গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-৩৫+৩৬

0
201

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৩৫
#Raiha_Zubair_Ripti

তপ্ত দুপুর,রুয়াত মেজেন্টা কালারের শাড়ি পড়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে শেষ বার দেখে নিলো। শাফায়াত বিছানায় পা তুলে বসে রুয়াত কে দেখে চলছে। হাতে থাকা হাত ঘড়িটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে হতাশ হয়ে বলল-
-“ আর কতক্ষণ রুয়াত?
রুয়াত পাশে ফিরে তাকালো। বলল-
-“ কেমন লাগছে আমাকে আগে বলুন। তারপর বলছি কতক্ষণ লাগবে।
শাফায়াত চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল-
-“ ভালো লাগছে।
রুয়াত এগিয়ে আসলো। শাফায়াত এর মুখ টা নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল-
-“ আমার দিকে তাকিয়ে বলেন। কেমন লাগছে? বিশাল বড় একটা কমপ্লিমেন্ট চাই।
শাফায়াত রুয়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ সো বিউটিফুল সো এলিগেন্ট,জাস্ট লুকিং লাইক অ্যা ওয়াও। জাস্ট লুকিং লাইক অ্যা ওয়াও।
রুয়াত শাফায়াত এর গাল থেকে হাত সরিয়ে ফের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ সত্যি.. আমি জানতাম আমাকে সুন্দর লাগবে।
শাফায়াত গা ঝেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল-
-“ এতো সময় নিয়ে সাজলে যে কাউকেই সুন্দর লাগবে।
রুয়াত ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ কই এতো সময় নিয়ে সাজলাম? মাত্র তো দু ঘন্টা লেগেছে।
-“ এখন বের হওয়া যাক? আমার ভাই টার কথা একটু ভাবো। বেচারা সকাল থেকে অপেক্ষা করছে।
-“ হু চলুন।

শাফায়াত রুয়াতের হাত ধরে বসার ঘরে আসলো। সাদমান পায়চারি করছে। শাফায়াত রুয়াত কে দেখামাত্রই এগিয়ে গিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল-
-“ কখন বের হবা ব্রো? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।

শাফায়াত খালা,আর খালুর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মনি তোমরা গাড়িতে গিয়ে বসো।
উনারা চলে গেলেন। সাদমান ও পেছন পেছন যেতে চাইলে শাফায়াত ডেকে বলে-
-“ তুই কোথায় যাচ্ছিস? তোকে কি যেতে বলেছি?
-“ আমি যাব না তে কে যাবে? ব্রো তুমি আর রুয়াত অনেক দেরি করাচ্ছো। দ্যিস ইজ নট ফেয়ার।
-“ আমি মানিব্যাগ টা রুমে রেখে এসেছি এনে দে।
সাদমান রাগতে রাগতে মানিব্যাগ আনতে চলে গেলো। রুয়াত শাফায়াত এর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে-
-“ আপনি বারবার সাদমান ভাইয়ার পেছন লাগছেন কেনো?
-“ আমার ভাই আমি লাগবোই।
সাদমান মানিব্যাগ টা এনে শাফায়াত এর হাতে ঠেসে ধরিয়ে দিয়ে বলে-
-“ এবার তো চলো।
শাফায়াত রুয়াত এর হাত ধরে হাঁটা ধরে বলে-
-“ হুম চল।

