#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা
১০.
‘ওগো রাগী কালনাগিনী,
মন তোমার কেন এমন রুক্ষ?
তোমার বদসুরত হাসি,
তোমার বেসুরা প্যাচাল শুনতে লাগে ভারী।
রাগের মেঘে ঢাইকা যায় তোমার ভয়ানক মুখ,
দেইখা তোমার রাগী চাহনি একটুও কাঁপে না আমার বুক।
তুমি তো আমার ঘাড়ে চাপা এক পিশাচিনী,
তোমার রাগের কারাগারে বন্দী আমি এক ক্ষণিক অতিথি।
মনে কইরো না এ কোনো প্রেমের পয়গাম,
আপাতত তোমারে জ্বালানো ছাড়া আমার নাই কোনো কাম!’
নতুন বাড়ি থেকে পুরোনো বাড়িতে যাওয়া উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলো অন্বেষা।উদ্দেশ্য জব্বার চাচার সাথে দেখা করা।সকাল সাতটা বাজে। জব্বার চাচার সাথে দেখা করেই ভার্সিটির দিকে যাবে।এরপর অফিস সেখান থেকে এই নতুন ঠিকানায়। সাঁঝ-সকালে উদ্ভট গান শুনতে পেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো অন্বেষার।রাগটা একটু বেশিই। গলির মোড়ে চায়ের দোকান। সেখানের বেঞ্চি নামক রাজসিংহাসনে বসে মুক্ত গলায় গান ধরেছে বখাটে বাউন্ডুলে ছেলেটা।শয়তানি হাসির দেখা মেলে মুখপটে।গানে উচ্চারিত শব্দগুলো শুনে কান ঝা-ঝা করে উঠলো।
সাব্বির বললো,
“ভাইজান এমন বিশ্রী গানটা কেমনে গাইলেন?কোনো তাল নাই ছন্দ নাই”
বর্ণ সাব্বির এর পিঠে চাপড় দিয়ে বলে,
“পাইকা গেছোস?নাক টিপ দিকে দুধ বাইর হইবো আমারে তাল ছন্দ শিখায়।”
সাব্বির যেনো ভীষণ মজা পেলো এরূপ কথায়। আদৌ হাসির কিছু ছিলো বর্ণের বচনে?তারপরও খুব উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আপার লেইগা গাইলেন এই গান?”
বর্ণ ডান পাশের ভ্রু তুলে প্রশ্ন করে, “তোর কি মনে হয়?”
“আপার লাইগাই গাইছেন।কিন্তু আপা মনে হয় চেইতা গেছে।”
দুজনে একত্রে অন্বেষার লালাভ বর্ণ ধারণ কথা মুখের দিকে চাইলো।কয়েক হাত দূরে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে।বর্ণ এবং সাব্বির এর কথপোকথন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।মেজাজ তুঙ্গে।আজই রিকশার আকাল পড়তে হলো?পেলেও ভাড়া চায় আকাশচুম্বী।বোঝা গেলো কোনো না কোনোভাবে বর্ণের বাসস্থলের অনেকটা কাছাকাছি এসে তার ঠাঁয় হয়েছে। কাকতালীয় বিষয়গুলো এখন বড্ড ভাবায় তাকে।সাথে বর্ণের অনাচার।
একটু পরপর মন বলে উঠে,
“তুই সৎ উদ্দেশ্যে সাহায্য করতে চেয়েছিলি অন্না।তোকে অপমান করা হয়েছে”
বারবার মনে পড়ছে এই বিষয়টা। মস্তিষ্কটা স্বস্তি দিচ্ছে না। মাত্রাতিরিক্ত ভাবনারা জুড়ে বসেছে।ঘিরে আছে বর্ণের এমন স্বভাব।বেশি ভাবছে ভেবেও চেনতা থেকে বেরোতে পারলো না।সেখানে দাঁড়িয়ে আড়চোখে বর্ণের দিকে চেয়ে মন আবার প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা লোকটা কি এভাবেই থেকে যাবে জীবনে?নাকি হারিয়ে যাবে?থাকলেও এই থাকার মেয়াদ কতদিন?আবার বেশি না জুড়ে যায়?ইতিমধ্যে তো তাই হচ্ছে।”
