গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-০৫

0
89

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৫
#Raiha_Zubair_Ripti

রমনা পার্কের ঠিক মাঝখান টায় দাঁড়িয়ে আছে শাফায়াত, রুয়াত,রজনী। রুয়াত বোনের হাত ধরে চারিপাশ দেখছে। আশেপাশে প্রচুর মানুষের আনাগোনা। আকাশ টা আগের তুলনায় আরো ঘুটঘুটে আঁধারে ডুবে গেছে। চারিপাশে ঝরো হাওয়া বইছে। রজনী মুগ্ধ হয়ে চারিপাশ দেখে চলছে। রুয়াতের এবার বিরক্ত লাগলো। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে তারা এখানে।
-“ আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো আমরা?
শাফায়াত ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে-
-“ আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না হাঁটা ধরুন।
-“ কোথায় হাঁটা ধরবো?
-“ সামনে।

রুয়াত বোন কে নিয়ে হাঁটা ধরলো। হেঁটে ব্রিজ টার উপর এসে দাঁড়ালো। শাফায়াত ও দাঁড়িয়ে গেলো। ইশারায় বুঝালো এখানে দাঁড়ালেন কেনো?
রুয়াত হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে বলে-
-“ কয়েক টা ছবি তুলবো। এই আপা দাঁড়িয়ে পোস নে।

রজনী হকচকিয়ে গেলো। এতো মানুষের সামনে সে ছবি তুলবে!
-“ না না আমি ছবি তুলবো না। তুই দাঁড়া আমি তুলে দিচ্ছি ছবি।

রুয়াত ফোনটা শাফায়াত এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-
-“ আমাদের ছবি তুলে দিন তো।

রুয়াত বোনের পাশে দাঁড়িয়ে পোস নিলো। রজনী ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। রুয়াত খোঁচা দিলো।
-“ পোস নে আপু।
রজনী রুয়াতের হাত ধরে পোস দিলো। শাফায়াত পিক তুলে দিলো। পিক তুলার সময় রুয়াতের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো। মেজেন্টা কালারের কুর্তি তে বেশ ভালোই লাগছে। ছবি তোলার পরপরই আকশের বুক চিঁড়ে ঝুম বৃষ্টির আগমন হলো ধরণীতে। শাফায়াত রুয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ঐ ছাউনির নিচে চলুন।
রুয়াত দৌড়ে ছাউনির নিচে গেলো। শাফায়াত রজনী ও আসলো। রুয়াত মাথা থেকে বৃষ্টির পানি ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলে-
-“ ঘুরার জন্য আর দিন পেলেন না? বৃষ্টির দিনই আসতে হলো।

শাফায়াত আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আমাকে কি সবজান্তা মনে হয় আপনার? সকালের রোদ দেখে কেউ ভেবেছিল বিকেলে বৃষ্টি হবে?

শাফায়াত পকেট থেকে ফোন বের করে সাদমান কে ফোন করে। বিরক্তের সহিতে বলে-
-“ কই তুই? তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে শহীদ হয়ে যাচ্ছি।

সাদমান গাড়ি থেকে দুটো ছাতা নিয়ে একটা ফুটিয়ে রমনার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলে-
-“ এই তো আমি এসে গেছি ব্রো। তোমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছো?
-“ ছাউনির নিচে।
-“ ওকে আ’ম কামিং।