আধঘন্টার মধ্যেই রুয়াত রা চলে আসে এ বাড়ি। রুয়াত এসেই মা কে হেল্প করছে। বসার ঘরে বসে আছে কবির শিকদার, শাফায়াত এর মা,সাদমান এর বাবা মা আর সাদমান। সাদমান বারবার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আশ্চর্য রজনী কে দেখার জন্য তার চোখ দুটো মরিয়া হয়ে যাচ্ছে। হৃৎস্পন্দন টা দ্রুততর করে বেড়ে চলছে অথচ কেউ রজনী কে আনছে না। রুয়াত প্লেটে মিষ্টি আর পানি নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখলো। শাফায়াত এর পাশে বসে বলল-
-“ মা খালাম্মা, খালু মিষ্টি খান।
সাদমান এর বাবা মিষ্টি করে হেসে বলল-
-“ আগে তোমার আপু কে আনো রুয়াত৷ শুভ কাজ টা সেরে তারপর মিষ্টি মুখ করি সবাই।
সাদমান খুশি হলো বাবার এহেন কথায়। রুয়াত মাথা নেড়ে চলে গেলো উপরে।
রজনী রুমে পায়চারি৷ শরীরে তার লেমন কালারের শাড়ি। হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। চুল গুলো খোপা করে মাথায় বেলি ফুলের গাজরা। মুখে হাল্কা প্রসাধনী ব্যবহার। রুয়াত এগিয়ে এসে বোন কে জড়িয়ে ধরলো। কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল-
-“ পৃথিবীর সব সুখ আমার আপুর তরে হোক। জীবন টা খুশিতে পূর্ণ হয়ে থাকুক।
রজনী স্মিত হাসলো। তার বুকটা ধড়ফড় করছে। সাদমান কে জিজ্ঞেস করেছিলো তার বাবা মা কে সব বলেছে কি না। সাদমান বলল বলেছিল। রজনী অবাক হয়েছে। সব জেনেও কি করে ছেলের বউ বানাতে চায়?
রুয়াত রজনী কে নিয়ে নিচে নামলো। সাদমানের নজরে আসতেই সাদমান সেই থেকেই চেয়ে আছে। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। রুয়াত রজনী কে সাদমানের পাশে বসালো। সাদমান এর বাবা মার পছন্দ হলো রজনী কে। দেখতে বেশ সুন্দর। রজনীর বাবার সাথে কথা বলে বিয়ের ডেট টা এই মাসের ৩০ তারিখে ঠিক করলো। এটাও জানালো বিয়ের শেষে রজনী কে তারা তাদের সাথে নিয়ে যাবে। যেহেতু তারা আমেরিকা থাকছে পার্মানেন্ট। সাদমান সবার অগোচরে রজনীর হাত ধরলো। রজনী ছাড়াতে চাইলে আরো চেপে ধরলো। মুখের সামনে হাত এনে ফিসফিস করে বলল-
-“ আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে রজনী।
রজনী কিছু বললো না প্রতিত্তোরে। সকলে মিষ্টি মুখ করলো। তারপর দুপুরের লাঞ্চ টা করে বিকেল হতেই চলে গেলো সবাই। রুয়াত কে থাকতে বলেছিলো রুয়াতের শাশুড়ী কিন্তু রুয়াত থাকে নি। বাড়িতে এতো মানুষ তার শাশুড়ী একা হাতে রান্না বান্না বাড়ির কাজ করবে! তাই চলে আসলো। শাফায়াত সবাই কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রুয়াত কে নিয়ে বের হলো সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাড়ি থেকে অল্প একটু দূরে থাকা ঝিলের পাড়ে। শীতল বাতাস চারিদিকে। লোকজনের কিছুটা সমাগম। ঝিলের পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে কিছু যুগলবন্দী প্রেমিক প্রেমিকা। শাফায়াত রুয়াত কে নিয়ে ঝিলের পাশে থাকা বেঞ্চে বসলো। পাশ থেকে চলে যাওয়া ছোলা, বাদাম বিক্রি করা লোক কে ডেকে ছোলা আর বাদাম কিনলো শাফায়াত।
রুয়াতের হাতে এক প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল-
-“ খেতে খেতে চারিপাশ দেখো। ভালো লাগবে।
রুয়াত বাদাম ছুলে খেতে লাগলো। আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ চোখ গিয়ে আটকালো কিছুটা দূরে গাছের নিচে বসে থাকা রোহানের দিকে। রোহানের সাথে রয়েছে একটা মেয়ে। যে মনের সুকে আইসক্রিম খাচ্ছে। আর রোহান তাকিয়ে দেখছে। রুয়াতের মনে হলো হয়তো মেয়েটা রোহানের গার্লফ্রেন্ড। রুয়াত চোখ সরিয়ে নিলো। শাফায়াত এর বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো।

