করছে। তাহলে বিশ্বাস করুন আমি জীবনেও আসতাম না এখানে। আপনাকে বিয়ে করার চেয়ে সারাজীবন সিঙ্গেল থাকা ঢের ভালো।

শাফায়াত ভ্রু কুঁচকালো রুয়াতের কথায়। মেয়েটা কি বুঝাতে চাইছে?
রুয়াত আশেপাশে তাকালো। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলছে। নিজেকে নিজেরই ঠাটিয়ে চড় দিতে ইচ্ছে করছে। এই লোকটা সামনে থাকলেই কায়নাথ ভয়ে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলে।
-“ আপনার বাবা কে তাহলে বাসায় গিয়ে বলে দিবেন আপনার আমাকে পছন্দ হয় নি।

অন্যমনষ্ক হয়ে জবাব দিলো রুয়াত -“ হু। পরক্ষণেই কথার মানে বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ বিস্ফোরণ নিয়ে বলে “ কিহ বললেন!
শাফায়াত মাথার চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিলো। তারপর নড়েচড়ে বসে বলল-
-“ আপনি নিজেই বলেছেন,আমাকে বিয়ে করার চেয়ে সিঙ্গেল থাকা ঢের ভালো। তো বিয়ে টা ভাঙার জন্য তো রিজন লাগবে। আমার ও তো শখ নেই নিজের ছাত্রী কে বিয়ে করার। রেপুটেশনের ও তো একটা ব্যাপার আছে। তাই বলছি বাসায় গিয়ে আঙ্কেল কে বলবেন আপনার আমাকে পছন্দ না তাই আপনি বিয়ে টা করবেন না।
কথাটা বলেই শাফায়াত বসা থেকে উঠে চলে গেলো।
রুয়াত চোখ বড়বড় করে তাকালো শাফায়ারের যাওয়ার পানে। লোকটা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এমন অভদ্রের মতো চলে গেলো! যেখানে রুয়াত বাবার মুখের উপর একটা টু শব্দ ও করতে পারে না, বিয়ে ঠিক করার আগে বলেছে তার বাবার পছন্দের ছেলেকেই সে বিয়ে করবে সেখানে কি না রুয়াত বলবে এসব,তার ছেলে পছন্দ না সে এই বিয়ে করবে না!

ইচ্ছে করলো লোকটাকে পঁচা পানিতে চুবাতে রুয়াতের। এখন বাসায় গিয়ে কি বলবে সে? তার মা তো পইপই করে বলে দিয়েছে নোয়াসের সাথে কোনরকম উচ্চবাক্য করবিনা। তোর বাবার খুব পছন্দ ছেলেটাকে। আর তোকে তোর বাবার অনুমতি নিয়েই রেস্টুরেন্টে দেখা করছে। তাই লক্ষী মেয়ের মতো দেখা করে চলে আসবি। মনে থাকে যেনো।”
সে তো ভদ্র মেয়ের মতোই ছিল। কিন্তু এই লোক তো মোটেও ভদ্র নয়। তা না হলে এভাবে হুট করে এসে কফি ঠান্ডার অফার না দিয়ে দুম করে চলে যায়?

মাথা ভর্তি রাগ নিয়ে রুয়াত ওয়েটার কে ডেকে একটা কোক অর্ডার করে। কোক টা খেয়ে মন মেজাজ হালকার উপর ঝাপ্সা ঠান্ডা করে বিল পে করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। তারপর রিকশা ডেকে বাসায় চলে গেলো।

এদিকে শাফায়াত রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে সোজা নিজের বাসায় চলে আসে। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। সে যদি ঘুনাক্ষরে ও টের পেতো কবির আঙ্কেলের মেয়ে তারই ভার্সিটির ছাত্রী তাহলে সে কস্মিনকালেও এই বিয়েতে হ্যাঁ জানাতো না।

শারমিন বেগম ছেলেকে এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে দেখে ছেলের দিকে এগিয়ে যায়। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে –
-“ মেয়েটাকে পছন্দ হইছে তোর তাই না শাফায়াত ? ভীষণ লক্ষী একটা মেয়ে পছন্দ হয় নি তোর এটা বললে আমি বিশ্বাস ই করবো না।

শাফায়াত শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো।
-“ মা এই বিয়েটা নিয়ে আর এগিয়ো না। মানা করে দাও।
শারমিন বেগম অবাক নয়নে তাকালো ছেলের পানে।
-“ মানা করে দিবো মানে কি শাফায়াত?
-“ তুমি যাকে আমার জন্য সিলেক্ট করছো সে আমারই ভার্সিটির স্টুডেন্ট মা। বিষয় টা ভেবে দেখো,আমি শিক্ষক হয়ে তো আর নিজের ছাত্রী কে বিয়ে করতে পারি না। প্লিজ তুমি এই বিয়ে নিয়ে আর এগিয়ো না।

