#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
মা ছেলের মধ্যে কথা শেষ হতে পারেনি তার আগেই আম্বিয়া বেগম কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। আজলান রাগত স্বরে বলল,
” তুমি এভাবে কাঁদলে আমি আর ফোন দেব না মা। ”
আম্বিয়া বেগম ক্ষীণ স্বরে বললেন,
” আরেক মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে তুই আমাকে মা ডাকিস না। পাঁচদিন তোর গলা না শুনে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সেখানে ওই দুধের বাচ্চাটাকে না দেখে ওর মায়ের কেমন লাগছে বুঝতে পারছিস তুই? কতটা পাষাণ রে তুই। ”
আজলান বলল, “কেঁদোনা। আমি দেখছি কি করা যায়। আগামী দুসপ্তাহ কাজের মধ্যে ডুবে থাকবো তাই সুযোগ হবে না। তারপর দেখি তোমাকে নিয়ে আসতে পারি কিনা। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” ওর মা কতবার ফোন দিয়েছে ডোডোর খবর জানার জন্য। তুই ওর সাথে কথা না বল কিন্তু বাচ্চাটার গলা তো শুনতে দিবি। এ কেমন রাগ তোর? ”
আজলান বলল,
” আমার কাজ শেষ হোক। ডোডোকে এসে তুমি নিয়ে যেও। এখানে আপাতত লোক রেখেছি। ওরা দেখভাল করছে ওর। ”
” আর ওর মা? ওর কাছে ওর বাচ্চাকে দিবি না?”
আজলান কোনো কথা বললো না তিথির ব্যাপারে শুধু জানার ছিল ও ফোন দিয়েছে কি দেয়নি। আম্বিয়া বেগম আফতাব সাহেবের অসুস্থতার কথাও চেপে গিয়েছেন। ছেলের উপর উনার অনেক রাগ কিন্তু তা দেখালেন না। ডোডোর কাছে পৌঁছানোর জন্য উনাকে শান্ত হয়ে কথা বলতে হবে। আজলান ফোন রাখার সাথে সাথে আফতাব শেখ জানতে চাইলেন,
” আজলান শেখ কেন ফোন দিয়েছে? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
“নিজের ছেলেকে এভাবে সম্বোধন করছো কেন? ”
” ছেলে আমাকে কিভাবে সম্বোধন করে দেখেছ? ”
” এসব তুমি শিখিয়েছ ওকে। ”
” তোমার ছেলে চায় টা কি বলোতো। কি চায় সে? বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে রেখে কি প্রমাণ করতে চাইছে? ”
আম্বিয়া বেগম রেগেমেগে বললেন,
” সব তোমার জন্য হয়েছে। তুমি সব নষ্টের মূল। তোমার ছেলে কেমন তুমি জানতে না? ওরকম মেয়ে পছন্দ করে এনেছ কেন? ”
” এর চাইতে ভালো মেয়ে তো চোখের সামনেই ছিল। তোমার ছেলে তাকে পাত্তা দেইনি। তাই সে নিজের মতো করে কাউকে পেয়ে ভেগেছে। ডোডোর মাও এমন ভেগে গেলে ভালো হতো। ”
সরোষে চেঁচিয়ে উঠলেন আম্বিয়া বেগম,
” মুখে অলক্ষুণে কথা এনো না। তোমার বোনের মেয়ে তলে তলে ব্যাটামানুষ হাত করে রেখেছিলো। সেই মেয়ের সাথে তুমি আর তোমার বোন আমার ছেলের বিয়ে ঠিক করলে কোন সাহসে? ”
আফতাব সাহেব নির্লিপ্ত গলায় বলল,
” তোমার ছেলেকে হুর-পরী এনে দিলেও সে দোষ খুঁজে বের করতো। হেনারও দোষ খুঁজে বের করেছিলো সে। তাই হেনা বুঝে গিয়েছিলো ওর সাথে বাকি জীবন কাটানো সম্ভব না। তাই পালিয়ে গিয়েছে। এখন বৌমার হাত পা তো বাঁধা তাই তাকে বাগে পেয়ে তোমার ছেলে তাকে শাস্তি দিচ্ছে। ”
” তোমার বোন, তোমার ভাগ্নি সবকটা বেঈমান। ওদের সাথে ডোডোর মাকে মিলাবে না। তুমি আর তোমার ছেলের কারণে ওকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। তোমার ছেলে ওকে ছেড়ে দিলে ও যাবেটা কোথায়? খবরদার বলছি এসব ভুলভাল কথা কারো সামনে বলবে না। ”
আফতাব শেখ বললেন,
” তুমি কি তোমার ছেলেকে ডোডোর মতো দুধের শিশু ভেবেছ নাকি? ওর মাথায় কি ঘোরে তা তুমি বুঝতেও পারবে না। ও বৌমাকে জব্দ করতে পারলেই খুশি। ওই ছেলেকে আমি চিনি। আমার রক্ত তো। ও মরে যাবে কিন্তু বৌমার কাছে মাথা নত করবে না। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” বউ কি ও আনছে? বউ আমরা আনছি। ওর বউ আমি রাখবো। ও রাখার না রাখার কে? আমি ওকে আজকে গিয়ে নিয়ে আসবো। ”
” তোমার কি মনে হয় ডোডোর মা তোমার সাথে আসবে? যার সাথে ঘর করবে সেই ওকে পাত্তা দিল না আর তোমার কথায় চলে আসবে? ”
” কি বলতে চাইছো তুমি? ”
” আমি কিছু বলতে চাইছিনা। তোমার ছেলে যেটা করতে চাইছে সেটা আন্দাজ করে বলছি ও বৌমার সাথে সংসার করতে ইচ্ছুক নয়। এইসব ভং ওর অজুহাত মাত্র। ”
আম্বিয়া বেগম টলমলে চোখে চেয়ে রইলেন।
_______
দিন বিশ একুশ দিনের মতো গড়িয়ে গেছে।