রোহান নীতির আইসক্রিম খাওয়া দেখছে। এই নিয়ে তিনটে খেলো৷ রোহানের বিরক্ত লাগছে। এতো আইসক্রিম কেউ খায়? ঠান্ডা লাগবে তো। এই ঝিলের পাড়ে এসেছিল নীতির মন টা ভালো করতে। অথচ এনেও বিপাকে পড়তে হলো। রোহান তপ্ত শ্বাস ফেলে দাঁত চেপে বলল-
-“ হয়েছে খাওয়া? নাকি আরো খাবি?
নীতি আইসক্রিম টা শেষ করে বলল-
-“ এখন লাগবে না। বাসায় যাবার সময় কিনে দিয়েন। বাসায় গিয়ে খাবো।
-“ তাহলে চল ঝিলের কাছে।
-“ আমি পানিতে পা ভিজাবো।
রোহান নীতির হাত ধরে ঝিলের পাশে আসলো। পায়ের জুতা খুলে বসে পানিতে পা ভিজালো দুজন। নীতি এগিয়ে আসলো রোহানের দিকে। রোহানের বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে পানিতে পা ঝাপটিয়ে বলল-
-“ এবার সুন্দর লাগছে।
রোহান মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে হাল্কা বাঁকা হাসলো।

সন্ধ্যা নেমে আসতেই নীতি রোহান কে টেনে বাসায় চলে আসলো। রোহান নীতি কে নীতির বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। আসার পথে অবশ্য নেহাল আর নেহালের বাবার সাথে একটু আলাপ-সালাপ করে এসেছে। নিজের বাসায় আসতেই নীতি ফোন দিয়েছে। রোহান বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল-
-“ বিশ মিনিট ও হয় নি। এরমধ্যেই ফোন?
-“ পৌঁছে গেছেন বাসায়?
-“ হ্যাঁ।
-“ খাবার খেয়ে ঘুমান।
-“ বুয়া আজ রান্না করে যায় নি।
-“ ওমা তাহলে খাবেন কি?
-“ ঘরে বিস্কুট চানাচুর আছে,নুডলস রান্না করে খেয়ে নিব নি।
-“ আপনার রান্না করা লাগবে না। রাখছি।

নীতি ফোন টা কেটে অনলাইন থেকে ভাত,মাংস,ডাল,ভাজি অর্ডার করে রোহানের ঠিকানা দিয়ে দিলো। ঘন্টা খানের মধ্যেই রোহানের বাসার কলিং বেল বাজে। রোহান মুচকি হাসে। মনে করে নীতি এসেছে হয়তো নেহালের সাথে৷ কিন্তু দরজা খুলে দেখে ডেলিভার ম্যান। হাতে করে খাবার নিয়ে এসেছে। রোহানের ফোনে কল আসে৷ রোহান রিসিভ করলে ওপাশ থেকে নীতি বলে-
-“ খাবার টা রিসিভ করে খেয়ে নিন।
রোহান রিসিভ করলো। বিল পে করতে চাইলে ডেলিভারম্যান বলল বিল পে করা হয়েছে। রোহান দরজা আটকালো। রুমে এসে নীতি কে বলল-
-“ খাবার কেনো পাঠাতে হবে তোর?
-“ আপনি খাবেন সেজন্য। আচ্ছা আমি ভিডিও কল দিচ্ছি।
নীতি ফোন কেটে ভিডিও কল দিলো। রোহান রিসিভ করলো। নীতি দেখলো রোহান প্যাকেট থেকে এক এক করে খাবার বের করছে।
-“ আমি কি রাক্ষস? এতো খাবার!
-“ খাওয়া শুরু করেন যতটা পারেন।
রোহান খেতে লাগলো। নীতি কে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাতের লোখমা টা এগিয়ে দিয়ে বলে-
-“ তাকিয়ে আছিস পেট খারাপ করবে। হা কর।
নীতি হা করলো। রোহান নিজের মুখে নিয়ে বলল-
-“ খেয়েছিস?
নীতি হেসে বলল-
-“ হ্যাঁ ইয়াম্মি।
-“ তুই খেয়েছিস রাতে?
-“ হু খেয়েছি।
-“ আচ্ছা ঘুমিয়ে পড় তাহলে। আমারও খাওয়া শেষ।