রুয়াত শাফায়াতের কথোপকথন গুলো শুনলো।
-“ কে আসছে?
শাফায়াত ফোন পকেটে ভরতে ভরতে বলে-
-“ আমার ছোট ভাই।
-“ নাম কি?
-“ সাদমান হোসাইন।
-“ ওহ্। সে কতদূর?
-“ ঐ তো এসে পড়েছে।
শাফায়াত সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল। রুয়াত তাকালো। ব্লু কালারের শার্ট পরিহিত মাথায় ছাতা নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। ধবধবে ফর্সা শরীরের রং। শাফায়াত এর থেকেও উজ্জ্বল রং তার। সাদমান শাফায়ত দের সামনে এসে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে-
-“ আসসালামু আলাইকুম ভাবি। ভালো আছেন?
রুয়াত মুচকি হেঁসে বলে-
-“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছি। আপনি?
-“ আমি তো ফাস্ট ক্লাস আছি। তো ভাই চলো রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাক।
-“ ছাতা টা দে।
সাদমান হাতে থাকা ছাতা টা শাফায়াত এর হাতে দেয়। শাফায়াত ছাতাটা ফুটিয়ে রুয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আসুন।
রুয়াত বোনের দিকে একবার তাকায়।
-“ আপু আমি আপনি হবে এক ছাতার তলে? ভিজে যাব তো।
শাফায়াত তপ্ত শ্বাস ফেললো। এ মেয়ে যে ভীষণ বোন পাগল তা এতক্ষণে বুঝে গেছে। একটুর জন্য ও হাত ছাড়া করে নি রজনীর।
-“ আপনি আসুন। রজনী কে সাদমান নিয়ে আসবে।

রুয়াত বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে-
-“ আপু তুমি এই ভাইয়া টার সাথে আসো।
রজনী তাকালো সাদমানের দিকে। সাদমান এতক্ষণ খেয়ালই করে নি রজনী কে। সাদমান শাফায়ত এর দিকে চেপে গিয়ে বলে-
-“ ব্রো এটা তোমার শ্যালিকা?
-“ হ্যাঁ বড় শ্যালিকা।
-“ মানে আমার বড় সে তাহলে?
-“ হ্যাঁ।
সাদমান হতাশ হলো। এতো সুন্দর একটা মেয়ে তার সিনিয়র দেখে। শাফায়াত রুয়াত কে নিয়ে চলে গেলো। সাদমান রজনীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
-“ আসুন মিস সিনিয়র।
রজনী ছাতার নিচে দাঁড়ালো। সাদমান এর থেকে অনেক টাই দূরত্ব রেখে। সাদমান রজনীর দিকে তাকালো। খুবই সুশ্রী রূপ মেয়েটার। সাদামাটা মুখের গরন। মনের মতোই তো সব হচ্ছিল। বৃষ্টিও পড়লো প্রথম সাক্ষাৎ এ। কিন্তু এ তো সিনিয়র। বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে ভাতেই রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছে গেলো।

শাফায়াত রুয়াত কে নিয়ে এক টেবিলে বসেছে। সেখানে চেয়ার দু’টোই। শাফায়াত সাদমান কে টেক্সট করে বলল- রজনী কে নিয়ে আলাদা বসতে।

সাদমান রেস্টুরেন্টের ভেতরে এসে একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে রজনী কে বলল-
-“ মিস সিনিয়র এখানে বসুন। ব্রো আর ভাবির ওদিকে না যাওয়াটাই বেটার। তাদের স্পেস দরকার। রজনী ও বুঝলো বিষয় টা সেজন্য সাদমানের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। সাদমান ম্যেনু কার্ড দেখে বলে-
-“ কি খাবেন সিনিয়র?
রজনী বিরক্ত লাগছে এই ডাক টা৷ সাদমান এর দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে বলে-
-“ আমি যেহেতু আপনার সিনিয়র তাই সিনিয়র না ডেকে আপু বলে ডাকুন। শুনতে ভালো দেখাবে।

সাদমান ত্বরিত গতিতে রজনীর পানে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলল-
-“ আপু ডাক আমি? ইম্পসিবল মিস সিনিয়র। আপনাকে আপু ডাক টা হজম হবে না আমার। মিস সিনিয়র ই বেস্ট।

রজনী কথা বাড়ালো না। সে চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরতে।
-“ কি খাবেন বললেন না তো।
-“ যা ইচ্ছে হয় অর্ডার দিন।
সাদমান ওয়েটার কে ডেকে বার্গার আর কোক অর্ডার দিলো।

