এই ভালো এই খারাপ পর্ব-০৪

0
85

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তিথির ঢেঁকুর বেড়েই চলেছে। আজলান গাড়ি থামিয়ে একটা পানির বোতল কিনে দিল। বলল,
” আর একটা কথাও বলবে না। ”
তিথি বোতলের ছিপি খুলে মুখ বসিয়ে চুকচুক করে পানি খেতে খেতে আজলানের দিকে তাকালো। আদেশ অনুযায়ী কোনো কথা বললো না। লোকটার কালো কুচকুচে দাঁড়ি গোঁফের ভীড়ে ঠোঁটদুটো যেন গভীর জঙ্গলের মাঝে হদিস না পাওয়া সেই গুহার মুখ। খুললেই যেন গপ করে একটা আস্ত মানুষ গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখে।

মনের দুঃখে তিথি আপাতত কিছু বললো না। ঝগড়া করতে দুজন মানুষ লাগে। একজন মানুষ কতক্ষণ একা একা ঝগড়া চালিয়ে যেতে পারে? তারমধ্য তিথি আবার গর্ভবতী। তার এত শক্তি কোথায়? এদের পুরো শেখ গোষ্ঠীর কাজ হচ্ছে জুতো মেরে গরু দান করা। তাকে সেদিন অপমান করে বের করে দিল আর আজ আবার গরুর মতো টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। শ্বাশুড়িটাও সারাক্ষণ গালিগালাজ করে আবার বিপদে পড়ে গেলে মিঠামিঠা কথা বলে তাকে হাত করার চেষ্টা করে। সবকটা ভন্ড। তিথির দুঃখ হলো। একটা ভালো মানুষ, ভালো পরিবার তো সে চেয়েছে। এত বাড়ি-গাড়ি দিয়ে কি হবে? এসব কে কতবার সে ঠ্যাং দেখিয়েছে হিসেব নেই। এসব তো সে চায় না। একটা মিষ্টিমুখো বর চায়।

বাড়ি পৌঁছামাত্রই তিথি গাড়ি থেকে নেমে ডানেবামে উঁকিঝুঁকি দিল। বাড়ির দক্ষিণদিকের সুইমিংপুলে বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাগুলো হৈচৈ করছে। আয়জাকেও উপস্থিত দেখলো সে। ওদের দেখাশোনা, গোসল করানো আর খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব আপাতত আয়জা নিয়েছে। সারাক্ষণ ওদের পেছনে লেগে থাকে।

বরটা ছাড়া বাকিদের তিথির অতটা খারাপ লাগে না। বকলে, কথা শোনালে অত গায়ে লাগেনা। কারণ দোষ তো তারও আছে। সে বিশ্বাস করে দোষেগুণে মানুষ। দোষ না থাকলে তাকে মানুষ বলে না, তাকে বলে রোবট।

তিথিকে দেখে বাচ্চাগুলো ইতোমধ্যে চেঁচিয়ে উঠেছে। তাদের সাথে মিশলেও গন্ডারটার সমস্যা। ওর কাছে ঘেঁষতে দেয় না বাচ্চাগুলোকে। যেন ওর আশপাশে থাকলে গায়ে গন্ধ লেগে যাবে। তিথির বড়ো অপমান লাগে সেসব।

আজলান বাচ্চাদের ডাকাডাকি চেঁচামেচি কানে না তুলে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। তিথি ব্যাথা পেয়ে বলল,

” আল্লাহ কেমন লোহার মতো হাত! আমার হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙে গেল! ”

আজলান ঘরে এসে তাকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ” দ্রুত গোসল নাও। ”

তিথি বলল, ” আমার কাপড়চোপড়, ফোন সব বাড়িতে।”

আজলান কাকে যেন ফোন করলো। মফিজুর রহমান ফোন তোলামাত্রই বললেন,

” হ্যা বাবা ওকে এভাবে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হলো? ”

আজলান বলল,

” অত ঠিকবেঠিক জানতে চাইনি। আপনার মেয়ের ব্যাগ ফোন আর যাবতীয় জিনিসপত্র যা আছে সব আমাদের ড্রাইভারকে দিয়ে দেবেন। সে কিছুক্ষণের মধ্যে যাবে। রাখুন। ”

মফিজ সাহেব বলে উঠলেন, ” ওর সাথে যদি একটু কথা বলতে পারতাম। মেয়েটা চলে গেল। মুখটাও দেখলাম না। ”