নীতি শুভ রাত্রি বলে ফোন টা কেটে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে বিরবির করে বলল-
-“ কোনো এক রাত আসুক। যেই রাতটায় আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। আর একটা সকাল আসুক শীগ্রই, যে সকালের সূচনা হবে আপনাকে দেখে।

#চলবে?

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৩৬
#Raiha_Zubair_Ripti

নতুন সকাল,,নতুন এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। রুয়াত খাবার টেবিলে বসে নখ কামড়ে কিছু একটা ভাবছে। পুরো বাড়ি ফাঁকা। রুয়াতের শাশুড়ী, সাদমান এর বাবা মা শাফায়াত এর নানা বাড়ি গিয়েছে আজ ভোরেই। পরশু চলে আসবে। সাদমান এখনও ঘুমে বিভোর। শাফায়াত রান্না ঘরে কফি বানাতে গিয়েছে। রুয়াত কে আজ রান্না করতে দেয় নি শাফায়াত। এই সকালে কফি না হলেই নয়। শাফায়াত দুই মগ কফি নিয়ে এসে রুয়াতের পাশে বসলো। রুয়াত কে ভাবনায় মশগুল থাকতে দেখে বাহু দিয়ে ঠেস দিয়ে বলল-
-“ কি ভাবছো?
শাফায়াত কফির মগ এগিয়ে দিলো। রুয়াত মগ টা নিয়ে বলল-
-“ অনেক কিছু ভাবছি।
-“ হু সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু কি ভাবছো?
-“ ভাবছি আমাদের ট্যুর দেওয়া উচিত একটা।
-“ কিসের ট্যুর?
-“ অনেক দূরের ট্যুর।
-“ বুঝলাম৷ যাব।
-“ কবে?
-“ বিয়ে টা মিটে যাক। তুমি আমি আমেরিকা যাবো।
-“ সাদমান ভাইয়া দের সাথে?
-“ না ওদের চলে যাবার পরে।
-“ ওহ্ আমার পাসপোর্ট ভিসা নেই।
-“ বানিয়ে নিবো।
-“ খুব মজা হবে। আম্মা যাবে না?
-“ না।
-“ কেনো? আম্মা একা থাকবে বাসায়?
-“ না সানজিদা আর নাইমুর আসবে।
-“ সবাই মিলে যাই চলুন।
-“ না আম্মা যাবে না। চটপট কফি টা খেয়ে নাও। আজ আমরা রাতে ডিনার টা রেস্টুরেন্টে করবো। আর সকালের ব্রেকফাস্ট টা অর্ডার দিয়ে দিছি। এসে যাবে খানিকক্ষণ পর। আমি নাইমুর কে ডেকে আনছি।