-“ কবির ভাইয়ের মেয়ে তোর ভার্সিটি তে পড়ে!
বিস্ময় নিয়ে কথাটা বলে শারমিন বেগম। শাফায়াত মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। শারমিন বেগম এবার হেঁসে ফেলে।
-“ বাহ তাহলে তো ভালোই। ছেলে আর ছেলের বউ একই ভার্সিটির।
-“ আমি এই বিয়ে করতে পারবো না মা।
-“ কেনো কি হইছে সমস্যা কি তোর।
-“ সমস্যা একটাই ও আমার স্টুডেন্ট। আমি আমার স্টুডেন্ট কে বিয়ে করে নিজের রেপুটেশন নষ্ট করতে পারবো না।
-“ আশ্চর্য ছাত্রী কে বিয়ে করলে তোর রেপুটেশন কেনো নষ্ট হবে? পৃথিবীতে কি কোনো শিক্ষক তার স্টুডেন্ট কে বিয়ে করে নি? নাকি তুই প্রথম শিক্ষক?
-“ অন্য শিক্ষক বিয়ে করুক বা না করুক বাট আমি করবো না। তুমি প্লিজ এটা নিয়ে ফোর্স করো না। এই নাও আঙ্কেল কে ফোন দিয়ে মানা করো এক্ষুনি।

কথাটা বলে শাফায়াত কবির শিকদারের নম্বরে কল করে ফোন টা মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয়।

কবির শিকদার মেয়ের সামনে বসে আছে। পাশে কবির শিকদারের ওয়াইফ সামিরা শিকদার। বেশ কিছুটা সময় মেয়েকে পরক্ষন করলেন। তারপর শুধালেন-
-“ নোয়াস কে তোমার পছন্দ হয়েছে?
রুয়াত বাবার পানে তাকালো। তার গলা শুকিয়ে আসছে। তার বাবা কে ব্যাপার টা বুঝাবে কি করে? অতঃপর লম্বা একটা শ্বাস টেনে রুয়াত কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই কবির শিকদারের ফোনে কল আসে। কবির শিকদার ফোনের দিকে তাকায়। নোয়াসের নম্বর দেখে মুচকি হাসে। ফোন রিসিভ করে কানে নিয়ে বলে-
-“ হ্যাঁ নোয়াস বলো।
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসলো-
-“ ভাই আমি নোয়াস না। নোয়াসের মা বলছি।
-“ হ্যাঁ আপা বলুন।
-“ নোয়াসের তো রুয়াত কে পছন্দ হয়েছে। তো চাইছি এবার বিয়ের ডেট টা ফিক্সড করতে। আপনার কি মতামত?
শাফায়াত চমকে উঠলো মায়ের এমন কথা শুনে। সে তো বিয়ে টা ভাঙার জন্য ফোন দিতে বলেছে। আর তার মা তার সাথে মীরজাফর গিরি করে বিয়ের ডেট ফিক্সড করার কথা বলছে! শাফায়াত ফোন টা তার হাতে দিতে বলল ইশারায়। শারমিন বেগম রাগী চেহারা নিয়ে ছেলেকে শাঁসালো।
-“ আমার আর কি মতামত থাকবে আপা। আপনারা একটা দিনক্ষণ দেখে আসুন। তারপর না হয় বিয়ের ডেট ফিক্সড করা যাবে।
-“ আচ্ছা বেশ। আমি আর শাফায়াত তাহলে বৃহস্পতিবার আসছি। আজ তো সোমবার।
-“ ঠিক আছে।
শারমিন বেগম ফোন কে’টে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন। শাফায়াত রাগী কন্ঠে বলল-
-“ এটা কি করলে তুমি? তোমাকে আমি বিয়ে নিয়ে এগোতে মানা করছি। আর তুমি বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্য আগাচ্ছ!
শারমিন বেগম এবার কন্ঠে রাগী ভাব এনে বলল-
-“ মেয়েটা দেখতে অসুন্দর? কালো? হাঁটতে পারে না? কানা? লেংরা? কোনটা বল।
-“ কোনো টাই না। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী।
-“ তাহলে তোর সমস্যা কি?
-“ সমস্যা একটাই ও আমার ছাত্রী।
-“ এটাই সমস্যা। মেয়েটা তোর ছাত্রী না হলে বিয়ে টা করে নিতি?
শাফায়াত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে- হ্যাঁ করে নিতাম।
শারমিন বেগম এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
-“ বেশ তাহলে ভার্সিটির জব টা তুই ছেড়ে দে। তাহলে রুয়াত আর তোর স্টুডেন্ট থাকবে না আর না তুই তার টিচার থাকবি। হয় জব ছাড়বি না হয় ঐ জবে থেকেই রুয়াত কে বিয়ে করবি। তোর এই জাস্ট টিচার স্টুডেন্টের সম্পর্কের জন্য আমি বিয়ে টা ভাঙতে পারবো না। মেয়েটা কে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমার ইচ্ছে রুয়াত কে তোর বউ করার। সে আমি যে কোনো মতেই করিয়ে ছাড়বো। এখন তুই টিচার থেকেই বিয়ে করবি নাকি জব ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করবি সেটা তুই-ই ভালো জানিস। বাট বিয়ে তোকে রুয়াত কেই করতে হবে।

কথাটা বলে শারমিন বেগম চলে গেলো। শাফায়াত মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রাগে কিড়মিড় করতে করতে নিজের রুমে ঢুকলো। অসহ্যকর লাগছে এখন। কোন কুলক্ষণে সে বিয়েতে হ্যাঁ করেছিল তার জন্য এখন কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।

#চলবে?