এই ভালো এই খারাপ পর্ব-২১

0
191

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২১
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বান্দরবনের একটা বাংলো বাড়িতে উঠেছিলো আজলান। নিজের সিনিয়র জাফর আহমেদের কথামতো রাতারাতি বাংলো বাড়িতে আসার পর প্রথমেই যে সমস্যা তাকে পড়তে হয়ে তা হচ্ছে ডোডোর কান্না।
হঠাৎ করে অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত মানুষজন দেখে সে ভয় পেয়ে কাঁদছে। এমতাবস্থায় মাকে পেলে তার কান্না থেমে যাওয়াটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এখানে তার মা কখনো আসবে না আজলান তাই কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ালো কান্না থামার জন্য কিন্তু তা হওয়ার নয়। ডোডো কিছুক্ষণ পরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। বাইরে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল যে গাড়িতে করে এসেছে সেই গাড়িতে করে ফের তার মায়ের কাছে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব?

সকালের ব্রেকফাস্টের সময় জাফর স্যার জানালেন, কাল থেকেই একজন ন্যানি আসবে। সে আগে আমার এখানে রান্না বান্না করে দিয়ে যেত। বাচ্চাও বেশ সামলাতে জানে। আগে এমন অনেক কাজ করেছে। যদিও মাইনে একটু বেশি খোঁজে কিন্তু বেশ বিশ্বস্ত এবং পরিচ্ছন্ন মেয়েমানুষ। তার কাজ আপনার পছন্দ হবেই। আপনি আপাতত কয়েকদিন ছেলের সাথে সময় কাটান। ন্যানিকে সুবিধা মনে হলে ডিউটিতে জয়ন করবেন, অপছন্দ হলে আরও একটা দেখা যাবে। যেহেতু এমন হঠকারিতা দেখিয়ে ফেলেছেন আপাতত সিচুয়েশনটা মোকাবেলা করতে হবে। এমন দুধের শিশুকে সামলানো শুধু কঠিন নয় তুলনামূলক যুদ্ধের সমান। এই যুদ্ধে আপনাকে জয়ী হতে হবে। আর কোনো পথ খোলা নেই।

সকালের দিকে ফর্মূলা দুধের বস্তা নিয়ে এসেছেন উনার এসিসট্যান্ট। ডোডো তখন ঘুম। রাতে একটুখানি সাবুদানা খেয়েছে। একটু মধু। মধুটা বোধহয় ওর ভালো লেগেছিলো। তাই আরও খেতে চেয়েছে। কিন্তু বেশি খেলে পেট করবে তাই বেশি খাওয়ায়নি আজলান। বাকিটা রাত সে নির্ঘুম ছিলো। আসার পথে গাড়িতে অনেক ঘুমিয়েছে কিন্তু এখানে আসার পর তার চোখের ঘুম উদাও। থেকে থেকে কেঁদে উঠে মাকে ডাকছে।

ভোরের দিকে যখন একটু ঘুম এসেছিলো চোখে তখন আজলানের বুকে খামচি দিচ্ছিলো সে মা ভেবে। বুকে মুখ গুঁজে হাপুসহুপুস করছিলো মাতৃদুগ্ধের নেশায়। আজলানের বুকটা তখন কেঁপে উঠেছিলো ছেলের এমন ছটফটানি দেখে। মায়ের স্পর্শ না পেয়ে, সে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লো।

বিছানায় বসে ফর্মূলা দুধ তৈরির রুলসগুলো পড়ছিলো আজলান। বাইরের হিমেল হাওয়ায় ঘরের পর্দা দুলছে, ঠিক তখনি মনে হলো সেটা কারো শাড়ির আঁচল। সে কাগজের দিকে চেয়ে আপনমনে বলল,

” মেহবুব, দেখো তো কতখানি গরম পানির মধ্যে কতটুকু পাউডার মিক্স করতে হবে। ”

কথাটুকু মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসার পর চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো সেটা পর্দা। মাথা ঝাড়া মেরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। কেউ ছিল না?
তন্মধ্যেই জাফর স্যার গটগট পায়ে হেঁটে এসে বললেন,

” ও চলে এসেছে ডেপুটি সাহেব। আপনি আসুন। ডোডো তার কোলে আছে। ”

আজলান উনার সাথে সাথে বেরোলো ঘর থেকে। বাড়ির বাইরে আউটডোর টেবিলের উপর ডোডোকে বসিয়ে হাতদুটো ধরে রেখে উনি ডোডোর দিকে তাকিয়ে আছেন একনাগাড়ে। ডোডোও উনাকে মনভরে দেখছে। বাবার আগে হয়ত সে নির্বাচন করছে এই মহিলার কাছে সে থাকবে কি থাকবে না। নাকি মাকে খুঁজছে?

