চৈত্র শেষে পর্ব-১২

0
125

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১২

আজ অনুর ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। অনু মাথা ধরে বসে রইল। সে জানার চেষ্টা করলো কী হলো। ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই তার খারাপ লাগলো। আজ সে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। বাবা হয়ত একাই বসে আছে।
অনু তড়িঘড়ি করে মুখ ধুয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে গেল। যা ভেবেছে তাই।
আনিস মিয়া একা বসে আছে। মাঝখানে দুটো কাপ। নিশ্চই অনুর আসার অপেক্ষায় ছিল।

অনু এগিয়ে যেতে যেতে শুধালো,
“যদি আমি আজ না আসতাম? তাহলে আরেক কাপ চা’টা কী করতে?”

আনিস মিয়া ফিরে তাকালেন। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন,
“ঘুম কেমন হলো? কাল তুমি আমার কথার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে। একদম ছোট্ট সেই বিড়াল ছানার মতো করে।”

অনু হাসলো। সে বুঝে উঠে পাই না। মানুষটা এতো ভালোবাসে কেন তাকে?
অনু এগিয়ে যেতেই আনিস মিয়া চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন।
অনু হাতে নিতে নিতে জানালো,
“কী হলো? বললে না তো?”

“আমিই খেয়ে নিতাম।” বলেই আনিস মিয়া হো হো করে হেসে উঠলেন।

“সেই ঠান্ডা চা খেতে? আমাকে ডাকলেই পারতে।”

আনিস মিয়া হুট্ করে গম্ভীর হয়ে গেলেন,
“ডাকিনি। কারণ ঘুমের সাথে সাথে কালকের আগের দুইবছরের সব স্মৃতি যাতে মুছে ফেলো। মনে করো, তোমার সেই বিয়ের আগের ২০ বছরের জীবন থেকে তোমার আবার নতুন করে জীবন শুরু।”
অনু মলিন সুরে জানালো, “কিন্তু আমার দুইটা বছর?”

“মনে করো, দুইটা বছর একটা তিক্ত স্মৃতির মধ্যে ছিলে। যেটার কোনো মানে হয় না। অপচয় হয়েছে।”

অনু জবাবে কিছু বললো না। সে এগিয়ে গিয়ে বাবার হাত ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। মাথা রেখে শুধালো,
“জানো বাবা? তুমি না অনেক ভালো। আমি যখন স্কুল কলেজে পড়তাম। আমার সহপাঠী যারা যারা তোমাকে দেখেছে তারা সবাই আমাকে এসে এসে বলতো,’তোর বাবার মতো মানুষ হয় না।’ আমি তখন হাসতাম। কিন্তু এখন বুঝি, আসলেই তোমার মতো মানুষ হয় না। প্রতিটা ঘরে ঘরে বোধহয় কমবেশি আমার মতো মানুষ আছে। খোঁজ নিলে জানা যাবে প্রায় কমবেশি ঘরে অনু আছে। যারা নিজেদের করা ভুলের মাশুল দিতে থাকে। সেই ভুল শুধরাবার জন্য কাউকে পাশে পায় না। এজন্য অনেকেই আ’ত্ম’হ’ত্যা’র পথ বেছে নেয়। কেন জানো? কারণ সবার তো আর তোমার মতো সাপোর্টিভ বাবা নেই। তোমার মতো মানুষ যদি প্রতিটা ঘরে ঘরে থাকতো তাহলে দেশের পরিসংখ্যানে হয়ত আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সংখ্যা অনেকটা কমে যেত। আমি যদি পারতাম, তোমার মতো মানুষ প্রতিটা ঘরে ঘরে দিতাম। কিন্তু এখন তো দিবো না। কারণ তুমি শুধুই একজন। আর সে হচ্ছে শুধুই অনুর বাবা।”