শাফায়াত চলে গেলো। রুয়াত কফি টা খেয়ে শাশুড়ি কে ফোন দিলো। প্রথম ফোনেই রিসিভ হলো। রুয়াত বলল-
-“ আম্মা আপনার কতদূর?
-“ বাড়ির কাছাকাছি ই।
-“ ওহ্ পৌঁছে ফোন দিবেন।
-“ আচ্ছা। ব্রেকফাস্ট করছো তোমরা?
-“ না। আপনার ছেলে রান্না করতে দেয় নি। বাহিরে অর্ডার দিছে। একটু পর আসবে খাবার।
-“ তাহলে খেয়ে নাও। সাদমান কি আশেপাশে আছে?
-“ না ভাইয়া তো ঘুমে। উনি ডাকতে গেছে।
-“ ওহ্ খেয়ে নিও সবাই মিলে। আর রাতে দরজা জানালা ভালো করে চেক করে তারপর ঘুমাতে যাবে।
-“ আচ্ছা।
-“ রাখছি পৌঁছে ফোন দিব।
শারমিন বেগম ফোন টা কেটে দিলো। পাশ থেকে সাদমান এর মা বলে উঠল-
-“ মেয়েটা ভীষণ ভালো তাই না?
শারমিন বেগমের ওষ্ঠে হাসি ফুটলো।
-“ হ্যাঁ ভীষণ।
-“ হুমম বাড়ির সব কাজ একা হাতে করে। আজকাল কার মেয়ে রা তো রান্না বান্না ঘরের কাজ তেমন একটা পারেই না।
-“ রজনীর থেকেই শেখা রুয়াতের সব কাজ। দু বোন বেশ লক্ষী মেয়ে।
-“ রজনী অনেক চাপা স্বভাবের তাই না?
-“ হ্যাঁ।
-“ আমার রুয়াত কে বেশ ভালো লাগে সাথে ওর চঞ্চলতা কে।
-“ রজনী ও হয়ে যাবে এক সাথে থাকতে থাকতে।
-“ হুমম।

সাদমান কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। শাফায়াত মাথার কাছে বসে আছে। আলতো হাতে মুখের উপর থেকে কাঁথা টা সরালো। বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল-
-“ এই সাদু ওঠ।
সাদমান পাশ ফিরে অন্য দিকে ঘুরে ঘুমালো। শাফায়াত সাইডে থাকা পানির গ্লাস থেকে হাতে পানি নিয়ে সাদমান এর মুখে ছুঁড়ে মারলো। সাদমান লাফিয়ে উঠলো। চোখ মেলতে গিয়েও সব ঝাপসা লাগলো। কয়েকবার চোখ ঝাপটানি দিয়ে সব ক্লিয়ার করে শাফায়াত এর দিকে তাকালো। রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল-
-“ হোয়াট ইজ দ্যিস ব্রো? এভাবে পানি ছেটালে কেনো? আমি ঘুমাচ্ছিলাম দেখো নি?
শাফায়াত ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল-
-“ না রে দেখি নি। এবার বলদের মতো বসে না থেকে ফ্রেস হয়ে খেতে আয়। বিকেলে বের হবো আমরা। রাতে ডিনার করে তারপর ফিরবো বাসায়।
সাদমান এর চোখ মুখে আলো জ্বলে উঠলো।
-“ রজনী কেও বলি আসতে?
শাফায়াত রুম থেকে বের হতে হতে বলে গেলো-
-“ না রে তোর বলতে হবে না। ও কে বলার জন্য রুয়াত আছে ওর বোন।
-“ আমি ওর উডবি ব্রো। বোনের থেকে বেশি হক আমার।
-“ আগে বিয়ে হোক তারপর বেশি হক বেশি বলে চেচামেচি করিস মেনে নিবো।

সাদমান মুখ বেঁকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেই দেখলো রুয়াত শাফায়াত টেবিলে বসে আছে খাবার সামনে নিয়ে। শাফায়াত সাদমান কে দেখামাত্রই বলল-
-“ ব্যাটা তাড়াতাড়ি আয় খেতে। অপেক্ষা করছি কখন থেকে।
সাদমান চেয়ার টেনে বসলো। রুয়াত প্লেট টা এগিয়ে দিয়ে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার মাঝে রুয়াতের ফোন টা বেজে উঠে। রুয়াত ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখে রুয়াতের মা ফোন করেছে। রুয়াত ফোন টা রিসিভ করে কানে নিলো। ওপাশ থেকে সামিরা শিকদার বলে উঠল-
-“ রুয়াত।
-“ হু বলো মা।
-“ কি করছিস?
-“ খাবার খাচ্ছি। কিছু বলবে?
-“ হুমম। একটু বাসায় আসতে পারবি? রজনী কে নিয়ে সেকরার দোকানে যেতে হবে। আপু তো আজকে আসতেছে বিকেলে আমাদের বাসায়। নিয়ে যাব নি তখন সেকরার দোকানে। গয়নার ছবি গুলো পাঠিয়ে দিও?
-“ আচ্ছা।
-“ খেয়েছো তোমরা?
-“ হ্যাঁ।
-“ রাখছি তাহলে।
-“ আচ্ছা।
শাফায়াত খাবার খেতে খেতে বলল-
-“ কি বলল?
-“ আপুকে নিয়ে সেকরার দোকানে যেতে বলল।
শাফায়াত ওহ্ বলে চুপচাপ খেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