আজলান বিরক্তিকর গলায় বলল, ” অসহ্য। ”

বলেই তিথির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিল। তিথি একটু দূরে চলে গেল। ফিসফিস করে বলল,

” হ্যা বাবা বলো। ”

মফিজ সাহেব গর্জন করে উঠলেন।

” সবাই এখানে বলাবলি করছে ওই গোলামের পুত নাকি তোকে টানতে টানতে গাড়িতে তুলেছে। ”

” হ্যা। ”

” শালাকে আমি দেখে নেব। ও পেয়েছেটা কি? আমার মেয়ে কি হাতের পুতল? ”

আজলান ভেস্ট খুলে রাখতে রাখতে ভুরু কুঁচকে তিথির দিকে তাকালো। তিথি তার দিকে কোণাচোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

” আচ্ছা আর গালাগালি দিওনা। আমার উপর ভরসা রাখো। আমি এদের সাইজ করে ছাড়বো।”

” তোর শ্বাশুড়ি মাতারি এক নম্বর জল্লাদ বুঝলি? ছেলের কান ভারী করে। আমাকে আজ তোর শ্বাশুড়ির এক আত্মীয় বললো, তোর জামাইরে নাকি তোর শ্বাশুড়ি আরেকটা বিয়ে করাবে বলেছে। কতবড় বজ্জাত দেখেছিস? ”

তিথি বলল, ” আমি সব জানি আব্বা। ”

” তোর পাশে ওই আহাম্মক আছে নাকি? ”

” হ্যা। ”

” ওহ তাই তুই এভাবে কথা বলছিস। শোন যদি তোকে আর একবারও ঘর থেকে বের করে দেয় এক্কেবারে ঠ্যাং দেখিয়ে চলে আসবি। আমার মেয়েকে বের করে দেবে!”

তিথি বিড়বিড়িয়ে বলল, ” ঠ্যাং দেখিয়েও লাভ হয়নি। এদের অপমান করলে তা গায়ে লাগে না। ”

আজলান এসে ফোন কেড়ে নিল। তিথিরকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে তোয়ালে আর শাড়িটা দিল। তিথি বলল,

” আমি তোমার ঘরে থাকবো না। ”

আজলান বলল,

” কোথায় থাকবে সেটা আমি ডিসাইড করব নট ইউ। ”

তিথি লম্বা জিহ্বাটা বের করে বলল,

” আমি ঠিক করব। ”

আজলান দরজাটা টেনে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। তিথি চেঁচিয়ে বলল,

” এই লোক, পেটিকোট ছাড়া শাড়ি পড়া যায় নাকি? ”

আজলান দরজা খুলে দিল। বলল,

” নিজে নাও। ”

তিথি তার ড্রয়ার খুলে পেটিকোট বের করলো। ওয়াশরুমে ঢুকে আবারও কি মনে করে বের হলো। আজলান মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঝেটা ভিজিয়ে ফেলছে তিথি। সে চেঁচিয়ে বলল,

” এই মাথায় মগজ বলতে কিচ্ছু আছে? ”

তিথি ভড়কে গিয়ে কপাল কুঁচকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল, ” এমন করে ক্যা ব্যাটা? ”

বললো, ” ওমা ওমা কি করলাম আমি? ”

আজলান বলল, ” তুমি ভেজা পায়ে হাঁটছো। মেঝে ভিজে যাচ্ছে দেখছো না? আবার কেন বের হয়েছ? ”

তিথি বলল, ” ওগুলো নেয়ার জন্য। ”

আজলানের কপালে ভাঁজ পড়লো।

” কোনগুলো? ”

তিথির লজ্জাবনত মুখে বলল,

” ব্লাউজ আর ওটা…

আজলান বলল,

” তোমার যা যা লাগে সব একেবারে নিয়ে ওয়াশরুমে যাও। ”

তিথি জোরেজোরে ড্রয়ার খুলে কাপড়চোপড় খুঁজে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। গোসল সেড়ে বের হতেই দেখলো লোকটা উদাম গায়ে বসে টিভি দেখছে। কিন্তু চোখ হাতের ফোনের দিকে।
টিভিতে চোখ রাখামাত্রই তিথির চক্ষু ছানাবড়া। একটা নেংটী মেয়ে কি বাজে পোশাক পড়ে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছে। তিথি রিমোট কেড়ে নিয়ে টুপ করে টিভি বন্ধ করে বলল,

