এই ভালো এই খারাপ পর্ব-১০

0
222

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১০
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আয়জা ঠান্ডা শরবত নিয়ে ঘরে এসে দেখলো আজলান কোচের উপর শুয়ে আছে। আয়জা ডেকে বললো, ” ভাইয়া শরবত এনেছি। ”

“টেবিলে রেখে দে। ”

আয়জা মাথা নেড়ে গ্লাসটা বেড সাইড টেবিলে রেখে বেরোনোর সময় শুনতে পেল।

” মেহবুবকে ডেকে দে। ওর বাবা কখন এসেছে? ”

” এই তো তিনটের দিকে। ”

” বল আমি ডাকছি। ”

” আচ্ছা। ”

আয়জা বেরিয়ে গেল। তিথি ঘনঘন চোখ মুছছিলো মফিজ সাহেবের পাশে বসে। আফতাব সাহেব বললেন,

” আমি তো বলছি তোমাকে যেতে। তুমি কাঁদছো কেন?”

তিথি চুপ করে রইলো। সে এখন বাবার সাথে চলে যেতেই পারে কিন্তু তারপর কি ঝামেলা হবে তা বলার বাইরে। অসুস্থ শরীরে এত ঝক্কিঝামেলা তার ভালো লাগেনা। আয়জা এসে বলল,

” ভাইয়া তোমাকে ডাকছে, ভাবি। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” ভাইজান ওর মারে নিয়া আসেন কাল। কিছুদিন এখানে থাকবে। আপনার জানা কথা ও নিয়মটিয়ম মেনে চলতে পছন্দ করে। তাই এখন ওরে কোথাও যেতে দিবে না। আপনি কাল ওর মা আর ভাইরে নিয়ে আসেন। ”

মফিজ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

” আচ্ছা কাঁদিস না। আমি তোর মারে নিয়ে আসবো। ”

তিথি বলল, ” সত্যি? মিছা কথা বলাবানা আব্বা। ”

মফিজ সাহেব হেসে ফেলে বলল,

” তোর আব্বা মিছা কথা বলে না। ”

তিথি বলল,

” আচ্ছা। আয়জা টিস্যু দাও। ”

আয়জা দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে টিস্যু বক্স নিয়ে এল। তিথি সেখান থেকে টিস্যু নিয়ে ঠোঁট দুটো মুছতে মুছতে ঘরে গেল। আজলানকে উদাম গায়ে কোচে শুয়ে চোখ বুঁজে থাকতে দেখে বিড়বিড়িয়ে বলল,

” আসামাত্রই কাপড়চোপড় খুলে ফেলেছে। বেশরম লোক। ওরকম গায়ে দেখলে তিথির তাকে লুইচ্চা লুইচ্চা লাগে। ”

তিথি ঠোঁট মুছতে মুছতে নাক টানলো। আজলান চোখ মেলে তাকে দেখলো। খানিকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইলো। তারপর উঠে তোয়ালে আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার পথে তিথিকে ফিরে দেখলো। লিপস্টিক ঠোঁটের আশেপাশে ছড়িয়ে অবস্থা নাজেহাল। সে ভুরু কুঁচকে চাইতেই তিথি বলল,

” ওটা দামী লিপস্টিক তাই সহজে যাচ্ছে না। ”

আজলান দেখলো তার নাক আর থুঁতনির নীচে ঘাম জমেছে। গালের দুপাশে জড়িগুলো ঝকমক করছে। গালের পাশে আঙুল চেপে তা দেখিয়ে বলল,

” মুখে এসব কি দিয়েছ? ”

” মেকআপ করেছি। বাপের বাড়িতে সেজেগুজে না গেলে শ্বশুরবাড়ি আর জামাইয়ের বদনাম হয়।”

” আচ্ছা, তারপর? ”

তিথি বলল,

” তাই সেজেছি। সবাই আমাকে বলছিলো সুন্দর লাগছে। ”

” গুড। এবার ধুয়ে ফেললো এন্ড অফকোর্স ডাবোল ক্লিনজিং। কুইক। আমি গোসল নেব। ”

তিথি মুখ ভালো করে ধুয়ে বের হলো। আজলান তোয়ালে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” মুখ মুছে ওই শরবতের গ্লাসটা নিয়ে এসো। ”

তিথি মুখটা মুছে তারপর গ্লাসটা নিয়ে এসে তার দিকে বাড়িয়ে দিল। আজলান বলল,

” তুমি অর্ধেক খাও। ”