বিকেলের দিকে রজনী আসলো রিকশায় চড়ে রুয়াত দের বাসায়। রুয়াত তখন রেডি হচ্ছিলো। সাদমান বসার ঘরে বসেছিলো। রজনী বাড়ির ভেতর ঢোকা মাত্রই সাদমান এর চোখ গিয়ে আঁটকায় রজনীর মাঝে। পেস্ট কালারের সেলোয়ার-কামিজ পড়েছে রজনী৷ চুল গুলো খোঁপা করা মাঝখানে সিঁথি কেটে। রজনীর অস্বস্তি হলো সাদমান কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে। এগিয়ে এসে একটু দূরে বসে বলল-
-“ এভাবে না তাকিয়ে থেকে বলুন রুয়াত কোথায়?
সাদমান চোখে পলক ফেললো। গালে হাত ঠেকিয়ে বলল-
-“ রুয়াত কে দিয়ে কি করবেন। আপনি আমাকে দেখুন রজনী। আমার থেকে কমপ্লিমেন্ট নিন।
-“ কিসের কমপ্লিমেন্ট?
-“ আপনার রূপের৷ অসম্ভব সুন্দর লাগছে আপনাকে।
-“ প্রতিবার তো এটাই বলেন। নতুন কিছু ট্রাই করুন।
-“ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। Je vous aime.
-“ মানে কি?
সাদমান মাথার চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল-
-“ অনেক কিছু। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কথা এটা।
-“ এই Je vous aime?
-“ ইয়েসস।
-“ এটা কোন দেশের ভাষা?
-“ ফ্রান্স।
-“ বাংলায় বলুন।
-“ উঁহু। আপনার এতো জানার আগ্রহ থাকে গুগুলে যান। তাকে গিয়ে আস্ক করুন।
-“ আশ্চর্য আপনি থাকতে গুগলের কাছে কেনো যাব?
-“ আমি আপনার গুগল নাকি?
-“ অবশ্যই, এখন বলুন এটার মানে কি?
-“ আমাদের বাসায় জানেন তো ওয়াইফাই আছে।
-“ হ্যাঁ জানি তো?
-“ পাসওয়ার্ড জানেন নিশ্চয়ই?
-“ হু জানি।
-“ তাহলে কষ্ট করে ওয়াইফাই অপশন টা অন করে গুগল কে আস্ক করুন। আমি বাহিরে যাচ্ছি ব্রো রা নামলে চলে আসবেন। আমি আর আপনি বাইকে চড়ে যাব।

সাদমান চলে গেলো। মিনিট পাঁচেক পড় রুয়াত শাফায়াত চলে আসলো। রজনী তাকালো। দুজনেই ম্যাচিং করে ব্লাক শার্ট আর শাড়ি পড়েছে। রুয়াত রজনীর দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল-
-“ কখন আসছো আপা?
-“ এই তো কিছুক্ষণ হলো।
-“ সাদমান ভাইয়া কোথায়?
-“ সে বাহিরে।
-“ ওহ্ আচ্ছা চলো যাওয়া যাক।
তিনজনে বাহিরে এসে দেখলো সাদমান বাইকে উঠে বসে আছে। শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো-
-“ এই তুই বাইকে কেনো?
-“ আমি বাইকে করে যাব।
-“ ওহ্ আচ্ছা একটু নাম তো।
-“ কেনো?
-“ আহ্ নামই না তাহলে তো দেখতেই পাবি।

