চৈত্র শেষে পর্ব-১০

0
66

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১০

অনু জানালার বাইরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বিকেল গড়িয়ে রাত হলো। চারদিকে গুটগুটে অন্ধকার। আজ তার মনের মতোই চারদিকের পরিবেশ। কেমন জানি গুমোট আবহাওয়া। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। ক্ষনে ক্ষনে ওই মেঘ গুলোর মাঝে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেন মুহূর্তের মধ্যে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামবে। অনুর মনে হলো আবহাওয়াটা তারই মন। এতো গুমোট কেন চারদিক! অনুর হুট্ করে বিবৎস লাগলো। তার কানে এখনো ভাসছে, “কী মা! জামাই বাবাজি না কি বিয়ে করলো?জানো কিছু?”চারদিক থেকে কথাটা বারবার কানে ভেসে আসতেছে। যেন দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে কথাগুলো। অনুর মনে হচ্ছে তাকে ঘিরে চারদিক থেকে এই এক কথাটা সবাই বলছে। একই কথার এতো এতো আওয়াজ সে নিতে পারছে না। তার মাথা ভনভন করে উঠলো। অনু কান চেপে ধরলো। সে আপনমনে বিড়বিড় করে আওড়ালো, “না, আদিত্য এই হতো পারে না। আমি তো এসেছি তোমাকে ভুলটা বুঝিয়ে সঠিক করার জন্য। তুমি আমার অনুপস্থিতি বুঝে যেন ফিরে আসো কিন্তু তা না হয়ে তুমি সত্যিই ছেড়ে দিলে আমায়! কীভাবে করলে আদিত্য!”
অনু কাঁদার চেষ্টা করলো। কিন্তু আসলো না। আশ্চর্য তার চোখ কী পাথর হতে গেল নাকি! বাবা বলেছে, কান্না আসলে কেঁদে নিতে মন হাল্কা হবে। তবে কেন তার কান্না আসছে না।তার কোথাও জানি আশা ছিল আদিত্য ফিরবে। কিন্তু না। সত্যিই এখন আর তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। সব সম্পর্ক শেষ! চিরতরে তারা পর হয়ে গেল! কীভাবে পারলো আদিত্য!
অনু যন্ত্রের ন্যায় উঠে দাঁড়ালো। এই জীবন সে আদিত্যকে ছাড়া চলতে পারবে না। সে কিছুতেই নিজের জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। যেখানে আদিত্যর সবটাই জুড়ে অনু ছিল সেখানে আজ অন্য কেউ থাকবে সে সেটা মেনে নিতে পারবে না। এই জীবন সে আদিত্যকে ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করেনি। সেই জায়গায় এখন আদিত্যকে ছাড়া সারাজীবন কাটাতে হবে তা অনু ভাবতেও পারছে না। না, আদিত্য ছাড়া সে শূন্য। জীবনে চলতে হলে প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে তার আদিত্যকে প্রয়োজন। সেখানে সে আদিত্যকে হারিয়ে ফেলেছে। আদিত্য ছাড়া অনু শূন্য। আর এই শূন্য জীবন সে বয়ে নিতে পারবে না। এই জীবন সে আর বাঁচিয়ে রাখবে না।
অনু উঠে এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। বেছে বেছে আদিত্যর বাড়ি থেকে আনা শেষ শাড়িটি নিলো। এরপর রোবটের ন্যায় তা ফ্যানের সাথে আটকালো।
অনু যেন পাথর হয়ে গেছে। তার মনে এখন আদিত্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না।
সে খাটের উপর রাখা চেয়ারে উঠে দাঁড়ালো। আদিত্যর কথা মনে পড়ছে ভীষণ। অনু বিড়বিড় করে আওড়ালো, “আদিত্য আমার মৃ’ত্যু’র খবর শুনে হলেও তুমি ফিরে এসো। শেষবারের মতো দেখে যেও তোমার অনুকে।”