ঝড়বাদলের দিন। সকাল বিকেল রাত তিনবেলা নিয়ম করে বৃষ্টি পড়ছে। নিস্তার নেই। ভীষণ আলসে আর বিষণ্ণ সময় কাটছিলো সবার।
মাগরিবের নামাজ পড়ছিলেন মালেকা বেগম। তিথি নামাজ পড়ে চা বসিয়েছে চুলায়। মফিজ সাহেব নামাজ পড়ে এসে চা খান। চায়ের পানি টগবগ করে ফুটে উঠামাত্রই তুষার এসে বলল,
” আপা কে যেন এসেছে। তোকে খুঁজছে। ”
তিথি সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ” কে? ”
তুষা কি যেন বললো। তিথি শুনতে পেল না ঠিকঠাক। কিন্তু তুষারের উত্তরের অপেক্ষা করেনি সে। বারান্দার চেয়ারে যারিফকে বসে থাকতে দেখে অবাকচোখে চেয়ে বলল,
” আপনি? ”
যারিফ তাকে দেখামাত্রই দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল, ” ভাবি আপনি একটু ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিন। আমরা বান্দরবান যাব।”
তিথি উত্তেজিত হয়ে বলল, ” বান্দরবান? কেন? ডোডো কোথায়? ওর কাছে নিয়ে যাবেন? ”
যারিফ বলল, ” জি। আমি বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ”
তিথি ব্যাকুল হয়ে বলল, ” আমার ডোডো কেমন আছে? ”
যারিফ বলল,
” সব ঠিক আছে। আপনি রেডি হয়ে নিন। ”
তিথি আচ্ছা বলে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে যেতেই থমকে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
” আপনার স্যার নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে বলেনি? ”
যারিফ বলল,
” স্যার আমার সাথে কথা বলেনি। উনি কথার বলার মতো সিচুয়েশনে নেই। আমার মনে হলো এই মুহূর্তে আপনাকে দরকার। তাই এসেছি। ”
তিথি ঘরে চলে গেল। ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিল। কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না সে। হাতটা ভীষণ রকম কাঁপছে। কতদিন পর ডোডোকে দেখবে সে।
দুটো শাড়ি, গামছা, কিছু জরুরি জিনিসপত্র আর কিছু টাকা নিয়ে নিল সে। বাকি টাকাগুলো মায়ের হাতে দিল। বলল,
” ডোডোর কাছে যাচ্ছি আম্মা। আমি ফোন দেব তোমাকে। ”
মালেকা বেগম চুপ করে রইলেন। বেরোনোর সময় মফিজ সাহেব বললেন,
” মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করিস মা। তোর এখন একটা বাচ্চা আছে। এখন নিজের কথা ভাবলে চলবে না। ওর কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিবি।”
তিথি বাবাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো। তারপর বেরিয়ে এল যারিফের সাথে।
পুরো শহরটা তখন নির্জীব। যানবাহনের চলাচল না থাকলে আর কোনো শব্দই থাকতো না কোনোখানে। সড়ক বাতির আবছা আলোয় পিচঢালা রাস্তা চকচক করছে। কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শোঁশোঁ বাতাসের শব্দ।
ডোডোর মুখটা কয়েকবার কল্পনা করলো সে। পেটে মুখ গুঁজে দিলে খিলখিল করে হাসিতে ফেটে পড়তো ডোডো। হাসিটাতে কি মায়া! এত মায়া কভু দেখেনি তিথি। তার চোখে জল নামলো। সাথে সাথে মুছে নিল সে। একবার ডোডোকে পেলে জাপ্টে জড়িয়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলবে সে। আর একমুহূর্তের জন্যও ছাড়বে না।
দুনিয়া উল্টে যাক কিন্তু ডোডোকে আর ছাড়বে না সে।
পথিমধ্যে একটা দোকান দেখতে পেয়ে নেমে গেল সে। ফিরে এল কিছু চিপস, আর মিনি বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে। ডোডো এখন খেতে শিখেছে। মাকে দেখামাত্রই যদি মুখের দিকে চেয়ে থাকে? মা খালি হাতে এসেছে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে?
যারিফ তার উত্তেজনা বুঝতে পারলো। মায়েরা এমনই হয়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে গাড়িটা একটা সেন্ট্রাল হসপিটালের পার্কিং প্লেসে গিয়ে থামলো। তিথি অবাককন্ঠে বলল, ” হসপিটালে কেন? আপনার স্যারের কিছু হয়েছে? ”
যারিফ বলল,
” তিন তলায় যেতে হবে। চলুন। ”
তিথি ওর পিছু পিছু কম্পিত পায়ে হেঁটে গেল।
আয়জা আর আম্বিয়া বেগম হসপিটালের লাউঞ্জে বসে আছেন। আয়জার পায়ের কাছে বড় একটা ব্যাগ। কোলে ছোট্ট একটা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগটাতে ডোডোর ছোট ছোট কাঁথা আর প্যাম্পাস রাখতো সে। তাকে দেখে আম্বিয়া বেগম হাঁ করে চেয়ে রইলেন। তিথি ছুটে গিয়ে বলল,
” কার কি হয়েছে মা? আমার ডোডো? কোথায় ও?”