সাদমান নামলো বাইক থেকে। সাদমান নামার সাথে সাথে সাথে শাফায়াত বাইকে উঠে বসলো। রুয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ রুয়াত উঠো তো বাইকে।
সাদমান কথা টা শুনেই শাফায়াত এর হাত টেনে ধরলো।
-“ ব্রো তুমি রুয়াত কে উঠতে বলছো কেনো? বললাম না আমও আর রজনী বাইকে উঠে যাব। নামো বলছি।
শাফায়াত মুখ গম্ভীর করে বলল-
-“ বড় ভাই কে হুকুম করছিস? রুয়াত এখন ও দাঁড়িয়ে কেনো আসো বলছি।
রুয়াত উঠে বসলো। শাফায়াত সাদমান এর থেকে হাত ছাড়িয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল-
-“ আমাদের ফলো করতে করতে আয়,টাটা।

সাদমান কোমড়ে হাত দিয়ে ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। রজনী গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল-
-“ ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিন।
সাদমান গাড়িতে উঠে বসলো। রাগান্বিত চেহারা নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল-
-“ আমার সব ফিলিংসের মধ্যে বা হাত ঢুকিয়ে দেয় ব্রো। কোথায় ভেবেছি আপনাকে বাইকের পেছন সিটে বসিয়ে ফুল স্পিডে বাইক চালাবো। তা আর হতে দিলো কই।
-“ আচ্ছা হয়েছে তো।
-“ কি হয়েছে?
-“ বাজে বকা।
-“ বাজে বকলাম কখন?
-“ এই যে বকবক করছেন। চুপচাপ গাড়ি চালান। গাড়ি চালানোর সময় সম্পূর্ণ ধ্যান সামনের দিকে দিতে হয়।
-“ পাশে এমন প্রিয়তমা কে রেখে কি সম্পূর্ণ দৃষ্টি সামনপ দেওয়া যায় নাকি?
-“ হু যায়।
-“ আমি পারি না।
-“ পারতে হবে। এতো আগে গাড়ি ঠুসে ম’রে পটল তোলার শখ নেই। সো সতর্কতার সাথে গাড়ি চালান।
সাদমান গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।

রুয়াতে বেশ ভালো লাগছে অনেক দিন পর বাইকে চড়ে। মৃদুমন্দ বাতাসে চুল গুলো উড়ছে। শাফায়াত সম্পূর্ণ ধ্যান দিয়ে বাইক চালাচ্ছে। রুয়াত ফিসফিস করে বলল-
-“ লেকচারার শাফায়াত একটু স্পিড নিয়ে বাইক চালান।
শাফায়াত জবাব দিলো-
-“ নো। যেভাবে চালাচ্ছি সেটাই সঠিক স্পিড।
-“ ভয় পান?
-“ ভয় কেনো পাবো?
-“ এই যে আপনি ভয় পান যদি এক্সিডেন্ট টেক্সিডেন্ট হয়ে যায় তাই।

শাফায়াত কান দিলো না রুয়াতের কথা। রুয়াতের ভালোর জন্যই সে স্পিডে চালাচ্ছে না। শাফায়াত একা থাকলে জোরে চালাতো। রুয়াত শাফায়াত কে বলল একটু জোরে চালাতে। শাফায়াত শুনলো না। মিডিয়াম গতিতেই এসে পৌঁছালো শপিং মলে। এখানে সেকরার দোকান আছে। বাইক থামাতেই দেখলো সাদমান রজনী ও চলে এসেছে। সবাই মিলে মলের ভেতর ঢুকে সেকরার দোকানে গেলো। রুয়াত তার মায়ের পাঠানো গয়নার ডিজাইন গুলো সেকরা কে দেখিয়ে দিলো। সেকরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বানিয়ে দিবে। রুয়াত অগ্রিম কিছু পেমেন্ট করলো। তারপর সবাই চলে আসলো রেস্টুরেন্টে। শাফায়াত খাবার অর্ডার দিলো। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার খাবার নিয়ে আসলো। চারজন খাওয়া আরম্ভ করলো। খাওয়া শেষে বিল পে করে শাফায়াত রুয়াত কে নিয়ে একটু শপিং করে নিলো। ফেরার পথে সাদমান বাইকে চড়লো রজনী কে নিয়ে। আগেই সে বাইকে চড়ে বসেছিলো। শাফায়াত এবার আর জ্বালালো না সাদমান কে। রুয়াত কে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। সাদমান এর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ চটজলদি বাসায় ফিরবি। আর সাবধানে পৌঁছে দিয়ে আসবি।
সাদমান মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।