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। আজলান এসে একপ্রকার কেড়ে নিল মহিলাটির কাছ থেকে। শান্ত করাতে করাতে বলল,

” ওইতো তোমার মা এসেছে। ”

ডোডো, ” মাম মাম মা ” শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। একটু শান্ত হয়ে আসতেই আজলান মহিলাটির সাথে কথা বলতে এগিয়ে এল। শক্তপোক্ত মজবুত শরীরের গাঁথুনি মহিলাটির। রোবটের মতো প্রতিক্রিয়াহীন মুখের আদল, এবং চোখের দৃষ্টি। অপ্রয়োজনীয় কোনো কথাবার্তা বললো না। বাড়ির দেখভাল থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, বাচ্চার দেখাশোনা সব করতে ওস্তাদ সে। বয়স আঠাশ উনত্রিশ হবেই। মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট তাকে দিতে হবে। আজলান বলল,

” রান্না-বান্নার কথা পরে আপনাকে সর্বপ্রথম বাচ্চা সামলাতে হবে। ও যেন একটুও না কাঁদে, একটুও ওর মাকে না খোঁজে, এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। ”

মহিলাটিকে ভাবুক দেখালো। ডোডোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,

” আপনি চিন্তা করবেন না। ওর চাইতে বেশি দুষ্টু বাচ্চা সামলানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। ”

ডোডো গালে একটা আঙুল ঢুকিয়ে রেখে মহিলাটির দিকে চেয়ে আছে। মহিলাটি তার দিকে তাকানোমাত্রই সে আজলানের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা ফেলে ডাকলো,

” আম মাম মা। ”

জাফর আহমেদ বললেন,

” কাল থেকে আমার বউরাণীও আসবে। চিন্তা নেই মিস্টার শেখ। আপনার বাচ্চা যদি মায়ের মতো হয় তাহলে মানিয়ে নিতে পারবে। বাবার মতো হলে বলতে পারছিনা। ”

আজলান টের পেল কথার পিঠে সূক্ষ্ম খোঁচার আঁচ। মহিলাটির মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একনাগাড়ে ডোডোর দিকে চেয়ে আছেন। ডোডোর আবারও কান্না শুরু হলো। আজলান জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি কবে থেকে আসছেন? ”

মহিলাটি জবাব দিল।

” এখন থেকে। আমার স্যুটকেস অলরেডি বাড়ির ভেতরে। স্যার আমার এডভান্স পেমেন্টের কথা বলেছেন? ”

জাফর স্যার বললেন,

” ইয়েস। মিস্টার শেখ আপনাকে বলেছিলাম। ”

আজলান বললো, ” সন্ধ্যায় পেয়ে যাবেন। ”

” থ্যাংকস। ”

আজলান বলল, ” ওকে এখন শান্ত করাতে পারবেন প্লিজ? ”

মহিলাটি হাত বাড়িয়ে ডাকতেই ডোডো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আরও জোরে। আজলানের কোল থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আজলান পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে বলল,

” কিছু খাবে বাবা? ”

ডোডো কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুললো। জাফর আহমেদ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,

” সে তার মাকে মিস করছে। ”

আজলান বলল,

” আমি দিনের পর দিন দূরে থাকি। আমাকে এভাবে মিস করেনা? ”

” কি হিংসুটে আপনি ডেপুটি সাহেব! ”

আজলান মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জোরালো একটা শ্বাস ফেলে ডোডোকে বলল,

” ওই দেখো তোমার মা। মেহবুব, তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও। ”

ডোডো বাবার আঙুলের ইশারায় বেড়ে উঠা ঝোপঝাড়গুলোর দিকে চেয়ে কাঁদতে থাকে। মহিলাটি এসে সামনে দাঁড়ায়। নিউজ প্রেজেন্টারদের মতো করে শাড়ি পড়া। মাথার চুলগুলো পেছনে গুছিয়ে বাঁধা। বলল,

” আমাকে দিন। ও হয়ত পটি করবে। ”

