#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৫
“স্বামীটাকেও হাতে রাখতে পারলে না? দুদিনেই বাবার ঘাড়ে উঠে এসেছো। লজ্জা করে না?”
“আমার কী দোষ মা?”রাহেলা বেগমের কথায় অনু প্রতুত্তর করতেই তিনি যেন আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তিনি রাগী আর টিটকারির সুরে জানালেন,
“না, তোমার কোনো দোষ নেই তো। তুমি তো কচি খোকা।”
রাহেলা বেগমের কথায় অনু রাগ সামলাতে না পেরে চেঁচিয়ে জবাব দিল,
“ছোট মা, মুখ সামলে কথা বলো।”
অনুর কথায় রাহেলা বেগম মোটেও দমে যাননি। উনি উল্টো আরো টিটকারি কণ্ঠে শুধালেন,
“মেয়ের রাগ দেখো। নিজে অন্যায় করে এখন আমার উপর চেঁচাচ্ছে। বলি এতো মুখ আসে কোথ থেকে?”
অনু চুপ হয়ে গেল। সে আর কথা বাড়াতে চাইলো না। এমনিতেও এই বাড়িই এখন তার স্থান। একটু চুপ থাকলে হয়ত শান্তি থাকবে সংসারটাতে। এখন কথা বাড়ালে হয়ত বাবা যেকোনো সময় দেখে ফেললে কেলে’ঙ্কা’রি হয়ে যাবে। কারণ অনু আসার সাথে সাথেই রাহেলা বেগমের এমন চেঁচামেচির জন্য আনিস মিয়া উল্টো তার স্ত্রীর উপরই চেঁচাবেন। এতে উনি আনিস মিয়াকে অনুর পক্ষে নিতে দেখে আরো রাগারাগি শুরু করে দিবেন। এতে সংসারে অশান্তি শুরু হবে। যেটা অনু মোটেও চায় না। তার জন্য উনাদের মধ্যে ঝামেলা হোক তা অনু একদমই চায় না।
অনুকে নীরব দেখে রাহেলা বেগম যেন আরো সুযোগ পেলেন। তিনি আবারো চেঁচিয়ে বললেন,
“প্রথম থেকেই চোখে চোখে রাখলে এতটা বাড় বাড়তে পারতো না। কেন সাবধান হওনি?”
ছোট মায়ের এমন প্রশ্নে অনু কোনো জবাব দিতে পারলো না। অনু জানে, উনি মোটেও বোঝানোর জন্য এসব বলছে না। উনি নিজের ঘাড় থেকে নামাতেই অনুকে এসব বলছে। কারণ অনুকে উনি অতটাও পছন্দ করে না, যতোটা বোঝানোর ভঙ্গিতে কথার ধরণে মনে হচ্ছে। উনি শাসন বা বোঝানোর জন্য এসব বলছে না। উনার এরূপ বোঝানোর ধরণের পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে তা অনু ভালোই টের পেয়েছে। কিন্তু এখন টের পেলেও কিছু করার নেই। অনু চুপ থাকায় শ্রেয় মনে করলো।
“আমি কী করবো মা?”
“আটকাতে পারলে না? এখনো সময় আছে ফিরে যাও।”
অনু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে জানে তার ছোট মা এমন। তাই বলে একটা মেয়ে হয়ে তার পক্ষে না গিয়ে উল্টো পুরুষের পক্ষ নিচ্ছে! শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অনুকে ফেরত যেতে বলছে। এতটা নিচু!
“তুমি আমাকে ফিরে যেতে বলছো?”
“হ্যাঁ, বলছি।”
“একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এমন বলতে তোমার দ্বিধা হচ্ছে না মা?”
“কেন হবে? আমি কী কিছু খারাপ বলছি নাকি?পুরুষ মানুষের বাইরে চোখ এরকম একটু আধটু থাকবেন। মেনে নাও।”
“মা!”
“চেঁচাবে না একদম। একটু মানিয়ে চলতে পারলে না? এভাবে তো চলা যায় না। বাপের বাড়িতে কী সারাজীবন কাটাতে পারবে না কি?”
অনু মলিন হাসলো। এখনো ঘরে ঢুকলো না। আর তার ছোট মা সারাজীবনের কথা বলে দিচ্ছে। এখনো একটা দিনও পাড় হলো না অথচ!