রুয়াত বোন কে সাদমান এর সাথে বসতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়। শাফায়াত চিকেন তন্দুরি আর বার্গার অর্ডার দিছে। ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেলে শাফায়াত রুয়াত কে বলে-
-“ খাওয়া শুরু করুন।
রুয়াত চিকেন তন্দুরি খাওয়া শুরু করলো।
-“ আমাদের বিয়ে টা কিন্তু হচ্ছে রুয়াত।
-“ হু জানি।
-“ এখনও কোনো অমত আছে আপনার?
-“ না।
-“ মন থেকেই করছেন বিয়ে?
-“ না মস্তিষ্ক থেকে বিয়ে টা করছি।
-“ মানে?
-“ মানে টা সিম্পল। মন থেকে বিয়ে করলে মুখে আমার লাজুক হাসি থাকতো। কিন্তু আমার মুখে কোনো লাজুক হাসি দেখেছেন?
-“ হ্যাঁ দেখেছিলাম সেদিন।
-“ কোনদিন?
-“ যদিন রিকশা থেকে পড়ে যেতে নিয়েছিলেন।
রুয়াতের মুখ চুপসে গেলো। এ লোক এখনও মনে রেখেছে ওটা! আবার শরম ও দিচ্ছে! শাফায়াত বাঁকা হাসলো রুয়াত কে চুপ হতে দেখে। মনে মনে বলল-
-“ আপনি ঠেস দিয়ে কথা বলতে জানলে আমি ও কম জানি না মিস রুয়াত। বিয়েটা যেহেতু হচ্ছেই তাই নিজেকে অতো ভদ্র আপনার সামনে রেখে লাভ নেই। ক্রমশ বেরিয়ে আসবে।

এদিকে সাদমান খাচ্ছে আর রজনী কে আড়চোখে দেখছে। রজনী বেশ বুঝতে পারছে কিন্তু বলছে না কিছু। সাদমান বার্গারে কামড় দিয়ে কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাস টা হাতে নিয়ে বলে-
-“ মিস সিনিয়র আপনি কি ম্যারিড?

রজনী থমকে গেলো কথাটা শুনে। হাতে থাকা বার্গার টা প্লেটে আকস্মিক পড়ে গেলো। আশেপাশে তাকালো। পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে হাত মুছে বলল-
-“ ন..না আমি ম্যারিড না।

সাদমানের মুখে অজান্তেই হাসি ফুটলো।
-“ পড়াশোনা করছেন এখনও?
-“ না।
-“ শেষ পড়াশোনা?
-“ না।
সাদমান অবাক হলো।
-“ তাহলে করেন টা কি আপনি? জব করেন?
রজনী বিরক্ত নিয়ে বলল-
-“ না। আমি বাসাতেই থাকি।

সাদমানের কৌতূহল হচ্ছে রজনী কে নিয়ে। রজনী কি রুয়াতের আপন বোন নাকি কাজিন? রজনী রুয়াত কে মেসেজ দিলো-
-“ আমি বাসায় যাব রুয়াত। ভালো লাগছে না।
রুয়াত মেসেজ টা পড়েই বসা থেকে উঠলো। শাফায়াত আকস্মিক রুয়াতের উঠে দাঁড়ানো দেখে রুয়াতের মুখের দিকে তাকাতেই রুয়াত বলে-
-“ বাসায় ফেরা উচিত আমাদের। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
শাফায়াত তাকালো থাই গ্লাসের দিকে। সত্যি সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। শাফায়াত বিল পে করে সাদমান দের টেবিলে আসলো। সাদমান এখনো খাচ্ছে। শাফায়াত বিরক্ত নিয়ে বলল-
-“ আরো তিন চার টা খাবার অর্ডার দেই? খেয়ে এখানেই থেকে যা আজকের রাত টা।

সাদমান বার্গারের লাস্ট টুকরো টা মুখে দিয়ে টিস্যু হাতে নিয়ে উঠে বলে-
-“ নো ব্রো আমার পেট ভরে গেছে।
শাফায়াত রুয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে- চলুন।

রুয়াত বোনের হাত ধরে হেঁটে বের হয় রেস্টুরেন্ট থেকে। রজনী রুয়াতের কানে ফিসফিস করে বলে-
-“ আমি কি বাচ্চা যে হাত ধরে ধরে হাঁটিস।
রুয়াত হাসলো কিছু বললো না। গাড়িতে উঠে মনে মনে বলল-
-“ আমার কাছে তুমি বাচ্চাই আপু। তোমাকে যে কেনো সাথে সাথে রাখছি তা তুমি বেশ বুঝতে পারছো।