প্রশ্ন উত্তরের সমাপ্তি ঘটে রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দে।চালক জানতে চান কোথায় যাবে? ভাড়ায় মিলতেই উঠে গেলো অন্বেষা।ফিরে চাইলো না একবার।এখন মাথায় নতুন দুশ্চিন্তা।
_______
“জব্বার চাচা আপনার খুব কষ্ট হয়ে যাবে তাইনা?আমি আপনাকে নাহয় প্রতিদিন আসা যাওয়ার ভাড়া দিবো”
জব্বার চাচার ঘামর্ত মলিন মুখ দেখে অন্বেষার ভীষণ মায়া হচ্ছে। খাঁটি মনের মানুষ তিনি একজন।নয়তো কে করে এই শহরে কারো সাহায্য?বাবার বয়সী লোকটা অমায়িক। আগের বাড়ির দারোয়ানের কাজ করেন তিনি।আগেতো আসতে যেতে দেখা হতো।এখন সেই সুযোগও নেই।তিনি হেসে বলেন,
“কিসের কষ্ট?তুমি কোনো টেনশনই করবা না আম্মা।আমি প্রতিদিন আটটায় আইসা খাওয়ন নিয়া যামু।আর ভাড়া দেওয়া লাগবো না।”
অন্বেষা জবাবে বলে,
“এভাবে হয়না চাচা। এখান থেকে ও-বাড়ি অনেক দূরে।হিসাব করে দেখলাম মাসে আসা যাওয়ার খরচ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।আপনার কষ্ট হবে।”
“কিয়ের কষ্ট আম্মা?তুমি আমার আর আমার ঘরের লেইগা রাইতের খাওয়ন দাও।কোনো টাকা নাও না।আমি তোমার থিকা যাতায়াত এর টাকা নিমু?”
“নিতে হবে চাচা।আমি কোনো কথা শুনবো না।আপনি আসুন আমার সাথে আমি বাড়ি চিনিয়ে দিচ্ছি”
_____
ক্লাস,অফিস শেষে ক্লান্ত বাড়ি ফিরেছে অন্বেষা।যাওয়ার পূর্বে গলির মোড়ে চায়ের দোকানে নজর দিয়ে এসেছে একদফা।সকালে যে গলা ছেড়ে গান গাচ্ছিলো অভদ্র ছেলেটা?সে নেই।মাঝেমধ্যে অন্বেষার মনে হয় তার মগজ নয় একটা উটকো চিন্তার কারখানা।কেনো নেই?এখন মূল প্রশ্ন এটা।প্রশ্নকে মাথায় চেপে বাড়িতে ঢুকে গেলো।এখনও পুরো ঘর গোছানো হয়নি।আগামীকাল শুক্রবার।শান্তিতে গুছিয়ে নিবে।গোসল সেরে হিসাব করে নিলো।একটা সিঙ্গেল বেড আর ছোট প্লাস্টিকের ওয়ার্ডরোব ছাড়া তেমন কিছুই নেই তার।আছে কিছু কাপড় আর বই খাতা।তবে ছোট ঘরে এসবই জঞ্জাল মনে হচ্ছে।তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে।খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে আজও রাত কাটবে একহাত সমান বারান্দায়।ঘুম আসবে না এই জায়গায় কিছুতেই।
গোসল সেরে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে কাটাকুটির কাজ শুরু করলো অন্বেষা।ঘন্টাখানেক পর জব্বার চাচা আসবেন।যত দ্রুত সম্ভব রান্না শেষ করতে হবে।ঘরে বসেই সবজি কেটে রান্না ঘরের দিকে এগোলো।গিয়েই দেখতে পেলো সাবলেট এ থাকা আরেক পরিবারের গৃহিণীর সাথে।হাসি বিনিময় করলো অন্বেষা। সুদীপ্তা প্রশ্ন করলেন,
“তুমি গতকাল আসলা তোমার দেখাই পাইলাম না।”
সিঁথিতে সিঁদুর। অন্বেষা বুঝতে পারলো সনাতন ধর্মাবলম্বীর তিনি।বললো,
“আমি অনেক দুঃখিত দিদি।আসলে গোছগাছ আর ভার্সিটির ক্লাস মিলিয়ে সময় হয়ে উঠেনি।”
“ওওও….রান্না করবে নাকি?”