কেউ কিছু বললো না।
ভয়ের চোটে আম্বিয়া বেগমকে একটা সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁদে উঠলো তিথি। আম্বিয়া বেগমও এতক্ষণ পর ফুঁপিয়ে উঠলেন। তিথি স্তব্ধ হয়ে গেল। আয়জাকে বলল,
” ডোডো কোথায়? আমার ডোডো। ”
আয়জা আঙুল দিয়ে কেবিনটা দেখিয়ে দিল। তিথি দৌড়ে গিয়ে জানালার কাচ বরাবর দাঁড়াতেই কেবিনের মধ্যে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে দেখতে পেল। নিজের ছেলেকে নিজে চিনতে ভুল করলো তিথি। হাতে ক্যানোলা, নাকে অক্সিজেন। শুকিয়ে এতটুকুনি হয়ে গেছে হৃষ্টপুষ্ট শরীরটা। গায়ের রঙটা পর্যন্ত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিথি চেয়েই রইলো। কাঁদতে ভুলে গেছে সে। শুধু চোখ ফেটে উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পড়লো।
শ্বাসকষ্টের জন্য কিছু খেতে পারছিলো না ডোডো। হা করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাঁদছিলো ভীষণ। নিউমোনিয়ার লক্ষ্মণ বুঝে তিনদিন আগে ডোডোকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন জাফর আহমেদ। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিলো প্রায়। তিথি সবটা শুনে জড়পদার্থের ন্যায় বসেছিলো অনেকক্ষণ। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে ডাক্তার জানিয়েছে বুকের ভেতর শুকনো কফ জমে গিয়েছিলো।
তিথি করিডোরের মেটাল ফ্রেমের সোফায় বসে ডোডোর কাছে যাওয়ার অপেক্ষায় বসেছিলো। কেবিনে সিস্টার আর ডাক্তারদের আনাগোনা আছেই।
কেবিনে যাওয়ার অনুমতি পেতেই আর দেরী করেনি। মা এসেছে শুনে ডাক্তার একনজর তাকে দেখে নিল। তখন অক্সিজেন মাস্কটা খুলে ফেলা হয়েছে। ডোডো নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে ক্যানোলা দিয়ে ইনজেকশন পুশ করে তিথির কোলে তুলে দিল। তিথি দেখলো পনের মাসের বাচ্চাটা কেমন ছয়মাসের বাচ্চার মতো হয়ে গেছে। এতক্ষণ চেপে রাখা কান্নাটা এবার আর কোনো বাঁধ মানলো না। ছেলের গালে আদর করতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, ” আমাকে এতবড় শাস্তি দিস না ডোডো। ”
তার কান্নার ফাঁকে ডোডো চোখ মেলে তাকিয়েছে। তিথি বড়বড় চোখ করে বলল,
” আব্বা চোখ খুলেছে! মা দেখো ডোডো চোখ খুলেছে।”
আম্বিয়া বেগম এসে বসলেন তার সামনে। ডোডো মায়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। তিথি সশব্দে কেঁদে বলল,
” মাকে শাস্তি দিচ্ছিস ডোডো? ”
ডোডোর ঠোঁটদুটো নড়ে উঠলো। তিথি বুঝলো। সে আম্মা ডাকতে চাইছে। সে মুখে অজস্র আদর দিয়ে নিজের গালের সাথে ছোট্ট গালটা লাগিয়ে রেখে বলল,
” তোকে ছেড়ে আর কোত্থাও যাবো না ডোডো। একবার আম্মা ডাক। ”
কাঁদতে গিয়ে গলাও ভেঙে গেছে ছেলেটার।
অনেকক্ষণ পর সুচিক্কণ ভাঙা স্বরটা কানে এল তিথির। মা ডাক শুনে তিথি পাগলের মতো কাঁদলো। আম্বিয়া বেগম সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
” আর কাঁদিস না। একটা কথা সারাজীবন মনে রাখবি, মায়ের মতো করে কেউ ভালো রাখতে পারে না বাচ্চাকে। ”
তিথি ডোডোর গালে গাল ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে রইলো।
সারারাত মা ছেলে জেগে ছিলো। ডোডোর একদৃষ্টে চেয়ে থাকা দেখে তিথি মনে মনে ভাবছিলো হয়ত সে ভাবছিলো, এই মা এতদিন কোথায় ছিল? ভোরবেলায় মা ছেলে দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রায় সকাল দশটার দিকে তিথির ঘুম ভেঙেছে। ডোডো তখনো তার বুকের উপর নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। যেন কতরাত সে এভাবে ঘুমাতে পারেনি।
আফতাব শেখ এসেছেন তখন। খাবার দাবার এনেছেন। ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করার পর ডাক্তার জানিয়েছেন আজ রাতেই ডোডোকে রিলিজ দেয়া হবে।
তিথি কেবিন থেকে বের হয়নি। দু-পিস পাউরুটি খেয়েছে জেলি দিয়ে।
ডাক্তার এসে শেষ ইনজেকশনটা পুশ করলো। ঔষধ খাওয়ানোর সময় আর ইনজেকশন পুশ করার কেবিন ফাটিয়ে কেঁদেছে ডোডো। আম্বিয়া বেগম বললেন, ডাক্তার দেখামাত্রই সে কান্না শুরু করে। কান্নার এক পর্যায়ে তিথিকে জড়িয়ে “আম মাম মা” বলে ডেকে চুপ করে গেল। তিথি তার গালে আদর করতে করতে বলল,
” আমার আব্বা সুস্থ হয়ে গেছে। আর মারবে না ওরা। আমরা এবার বাড়ি যাবো। ”