” বউ নাই তাই এতদিন ওসব দেখছিলে নাকি তুমি? ”

আজলান ফোনে এতটাই ব্যস্ত যে চোখতুলে তাকালো না। কাজশেষে মাথা তুলে বলল,

” কি বললে? ”

চেহারাটা এখন হনুমানের মতো বানিয়ে ফেলেছে অথচ এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিল। তিথি স্পষ্ট করে বলল,

” নেংটী মেয়েগুলোকে দেখতে তোমার ভালোলাগে। তাই না? ”

কথাগুলো একটু আওয়াজ করে বললো সে।
বলার পর স্তব্ধ হয়ে গেল আজলানের প্রতিক্রিয়া দেখে! কি এমন বললো যে এভাবে দাঁত কটমট করতে হবে! বিছানা থেকে নেমে টিশার্ট হাতে নিয়ে এমন ঝাড়া মারলো তার মুখের সামনে তিথির মনে হলো তার কলিজা ফুসফুস সব দুলে উঠলো যেন।

তারপর দাঁতের পেশনে নিজের ঝকোমকো দাঁতগুলোকে পিষতে পিষতে বেরিয়ে গেল লোকটা। তিথি দরজার কাছে গিয়ে বলল,

” সদা সত্য কথা বলিবে” এই কথা যে বলেছে তার সাথে রাগ দেখাও। আমি তো জাস্ট সেটা করে দেখিয়েছি। আজব! ”

_______

আম্বিয়া বেগম ঘরে এসে বললেন, ” এই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়েছিস না? তাও আবার এলি যে? ”

তিথি হা হা করে হেসে বলল, ” তোমাদের লজ্জাশরম নেই। ঠ্যাং দেখানোর পরেও ঠ্যাং ধরে মাফ চেয়ে নিয়ে এলে কেন? বুঝো আমার দাম কত! ”

আম্বিয়া বেগম অপমানিত হয়ে চেয়ে রইলেন। এই মেয়ে কিসের তৈরি? বললো,

” আমি কি তোর শত্রু? আমি চাই তুই ওর সাথে ভালো করে সংসার কর। নাতিপুতিতে ভরে উঠুক আমার ঘরদুয়ার। এতবড় বাড়ি ঘর ওদের জন্যই তো বানিয়েছি। ”

তিথি শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বললো,

” তোমার ওই রসকষহীন ছেলেকে আমার সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে বহুত নাচা নেচেছ সাসুমা। রসকষ নেই বলেই তো গরীব ঘরের মেয়ে এনেছ। নইলে তো মিস পার্ফেক্টিকে খুঁজে আনতে। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” বেকুব মাথামোটা। ও ছোট থেকেই ওরকম গাদ্দার তাই ওর জন্য একটা সাদামাটা বউ খুঁজে এনেছি। যাতে মুখে মুখে তর্ক না করে, ওর মন যুগিয়ে চলে। তুই এমন বোম্বেমরিচ হবি কে জানতো? তোকে প্রথম দেখায় তো মন্দ লাগেনি রে। তুই একটু ওর মনের মতো হয়ে চলতে পারিস না?”

তিথি বলল, ” অনেক মন যুগিয়ে চলেছি। আমার ডিসিশন ফাইনাল। বাচ্চাটা তোমাকে ধরিয়ে দিয়ে আমি এই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়ে চিরতরে চলে যাবো। ”

আম্বিয়া বেগম তিথির মাথাটা ঠেলে দিয়ে বললেন, ” তোর মতো খানকি মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি।”

আজলান ঘরে আসতেই আম্বিয়া বেগম বেরিয়ে গেলেন। আজলান ফোনটা কানে চেপে ধরে তার সিক্রেট ড্রয়ারটাতে চাবি লাগালো। কথা বলতে বলতে দেখলো তিথি ব্লাউজটা শুধু টানছে। কোথায় একটা টান পড়ছে। অস্বস্তিতে তার চোখমুখ তেঁতো হয়ে আছে। আজলান ফোনে কথা বলা শেষে বলল,

” সমস্যা কি তোমার? ”

তিথির হাত থেকে তোয়ালেটা মেঝেতে পড়ে গেল। সে মেঝে থেকে ভেজা তোয়ালেটা নেয়ার সময় আজলান দেখলো ব্লাউজের উপরের বোতাম নীচেরটার সাথে লাগানো। এভাবে সব এলোমেলোভাবে লাগিয়েছে। আশ্চর্য হলো সে।