আনিস মিয়া মেয়ের কথা চুপ করে শুনলেন। তিনি হেসে শুধালেন,
“আমি আর এমন কী! মানুষ মাত্রই ভুল। সবাই কমবেশি ভুল করবে। তাই বলে কী তাকে ক্ষমা করে জীবনে এগিয়ে যেতে দিবো না? দোয়া করো, সবাই যেন বুঝে।”

অনু বাবার হাত আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিল।

“আচ্ছা, শোনো? তোমার সালিহা আন্টির কথা মনে আছে?”
আনিস মিয়ার কথায় অনু বাবার দিকে তাকালো। প্রশ্নবোধক চাহনীতে শুধালো,
“সালিহা আন্টি?”

“হ্যাঁ।”
সালিহা আন্টির কথা শুনতেই অনুর মুখ মলিন হয়ে গেল। কতগুলো বছর পরে!
আনিস মিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবারো প্রশ্ন করলেন,
“মনে আছে?”

“হ্যাঁ, উনাকে কিভাবে ভুলি! উনাদের ভোলা যাবে কোনোদিন?” বলতে বলতেই অনু অন্য মনস্ক হয়ে গেল।
মেয়ের মলিন সুরের কণ্ঠে আনিস মিয়ার খারাপ লাগলো। তিনি খারাপ লাগা দূরে রেখে শুধালেন,
“তোমাকে তো বলায় হয়নি। কয়েকমাস আগে থেকে উনি যোগাযোগ করেছে।”

“উনি আর আসেনি বাবা?”
আনিস মিয়ার মুখ কালো হয়ে গেল।
“না, আমার ভুলে আর আসবে?”

“তুমি কোনোদিন ভুল করতে পারো না বাবা।”

“করে ফেলেছি তো।”

“নিজের ইচ্ছেতে করেছো? আমার কথা ভেবেই তো করেছো। আর ভালোই করেছো। শেষ বয়সে সবারই তো জীবন সঙ্গী লাগে।”

“তোমার ভালোর জন্য করতে গিয়ে কতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়েছি। তোমাকে তো দিয়েছিই । আবার তোমার নানুরবাড়ির সাথেও সম্পর্ক খারাপ হয়েছে।”

“উফ বাবা, আর বলো না। এখন সালিহা আন্টি খবর নিচ্ছে। তার মানে তো সম্পর্ক ভালোই হচ্ছে।”

“হ্যাঁ, তা একটু। তোমার খবর জেনেছে উনারা। সামনের মাসে মানে আরেকমাস পরে তোমার ছোট মামার বিয়ে। সবাই ওখানে যাচ্ছে। আমাদের দাওয়াত করেছে। জানিয়েছে অন্তত তোমাকে যেন দিই।”

অনুর সব স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সেই ছোট মামা! যে অনুর মাত্র ১০বছরের বড়ো ছিল। কাজিনমহলের সবাইকে নিয়ে কী যে হৈ হুল্লোড় করতো! আড্ডামহলে উনার জনপ্রিয়টা ভীষণ ছিল। কী চঞ্চল! অনুরও অনেক পছন্দের মানুষ ছিল। আড্ডামহলের কয়েকজন বড়ো থেকে উনি থাকতো। আরেকজনের কথাও মনে পড়ে গেল। সাহিল ভাইয়া! উনিও জনপ্রিয় ছিল। তার গানের জন্য! এই দুইজন ছিল কাজিনমহলের মধ্যমনী। মাঝখানে কতগুলো বছর কেটে গেল। অথচ কোনো যোগাযোগই ছিলো না তাদের মধ্যে! সেই ১৬বছরের যুবতী হয়ে শেষবারের মতো গিয়েছিল! কে জানতো এরপর সব আলগা হয়ে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে! কে কেমন হলো তাও আর জানা হলো না!

“কী? যাবে তুমি?”