ডোডো তার শাড়িটা ধরে রাখলো শক্ত করে। কাঁধে মাথাটা ফেলে রাখলো। তিথি তাকে কোলে নিয়ে হাঁটার সময় খেয়াল করলো সে একদম হালকা হয়ে গিয়েছে। অথচ আগে বেশিক্ষণ কোলে রাখলে কোমর ব্যাথা করতো।
__________
আজলান শেখের কথা তিথি জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে কিন্তু করেনি। কারণ সে নিজেই অপেক্ষায় ছিল কবে আজলান শেখ আসবে। কিন্তু এল না। হয়ত নিজের পরাজিত মুখখানা তিথিকে দেখাতে চায়নি কিংবা নিজের ছেলের অসুস্থতার দায়ে তিথিকে দায় করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে যাবে তাই সামনে আসেনি। তিথির এতকিছু ভাবতে ইচ্ছে করলো না। তার ছেলে তার বুকে আছে এটাই এখন তার সবচাইতে বড় পাওয়া।
আয়জা, আম্বিয়া বেগম এমনকি আফতাব শেখও কিছু বলেনি এই ব্যাপারে। তিথি খেয়াল করেছে ঔষধ আনা, খাবারদাবার আনা নেওয়া, সব ছোটাছুটি যারিফই করছে। তার কাছে নিশ্চয়ই তার স্যারের খোঁজ থাকতে পারে। কিন্তু সে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। ডিসচার্জ পাওয়ার পর ডোডোকে ভালো করে কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে শিশু ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিথি আম্বিয়া বেগমকে ডেকে বললো,
” আয়জা কোথায়? তোমরা যাবে না? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” তোর ছেলে সুস্থ হয়েছে। আমার ছেলে নয়। ”
তিথি ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। আফতাব শেখ এসে বললেন,
” বৌমা তোমাকে বাংলোয় যেতে হবে। আমরা বাড়ি যেতে পারছিনা আপাতত। যারিফ তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে ওটা ডোডোর বাপের স্যারের বাংলো। ওখানে উনার স্ত্রী আর একজন সিটার আছেন। রান্নাবান্না তোমাকে করতে হবে না। তুমি চলে যাও। ”
তিথি মাথা নাড়লো। যারিফ ব্যাগপত্র নিয়ে এসে বলল,
” ভাবি চলুন। ”
তিথি যেতে যেতে আরও একবার ফিরে তাকালো। আম্বিয়া বেগমের চোখে জল থৈথৈ করছে। তিথি যেতে যেতে যারিফকে জিজ্ঞেস করলো, ” কি হয়েছে আপনার স্যারের? ”
যারিফ একটু চমকে যেতেই তিথি বলল, ” আমি বুঝতে পেরেছি কিছু একটা হয়েছে। ”
যারিফ সংকোচ ঝেড়ে তাকে জানালো, পনের দিন আগে হাসানুজ্জামান নামের এক অবৈধ অস্ত্র পাচারকারী বিদেশী পিস্তল নিয়ে নাশকতার উদ্দেশ্যে টেলাপাড়া এলাকায় অবস্থান নিয়েছে বলে র্যাবের কাছে সংবাদ আসে। ওই সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-7 পূর্বাচল ক্যাম্পের একটি দল অভিযান চালিয়ে পিস্তল সহ হাসানুজ্জামানকে আটক করে। আটকের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সেই দলের এক সদস্য আড়াল হতে গুলি ছুঁড়ে। আর সেখানেই..
তিথির কন্ঠস্বরে কাঁপুনি।
” সেখানে?..
” স্যারের ফুসফুসে বুলেটের আঘাত লেগেছে। ”
তিথি আটকে রাখা দমটা সবেগে ছেড়ে বলল, ” ওহহ। ”
ডোডোকে যারিফের কোলে দিয়ে দ্বিতীয় তলার একটা সাদা কাচের কেবিনের ভেতর সিডেটিভে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে থাকা আজলান শেখকে দেখে তিথির অন্তরআত্মা কেঁপে উঠেছিলো। দাপুটে যার চলনবলন, আর ধারালো যার কথা। তাকে এমন পরাজিত সৈনিকের মতো পড়ে থাকতে তিথির আপনমনে বলল, ” তুমি আমাকে তোমার বিরোধীদল ভাবলেও আমি তোমাকে সবসময় বিজয়ীর বেশে দেখতে চেয়েছি। এভাবে নয়। ”
তার ঠিক তের কি চৌদ্দ দিনের মাথায় আজলান শেখের গাড়ি এসে থামলো বাংলোর সামনে। ডোডো তখন দোলনায় চড়ছে আর হাসছে। গাড়িতে বসে একদৃষ্টে তার বাবা তার দিকে চেয়ে রইলো। বাবা এখনো জানতে পারেনি তার অনুপস্থিতিতে ছেলেকেও হাসপাতালে ঘুরে আসতে হয়েছে। তবে ছেলের সবল দেহ, মুখের ঝলমলে হাসিই বলে দিচ্ছিলো এই বাংলোয় তার মায়ের উপস্থিতি।
আফতাব শেখ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললেন,
” এসো, এসো। বেলাশেষে পাখি নীড়ে ফেরে। ”
আজলান গাড়ি থেকে নেমে আসতেই আয়জার কোল থেকে ডোডোও নেমে এল হামাগুড়ি দিয়ে। এসে তার পায়ের কাছে বসে মুখ তুলে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে পা ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো পায়ের পাতায় ভর দিয়ে। হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো, ” পাপ্পাহ। ”
চলমান…..