গালের ভেতর কথা রেখে একদৃষ্টে তিথির দিকে চেয়ে রইলো সে। তিথি তোয়ালেটা বালতিতে ছুঁড়ে মারলো। আজলানকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপালকুঁচকে বালতিটা হাতে নিল। আবারও ফিরে চাইলো। আজলানকে একইভাবে চেয়ে দেখতে দেখে বিড়বিড় করে বলল,

“মনে হয় রাতের শয়তানটা গায়ে এসে বসেছে।”

সে ঘর থেকে বের হবে এমন সময় আজলান তার বাহু খপ করে ধরে টেনে এনে বলল,

” গবেট কোথাকার। ব্লাউজের বোতাম উল্টাপাল্টা লাগিয়েছ। ঠিক করো। ”

তিথি শাড়ি আঁচল সরিয়ে বললো, “ওমা তাই তো। তোমার চোখ তো ডেঞ্জারাস।” বলেই বোতামগুলো ঠিকঠাক লাগাতে শুরু করলো। আজলান বলল,

” ওহ শিট। তোমার মধ্যে লজ্জা বলতে কিছু নেই? মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে কেউ বোতাম ঠিক করে?”

তিথি বুঝলো না বরের সামনে ব্লাউজের বোতাম ঠিক করতে লজ্জার কি আছে? সে জিজ্ঞেস করলো, ” তোমার আছে? ”

আজলান বলল, ” মানে? ”

তিথি হেসে বলল, ” তোমার লজ্জাশরম থাকলে সেটাকে যত্ন করে রাখো। আমরটা তুমি কবেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছো। ”

আজলান বলল, ” জিভটাকে কন্ট্রোল করতে শেখো। নইলে…

আয়জা এসে বলল, ” ভাবি তোমার কাঁথাটা নিয়ে এসো শুধু। বাকিটা আমি ঠিকঠাক করে রেখেছি।”

আজলান বললো, ” কি হয়েছে? ”

আয়জা বলল, ” ভাবি বলছিলো আজ থেকে আমার সাথে থাকবে তাই বলতে এসেছি। ”

আজলান বলল, ” হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? ”

তিথি বলল, ” ডাক্তার বলেছে। ”

” কি বলেছে? ”

তিথি বলল, ” ওটা তো আর করতে পারবে না। তাই আর কি। ”

আজলান গর্জে উঠে বলল, ” ওটা মানে কি? স্পষ্ট করে বলো ফাজিল। ”

তিথি ভড়কে গিয়ে বলে ফেললো, ” সহবাস আর কি। যেন বুঝে না কিছু। ডাক্তার বারণ করেছে। ”

পিনপতন নীরবতার একটা ফোয়ারা বয়ে গেল চারপাশে। আজলান স্তব্ধ, হতচকিত, অপমানিত! আয়জা লজ্জায় কোনোমতে পালিয়ে গেল।

তিথি বলল, ” ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছে বর ডাকলে একদম কাছে যাবে না। বলবে, আমার কাছে বাচ্চা আগে। ”

আজলান পাথরের মূর্তির ন্যায় চেয়ে রইলো তার দিকে। তিথি খেয়াল করলো তার চোখদুটো পিটপিটও করছেনা। র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়নের ডেপুটি ডিরেক্টর কোনো অস্ত্রযুদ্ধ ছাড়াই ভবলীলা সাঙ্গ করলো নাকি? পরে ভাবলো ধুরর ফাটাকেষ্ঠ চিল্লানি দিতে না পারলে এরকম পাথরের মতো শক্ত হয়ে চেয়ে থাকে। কিন্তু জিভ থেকে পাকস্থলী অব্দি সব গালাগালি ধমকাধমকি আর চিল্লাচিল্লির দিয়ে ভরা। তিথি বলল,

” আমি ডাক্তারকে কি বলেছি জানো? বলেছি, কাছে এলেই মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে।”

বলেই একা একা হেসে উঠে বেরিয়ে যাবে অমন সময় আজলান তাকে চেপে ধরে ঘরে ঢুকিয়ে ধপাস ধপাস শব্দে দরজা দুটো বন্ধ করে দিল। তিথি চিল্লিয়ে উঠে বলল, ” আমি সদা সত্যি কথা বলি। আজও তাই বলেছি। ”

চলমান……..