আনিস মিয়া এতো চেঁচামেচির শব্দে রুম থেকে বেরিয়ে মেয়েকে দেখেই তব্দা বনে গেলেন। তিনি মেয়ের এমন শান্ত চেহারা দেখে কিছুটা হলেও আন্ডাজ করে নিলেন।
অনুর চোখ বাবার দিকে পড়তেই তার কোথাও জানি ভরসা চলে এলো। সে এবার আর নিজের রাগ সামলাতে পারলো না। ঘরে না ঢুকতেই উঠান থেকে এতো এতো চেঁচামেচির সহিত কথা তার বিরক্ত লেগে উঠল। সে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“আমি আমার বাপের বাড়িতে থাকতে এসেছি। কার কী সাধ্য আমাকে বের করার!” বলেই সে ধীরপায়ে বাবার দিকে এগিয়ে গেল।
আনিস মিয়া হাসলেন। তার নরম মেয়ে তাহলে তেজী হতে শিখতে শুরু করেছে! তিনি এগিয়ে মেয়েকে আগলে নিলেন। এরপর বাবা মেয়ে দুজনেই ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
পেছনে থেকে রাহেলা বেগম তেলেবেগুনের মতো জ্ব’লে অনু আর আনিস মিয়াকে যা নয় তা গালি দিচ্ছেন। কিন্তু অনু আর আনিস মিয়া সেগুলোতে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চলল।
আনিস মিয়া রাহেলা বেগমকে শুনিয়ে অনুকে উচ্চস্বরে জানালেন, “চল মা, তোকে ঠান্ডা ঠান্ডা এক গ্লাস শরবত করে দিই।”
পেছনে থেকে রাহেলা বেগমের চিৎকার চেঁচামেচি শুনেও তারা বাপ্ মেয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
আর উঠানে রেখে গেল রাহেলা বেগমের এক জোড়া জ্ব’ল’ন্ত চোখ।
———-
সকাল হয়েছে অনেকক্ষন হলো। আদিত্যর মনে হলো তার নাম ধরে কেউ অনেকক্ষন ধরে ডেকে চলেছে। সে ঘুম ঘুম ঝাঁপসা দৃষ্টিতে তাকাতেই অনুকে দেখতে পেল।
“আদিত্য, উঠো উঠো। তোমার অফিসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।”
আদিত্য হামি দিয়ে উঠে বসলো। এরপর ঘড়ির দিকে তাকাতেই সে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এখনো সবেমাত্র সাতটা বাজে আর অনু এমনভাবে ডাকছে যেন ৯টা বেজে গিয়েছে। আদিত্য অনুর দিকে রাগী চোখে শাসালো,
“তুমি জানো? এটার জন্য তোমার শাস্তি কী হতে পারে।”
অনু কাঁথা ভাঁজ করতে করতে জানালো,
“আমাকে শাস্তি দিতে গেলে এইবার সত্যিই কিন্তু তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাবে।”
“তাই বলে দেরি হয়ে গিয়েছে বলে এতো তাড়াতাড়ি তুলে ফেলবে আমাকে?”
আদিত্যর অভিমানী সুরে বলা কথাটার প্রেক্ষিতে অনু হাত থেকে কাঁথা রেখে শুধালো,
“যতোটা ঘুমকে ভালোবাসো ততটা আমাকেও তো বাসো না বোধহয়!”
আদিত্য চোখ টিপ্পনি কেটে জানালো,
“অহ তার জন্য মহারানীর রাগ সেই কথা আগে বলবা না? এজন্যই কী আমাকে এতো আগে আগে ঘুম থেকে ডেকে দিয়েছো?”
আদিত্যর ভঙ্গিমা দেখে অনু কথা ঘুরানোর প্রেক্ষিতে জানালো,
“তা নয়তো কী করবো? না ডাকলে তো আপনি তো মহারাজার মতো পড়ে পড়ে সারাদিনই ঘুমাতে থাকবেন।”
“আরেকটু ঘুমায় অনু।”
অনু কোমরে দুহাত রেখে শাসনের সুরে জানালো,
“এই না, একদম না। এখন ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে নিন। এরপর তৈরী হয়ে যান।”
“অনু।” বলেই আদিত্য আবারো শুয়ে পড়লো।
অনু আদিত্যর হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে জানালো,
“এইবার কিন্তু সত্যিই দেরি হয়ে যাবে। উঠে পড়ুন। বেলা হয়ে যাচ্ছে।”
আদিত্য ঘুম চোখে পাশ ফিরে জানালো,
“উফ অনু আরেকটু ঘুমায়।”
“আদিত্য, উঠো উঠো।” অনুর কণ্ঠ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। সাথে অনু নিজেও। অনুর অস্তিত্ব যেন চোখের সামনেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
আদিত্য ঘুমের মধ্যে এপাশ ওপাশ ছটপট করতে লাগলো। সে চোখ বন্ধ অবস্থায় আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল, “অনু, অনু”। হুট্ করে সে ঘুম থেকে উঠে বসলো। আদিত্যর বুক ধড়ফড় করছে। সে উঠেই চারপাশে তাকিয়ে দেখল, কোথাও অনু নেই।
আদিত্য হুট্ করে বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো। তার কোথাও জানি খালি খালি লাগছে। এতটা বাস্তব স্বপ্ন। সে বেশ কিছুক্ষন ঝিম মেরে খাটে বসে রইল।
ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখল বেলা দশটা। আজকে সত্যিই অনু তাকে ডাকেনি। স্বপ্নের কথা অনুযায়ী আদিত্য আজ অনেক ঘুমিয়েছে কিন্তু তবুও তার কোথাও জানি অনেক খারাপ লাগছে। তার অভিমান হলো। কেন অনু আজ তাকে ডাকলো না!
দরজা ধাক্কানোর শব্দে আদিত্য খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আছিয়া বেগমকে দেখে সে ভ্রু কুঁচকালো। তার মানে এতক্ষন ধরে মা ডাকছিলো!
আদিত্য জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে মা? ডাকাডাকি করছো কেন?”
আছিয়া বেগমকে দেখতে অন্যরকম লাগছে আদিত্যর কাছে। তার চিন্তা হলো। সে চিন্তিত কণ্ঠে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে মা?”
“আদিত্য, অনু…”
#চলবে ইন শা আল্লাহ।