#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
ডোডো একটু একটু করে দাঁড়াতে শিখছে। দাঁড়াতে গিয়ে আবার পড়ে গেলে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকে আবার নিজে নিজে দাঁড়িয়ে পড়ে।
তাহেরা বেগম এই কয়েকদিন খেয়াল করলো মাকে পেয়ে সে পুরোদস্তুর ভালো ছেলেতে রূপান্তরিত হয়েছে। সারাক্ষণ আম্মা আম্মা বলে চেঁচাবে, তার মাকে উত্তরে জি জি বলতে হবে।
ব্যস সে খেলতে থাকবে।
এইটুকুনি বাচ্চা, অথচ মাকে সে আপাদমস্তক চিনে ফেলেছে। তার সাথে সাথে মাকেও কথা বলতে হয় এখন। নইলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠবে। মা ছেলে এখন পুরো বাংলোটা মাতিয়ে রাখে। উনার বেশ ভালো লাগে। চলে যাবে ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
ডোডো এখন বাবার কোলে উঠে বসে আছে। বাবার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। বাবাকে সে অনেকগুলো দিন পর দেখছে। আয়জা আম্বিয়া বেগমকে বলল, ” আম্মা দেখো ভাইয়াকে কিভাবে দেখছে। ”
আম্বিয়া বেগম হাসলেন। আজলান ফোনে কথা বলছে ,ডোডো ফোনটা কেড়ে নেওয়ার পায়তারা করছে। বাবা তার সাথে কথা না বলে কেন ফোনে কথা বলবে?
রাতের খাবারের বন্দোবস্ত চলছে রান্নাঘরে। শায়লা একাহাতে রান্নাঘর সামলাতে পারলেও তিথি আসার পর থেকে তার কাঁধ থেকে কাজের ভার হালকা হয়ে গেছে। বরং সে এ কয়েকটা দিন ভীষণ আনন্দে কাটিয়েছে বাংলোয়। একমাসের বেতন নিয়ে সে চলে যাবে মাস শেষে। স্যারেরাও মনে হয় তাদের বাড়ি ফিরে যাবে।
যারিফ হসপিটাল থেকে আনা যাবতীয় সব জিনিসপত্র গুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে বাংলোয় নিয়ে এল। আজলান ফোন রেখে বলল,
” হয়েছে, ওখানে রাখো। বাকিটা আয়জা সামলে নেবে।”
যারিফ বলল, ” আরেকটা ব্যাগ আছে। ওটা নিয়ে আসছি। ”
যারিফ বেরিয়ে গেল। তাকে ইস্যু করে এত কাহিনি ঘটে গেছে সে এইসব ব্যাপারে জানে না। আয়জা তাকে কিছু বলেনি। সেদিন ঘটনাস্থল হতে স্যারের এক সহকর্মী প্রথম ফোনটা তাকে করেছিলো। হয়ত নাম্বারটা স্যারের কললিস্টে শুরুতেই ছিল নয়ত স্যার বলেছে। আর তারপর যারিফ একমুহূর্তও অপেক্ষা করেনি। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হসপিটালে ভর্তি করানোর আট দিনের মধ্যে আজলানের শরীরের অবস্থার একটু উন্নতি ঘটলে যারিফ তাকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করায় এক্সট্রা কেয়ারের জন্য। এই যাত্রায় স্যার বেঁচে গিয়েছে তবে লাংস এখনো দুর্বল। প্রপার ট্রিটমেন্ট নিতে হবে। আর রেস্টে থাকতে হবে আরও দেড় দুইমাস। কিন্তু সেটা আপাতত হয়ে উঠবে কিনা স্যারই জানেন। আজ রাতটা বাংলোয় কাটিয়ে দিয়ে কাল সকাল সকাল বাড়ি ফিরে যাবে সে। তার দায়িত্ব শেষ।
বাবা ছেলের মান অভিমান ভেঙেছে অনেক আগে। একমাত্র ছেলেকে জানপ্রাণ দিয়ে হলেও সুস্থ করার লড়াইয়ে নেমেছিলেন আফতাব শেখ। ছেলের এমন দুর্দশার কথা শুনে সকল দ্বন্দ ভুলে উদভ্রান্তের মতো তিনি ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। বেডে শায়িত মরণাপন্ন ছেলের মুখ দেখে দ্বিতীয়বার ভাবার ফুরসত পাননি যে, এই ছেলের সাথে বহুদিন ধরে উনার দ্বন্দ চলছিলো। মৃত্যুভয় কত সহজ করে দেয় সবকিছু।