———
আছিয়া বেগম আজ বেশ খুশি। কারণ এই দিনটা তার বহু অপেক্ষার দিন। আজ কতগুলো বছর ধরে তিনি এই দিনটারই তো অপেক্ষায় ছিল। শুধু মাঝে ওই মেয়েটা এসে সব গোলমাল করে দিয়েছিলো।
আছিয়া বেগম অনুর কথা মাথা থেকে বের করে দিলেন। শুভ দিনে এমন অশুভ মেয়ের কথা ভাবনায় আনলেও অমঙ্গল। যদিওবা আসল কাবিন কালকেই হয়ে গিয়েছে। একদম কাউকে ডাকা হয়নি সেই কাবিনে। বলা তো যায় না! আজকালকার মানুষ মানুষের শত্রু!
রিহির বাবা মায়ের জোরাজোরিতে আজকে মেহমানদের এনে ঘরোয়া অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। আছিয়া বেগম হাসলেন, মনে মনে তিনি যা চেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি পেয়ে যাচ্ছে। এই যে ঘরোয়া অনুষ্ঠান, কাবিন এসবের একটা টাকাও আছিয়া বেগমের খরচ করতে হয়নি। সব টাকা, খাবার রিহির বাড়ির লোকেরাই দিচ্ছে। ঠিক আছিয়া বেগমের মনের মতোই সব হচ্ছে।
“কী গো? রিহি কই? এখনো তৈরী হয়নি? নতুন বউকে দেখবো তো।”
আছিয়া বেগম রিহির রুমে এগিয়ে গেলেন। রিহিকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। পুতুলের ন্যায়। মেয়েটা একদম সাদা চামড়া। আছিয়া বেগমের চোখে এটাই তো সৌন্দর্য। মেয়ে মানেই তো ফর্সা, চওড়া। আর অনু মেয়েটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। অনুর কথা মনে পড়তেই আছিয়া বেগমের মেজাজ বিগড়ে গেল। বারবার তার তুলনার মধ্যে এই মেয়েটা ঢুকে যাচ্ছে তা তার পছন্দ হচ্ছে না। তার ভাবনাতেও এই টুনকো মেয়েটা এতটা জায়গা করে নিয়েছে তা তার ভাবতেও খিটখিট লাগছে।
রিহি আছিয়া বেগমের দিকে এগিয়ে এসে সালাম করতেই তিনি হেসে উঠলেন। তিনি মনে মনে আওড়ালেন,
“কোথায় ওই মেয়ে আর কোথায় আমার রিহি বৌমা। পার্থক্য করলেও তো নিচে গিয়ে পড়ে থাকবে।”

“মা? কিছু বলবেন?” রিহির মুখে মা সম্বোধন শুনে আছিয়া বেগমের যেন খুশি উপচে পড়ছে। তিনি খুশি হওয়ার ভঙ্গিমায় জানালেন,
“তোমার মুখে মা ডাক শুনে কী যে ভালো লাগছে।”
রিহি হাসলো।
আছিয়া বেগম তড়িঘড়ি করে জানালেন,
“দ্রুত আদিত্যর কাছে বসো। ওকে একা রাখিও না। আমি দেখে আসলাম। মনমরা হয়ে বসে আছে। এই সময়টা ওকে একদম একা রাখবে না। বুঝছো?”
আছিয়া বেগমের কথা শুনে রিহি দ্রুত এগিয়ে গেল। আদিত্যকে কিছুতেই একা রাখা যাবে না। অনেক কষ্টে সে তার স্বপ্নপুরুষকে হাতের নাগালে পেয়েছে। কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
রিহি রুমে এগিয়ে গেল। আদিত্য পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছে। রিহি আদিত্যর কাঁধে হাত রাখতেই আদিত্য কেঁপে উঠল,
“তুমি এখানে?”
আদিত্যর কথায় রিহি হাসলো। হেসে জবাব দিল,
“ওমা, আমার রুমে আমি আসবো না? এটা তো এখন থেকে আমারই রুম।”

আদিত্য রিহির দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষন পরে রয়েসয়ে জবাব দিল,
“তোমার রুম!”

“হ্যাঁ তা নয়তো কী! তোমার সাথে না আমার বিয়ে হলো। এখন তো আমি তোমারই স্ত্রী। আর স্বামী স্ত্রী একসাথেই তো থাকে।”
আদিত্যর অনুর কথা মনে পড়লো। তার বুক ধক করে উঠলো। আশ্চর্য! সে তো নিজের ইচ্ছেতেই বিয়েটা করেছিল তবে তার এমন খারাপ কেন লাগছে!

রিহি আদিত্যর ভাবগতি বোঝার চেষ্ঠা করলো। যে রিহি কোনোদিন ধর্মের প্রতি উৎসাহী ছিল না সে রিহি আছিয়া বেগমের জোরাজোরিতে শুধুমাত্র আদিত্যর জন্য হুজুরের কাছে গিয়েছিল। এতো কষ্ট করেছে। অনেক কষ্টে আদিত্যকে তার দিকে ফিরিয়েছে। এতো সহজে তো ছাড়বে না। কিন্তু আদিত্যকে দেখে এমন কেন মনে হচ্ছে! রিহি আদিত্যর দিকে তাকালো,
“আদিত্য তুমি ঠিক আছো?”

আদিত্যর মনে হচ্ছে সে নিজের হুশের মধ্যে নেই। কেউ তাকে রোবটের ন্যায় চালাচ্ছে। সে রয়ে সয়ে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সম্বোধন করতেই রিহি হেসে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শুধালো,
“আমাকে কেমন লাগছে আদিত্য?”
আদিত্য রিহির দিকে তাকালো না তেমন। সে জবাব দিল,
“ভালো লাগছে।”
রিহি অভিমানী কণ্ঠে জবাব দিল,
“শুধুই ভালো লাগছে?”

আদিত্য মাথা তুলে তাকালো। এই ধরণটাতো অনুর ছিল তবে রিহি কেন অনুর মনে করছে! আদিত্যর হুট্ করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে বেশ চেঁচিয়ে জবাব দিল,
“এই জায়গাটা তুমি নেয়ার চেষ্টা ভুলেও করবে না।” বলেই সে বেরিয়ে গেল।
রিহি আদিত্যর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। হুট্ করে শান্ত আর হুট্ করে রাগ! তার কেন জানি ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না। কোনো উল্টো কিছু হয়ে যাচ্ছে না তো!

#চলবে ইন শা আল্লাহ