“আমি? এতদিন পরে? না বাবা ওখানে আমার অস্বস্তি হবে।”

“হবে না। তোমার মায়ের স্মৃতি দেখবে। তোমার সাথে সম্পর্ক ভালো হলে আমি ম’রেও শান্তি পাবো।”

বাবার কথায় অনু চুপ হয়ে গেল।

“আমি নিজেও চাইছি, তোমার ক্লাস শুরু হওয়ার আগে কোথাও থেকে মন ফ্রেস করে আসতে। কিন্তু পারিনি,এখন পেলাম যখন যাও। এমনিতেও দুইমাস পরে তোমার ক্লাস শুরু। তখন একদম গ্যাপ দিতে পারবে না। এর মাঝে গিয়ে ঘুরে এসো। এখনো একমাস বাকী। একমাসের মধ্যে এতদিনের তৈরীটা হয়ে যাবে। অনেকবছর পরে সবার সাথে মিলবে ভালোই থাকবে। তোমার নানুরবাড়ির সবাই তোমার অপেক্ষায় আছে।”

অনু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এতগুলো বছর পরে! তাওবা সম্পূর্ণ অন্য পরিচয়ে! সেই ১৬বছরের যুবতী এখন একজন ডিভোর্সি হয়ে যাবে! একসময়ের পরিচিত মানুষগুলো অপরিচিত আর সম্পূর্ণ নতুন রূপে ধরা দিবে! অনুর মানসপটে সব স্মৃতি ভেসে উঠতেই তার বুক ধক করে উঠল।

——
আদিত্যর দিন আবার আগের নিয়মে শুরু হয়েছে। সে ভেবেছিল অনুকে ছাড়া তার চলতে কষ্ট হবে কিন্তু না। সব সুন্দরভাবেই চলছে। রিহি সব সুন্দর করেই সামলে নিচ্ছে। এখন আর অফিস শেষে গিয়ে ক্লান্ত শরীরে মায়ের কথা শুনতে হয় না। যতদিন অনু ছিল ততদিন সে এদিক দিয়ে অশান্তিতে ছিল। দিন শেষে গিয়ে ক্লান্ত শরীরে অনুর নামে এক গাধা কথা শুনতে হতো। আবার রুমে এসে অনুকেও বোঝানো লাগতো যে,
“মায়ের শরীর খারাপ, মাকে এই বয়সে এতো টেনশন দিও না।”
কিন্তু অনু এতে নিজের দোষ স্বীকার না করে উল্টো জানাতো,
“আমি কী করেছি! তোমার মাই তো সব করতো। শুধু শুধু আমার উপর চেতে। আসলে জানো তো? তোমার মা আমাকে পছন্দ করে না তাই এমনটা করে।”
আদিত্য বুঝিয়ে কুল পেতো না। দিন শেষে শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারতো না। কিন্তু এখন সব স্বাভাবিক। আদিত্য তো এটাই চেয়েছিল। যাক, মন এখন শান্তি। তবু কোথাও জানি অনুর জন্য মায়া হয়।
আদিত্য ফোন করবে ভেবে ফোন হাতে নেয়। মেয়েটা কেমন আছে কে জানে! আদিত্য নিজের মনকে শান্ত করলো,তার বিবেক থেকে অনুর দায়িত্ব নেওয়া উচিত। বেচারি মেয়েটা হয়ত বাবার ঘাড়ে গিয়ে উঠেছে। যদি এমনটা হয় তাহলে সৎ মায়ের কথা তো কম শুনবে না! আদিত্য তো জানে সবটা।