তিথি খুশিমনে খেয়ে নিল। অর্ধেক খাওয়া শেষ করে বাকিটা আজলানের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আজলান বলল,

” আরও খাও। ”

তিথি খানিকটা রেখে বাকিগুলো খেয়ে নিল। শেষটুকু আজলানের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আজলান বলল,

” পুরোটা শেষ করো। ”

তিথির বুক ভার হয়ে এল। সে ভেবেছিলো ফাটাকেষ্ঠ তার চুমুক দেয়া গ্লাসে মুখ বসিয়ে বাকি শরবতটুকু খাবে। এত রাগ লাগলো তার। শরীরে জোর পাচ্ছে না নইলে কি করতো সে নিজেই জানে না।

আজলান ওয়াশরুমে চলে গেল। গেল যে গেল আর আসার নামগন্ধ নেই। তিথি বুঝে পায় না গায়ে সাবান কয়বার মাখে, কয়বার ধোয়। এতক্ষণ লাগে ব্যাটামানুষের গোসল করতে?

গোসল শেষে বের হতেই আজলানকে অনেক প্রাণবন্ত দেখালো। চুলগুলো কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। উদাম গায়ে খুশবু বেরোচ্ছে। পরনে শুধু সাদা ট্রাউজার। বিছানায় বসে স্যুটকেসটা টেনে কাপড়চোপড় জিনিসপত্র বের করতে করতে তিথিকে ডাকলো,

“মেহবুব!”

তিথি শব্দ করলো।

” হু। ”

” তোমার বাবাকে রাতে খেয়ে যেতে বলো। ”

তিথি ” আচ্ছা ” বলে খুশিমনে বেরিয়ে গেল। বলে এসে বিছানায় উঠে আজলানের পাশে বসে বললো,

” তুমি এতদিন কোথায় ছিলে গো? তোমাকে অনেক মিস করেছে বাড়ির সবাই। ”

” শুনে খুশি হয়ে গেলাম। কারা কারা মিস করেছে?”

” সবাই। বাবা, মা, আয়জা, সামির, আভিরা, আতিফা আপা সবাই সবাই। ”

” আর? ”

তিথি বলল,

” কিন্তু তেলাপোকা, নেংটি ইঁদুরগুলো ভীষণ খুশি হয়েছে। বেশ আনন্দের সাথে ছোটাছুটি করেছে এ কয়দিন। ”

” আচ্ছা। আর কেউ মিস করেনি?”

” করেছে। ”

” কে? ”

” রমলা চাচী। বললো, আহারে বাবুটার কথা মনে পড়তাছে বউ। বাড়িত থাকলে কত মেজাজ দেখায় এখন দেহো বাড়িডা একদম শান্ত হয়ে পড়ে আছে।”

” ইন্টারেস্টিং! আর কেউ? ”

তিথি বিছানার উপর দুই হাঁটুতে ভর করে তার পিঠের সাথে লেগে কপালের সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বললো,

” আম্মাও মিস করেছে। ফোন করলে জিজ্ঞেস করে জামাই কখন আসবে? ”

আজলান বলল,

” আর কেউ? ”

তিথি বললো,

” ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা মিস করেছে। ”

” বাহ! তারপর? ”

” আমার পাশের বালিশটা। ”

” আর? ”

” চাদরটা। ”

” আর কেউ? ”

তিথি ভেবে ভেবে বললো,

” ওহ হ্যা তোমার বাবু তোমাকে মিস করেছে। তোমাকে মিস করলে তখন এমন জোরে লাথি মারে, ওরে বাবারে কি আর বলব! আমি তো সেইরাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছি। ”

” সিরিয়াসলি! আর কেউ মিস করেনি? ”

তিথি বললো, ” তুষারও মিস করেছে। দু’দিন আগে ফোন দিয়ে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো। দুলাভাই কোথায় গেছে, কখন আসবে সেকথা জিজ্ঞেস করেছে।”

আজলান জোরে জোরে শব্দ করে স্যুটকেসটা বন্ধ করলো। পায়ে ঠেলে পাশে রেখে তিথির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,

” এটা ধুতে হবে। কি যেন বলছিলে না? ”

তিথি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” কিছু না। তোমাকে সবাই মিস করেছে ওটা বলেছি। ”

আজলান বললো, ” আর কেউ মিস করেনি? ”

তিথি বললো, ” সবাই মিস করেছে। আর কেউ বাকি নেই। ”

আজলান তার হাত সরিয়ে আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো,

” ছাড়ো। ”

তিথি এমন ভয় পেয়ে গেল। তাকে ছেড়ে দূরে সটকে পড়ে গোলগাল চোখে চেয়ে রইলো। বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠেছে, শরীর কাঁপুনি দিয়েছে। হাঁপাতে গিয়ে কষ্ট লাগায় কেঁদে উঠলো সে। আজলান তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললো,

” তুমিও ওই নেংটি ইঁদুরগুলোর মতো বেশ খুশি ছিলে?”

