এই ভালো এই খারাপ পর্ব-১৩

0
93

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তিথিকে বাড়িতে আনা হলো তারপরের দিন। অদক্ষ হাতে একটা তুলতুলে বাচ্চা সামলাতে গিয়ে কত নাকানিচুবানি খেতে হলো তাকে। অধৈর্য, সংযমহীন তিথি যেন একরাত্রের মধ্যেই ভীষণ সংযমী হয়ে উঠেছে। রাতে চোখ বুঁজে ঘুমাবে তার উপায় নেই। যেমন বাপ তেমন ছেলে।

বাপ ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে অর্ধেক রাত সাবাড় করে দেবে, আর ছেলে ক্যা কু করতে করতে ফজরের ওয়াক্ত হয়ে যাবে। রাতে ঘুমাতে না পেরে তিথি পড়েছে মহামুশকিলে। দিনের বেলায় যত ঘুমাক রাতের ঘুমের অভাবটা যেন পূরণ হতেই চায় না। সকালের দিকে একটু ঘুমাতে পারে যাও দশটা হতে না হতেই বাবু আবারও ঘুম থেকে উঠে যায়।

অবশ্য রাতে শুধু সে নির্ঘুম থাকে এমন না। তার সাথে সাথে তার বাচ্চার বাপও নির্ঘুম থাকে। তিথি স্বাস্থ্যবিধি মেইনটেইন করছে কিনা সেটা দেখার জন্য হলেও সে সারাক্ষণ মা ছেলেকে নজরে নজরে রাখবে। ভাগ্যিস কাজে চলে যায় নইলে মরার মতো ঘুমানোও চুটে যেত তিথির।

আজলান আজ হুট করে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে এল। এসে দেখলো বাচ্চা কাঁদছে। তিথি তার কান্নাকে উপহাস করে বলছে, ” ভ্যা ভ্যা ভ্যা। ”

মায়ের এমন উপহাস দেখে সে আরও চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে হাত পা নেড়ে। আজলান দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই তিথি বলল,

” তোর জন্য চুল আঁচড়াতে পারছিনা ডোডো। দেখ দেখ চোখের নীচে কালি। একটু মায়া হয় না তোর? হবেই বা কেন? বাপ বজ্জাত। ছেলে বজ্জাত হবে না? তুই ভালা মাইনষ্যের বেটা নোস। কিন্তু আমি তো তোর মা। ন মাস পেটে রেখেছি। তোর কত লাথি খেয়েছি। আমার জন্য তোর মায়া হয় না ডোডো? ”

ডোডোর কান্না থামার নয়। আজলান তার অস্বাভাবিক কান্না দেখে ভুরু কুঁচকে ভেতরে ঢুকলো। তিথি তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেল। আজলান হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছতেই তিথি একটা ব্লু গ্যাস ম্যাচ নিয়ে এসে বললো,

” নাও নাও আগুন ধরো আগে। ”

আজলান হাত বাড়িয়ে দিতে আগুন ম্যাচ জ্বালালো। আগুন ছুঁয়ে বাচ্চার কাছে যেতেই আজলান কোলে তুলে নিয়ে দেখলো সে হিসু করে রেখেছে তাই কাঁদছে। তিথির দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আজলান বললো,

” তুমি ওকে এভাবে ফেলে রেখেছ? ”

তিথি বলল, ” আমি জানতাম না। ”

আজলান বলল, ” ওর ঠান্ডা লাগলে তোমাকে ছাড়বো না আমি। ননসেন্স মহিলা। খেয়াল কোথায় থাকে তোমার?”

তিথি গোমড়া মুখে ডোডোর দিকে চেয়ে রইলো। ডোডোকে পরিষ্কার করে কোলে তুলে নিল আজলান। তিথি দেখলো সে একদম শান্ত হয়ে গেছে। ন’মাস পেটে রেখে দুনিয়া দেখিয়েছে সে। আর হয়েছে বাপ পাগল। বাপ ধরলেই কান্না বন্ধ। বাপ কোলে নিলেই ঘুম। এ কেমন কথা তিথি বুঝে পায় না। ডোডো ঘুমিয়ে যেতেই আজলান বলল,

” তুমি চুল আঁচড়ে নাও। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। খবরদার শব্দ করে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করবে না। ”

বলেই কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। এসে দেখলো তিথি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাথার নীচে বালিশ নেই। হাত খোপাটা খুলে গিয়েছে। আজলান তার মাথার নীচে বালিশ দিল। তারপর লাইট নিভিয়ে নীচে চলে গেল।

কফি খেয়ে তিথির জন্য চা বিস্কিট নিয়ে ঘরে আসামাত্রই দেখতে পেল তিথি ঘুম থেকে উঠে দোলনার সামনে বসে ডোডোর ঘুমন্ত মুখ ধরে বলছে,

” এই দুষ্টু ছেলে উঠ বলছি। সারারাত আমাকে ঘুমাতে না দেয়ার ফন্দি এঁটেছিস না বাপ ছেলে মিলে? আমি কিন্তু অত রাত জাগতে পারবো না ডোডো। বলে দিচ্ছি কিন্তু। তুই কাঁদবি আমি ঘুমাবো। আমার মনে কিন্তু মায়াদয়া নেই ডোডো। আমি পাষাণ মা বুঝলি। এই ছেলে তুই উঠবি কি উঠবি না? ”