আদিত্য দোটানা মন নিয়ে তিথির নাম্বারে কল দিল। প্রথমদুবার কল কে’টে গেল। আদিত্য জানে, তিথি ইচ্ছাকৃত কল কে’টে দিচ্ছে। বারবার কল দেওয়ার পরে তিথি কোনো কথা বলতে চাইলো না। সে কল কে’টে দিতে চাইলে আদিত্য বারণ করে একটু অনুকে দিতে বলে।
তিথি শেষে কী মনে করে মোবাইল অনুর দিকে এগিয়ে দিল।
তিথির মুখ থেকে আদিত্যর কল শুনতেই অনু চমকে তাকালো। মনে মনে আশার প্রদীপ জ্ব’লে উঠল। কিন্তু অভিমানী হয়ে মোবাইল সরিয়ে দিল।
তিথি ওখানেই মোবাইল রেখে চলে গেল। থাক না শেষবার নাহয় নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিক।
তিথি চলে যেতেই অনু মোবাইল হাতে নিল। আদিত্যর সাথে কথা বলার লোভ সে সামলাতে পারলো না। অনুর মনে আশার প্রদীপ জ্ব’লজ্ব’ল করছে। সে নীরবে মোবাইল কানে নিল।

“অনু?”
আদিত্যর ডাকে অনুর বুক চিনচিন করে উঠল। মনে হচ্ছে, কতগুলো বছর পরে আদিত্য তার নাম ধরে ডেকেছে!

“কেমন আছো তুমি?”

“সেটা জেনে কী করবেন?” অনুর ইচ্ছে করলো, আদিত্যকে চেঁচিয়ে জানাতে যে আমি ভালো নেই আদিত্য। কিন্তু সে সেটা বলতে পারলো না। চুপ করে গেল।

“বলছি, তুমি এখন বাবার এখানে আছো না?”

আদিত্যর কথায় অনুর মন ফুরফুরে হয়ে গেল। তাহলে সে যা ভেবেছে তাই হয়েছে। আদিত্য নিশ্চই অনুকে নিয়ে যাবে তাই তো এরূপ প্রশ্ন করছে।
আদিত্য দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করতেই অনু অভিমানী সুরে জবাব দিল,
“আছি তা জেনে কী করবেন?”

“তুমি চাইলে আমি তোমার ভরনপোষণ দিতে রাজি আছি। তুমি এভাবে উনার ঘাড়ে উঠেছো ।নিশ্চই তোমার ছোট মা অনেক রেগে আছে। আমি কী তোমার খরচ পাঠাবো?”

অনু তাচ্ছিল্য হাসলো। তার আশার প্রদীপ ধুপ করে নিভে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সে ভেবেছিল, আদিত্য বুঝি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুকে ফিরিয়ে নিতে কল করেছে কিন্তু তা তো না। অনুর নিজের বোকামির জন্য নিজেই হাসলো। কী থেকে কী ভেবে ফেলেছে সে!

আদিত্য একই প্রশ্ন আবার করতেই অনু নিজেকে সামলালো। সে যথেষ্ট শক্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“ধন্যবাদ আদিত্য। আমাকে নিয়ে এতটা ভাবার জন্য। আমার কিছুর দরকার হবে না। তুমি তোমার নতুন জীবনে সুখী হও। আর কল করবে না।”
বলেই অনু মোবাইল রেখে কান্নায় ভেঙে ফেলল। সে সম্পূর্ণ ভেবে নিয়েছিল আদিত্য ফিরে এসেছে কিন্তু না সে ভুল। অনু হাসলো নিজের উপর। এতকিছুর পরেও সে এখনো আদিত্যকে ভালো ভাবছে! মা ভক্ত ছেলেরা কখনো বউকে সুখী রাখতে পারে না। আদিত্য কোনোদিন অনুকে বুঝেনি। উল্টো অফিস শেষে এসে তার মায়ের কথা শুনে অনুর উপর রাগারাগী করতো। সেই মিথ্যাগুলো একবার যাচাইও করার প্রয়োজনবোধ মনে করতো না। সম্পূর্ণ আলগাভাবেই সংসারটা ছিল। তবুও সে আদিত্যর উপর এতটা আশা কীভাবে রাখলো! অনু নিজের বো’কা’মি ভাবনার জন্য মলিন হাসলো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।