সবাইকে চা খেতে দেখে ডোডো কাড়াকাড়ি করছে। আজলানের চা, সিগারেট এসব খাওয়া বারণ। যদিও সে জীবনেও সিগারেট নামক জিনিসটা ছুঁয়েও দেখেনি কিন্তু আফতাব শেখকে সিগারেট খোর বলা যায়।
আম্বিয়া বেগম পইপই করে বারণ করে দিয়েছেন সিগারেটের ধোঁয়া, গন্ধ কোনোটাই যেন উনার ছেলের নাকে না যায়।
আয়জা ডোডোকে চা খাওয়ানোর জন্য কোলে নিয়ে নিল।
কি তৃপ্তি নিয়ে চা খাচ্ছে সে। আজলানের মনেই ছিল না সে এভাবে চা খেতে পছন্দ করে। আয়জা চামচে ফুঁ দিচ্ছে, খাওয়ার আগে সেও চামচে ওভাবে ফুঁ দিচ্ছে। আয়জা হেসে খুন। পুরো বাঁদর একটা।
খোশগল্পের মধ্যে ডোডোর অসুস্থতার কথা উঠলো। তাকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছে শুনে আজলান খানিকটা ক্ষেপাটে স্বরে বলল,
” এত ঠান্ডা লেগে গেল কি করে? ”
তাহেরা বেগম বললেন,
” বাচ্চাদের ঠান্ডা লাগা স্বাভাবিক। মায়েদের ভীষণ সতর্ক থাকতে হয়। সেখানে ওর মা ছিল না। ঠান্ডা লেগে যাওয়া অসম্ভব কিছু না। ”
আফতাব শেখ কথা বলে উঠলেন এবার। বললেন,
” জন্মের পর থেকে ওর শরীর শুকোয়নি তেমন। এখানে এসে শুকিয়েছে। তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” যা হয়েছে তা নিয়ে কথা বলে আর লাভ আছে? তুই একটু ঘুমাবি আব্বা? ”
আজলান বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, ” না। তবে কাজ আছে। ”
আম্বিয়া বেগম তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
” বউ ঘরদোর সব সাফ করছে আজ। খবরদার কোনোকিছুতে হাত দিবি না আজলান। সবসময় অবাধ্য হোস না। ”
আজলাম হাঁ করে চেয়ে রইলো। মা বুঝে গেল কি করে? আয়জা বলল,
” হ্যা ভাইয়া। আমি আর ভাবি মিলে সব ঝেড়েমুছে ধুয়ে পরিষ্কার করে রেখেছি। ”
আফতাব শেখ বললেন,
” তোমার শরীরের উপর যাতে প্রেশার না পড়ে। সবসময় নিজের মর্জিমাফিক চলা যায় না। ”
আজলান ঘরে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াতে গিয়ে আবার থেমে গিয়ে যারিফকে বলল,
” আমি না বলা অব্দি কোথাও যাবে না। ”
যারিফ মাথা নাড়লো। আয়জা তার কোলে ডোডোকে দিয়ে বলল,
” ফুপী কাজে যাই। কেমন? ”
ডোডো আঙুল তুলে বলল,
” আমমাহ। ”
আয়জা তার নাক টিপে দিয়ে বলল,
” আপনার আম্মা কাজ করছে। যাই দেখে আসি।”
যারিফ বলল, “আমাকে কাল চলে যেতে হবে। স্যারকে একটু বুঝিয়ে বলবে?”
আয়জা মাথা নেড়ে বলল,
” আম্মাকে বলব। ”
আজলান ঘরে গিয়ে বিছানায় বসলো। ঘরটা পরিপাটি করে রাখা হয়েছে। ডোডোর দোলনা, খেলনা, বেবি ওয়াকার, কাপড়চোপড়, ঔষধের বক্স ছাড়া আর কিছুই ঘরে দেখা যাচ্ছে না।
এই বাংলোর পেছনটা জঙ্গলের মতো। ঝিঁঝি পোকার ভারী ডাক কান ঝালাপালা করে দেয়ার মতো, এখন কুনোব্যাঙগুলোও যোগ দিয়েছে। জানালাটা বন্ধ। মশার কারণে বোধহয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে উঠে জানালাটা খুলে দিল। দমকা হাওয়া ঢুকে পড়লো ঘরে। আজলান ফোঁস করে একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তারমধ্যে ঘরে কেউ একজন এমনভাবে এল যেন মেঝেতে পায়ের ধূলো না পড়ে, এমনভাবে গেল যেন পায়ের শব্দ না হয়। ঠিক এভাবে হাসপাতালের কেবিনেও এমন একজোড়া পা আসা যাওয়া করতো যা আজলান শেখের জানার কথা নয়।
_______
রাতের খাবারের বেশিরভাগই ঝাল কম দিয়ে রান্না করা হয়েছে। গত চৌদ্দ দিন বাংলোতে যেভাবে রান্না করেছে ঠিক সেই নিয়মে।