বলেই দোলনায় ধুপধাপ মাথা ঠুকালো। আজলান ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল,

” তোমার পাগলামো কমবে কিসে? ”

তিথি অসহায় চোখে চেয়ে রইলো। বলল,

” ওকে এখন ঘুম পাড়ালে কেন? সারারাত জেগে থাকবে। ”

” আমি জেগে থাকবো ওর সাথে। তুমি ঘুমিও। ”

” তাহলে তুমি ওকে খাইয়ে দিও। আমি দেব না। ”

আজলান বলল, ” চুপচাপ চা খাও। ”

তিথি এসে চা দেখে বলল, ” আমি মগভর্তি চা খাই। এসব অল্প চায়ে হবে না। ”

আজলান বলল, ” চা বেশি খাওয়া ভালো না। ”

” বেশিই খাব। ”

আজলান গর্জে বলল, ” ওকে ফাইন। ”

আজলানের নির্দেশে কিছুক্ষণ পর মগভর্তি চা নিয়ে এল আয়জা। তিথি চা খাওয়া শেষ করে আজলানকে জড়িয়ে ধরে থুঁতনিটা বুকে ঠেকিয়ে মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

” আচ্ছা বলোতো ডোডো কাকে বেশি ভালোবাসে। তোমাকে না আমাকে। ”

” ছেলেরা মাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। ”

তিথি খুশি হয়ে বলল,

” তুমি এতদিন পর একটা ভালো কথা বললে। তোমাকে একটু কম কেন ভালোবাসবে? ”

” যেটা একটু কম মনে হয় সেটা অপ্রকাশিত রয়ে যায়। ছেলেরা বাবাকে ভালোবাসে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারে না। ”

” তারমানে তুমিও শ্বশুরআব্বাকে খুব ভালোবাসো। তাই না? ”

আজলান বলল,

” জানিনা, ছাড়ো। ”

তিথি বললো, ” বলো না বলো না। তুমি শ্বশুর আব্বার সাথে ভালো করে কথা বলো না কেন? একটা সময় গিয়ে তুমি উনাকে কথা বলার জন্য খুঁজে পাবে না। তুমি কথা বলাকে এত অপছন্দ করো কেন? আমাকেও কত অপছন্দ করো। ”

আজলান বলল, ” তুমি চুল আঁচড়ে নাও। তোমার কাছে এখন যথেষ্ট সময় আছে। ”

তিথি চিরুনি নিয়ে এসে আজলানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি আঁচড়ে দাও। ”

আজলান আঁচড়ে দিতেই তিথি চেঁচিয়ে উঠে বলল,

” সব চুল ছিঁড়ে ফেললো। ইচ্ছে করে করেছ তাই না? শাস্তি দিয়েছ আমাকে?”

আজলান বলল, ” জট বেঁধেছে সেটা ছাড়িয়েছি। আজব!”

তিথি কেঁদে ফেললো প্রায়। বলল,

” তোমাকে যদি আমি ডোডোর পটি আর উঁকুন ভাজা না খাইয়েছি। ”

তিথির কথায় আজলান নিৰ্বাক হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। তার চোখমুখ দেখে তিথি পালাতে যাবে তখনি আজলান তাকে খপ করে ধরে ফেললো। তিথি চেঁচিয়ে বলল,

” ডোডোরে তোর বাপ আমাকে মারছে দেখ। ”

_____

ডোডোর নামকরণ আর গরু জবাই করে আকীকা করা হলো একুশতম দিনে। বেশ বড়সড় আয়োজন হয়েছে সেদিন। ওর পুরো নাম দেয়া হয়েছে শেখ তাশদীদ আইজান। মফিজ সাহেব আর মালেকা বেগমের খুশির শেষ নেই নাতিকে পেয়ে। তিথি এতটাই ব্যস্ত যেন সে ছেলের বিয়ে দিচ্ছে। আজলান তাকে সারাদিন আশেপাশে দেখিনি। নতুন নতুন কোল পেয়ে ডোডো ভীষণ খুশি। কোলে চড়ালে কান্না ভুলেও আসবে না তার।

মেহমান কমে আসতেই তিথি রান্নাঘর থেকে ঘরে এসে হাজির হলো। আজলানের পাশে এসে বসে বললো,

” ডোডো আজ অনেক টাকা পেয়েছে জানো? শ্বাশুমা অনেক টাকা কট করে নিয়েছে নইলে আরও বেশি হতো। ”

বলেই টাকাগুলো হিসাব করতে লাগলো। হিসাব শেষে বলল,

” তেইশ হাজার টাকা। তুমি যে আমাকে হাতখরচ দিয়েছ সেখানে কিছু আছে। সেগুলো সহ টোটাল হয়েছে ত্রিশ হাজার টাকা। শুনো এগুলো দিয়ে আমি ডোডোর বউয়ের জন্য একটা নেকলেস বানাবো। ”

আজলান বলল, ” গুড ডিসিশন। ”

তিথি তাকে জড়িয়ে ধরে তার গালের দাঁড়িগুলোতে আঙুল গলিয়ে বলল,

” তোমাকে একটা দাঁড়ি ছাটাই করার মেশিন কিনে দেব। তুমি আমার গাল টাল ছিঁড়ে ফেলো। ”

চলমান