সাদমান তার গাড়ি করে বাসায় চলে যায়। আর শাফায়াত রুয়াত দের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে।

—————

পরের দিন সকালে রুয়াত ভার্সিটি আসে। ভার্সিটির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই রোহান এসে সামনে দাঁড়ালো। রুয়াতের কপালে দু ভাজ পড়লো। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক,শুষ্ক ঠোঁট। কেমন একটা অগোছালো ভাব রোহানের মধ্যে। তার জানা মতে এই ছেলে টা বেশ পরিপাটি স্টাইলিশ সেজে আসে ভার্সিটি তে। রুয়াত পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে রোহান পথ আগলে দাঁড়ালো। রুয়াত রাগান্বিত হয়ে বলল-
-“ আশ্চর্য সমস্যা কি আপনার? সরে দাঁড়ান সামনে থেকে।
রোহান সরলো না। আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকলো। মেয়েটা কে ফাইনালি দেখতে পেলো। তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো শীতল হলো।
-“ কাল ভার্সিটি আসো নি কেনো?
-“ আমার বিয়ে হবু জামাই নিয়ে ঘুরতে গেছিলাম।
রোহান হাসলো। রুয়াত সত্যি টাই বললো। কিন্তু রোহান ফান হিসেবে ধরে নিলো।
-“ নেক্সট টাইম থেকে ভার্সিটি মিস দিবা না। প্রতিদিন আসবে।
-“ আপনার কথা মতো চলতে হবে নাকি আমার?
-“ সব না কিছুটা।
-“ সরুন সামনে থেকে।
রোহান সরে দাঁড়ালে।
-“নাও সরে দাঁড়ালাম ক্লাসে যাও৷ আর কোনো ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে মিশবে না।
-“ তো আপনি কি মেয়ে?
-“ শাট-আপ। আমি মেয়ে হতে যাব কেনো। আমি ছেলেই।
-“ তো আপনি কেনো কথা বলছেন আমার সাথে।
-“ আমার বিষয় আলাদা৷ তা শোনো কি বলছি। তোমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি এক্সেপ্ট করো নি কেনো?
রুয়াত চলে যেতে যেতে বলে-
-“ সরি অপরিচিত মানুষদের লিস্টে এড করি না।

রোহান রুয়াতের চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে মাথা চুলকে হাসলো। নেহাল রোহানের দিকে অবিশ্বাসের চাহনি নিয়ে বলে-
-“ হোয়াট’স রং উইথ ইউ রোহান? একটা মেয়ের পিছে এভাবে ঘুরছিস কেনো? এটা তোর স্বভাবের সাথে যাচ্ছে না একদমই।
রোহান নেহালের গলা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাঠের মাঝখানে হেঁটে এসে বলে-
-“ মনের উপর কন্ট্রোল রাখা বড় দায় নেহাল।
-“ তারমানে তুই….
রোহান ছেড়ে দিলো নেহাল কে। দু হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল-
-“ ইয়েস নেহাল আই অ্যাম ইন লাভ। কালকে সারাটাদিন চাতকের মতো খুঁজেছি পুরো ভার্সিটি এই মেয়েটাকে। একদিন না দেখাতেই কি অবস্থা হয়েছিল আমার ইউ নোও না?

নেহাল ভীষণ অবাক হচ্ছে এই রোহান কে দেখে। রোহানের মতো মানুষ কোনো মেয়েকে ভালোবাসছে! তাও সেটা নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে!

এদিকে শিকদার বাড়িতে রজনী নিজের রুমে বসে আছে। বাহিরেই ড্রয়িং রুমে রুয়াতের বিয়ের শাড়ি দেখা হচ্ছে। সামিরা শিকদার ডেকে গেছে রজনী কে কিন্তু রজনী যায় নি। বেনারসি দেখলেই তার অতীত মনে পড়ে। এই তিক্ত অতীত চেয়েও পারছে না ভুলতে। লাল যেমন প্রণয়ের রঙে রাঙিয়েছিল তাকে তেমনই এই লাল-ই তাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করেছে।

#চলবে?