এই রাত সাতটায় বাজে নীতি কে নিয়ে এসেছে নেহাল রোহানের বাসায়। বেচারা রোহানের হুট করে জ্বর এসেছে রাতে৷ বুয়া টাও কদিন ধরে বেশ অনিয়ম করে আসে। আজ তো আসেই নি। রাতের রান্না টা করার জন্য নীতি এসেছে। নীতি মুরগির মাংস রান্না করছে। রোহান এতক্ষণ নেহালের সাথে কথা বলছিলো। নেহালের ফোনে ফোন আসায় নেহাল ছাঁদে চলে যায়। রোহান দূর্বল শরীর নিয়ে রান্না ঘরে আসে। নীতি রান্না করছে। রোহান চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলো। পাক্কা গিন্নি গিন্নি লাগছে নীতি কে।
-“ কি রান্না করছিস?
কোমড়ে ওড়না বেঁধে রান্না করছিলো। রোহানের কথায় পিছু ফিরলো। তড়িঘড়ি করে বলল-
-“ আপনি এখানে কেনো? কিছু লাগবে?
-“ না।
-“ তাহলে রুমে যান।

রোহান গেলো না। কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলে উঠল-

-“ আচ্ছা তুই এতো ভালো কেনো বলতো? নীতি
স্মিত হাসলো। খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়াচাড়া করতে করতে জবাব দিলো-
-“ আপনি আজ জানলেন আমি এতো ভালো?
রোহান দেওয়ালে হেলান দিয়ে বুকে দু হাত গুঁজে বলল-
-“ আগে জানলেও সেভাবে বুঝি নি। তবে এখন বেশ ভালো করে জানি আর বুঝি।
নীতির মুখ প্রসারিত হলো। কড়াই তে টুকটাক আওয়াজ তুলে বলল-
-“ এই জানা টা কতদিন থাকবে?
-“ যদি তুই অনুমতি দিস তো চিরকাল এই জানায় জেনে থাকবো। দিবি অনুমতি?
ত্বরিত গতিতে পেছন ফিরলো নীতি। লোকটা অনুমতি চাইছে! সে কি জানে না নীতি সেই ভালোবাসার প্রথম দিন থেকেই নিজ থেকে অনুমতি দিয়ে রেখেছে। সে তো জানে তাকে নীতি প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে। জেনেও চাইছে অনুমতি!
-“ অনুমতি চাচ্ছেন?
-“ হু দিবি?
-“ আমি তো আপনি না চাওয়ার আগেই দিয়ে বসে আছি। সেখানে চাওয়া টা বেমানান লাগছে না?
-“ আমি তো জানতাম না সেটা।
-“ এখন তো জেনে গেলেন?
-“ হু।
-“ তাহলে আশা করি আর চাইবেন না?
-“ উমম চাইতে না করছিস? আমি তো অনুমতি ছাড়া কোনো কিছু করি না। তাই আমার সবসময় সব কিছুতে অনুমতি টা ম্যাটার করে।
-“ কোন কোন কিছুতে আপনার অনুমতি লাগে?
-“ সব,, মানে এভরিথিং।
-“ ওহ্ আচ্ছা। এখন যান আমি তরকারি টা নামিয়ে নিয়ে আসছি।
-“ ঝাল দিয়েছিস তো বেশি করে?
-“ হু, যান এবার।
রোহান চলে গেলো। নীতির কেমন ভালে লাগাটা দ্বিগুণ হয়ে গেলো।

#চলবে?