চিংড়ি মাছটা বেশ ঝাল করে রেঁধেছে তিথি। কারণ আজলান চিংড়ি মাছ খায় না। তারমতে চিংড়ি মাছ নয়, পোকা। জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণী। তাছাড়া চিংড়িতে হাজার রকমের এলার্জি। সে ঘৃণা করে চিংড়িকে। তাই তিথির মনে হলো চিংড়িটা সে নিজের মতো রাঁধতে পারবে। বাকি সব রান্না শায়লা রেঁধেছে। তিথি এটা ওটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
আজলান তেল মশলা বেশি খেতে পছন্দ করে না। আগেও কম খেত। এখন আরও কম। অপরদিকে তিথির পছন্দ তেল চটচটে মাছ মাংস। মাছ মাংসের উপর তেল না ভাসলে, লাল মরিচ আর পেঁয়াজ মশলায় মাখা ঝোলঝাল না হলে খাবার তার মুখে রোচে না।
আম্বিয়া বেগমও আগে এমন খেতেন। ছেলের জন্য পছন্দ বদলে ফেলেছিলেন। এখন তিথি রান্না করলে তা বেশ আরামে খান। যদিও তিথির রান্না খুব কম খাওয়া হয়েছে।
কিন্তু গত চৌদ্দ দিন তিথিই রেঁধেছে তাও শায়লার কথামতো আর হাসপাতালে খাবার নিয়ে গিয়েছে। বেশ ঘন করে করে ডাল, পেঁপে ভাজি, অথবা মসুর ডাল আর লাউ তরকারি, পটল কিংবা বরবটি ভাঁজা, ডিম এসব। মাছ মাংস একদম ছুঁয়েও দেখেনি আজলান। মাংস খাওয়া বারণ ছিলো।
খাওয়ার ফাঁকে আফতাব শেখ আর জাফর আহমেদ চিংড়ি রান্নার বেশ প্রশংসা করলেন। তিথি আম্বিয়া বেগম আর তাহেরা বেগমকে মাছ মাংস তুলে দিচ্ছিলো। তখনি জাফর আহমেদ বললেন,
” শায়লা আজ সব রান্না দারুণ মজা হয়েছে। চিংড়িটা দশে এগারো। আজলান শেখ আপনি এটা মিস করে গিয়েছেন। একবার খেয়ে দেখুন। দেব? আরেহ কিচ্ছু হবে না। একবার খেয়ে দেখুন। চিংড়ি মাছ আবার মিস দেয় নাকি কেউ? ”
তিথির ইশারায় শায়লা বাটি সরিয়ে নিয়ে বলল,
“এটা ম্যাডাম রেঁধেছেন স্যার। আমি নই।”
বাটিতে শেষ কয়েকটা চিংড়ি ছিল। সেগুলো তাহেরা বেগমের পাতে দিয়ে বাটিটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল তিথি। আয়জা চুপচাপ খেতে খেতে মায়ের চোখ বরাবর তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল। আজলান খেতে খেতে যারিফকে বলল,
” তুমি কাল ওদেরকে নিয়ে চলে যাচ্ছ। ”
আম্বিয়া বেগম অবাককন্ঠে বললেন,
” তুই যাবি না? ”
” যাব। এখন না। কাজ আছে। আমাকে হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে একটু। ”
জাফর আহমেদ বললেন,
” আমি সামলে নেব। তুমি আগে বাড়ি যাও। যদি না যাও তাহলে সবাই এখানে থাকুক। ”
আজলান আর কিছু বললো না। তিথি ডোডোকে নিয়ে ফিরে এল। বাসনের এককোণায় এক চামচ ভাত নিয়ে চিংড়ির ঝোল নিয়ে মেখে ডোডোকে হাঁটতে হাঁটতে খাইয়ে দিতে লাগলো। ডোডো ঝাল খেতে ঠোঁট দুটো লম্বা করে উঃ উঃ বললো। তিথি গালে চেপে চুমু খেয়ে বলল, ” মজা? ”
ডোডো মাথা ঝাঁকালো। জাফর আহমেদ বললো,
” ছেলেও মাথা ঝাঁকিয়ে মায়ের প্রশংসা করছে।”
আম্বিয়া বেগম বললেন,”বেশি ঝাল দিস না বউ। ওর পেট খারাপ করবে। ”
আয়জা বলল, ” পাতলা খাবার খেলে ওর পেট খারাপ হয় আম্মা। ঝাল খেলে ঠিকই থাকে। ”
ডোডো তিথির কোল থেকে খানিকটা নীচে ঝুঁকে গলা কাত করে চুপচাপ খেতে থাকা আজলানকে ডেকে বলল, ” এ-পাপ্পাহ। ”
আজলান সবেমাত্র পানির গ্লাস ধরেছিলো মুখের কাছে। ডেডোর এমন ডাক শুনে তার কাশি উঠে গেল তখুনি। আম্বিয়া বেগম চেয়ার ছেড়ে ছেলের কাছে ছুটে এসে বুকে পিঠে মাথায় মালিশ করে দিতে দিতে আয়জাকে বলল,
” পানি দে। এখন কি হবে রে?”