আজলানের ভুরু কুঁচকে এল। মহিলাটি কোলে নিয়ে বলল,

” দয়া করে কার পটিটা এনে দিন। ”

আজলান দ্রুত গতিতে ঘর থেকে কার পটি নিয়ে এল। মহিলা ডোডোকে পটিতে বসিয়ে দিতেই সে শান্ত হয়ে এল। আজলান অবাক চোখে চেয়ে বলল,

” বুঝলেন কি করে? ”

মহিলাটি বলল,

” আমি অবাক হচ্ছি আপনি এতদিন বাচ্চাটাকে রেখেছেন কিভাবে? ওর মা বিয়োগের কতদিন হলো? ”

আজলানের পিলে চমকে উঠে বলল,

” ওর মা? ওর মা আছে। ”

মহিলার অবাক চাহনির সাথে সাথে প্রশ্ন ছুটে এল।

” কোথায়? ”

আজলান খানিকটা ধমকের সুরে বলল,

” আপনি আপনার কাজ করুন। এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নয়। চেষ্টা করুন ওর প্রিয় হয়ে উঠার। ভীষণ মা পাগল ছেলে। মায়ের গা ঘেঁষে থাকার অভ্যাস। ওটা ছাড়াতে হবে। ”

” আমি চেষ্টা করবো। ”

______

ঘরটা গোছগাছ করতে লেগে পড়েছিলো আজলান। ডোডোর জন্য কিছুতে হাত লাগাতে পারছিলো না। সব ঠিকঠাক করার সময় মহিলাটি দরজায় কড়া নাড়লো।

” আইজানের যাবতীয় জিনিসপত্র যদি আমি আমার ঘরে রাখি তাহলে আমার জন্য ভালো হয় স্যার। নইলে আপনাকে ডিস্টার্ব করতে হবে। ”

আজলান বলল,

” নিয়ে যান। এই গোটা ব্যাগটাতে ওর জিনিসপত্র।”

মহিলাটি সব নিয়ে যেতেই ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। আজলান চুপিসারে ওই মহিলার ঘরে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো ডোডো শুয়ে আছে, বালিশের সাথে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে ফিডারটি, নিপল মুখে নিয়ে সে চোখ বুঁজে ঘুমোচ্ছে। আজলান বলল,

” ও কি ঘুমিয়ে গিয়েছে? ”

মহিলাটি চমকে উঠে তার কন্ঠস্বর শুনে। বলে,

” হ্যা একটু ঘুম এল। মনে হচ্ছে না বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে। আমাকে চিনতে ওর সময় লাগবে। ”

আজলান বলল,

” ঘুমালে আমার ঘরে রেখে আসবেন এরপর থেকে। ”

” আচ্ছা। ”

ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় আজলান ঘাড় ফিরিয়ে ঘরটার দিকে তাকালো। অল্পসময়ের মধ্যে মহিলাটি ঘরটা গুছিয়ে ফেলেছে দক্ষ হাতে। বেশ পরিচ্ছন্ন মনে হলো। আজলান একটু ভারমুক্ত হলো। এমনিতেই সে টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে সবটা নর্মাল। কিচ্ছু হয়নি কিন্তু ডোডোর কান্না সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। ডোডোর রাতের কান্না বড্ড ভয়ংকর লাগে তার। অনেকটা কষ্ট, হাহাকার, মিশে থাকে সেই কান্নায়। সময়টা তখন ফুরোতেই চায় না।

__________

মহিলাটি কাজকর্মে দারুণ পটু। একহাতে রান্না সামলে ডোডোকে সামলাচ্ছে। কোনোকিছুতে বিরক্ত নেই যদিও তাকে রান্না কাজে রাখা হয়নি কিন্তু জাফর আহমেদ স্যারের ওয়াইফ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি রান্না বান্না করতে পারবেন তাই রান্নার অনুরোধটা উনারই। আলাদা করে রান্নার লোক রাখার চাইতে সেই টাকাটা উনাকে দিলে সে আরও যত্নের সাথে কাজ করবে। যেহেতু তার কাজ পরিপাটি সেহেতু উনি এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। দুপুরে ডাল, আলু ভর্তা, পাবদা মাছের ঝাল, মুরগীর মাংস রেঁধেছে মহিলাটি। জাফর স্যারের ওয়াইফ দশটার দিকে এসেছেন। খেতে খেতে বললেন,