“হ্যাঁ।কিন্তু আমার চুলো বসানো হয়নি এখনো। আমি যদি….”
“আমার চুলোয় রান্না করো।কোনো সমস্যা নাই।”
“আপনার রান্না আছে?”
সুদীপ্তা ফিডারে দুধ ঢালতে ঢালতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,
“আরেহ না।আমি রাতের খাবারও দুপুরে রান্না করে ফেলি।তিনজনের সংসার।তার মধ্যে চার বছরের মেয়ে একটা।কতই বা খাই আর?”
“বাহ বেশতো!আপনার মেয়ে কোথায়?”
“ঘরে টিভি দেখে।তোমারে খুঁজছে বুঝছো?আমি বলছি আন্টি ব্যস্ত।আসলে তুমি গল্প কইরো”
সুদীপ্তার কথাবার্তা পছন্দ হলো অন্বেষার।কোনো ধূর্ততা নেই।খুবই সরল মনে হলো।সামনে কি হয় দেখার অপেক্ষায়।অন্তত ঝুমা এবং রুম্পার চেয়ে ভালোই হবেন।এক চুলোয় ভাত চড়িয়ে অন্য চুলোয় তরকারি বসায় অন্বেষা।বললো,
“ওকে কাল আমার কাছে পাঠাবেন কেমন?আমার ছুটি আছে।গল্প করবো আপনার ছোট্ট বুড়ির সাথে।”
সুদীপ্তা চওড়া হেসে জবাব দেয়, “আচ্ছা।কিন্তু কালকে তুমি আমার ঘরে খাবা।না করবা না কিন্তু!আর কোনো সাহায্য লাগলে ডাইকো।দরজা খোলা আছে।”
“জ্বি দিদি অবশ্যই”
রান্না করতে করতে হাতে দ্রুততা এসেছে অন্বেষার।ফটাফট তৈরি করে ফেললো খাবারগুলো।হালকা ঠান্ডা করে একে একে টিফিন বক্সে মধ্যে রাখতে রাখতেই জব্বার চাচার ফোন।সব একটি বড় ব্যাগে করে নিচে নেমে দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে।
“এই নিন চাচা আপনার ভাড়া আর খাবার।লাল রঙের বাটিতে আপনার খাবার আছে”
বারবার না করা সত্ত্বেও ভাড়া আর খাবার দুটোই নিতে হয়েছে। অন্বেষার জোরাজুরিতে।কিছুতেই খালি হাতে যেতে দেয়নি।ঘরে ফিরে এসে নজর যায় আরো একটি বাটিতে।কিছু সময় চেয়ে রইলো সেখানে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে বিজড়িত হয়ে ফোন হাতে নিলো। কদম জোড়া চললো আনমনে। ধীরো মধ্যম গতিতে।এসে থামে বারান্দার দরজায়।ফ্যাকাশে মুখ।একবার শূন্যে চাইলো আনমনে।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ডায়াল করলো অপরিচিত এক নাম্বারে।কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হয়।
সুরেলা কণ্ঠে কেউ বললো, “হ্যালোওওও”
অন্বেষা কোনো কথা বললো না।মুখে কুলুপ এঁটেছে এবারও।অপেক্ষার পরও কোনো জবাব না পেয়ে বর্ণ প্রশ্ন করে,
“আরেহ কেঠায়!কল দিয়া কথা কও না কেন শালা?”
শালা শুনে নড়েচড়ে উঠলো অন্বেষা।ঘড়িতে সময় আটটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট।নিভু নিভু স্বরে জবাব দিলো,
“আমি”
“আমি কেঠা?” দ্রুত প্রশ্ন আসে আবারো বর্ণের তরফ থেকে।
অন্বেষা রয়ে সয়ে জবাব দিলো, “আমি অন্বেষা”
“ওওওও রাগিনী পিশাচিনী?”