তিথি বাম হাতে চোখ মুছে নিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললো,

” না না আমিও মিস করেছি। তোমার কথা মনে করে করে ব্রাশ করেছি, শ্যাম্পু করেছি, ভেজা তোয়ালেটা বিছানা থেকে সরিয়ে রেখেছি, ব্যায়াম করেছি, গোপাল ভাঁড় দেখতে গিয়ে টিভি বন্ধ করে দিয়েছি, টাইমে টাইমে গ্যাস্টিকের ঔষধ খেয়েছি, বেশিবেশি পানি খেয়েছি। ”

আজলান বলল, ” তারপর? ”

তিথি পিছু টলতে গিয়ে আজলানের গলা জড়িয়ে ধরে ফেললো। বলল,

” তুমি এসে গালাগালি করবে তাই সবসময় তোমার কথা ভেবে কাজ করেছি। ”

আজলান বলল, ” আমি গালাগালি করি? ”

” না। ”

” কি করি? ”

” সাবধান করো। নিয়ম মেনে চলতে বলো। ”

” গুড। আমার কথা মনে করে সব নিয়ম মেনেছ কিন্তু সেজেগুজে বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় আমার কথা মনে ছিল না? ”

তিথি দুপাশে মাথা নেড়ে বললো,

” বিশ্বাস করো ওখানে গিয়ে তোমাকে আবার মনে করতাম। ”

আজলানের চোখমুখ কঠিন হয়ে আসতেই তিথি দুঃখের সাথে বললো,

” আমার ব্যাথা লাগছে। ওরে বাপ্রে। ”

আজলান বললো,

” কোথায়? ”

তিথি পেটের দিকে আঙুল তাক করে বললো,

” এখানে। কাল এদিকে বেশি লাথি দিয়েছে ও। মনে হচ্ছিলো হাডুডু খেলছে। তাই আমি ঠিক করেছি ওর নাম দেব ডোডো। ”

আজলান বললো,

” একেবারে বাজে নাম। ওর নামধাম সব আমি দেব। তুমি দূরে থাকো। ”

তিথি মুখ গোমড়া করে বসে রইলো।
আজলান একটা বয়াম এনে বাড়িয়ে দিল তার দিকে। বললো,

” বেশি খাবে না। পরিমিত খাবে। ”

তিথি খপ করে বয়ামটা কেড়ে নিল। দেখলো বরই আচারের বয়াম। চোখ বড় বড় করে চাইলো। আজলান বললো, ” বাহ্বা! খুশি দেখি ধরে না। ”
তিথি খুশি হয়ে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।
দু’জন দু’জনকে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল।

তিথি বয়ামের ঢাকনা খোলার চেষ্টা করলো। খুলতে না পেরে আজলানকে দিল। আজলান বয়ামের ঢাকনা খুলে দিতেই তিথি হেসে উঠে বললো,

” কি সুগন্ধি গো। খুব মজা হবে নিশ্চয়ই। ”

আজলান বললো, ” হু, আরও একটা আছে। ওটা আয়জাকে দিয়ে দেবে। ”

তিথি মাথা নেড়ে একটা আচার তুলে মুখে পুরার আগেই আজলানের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আজলান মুখ ফিরিয়ে নিল। তিথি সেটা খেয়ে নিল। খেতে খেতে বললো,

” উমম কি মজা! ”

আজলান ভুরু কুঁচকে বলল,

” কোনটা? ”

তিথি বললো,

” আচার। ”

আজলান তাকে কোলে তুলে নিল তখুনি। আচারের বয়ামটা শক্ত করে ধরে রেখে তিথি চেঁচিয়ে উঠলো,

” না না তোমার আদর বেশি মজা। এবার নামাও প্লিজ। ফেলে দিলে আমার ডোডো ব্যাথা পাবে। ”

আজলান ধমকে বলল,

” শাট আপ। ”

তারপর ওজন মাপার মেশিনে দাঁড় করিয়ে দিল তিথিকে। তিথি আচার খেতে খেতে বললো, ” ওহহহহহহ এই ব্যাপার। ”

চলমান….