” ভালো রেঁধেছ শায়লা। তুমি কখন খাবে? ”

” আপনারা খেয়ে নিন। তারপর। ”

জাফর আহমেদ খেতে খেতে বললেন,

” ডেপুটি সাহেবের কেমন লাগছে রুমার রান্না? ”

আজলান খেতে খেতে মাথা নাড়লো। আর আপন মনে ভাবলো কবে তিথির হাতের রান্না খেয়েছে সে। মনে নেই ঠিক। বিয়ের পরের দিনগুলোর মধ্যে কোনো একদিন মাছের ভেতর চুল পাওয়ার পর মাকে সে বারণ করে দিয়েছিলো তিথিকে রাঁধতে না দেয়ার জন্য। ওর ঘাড়ে কাঁটা বাছার দায়িত্ব পড়েছে তারপর থেকে। রান্না মা করতো, নইলে রমলা চাচী। চুল দেখে আজলান না খেয়ে উঠে গিয়েছিলো সেদিন।

” ভালো হয়নি স্যার? ”

আজলান শব্দ করলো, ” হুহ, ভালো। ”

জাফর আহমেদ হেসে বললেন,

” ডেপুটি সাহেব আমার বিবির হাতের শুঁটকির ঝাল ভুনা না খেলে আপনার জীবন বৃথা। আহ! জিভে জল চলে এল। কাল রতনকে বলব। ও শুঁটকি দিয়ে যাবে তুমি একটু রসুন বেশি করে দিয়ে শুঁটকি ভুনা রেঁধো তো। ”

উনার বিবি তাহেরা বেগম হেসে বললেন,

” যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে কি এক অমৃত! ”

” তুমি বুঝবে না বুঝবে না। তোমাকে শ্রেষ্ঠ রাঁধুনির খেতাব দিলেও কম হবে আর সেই তুমি নিজের রান্নাকে এত তুচ্ছজ্ঞান করো। ভেরি ব্যাড। হেই জেন্টলম্যান আপনি শুঁটকি খান না মনে হয়? ”

আজলান অপ্রতিভ হেসে বললো,

” না সরি। ”

টেবিলে ধড়াক করে চড় মেরে উনি বললেন,

” আমার বিবির শুঁটকির ঝাল ভুনা খেলে আপনি শুঁটকির ফ্যান হয়ে যাবে। বন্দরের মানুষ হয়ে শুঁটকি খান না এ কেমন কথা ডেপুটি সাহেব? এ তো ভারী লজ্জার। আপনার বিবি কি শুঁটকি রান্না জানে না? ”

আজলান খেতে খেতে বিষম খেল। তাহেরা বেগম পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি বড্ড বকো। খেতে দাও ছেলেটাকে। ”

তক্ষুণি ঘুমঘুম চোখে উঠে এল ডোডো। শায়লার কোল থেকে বাবার দিকে পিটপিট করে চেয়ে আছে। তাহেরা বেগমকে পেছন থেকে দেখে খুশিতে দুহাত একত্র করে তালি দিল। তারপর উনার কাছে হামলে পড়ার জন্য হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো,

” আম মাম্মা! ”

তার আদুরে কন্ঠস্বর শুনে তাহেরা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হাসলো।

” বাবুসোনা উঠে গিয়েছে। ভাত খাবে তুমি? ”

ডোডো উনার মুখের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। উনি কোলে নিতে যাবে তক্ষুণি শায়লাকে ঝাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। যেন ধোঁকা দিয়েছে তার মা তাকে। এবারের কান্না আরও জোরালো। আজলান ভুক্তাবশেষ রেখে উঠে গেল হাত ধুয়ে। দোল দোল দিতে দিতে দোতলার বারান্দায় চলে গেল। বলল,

” ওই-যে মা। ডোডোর মা। এই দ্রুত আসো। নিয়ে যাও।”

ডোডো শান্ত হলো না। করুণ সুরে মা মা শব্দে কাঁদতে লাগলো। আজলানের বড্ড মায়া হলো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খেয়াল করলো তার কাঁধটা ডোডোর চোখের জলে ভিজে উঠেছে।