ঠান্ডা মেজাজ ভড়কে উঠতে কতক্ষণ?কথাবার্তার ধরনে গা জ্বলে উঠে বারবার।এবারও অতি রাগে উত্তর দিতে পারলো না অন্বেষা।বর্ণ বলে,
“ফোন দিছো কেল্লেগা?ওই ভোটকা আবার আইছে নিহি?”
“নাহ!”
“তো কি পিরিতের আলাপ পারতে কল দিছো?”
“নাহ”
“আহো দুইটা পিরিতের আলাপ করি।…. কি করো ময়না পাখি?রাইতে খাইছো?”
রি রি করে উঠলো অন্বেষার সর্বাঙ্গ। অদ্ভুত রকমের অদ্ভুত শুনাচ্ছে কথাগুলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“তুমি চরম লেভেলের অসভ্য!”
“কেনো ময়না পাখি আমি তোমার সাথে কি অসভ্যতামি করছি?”
এই ছেলের সাথে যত কথা বলবে সে তত কথা পেঁচাবে।আর কথা না বাড়িয়ে আসল কথায় এলো অন্বেষা।বললো,
“আজ খাবার একটু বেশি রান্না করে ফেলেছি।আমি অপচয় পছন্দ করিনা।ফেলে দিবো?ভাবলাম তোমাকে দান করি।একা মানুষ এত খাবার খাওয়াতো সম্ভব না তাই না।বাড়ির কাছে এসে নিয়ে যেতে পারবে?”
বর্ণ ফোনের অন্যপাশ থেকে হো হো করে হেসে উঠে।বলে,
“আমারে কি কোনোদিক দিয়া মক্কেল মনে হয়?”
“হুম!মনে হয় সম্পূর্ণ দিক থেকেই মনে হয়”
“মনে যেহেতু কইরাই ফালাইছো তাইলে আমি ক্লিয়ার কইরা দেই।আমি মক্কেল না উল্টা তুমি বেকুব! সোজাসাপ্টা কইতে পারতাছো না আমার লেইগা খাবার দিতে চাও।”
“কে বলেছে এসব?নিজে থেকে উল্টোপাল্টা ভেবে নেওয়া ঠিক না।”
বর্ণ বহুদিন পর সিগারেট পেয়েছে।একটি সিগারেটকেই খুব আরাম আয়েশে টেনে যাচ্ছে। ফুরাতে দিবে না অত সহজে। ঠোঁটের কোণে সিগারেট চেপে রেখে মৃদু অস্পষ্ট গলায় বললো,
“আমি গার্মেন্টসে। কাম শেষ হয় সকালে।তুমি চাইলে খাওন ফ্রিজে রাখতে পারো।”
“আমার ফ্রিজ নেই”
“তাইলে নিজে গিলো বইয়া বইয়া।”
“তুমি গার্মেন্টসে কাজ করো?তাহলে টিউশন?”
“আমি সব করি…”
বারবার পায়ের টিউমারটার কথা মাথায় আসছে এখন।সাথে বর্ণের বিরক্তিকর আচরণের বিষয়টাও।সবসময়ের মত ভাবনার সমুদ্রে ডুবে গেলো অন্বেষা।ফোন চলছে। কানে পেতে রাখা। বর্ণও সময় দিলো অন্বেষার নীরবতাকে।তার কি?তার ফোনের টাকাতো আর কাটছে না।তাছাড়া ফোনে টাকা থাকলে না কাটবে?
দালানের আশপাশ হতে আসা মৃদুমন্দ হাওয়া ভালো লাগছে অন্বেষার।ঠান্ডা করে তুলছে কায়া।বিশাল এক দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শেষে শীতল স্বরে প্রশ্ন করলো অন্বেষা,
“আমাকে তোমার কেমন মনে হয়?”
“গোবরে পদ্মফুলের মতো”
তৎক্ষনাৎ উত্তর এলেও অন্বেষার খারাপ লাগলো।ভীষণ রকমের খারাপ লাগা অনুভব করলো।মনের মাঝে অদৃশ্য আঘাতটা ফোন কেটে দিতে বাধ্য করে।
চলবে…