আজলান কাশতে কাশতে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার খাওয়া এমনিতেই শেষ হয়ে এসেছিলো। দুর্দান্ত একটি কাশির ধমক ফুসফুস বেয়ে উপরে উঠে আসছে ধীরেধীরে। সে দ্রুতবেগে হেঁটে ঘরে চলে গেল।
ঘরে এসে নিজের ঔষধপত্র খুঁজতে গিয়ে একেরপর এক সব ড্রয়ার ধুপধাপ টেনে খুললো। বিছানার বালিশ, চাদর তুলে ফেললো, টেবিলের ড্রয়ারটা চেক করলো। ঔষধের বক্সটা কোথায় রেখেছে মাথায় আসছে না। কোথায়? কাশির ধমকটা বুকে এসে আটকে গেছে। উতলে উতলে উঠছে কাশির বেগ। শ্বাস ছাড়তে কষ্ট হলো। কাশির চোটে চোখে পানি চলে এল। গলার দুইপাশের শিরা ক্রমাগত উঠানামা করতে লাগলো। লাংসে বুলেটের আঘাত লাগায় তা এখনো অনেকটা দুর্বল। ডাক্তার নিয়মিত নেবুলাইজার অথবা ইনহেলার ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে। কিছুতেই বুকে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। ইনহেলারটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। কাউকে ডাকার মতো অবস্থায়ও নেই। টেবিলের উপর হতে ঝপাৎ করে একগাদা ঔষধ পড়ে গেল। হাঁটুভেঙে বসে ঔষধগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে গলা চেপে ধরলো সে। চোখদুটো প্রায় ঝাপসা হয়ে আসছে।
ডোডোকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলো তিথি কিন্তু সে ঘুমাবে না এখন। তিথি তার মাথা বুকে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে আর সে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তিথি বলল,
” ঘুম কবে আসবে? আমার অনেক কাজ ডোডো।”
ডোডো হা করে চেয়ে রইলো। তিথি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দুগালে আদর করতে করতে ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। ঘরের ভেতর সমস্ত জিনিস এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখে কৌতূহলবশত ঘরে পা রাখলো। তখুনি আজলানকে পাগলের মতো ঔষধ হাতড়াতে দেখে ডোডোকে মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে ইনহেলারটা খুঁজে আজলানের ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিল। দুঠোঁটে ইনহেলার চেপে ধরে শ্বাসকষ্টকে দমিয়ে রাখার চেষ্টায় রত হলো আজলান। ডোডো হামাগুড়ি দিয়ে আজলানের সামনে এসে বসে বাবার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তিথি তাকে বুকে টেনে নিয়ে আজলানের দিকে চেয়ে রইলো। আজলান একটু স্বাভাবিক হয়ে আসতেই তিথি ডোডোকে নিয়ে উঠে যাওয়ার সময় আজলান বলল,
” ডোডো সামনে বসো। ”
তিথি ডোডোকে তার সামনে বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। পায়ে জোর দিয়ে দাঁড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো আজলান। পাশে ডোডোকেও শুইয়ে দিল। ধীরেধীরে ধীরেধীরে শ্বাসপ্রক্রিয়া চলছে তার। ডোডো তার হাতে থাকা ইনহেলারটা কেড়ে নেয়ার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করলো তার গায়ের উপর উঠে। আজলান বলল,
” মহামুশকিল তো। ”
তিথি এসে একটানে কোলে নিয়ে নিল ডোডোকে। হাতদুটো চেপে ধরে গালে আলতো করে চড় বসিয়ে বলল, ” ঘুমা। খুব মারবো ডোডো। ”
ডোডো ঠোঁট টানলো। তিথি তাকে বুকে চেপে ধরে বিছানার এককোণায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ঔষধ খেয়ে কড়া আলো নিভিয়ে ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিয়ে আজলানও ধীরেসুস্থে শুয়ে পড়লো। বিছানার মধ্যে দু-হাত জায়গা এমনি এমনি খালি পড়ে রইলো।
____
যারিফ চলে যেতে চাচ্ছিলো আজলান তাই আম্বিয়া বেগমকে বলল, ” তোমরাও ওর সাথে চলে যাও। আমি কাল পরশু যাব। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন, ” তোর শরীর সুস্থ না। আমরা এভাবে যাব না। কখন কি ঘটে যায়। ”
আজলান বলল, ” কিছু হবে না। চিন্তা করার দরকার নেই। ”
” তাহলে বউ থাকুক। ”
” কাউকে দরকার নেই। ”
আফতাব শেখ বললেন,
” ডোডোর মা কি শেখ বাড়িতে যাবে? ”
আজলান ভ্রকুটি করে উনার দিকে চাইলেন। আফতাব শেখ গলা ঝেড়ে কেশে বললেন,
” যেহেতু আমার পর তুমি ওই বাড়ির উত্তরসূরী। মনে হলো তোমার পারমিশন দরকার। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন, ” ওকে না খোঁচালে তোমার ভালো লাগে না। না? ”
আফতাব শেখ হাসলেন। বললেন,
” খোঁচাখুঁচিও মাঝেমধ্যে ভালো কিছু বয়ে আনে। কি বলো আজলান শেখ? ”
আজলান বলল, ” যার ইচ্ছা সে থাকবে, ইচ্ছা না হলে বেরিয়ে যাবে। ”
আফতাব শেখ হেসে বললেন,
” তো তার ইচ্ছে হয়েছে সে ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে উঠবে। তাহলে উঠুক। ”
আজলান গলায় জোর দিয়ে বলল,
” নাহ। কারো কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। এই বাংলোয় থাকবে। যারিফ তুমি সাবধানে যেও। গিয়ে আমাকে ফোন করবে। ”
যারিফ খুশিমনে বলল,
” থ্যাংকস স্যার। ”
সে চলে যেতে উদ্যত হতেই আফতাব শেখ বললেন,
” আয়জার বিয়ের সময় সময়মতো চলে এসো। তোমার স্যার ভালো পাত্র দেখে বোনকে বিয়ে দেবে। এবার আমি শুধু চুপচাপ দেখবো। নো ইন্টারফেয়ারেন্স। ”
আম্বিয়া বেগম দাঁতে দাঁত পিষলেন। আজলান বলল,
” মাঝেমধ্যে অবাক লাগে আপনার সন্তান হয়ে আমি এত ভালো হলাম কি করে? ”
আফতাব শেখ হো হো করে হেসে উঠলেন। যারিফও হাসলো।
চলমান….