_________

শায়লা সবটা সামলে নিতে পারছে দেখে আর তাহেরা বেগমের হাতে ডোডোকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজে এসেছে সে কিন্তু মনটা সেখানে পড়ে রইলো। ডোডো কিছুক্ষণ পর পর তার মাকে খুঁজছে। ফিডার মুখে তুলছেনা। ভাত একদমই খাওয়ানো যাচ্ছে না তাকে। তিথি চা খাওয়ার সময় ঠান্ডা করে ডোডোকেও চা খাওয়াতো। আজলান সকালে সেভাবে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। ডোডো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শায়লাকে বললে শায়লাও চেষ্টা করলো খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু ডোডো মুখে নিল না। আজলান মনে করার চেষ্টা করলো তিথি তাকে কি বলে বলে খাওয়াতো। সে কত কথা! যুক্তিহীন, উজবুক আর আজগুবি কেচ্ছা কাহিনী। কথার কোনে আগা নেই, মাথা নেই। সেসব শুনে ডোডো খিলখিল করে হাসতো আর সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা টানতো চামচ থেকে। যন্ত্রমানবী শায়লা এসব কিছুই জানেনা। তাই ডোডোর খাওয়াও হলো না। প্রচন্ড খিদে পেলে তখন ফিডার টেনে মুখে দেয়। কয়েক চুমুক খেতে খেতে কেঁদে উঠে। আজলান অবাক হয়। এইটুকুনি ছেলে মাকে কি সুন্দর চিনে ফেলেছে, মায়ের আদর, কথা, ছোঁয়া, অনুপস্থিতি সব সে বোঝে।

যেহেতু কর্মস্থল কাছে সেহেতু সে দ্রুত ফিরে আসে। আজ দ্রুত ফেরার পর শুনতে পেল ডোডোর কান্না। তাহেরা বেগম বললেন,

” এমনি এমনি কাঁদছে। কোনো কারণ ছাড়া। এ কেমন ছেলে? ”

আজলান শায়লাকে ডাকতেই সে হাজির হলো তৎক্ষনাৎ। হাতে বাটি। তাতে সেদ্ধ নুডলস। বলল,

” সরি স্যার। ও কিছুতেই খেতে চাইছেনা। দুপুরে একটা লোকমা খাওয়াতে পেরেছি কোনেমতে কিন্তু সেটাও বমি করে দিল। এরকম চলতে থাকলে ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। ”

আজলান ডোডোকে কোলে তুলে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিরক্তিকর এবং ঝাঁজালো সুরে বলল,

” মায়ের মতো করে খাওয়াতে জানতে হয়। আপনি দেখছি কিছুই পারেন না । ”

শায়লা একটু রাগান্বিত স্বরে বলল,

” কি পারিনা? ”

” আপনার ট্রেনিং কাঁচা। বেবি ফ্রেন্ডলি হতে হবে আপনাকে। একজন মা বাচ্চাকে যেভাবে ট্রিট করে সেভাবে। ”

বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে ঘরে চলে গেল সে। ডোডো একটু ঘুমিয়ে এলেই আজলান তাক সযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গালে, কপালে, হাতের তালুতে চুমু দিল। ইউনিফর্ম চেঞ্জ করার জন্য প্রস্তুত হতেই শায়লাকে খেয়াল করে বলল,

” এনিথিং রং? ”

” আমাকে শিখিয়ে দিন কিভাবে মায়ের মতে ট্রিট করবো বেবিকে। ”

আজলান বলল,

” মায়েরা সবসময় ফিটফাট যন্ত্রের মতো গোছানো থাকেনা, যার কোলে উঠলে বাচ্চারা স্বস্তি পায়। আপনি আগে সেসব আয়ত্ত করুন। ”

শায়লা বলল, ” সরি স্যার আমি বুঝতে পারিনি। ”

আজলান বিরক্তি চেপে রেখে বলল,

” আপনি এমন রোবটের মতো চলাফেরা করলে, এমন সেজেগুজে ফিটফাট থাকলে, মেপে মেপে কথা বললে বেবি আপনার সাথে ভাব জমাবে কেন?”

শায়লা বলল, ” তাহলে কি করব? ”

” এখন আমাকে ট্রেনিং দিতে হবে? তাহলে আমি আপনাকে রেখেছি কেন? ”

শায়লা চোখ নামিয়ে বলল,

” সরি স্যার। আমি চেষ্টা করবো। ”

আজলান কপালে আঙুল বুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,

” ননসেন্স। ”

শায়লা চলে গেল। আজলান বিছানায় বসে ডোডোর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

চলমান